#উড়ো_পাতার_ঢেউ
#লেখা: ইফরাত মিলি
#পর্ব: ৫৪
_________________
রাতে ভালো ঘুম হয়নি। মাথার ভিতর শুধু একটা চিন্তাই ঘূর্ণমান ছিল, বাবাকে সবটা কীভাবে জানাবে? কীভাবে বোঝাবে? খুব শীঘ্রই ইরতিজা বাবাকে সবটা জানিয়ে দেওয়ার তাগিদ অনুভব করছে। কিন্তু কীভাবে জানাবে ভাবতে গেলেই ভয়ে তার ভিতরটা মিইয়ে যাচ্ছে। বাবা ব্যাপারটা কীভাবে নেবে? চিন্তায় চিন্তায় পাগল হয়ে যাওয়ার উপক্রম ইরতিজার। সকাল বেলা সে উঠলো না রোজকার সময় মেনে। ঘুমাচ্ছিল যে তা না। বালিশে এক গাল ডুবিয়ে সে এসব নিয়েই ভেবে যাচ্ছিল বিরতিহীন। কীভাবে বলবে মনে মনে সেটা সাজাচ্ছিল। কতকদূর গিয়ে আবার সেই সাজানো-গোছানো পরিকল্পনা ভেঙে চুরমার করে দিচ্ছিল। এমনভাবেই যখন চলতে লাগলো তার মস্তিষ্কের কার্যকলাপ, তখনই জোনাসের কল এলো। ইরতিজা অবাক হলো। ওই ঘটনার পর জোনাস তাকে কল দিতে পারে এ তার ধারণা যোগ্য ছিল না। প্রথমে ভাবলো কল রিসিভ করবে না, পরে আবার জোনাসের অবস্থা সম্পর্কে জানার প্রয়োজন বোধ করলো। ক্যানিয়ল যেমন মারাত্মক ভাবে আঘাতটা করেছিল জোনাসকে… ইশ! চোখ খিঁচে ধরলো ইরতিজা। দৃশ্যটা মনে না করাই শ্রেয়। ইরতিজা কল রিসিভ করে নীরব রইল। ওপাশ থেকেও কেউ কিছু বললো না।
কিছু সময় পার হওয়ার পর জোনাসের কণ্ঠ শোনা গেল,
“তোমার সাথে দেখা করতে চাই টিজা। তুমি কি একবার সুইমিংপুলের এখানে আসবে?”
“আমার মনে হয় না ওই ঘটনার পর আমাদের মাঝে আর কোনো দেখা সাক্ষাতের বিষয় অবশিষ্ট থাকতে পারে। আমার সাথে আর দেখা করার চেষ্টা করো না জন।”
“তুমি না এলে আমি তোমার বাড়ি যেতে বাধ্য হবো।”
ইরতিজা গ্রাহ্য করলো না জোনাসের কথা। কল কেটে দিলো। কান্নায় বুক ভার হয়ে এলো তার। এক হাত দিয়ে কম্বল আঁকড়ে ধরলো শক্ত মুষ্টিতে। এই ছেলেটা তার জীবনের আরেক জ্বালাময় ব্যক্তি। যেসব বিষয় অনেক আগে ক্লোজ হয়ে গেছে সেই বিষয়গুলো আবার জাগিয়ে তুলছে ছেলেটা। ভালোবাসে এটা পুরোনো একটা বিষয় ছিল। মাঝখান দিয়ে তাদের সম্পর্কে তীব্র ঘৃণার ঝড় বইছিল শুধু। কিন্তু পুরোনো সেই ভালোবাসার বিষয়টা আবার জাগ্রত করেছে। বিব্রতকর পরিস্থিতি সৃষ্টি করেছে। আগের মতো এবারও প্রত্যাখ্যান হয়ে জোনাসের মানসিক অনুভূতি কেমন এখন? ওর মনে কি এখন আরও তীব্র ঘৃণা ঝংকার তুলেছে? ইরতিজা আর ভাবতে চাইলো না। বিছানা ছেড়ে নামলো।
ফ্রেশ হয়ে কিছু খাওয়ার জন্য কিচেনে গেল। বাড়িতে কেউ নেই এখন। কাজে বেরিয়ে পড়েছে সবাই। ইরতিজাও চাইছে সে পার্ট টাইম জব করবে। তাতে জবটা যে ধরনের হোক, সমস্যা নেই। নিজের কিছু ইনকাম তো থাকবে।
দরজায় করাঘাতের শব্দ কানে এলো নিস্তব্ধতার বুক চিরে। ইরতিজার বুকে ভয় ঠকঠকিয়ে উঠলো। জোনাস সত্যি সত্যি আসেনি তো আবার? কিছুক্ষণ কান পেতে রইল। কিন্তু দ্বিতীয়বার আর কোনো শব্দ শোনা গেল না। ব্যাপার কী? এটা কি জোনাস ছিল? না কি জুহি অথবা রিশন? ইরতিজা চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালো। একবার না গিয়ে দেখলেই নয়।
ইরতিজা দরজার কাছে এসে ডোর ভিউতে উঁকি দিলো। সামনেটা ফাঁকা। যে এসেছে সে কি চলে গেছে? ইরতিজা দরজাটা খুললো। দরজা অর্ধ ফাঁকা হলেই সে জোনাসের অর্ধ অবয়ব দেখতে পেল। দরজার কপাট আর না খুলে ওখানেই থমকে গেল ইরতিজা। দ্রুত দরজা বন্ধ করতে যাবে তখনই জোনাস দরজাটা চেপে ধরলো শক্ত হাতে। ইরতিজার সারা শরীর কেঁপে উঠলো। জোনাস বললো,
“বলেছিলাম আমি আসবো।”
জোনাস দরজার ওপাশে হাত বাড়িয়ে ইরতিজার একটা হাত চেপে ধরলো। একটানে ইরতিজাকে বের করে আনলো ঘর থেকে। ইরতিজা ঘরে প্রবেশের চেষ্টা করলেই জোনাস এবার ওর দুই হাতই শক্ত করে চেপে ধরলো। বললো,
“বোকা বাচ্চাদের মতো ছটফট করো না টিজা। তুমি বাচ্চা নও। শান্ত থাকো। তাহলে আমিও শান্ত থাকবো।”
“অশান্ত থাকলে কী করবে তুমি?” রক্তচক্ষুতে তাকিয়ে বললো ইরতিজা।
জোনাস একটু অদ্ভুত হাসলো। বললো,
“যা করবো সেটা নিশ্চয়ই তুমি চাইবে না। হাগ করার কথাই ধরো। তুমি কি চাইবে আমি তোমাকে হাগ করি?”
জোনাস ইরতিজাকে নিজের নিকটে টেনে নেওয়া দিলেই ইরতিজা বলে উঠলো,
“স্টপ।”
জোনাস হাসলো,
“বরাবরই তোমার সাথে মজা করতে ভালো লাগে টিজা।”
বলে আবারও হাসলো। তারপর বললো,
“লিসন, আমার জাস্ট কিছু কথা বলার আছে তোমাকে। তাই চলো আমার সাথে।”
ইরতিজা দরজাটা বন্ধ করে দিলো। জোনাস ইরতিজাকে নিয়ে এলো সুইমিংপুলে। যেহেতু সে আগেই এখানে বসে ইরতিজার সাথে কথা বলার ইচ্ছা পোষণ করেছিল। এখানে এসে সে ইরতিজার হাত ছেড়ে দিলো। তাদের দুজনের মাঝে দুই-তিন কদম দূরত্বের সৃষ্টি হলো। ইরতিজা জোনাসের নাকের দিকে তাকিয়ে আছে। জোনাসের নাকে আঘাতটা বেশ মারাত্মক ভাবেই লেগেছিল। ঘু’সি মা’রার পরপরই ওর নাক দিয়ে অঝরে রক্ত পড়তে শুরু করেছিল। কিন্তু সে তুলনায় ওকে এখন বেশ সুস্থ মনে হচ্ছে। নাকে ব্যান্ডেজ নেই। কিন্তু নাকটা কেমন অস্বাভাবিক দেখাচ্ছে। জোনাসের কথায় জোনাসের নাক থেকে দৃষ্টি সরে গেল ইরতিজার,
“আমি কেন তোমার কাছে গ্রহণযোগ্য নই টিজা? কী দোষ আমার? দুই দুইবার প্রত্যাখ্যান করেছো আমায়! কী কারণ? আমি কি দেখতে অসুন্দর? না তো, আমি যথেষ্ট সুন্দরই আছি। এমনকি আমার ফ্যামিলিও বেশ উন্নত। ভবিষ্যতে আমার ভালো ইনকাম করার সোর্সও থাকবে। তাহলে দোষটা কী আমার?”
“আমি তোমার সাথে এ ব্যাপারে কথা বলতে একেবারেই অনিচ্ছুক।”
“তাহলে কোন ব্যাপারে কথা বলতে ইচ্ছুক তুমি?”
“আমি তোমার সাথে সবরকম কথা বলতেই অনিচ্ছুক।”
“কিন্তু এ ব্যাপারে কথা বলাটা প্রয়োজন। তোমাকে বলতেই হবে, আমার দোষ কী? উত্তর দাও।” বেশ উঁচুতে চড়ে গেল জোনাসের গলা।
ইরতিজা অতিষ্ঠ বোধ করছে। এসব ব্যাপার সে এড়িয়ে চলতে চায়। সেই এক প্রশ্ন, কী দোষ? জোনাস জানে না ওর কী দোষ? ইরতিজা বললো,
“আমি চলে যাচ্ছি। এসব ফালতু ব্যাপারে কথা বলার জন্য আমাকে নিয়ে এসে একদম ঠিক করোনি।”
ইরতিজা পা বাড়ালো। জোনাস ঝড়ের বেগে এসে ওর পথ আটকে দাঁড়িয়ে বললো,
“আর এক পা সামনে এগোবে না। এরকমভাবে বার বার এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেছো আমায়। এবার ওসব চেষ্টা বাদ দাও। উত্তর দাও আমার প্রশ্নের। কী দোষ আমার?”
ইরতিজা এবার অতিষ্ঠ হয়ে বলে উঠলো,
“দোষের কথা বাদই দিলাম। নিজের ধর্মের দিকে দেখো জন। তোমার আর আমার ধর্ম ভিন্ন। তুমি ক্রিশ্চিয়ান আর আমি মুসলিম।”
জোনাস এবার বিরক্ত হওয়ার ভঙ্গি করে বললো,
“উহুঁ টিজা, তুমি বার বার ধর্মের প্রসঙ্গ কেন টানো? এখানে ধর্ম কেন এত মুখ্য তোমার কাছে? আমি তো কখনও তোমার ধর্ম নিয়ে কিছু বলিনি। ভবিষ্যতেও বলবো না কখনও। আমরা যে যার ধর্ম পালন করবো। এখানে তো সমস্যার কিছু নেই। তাহলে ধর্ম নিয়ে কেন এত উদ্বিগ্ন তুমি?”
ইরতিজা জোনাসের চোখে স্থির দৃষ্টি রেখে দৃঢ়তার সাথে বললো,
“তোমার সমস্যা না থাকলেও আমার সমস্যা ছিল। একজন ভিন্নধর্মীকে কখনও আমি নিজের জীবনসঙ্গী হিসাবে মানতে পারবো না। আর না তো এটা আমার ফ্যামিলি মানবে। আচ্ছা সকল ব্যাপার বাদ দিলাম। তুমি শুধু আমাকে এটা বলো, তুমি কি আমার জন্য কখনও নিজের ধর্ম ত্যাগ করতে পারতে বা পারবে?”
জোনাস অপ্রস্তুত হয়ে গেল ইরতিজার এই প্রশ্নে।
“তুমি এই…”
“শুধু হ্যাঁ অথবা না’তে জবাব দাও।”
জোনাস থমকে রইল কিছুক্ষণের জন্য। তারপর বললো,
“অবশ্যই না। আমি আমার ধর্মকে ভালোবাসি। সুতরাং এটা ত্যাগ করার প্রশ্নই আসে না।”
“সেটাই, তুমি পারবে না এটা ত্যাগ করতে। তুমি করতে সম্মত হলেও তোমার মা-বাবা কখনও এটা মানবে না। তুমি তাদের একমাত্র সন্তান। খুব বেশি আদরের সন্তান। তুমি তাদের মনে কষ্ট দিয়ে অন্য ধর্ম গ্রহণ করতে পারবে না। তাদের ছেড়ে তুমি থাকতে পারবে না, তারাও তোমাকে ছেড়ে থাকতে পারবে না। আমাদের মাঝে বড়ো একটা দেয়াল ছিল ধর্ম। এটা মাথায় রাখবে। তোমাকে ভালোবাসা কখনও সম্ভব ছিল না কারণ তুমি একজন ভিন্নধর্মী মানুষ। আমি বন্ধু হিসেবে যথেষ্ট ভালোবাসতাম তোমায়। বলতে পারো এখন আমি তোমাকে ঘৃণা করি, তবুও তোমার প্রতি বন্ধুত্বের একটা টান আছে। কিন্তু ওরকমভাবে ভালোবাসা এটা জাস্ট অসম্ভব। কখনও সম্ভব না। বুঝতে পেরেছো? আমি মুসলিম, তুমি ক্রিশ্চিয়ান। তুমি কোনো দিন তোমার ধর্ম ত্যাগ করতে পারবে না সেটা আমি শুরু থেকে জানি।”
ইরতিজা জোনাসের পাশ কাটিয়ে চলে যাওয়া দিলেই জোনাস বললো,
“আমি ক্রিশ্চিয়ান এটাই কি শুধু আমাকে মেনে না নেওয়ার কারণ?”
ইরতিজা থেমে গেল।
“ওই ছেলেটা কোনো কারণ নয়?”
পিছন ফিরে তাকালো ইরতিজা।
জোনাস বললো,
“ধরে নাও আমি ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করলাম, তখন তুমি কী করবে? ভালোবাসবে আমাকে? ওইরকম ভালোবাসা?”
“প্রথম যখন আমাকে প্রোপোজ করেছিলে, তখন যদি তুমি তোমার ধর্ম পরিবর্তন করতে আমি জানি না আমি কী করতাম! কিন্তু ব্যাপারটা এখনকার হলে আমি স্পষ্ট জানি আমি কী করবো। যদিও তুমি তোমার ধর্ম কখনোই ত্যাগ করবে না। ওইরকম ভালোবাসা ইতোমধ্যে অন্য কেউ দখল করে নিয়েছে। এই হৃদয়ে আর একটু জায়গাও খালি নেই। এটা পূর্ণ, তার ভালোবাসায়। আমার হৃদয়ের সবটা জুড়ে শুধু তার বিচরণ।”
জোনাস দাঁতে দাঁত চেপে অস্ফুট স্বরে উচ্চারণ করলো,
“ইউ পাঙ্ক!”
এরপর সে ইরতিজার দিকে এগিয়ে এসে ক্ষুব্ধ গলায় বললো,
“তুমি কী ভাবো নিজেকে? আমার জীবন নিয়ে ছিনিমিনি খেলে এখন কোন মুখে বলছো তোমার হৃদয় অন্য কারো ভালোবাসায় পূর্ণ?”
জোনাস দুই হাত দিয়ে চেপে ধরলো ইরতিজার দুই গাল। খুব কঠিন হাতে ধরলো।
“তুমি জানো তোমার জন্য আমার মস্তিষ্ক, আমার হৃদয়, আমার সর্ব চেতনায় কেমন প্রলয় ঝড় বয় সব সময়? আমি ছটফট করি। এক মুহূর্ত শান্তিতে থাকতে পারি না। আমার হৃদয় শুকিয়ে মরুভূমি হয়ে যায় তোমার ভালোবাসার তেষ্টায়। অথচ তুমি কখনও বোঝার চেষ্টা করোনি আমায়। শুকনো মরুভূমি কখনও এক ফোঁটা জল পরিমাণও সিক্ত করে তোলোনি তোমার ভালোবাসায়! সব সময় শুধু একেকটা বাহানা দিয়ে সরিয়ে দিয়েছো। অথচ আজ বলছো তোমার হৃদয়ে একটু জায়গাও খালি নেই? সব পূর্ণ অন্য কারো ভালোবাসায়? অসম্ভব!”
জোনাস এবার ইরতিজার গাল থেকে হাত সরিয়ে নিলো। দুই হাতে চেপে ধরলো ইরতিজার দুই বাহু। এত কঠিনভাবে চেপে ধরলো যে ইরতিজার মনে হলো ওই স্থানটা বিষ হয়ে উঠছে ব্যথায়।
জোনাস অগ্নি চোখে তাকিয়ে থেকে বললো,
“আমার জীবন আগে সকালের স্নিগ্ধ রোদের মতো উজ্জ্বল ছিল। কিন্তু তোমার কারণে এখন এটা অমানিশার আঁধারের মতো হয়ে গেছে। আমাকে আমার সেই উজ্জ্বল জীবন ফিরিয়ে দাও। ফিরিয়ে দাও সেটা। মুছে ফেলো ওর জন্য তোমার মনের সকল ভালোবাসা। ওই ভালোবাসা কেবল আমার জন্য। ও একটা নর্দমার কীট! তোমার ভালোবাসা শুধু আমার। তোমাকে আমার প্রয়োজন। আই নিড ইউ। আই নিড ইউ।”
“তুমি বুঝতে পারছো না কেন? আমি অন্য কারো।”
জোনাস আরও জোরে চেপে ধরলো ইরতিজার হাত। ব্যথায় ইরতিজার দু চোখে পানি এসে গেল।
জোনাস কঠিন স্বরে বলতে লাগলো,
“না তুমি নও। তুমি আমার। তোমার কোনো অধিকার নেই আমার জীবন নষ্ট করার। কিন্তু তুমি তা করেছো। তোমার কোনো অধিকার ছিল না আমাকে সর্বক্ষণ ছটফটানির ভিতর রাখার, কিন্তু তুমি তা রেখেছো। এসব করার পর তোমার অধিকার নেই আমাকে ছেড়ে যাওয়ার। আর যদি যেতে চাও তাহলে আমার জীবনকে ঠিক তেমন করে দাও যেমন ছিল তোমাকে ভালোবাসার আগে। করে দাও তেমন। দাও।”
চিৎকার করে উঠলো জোনাস।
ইরতিজার হৃৎপিণ্ড যেন কষ্টে ক্ষত-বিক্ষত হয়ে যাচ্ছে। অতিষ্ঠতা ঝাপটে ধরেছে তাকে। দম বন্ধ হয়ে আসছে তার। সে ভীষণ ক্ষুব্ধ হয়ে জোনাসকে ছিটকিয়ে সরিয়ে দিলো কাছ থেকে। চেঁচিয়ে উঠলো,
“তুমি পাগল হয়ে গেছো জন। ইউ আর সিক! নিউ ইয়র্ক ফিরে গিয়ে চিকিৎসা করাও তোমার। সাইকোলজিস্টের কাছে যাও। দয়া করে আর বিরক্ত করো না আমায়। অতিষ্ঠ হয়ে গেছি আমি। আমার জীবনে তো অনেক আগেই জ্বালার সৃষ্টি করে দিয়েছো তুমি। এখনও আমাকে আর কী জ্বালানো বাকি আছে তোমার? মেরে ফেলতে চাও আমাকে? মেরে ফেলো।”
ইরতিজা জোনাসের কাছাকাছি এসে জোরে চিৎকার করে বললো,
“মেরে ফেলো আমায়!”
ইরতিজা রাগে রক্তিম চক্ষুতে চেয়ে আছে জোনাসের দিকে। মেয়েটা আজকের মতো এত বেশি আর কখনও রেগে যায়নি। কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকার পর ইরতিজা দ্রুত চোখ সরিয়ে নিয়ে ঘুরে দাঁড়ালো। প্রস্থান করার জন্য এক পা, দুই পা, তিন পা যখন এগোলো তখন হঠাৎই জোনাস ওর একটা হাত পিছন থেকে টেনে ধরে ওকে ঘুরিয়ে সুইমিংপুলের দিকে নুইয়ে ধরলো। আতঙ্কে ফ্যাকাশে হয়ে গেল ইরতিজার মুখ। ধুক ধুক শব্দ করতে লাগলো হৃৎপিণ্ড। ভয় এবং বিস্ময় জড়িয়ে তাকিয়ে রইল সে জোনাসের দিকে।
জোনাস হৃদয়ের ঘৃণা নিংড়িয়ে বললো,
“তুমি বিরক্তিকর! বাজে! আমি ভুল করেছি তোমায় ভালোবেসে। ভুল করেছি তোমায় ঘৃণা করেও। তুমি আমার জীবনের বৃথা একটা অংশ বৈ আর কিছুই না!”
জোনাস ছেড়ে দিলো ইরতিজাকে। সে এমনভাবে ইরতিজাকে ধরে রেখেছিল যে, সে ছেড়ে দিলেই ইরতিজা পড়ে যাবে পানিতে। আর তাই হলো। সে ইরতিজাকে ছেড়ে দেওয়ার সাথে সাথে ইরতিজা পড়ে গেল হিম শীতল পানির মাঝে। না কিছু বলার সুযোগ পেল ইরতিজা, আর না কিছু করার। ঝপ করে একটা শব্দ হলো পানিতে। হিমশীতল পানির নিচে যখন ক্ষণিকের জন্য তার মাথা ডুবে গেল, তখন মনে হলো তার প্রাণটা বেরিয়ে যেতে চলেছে দেহ থেকে। সে ধড়ফড় করে মাথা উপরে তুললো। শ্বাস নিতে লাগলো জোরে জোরে। এদিকে তার শরীর জমে যাচ্ছে প্রচণ্ড এই ঠান্ডা পানিতে। সে তাকালো জোনাসের দিকে। জোনাসের ঠোঁটের কোণে আনন্দের হাসিটুকু দেখতে পেয়ে স্তব্ধ হয়ে গেল। জোনাস তাকে এই ঠান্ডার ভিতর এই বরফ সম পানিতে ফেলে দিয়ে আনন্দিত? তাকে ফেলে দিয়ে মজা পাচ্ছে? ঘৃণায় বিষাক্ত হয়ে উঠলো ইরতিজার অন্তঃকরণ। জোনাস চলে গেল।
ইরতিজা অনুভব করছে এই হিমশীতল পানিতে তার শরীর চেতনা হারাচ্ছে ক্রমশ। অবশ হয়ে যাচ্ছে তার গোটা শরীর। সে পানি থেকে ওঠার জন্য ফ্লোরের উপর হাত রাখলো। এমন সময় দেখতে পেল জুহি আর রিশন দৌড়ে আসছে তার দিকে। দৃষ্টি জোড়া ঝাপসা হয়ে যাচ্ছে তার। চেতনা বিলুপ্তির পথে। ফ্লোরের উপর রাখা হাত দুটো খসে পড়ে গেল আবারও পানিতে।
জুহি আর রিশন মিলে ইরতিজাকে টেনে তুললো পানি থেকে উপরে। রিশন গায়ের জ্যাকেট খুলে ইরতিজার শরীরে জড়িয়ে দিলো। ইরতিজাকে নিয়ে দ্রুতই বাসায় পৌঁছাতে হবে। মেয়েটা অজ্ঞানও হয়ে যেতে পারে!
________________
“বেয়াদবটার সাহস কীভাবে হলো তোমার সাথে এটা করার? ইচ্ছা করছে পুলিশে দিই অসভ্যটাকে! তোমার জীবন নরক করেও বেয়াদবটার মন ভরেনি। এখন তো দেখছি তোমাকে মেরে ফেলতে চায় ও। ভাগ্যিস আমি আর রিশন তখন পেনড্রাইভটা খুঁজতে গিয়েছিলাম। আর না হলে তোমার যে অবস্থা ছিল তাতে তো তুমি পানি থেকে উঠতেই পারতে না। খুব খারাপ কিছু ঘটতে পারতো!”
ইরতিজা কাঁদছে। দু চোখ দিয়ে গড়িয়ে পড়ছে অনর্গল জল ধারা। বর্তমানে সে নিজের রুমে নিজের বিছানায় অবস্থান করছে। হেলান দিয়ে বসে আছে বেডের সাথে। গায়ে কম্বল টেনে দেওয়া বুক পর্যন্ত। সে কাঁদতে কাঁদতে জুহিকে বললো,
“আমি ভাবতে পারিনি জোনাস এমনটা করবে। আমি ভাবতাম ওর মাঝে হয়তো কিছুটা হলেও বন্ধুত্বের টান আছে। কিন্তু ও আসলে শত্রুর থেকেও নিকৃষ্ট। ওর জন্য ঘৃণা অনুভব করতেও ঘৃণা হচ্ছে আমার।”
জুহি টুল থেকে উঠে জড়িয়ে ধরলো ইরতিজাকে।
“কেঁদো না টিজা। কেন কাঁদছো তুমি? শরীর খারাপ করবে তো আরও। কান্না থামাও। আমি ক্যানিকে বলবো এটা সম্পর্কে। ও জানতে পারলে জোনাসকে মে/রে হাড়গোড় ভে/ঙে দেবে।”
ইরতিজা বললো,
“না, ক্যানিয়লকে জানানোর দরকার নেই এটা সম্পর্কে। তুমি এ বিষয়ে ওকে কিছু বলবে না।”
জুহি ইরতিজাকে ছেড়ে দিয়ে বললো,
“ঠিক আছে বলবো না। কিন্তু তুমি কান্না থামাও।”
ইরতিজা কান্না বন্ধ করলো। রিশন রুমে প্রবেশ করলো হাতে একটা গ্লাস নিয়ে। গ্লাসের ভিতর মিল্ক দিয়ে তৈরি একটা পানীয় দেখা যাচ্ছে। সে গ্লাসটা ইরতিজার দিকে বাড়িয়ে দিলো। ইরতিজা নিলো। জুহি ঘড়িতে সময় দেখে রিশনকে বললো,
“তুমি টিজার কাছে থাকো। বিশ মিনিট পরই পিটারের সাথে আমার ডেট আছে। আমার যেতে হবে।”
জুহি ব্যস্ত পায়ে দরজার দিকে দৌড় দিলো। আবার থেমে ইরতিজার দিকে ফিরে বললো,
“যা যা প্রয়োজন হবে সব রিশনকে বলবে। মনে করবে ও তোমার বাসার মেইড।”
বলেই সে বেরিয়ে গেল। রিশনের মুখ হা হয়ে গেছে বোনের কথা শুনে। সে অবিশ্বাস্য কণ্ঠে বললো,
“মেইড?”
তারপর গর্জে উঠে বললো,
“আমার ফ্যানরা যদি জানতে পারে তুমি আমার সম্বন্ধে এমন কথা বলেছো, তাহলে নিশ্চিত ওরা তোমায় তুলে নিয়ে গিয়ে ঠান্ডা পানিতে ভিজিয়ে রাখবে!”
ইরতিজা হেসে উঠলো। রিশন বিস্ময় নিয়ে ইরতিজার দিকে তাকিয়ে বললো,
“হাসছো কেন?”
______________
ইরতিজা সারাদিনে আর রুম থেকে বের হলো না। সন্ধ্যায়ও সে শুয়ে রইল। শরীরের দুর্বল ভাবটা কমে এসেছে। আব্বু এবং মা দুজনই তাকে এমন থাকতে দেখে জিজ্ঞেস করেছে, সে অসুস্থ কি না? ইরতিজা বলেছে এটা তেমন কিছু না। একটু দুর্বল অনুভব করছে, এই যা।
সন্ধ্যায় একটা কল এলো ইরতিজার মোবাইলে। কল রিসিভ করে যা শুনলো তাতে হৃৎপিণ্ড কিছুক্ষণের জন্য নিজের কাজ বন্ধ করে দিলো। সে থম মেরে রইল কিছু সময়। তারপর আর শুয়ে থাকলো না। দ্রুত বিছানা ত্যাগ করে নামলো। রুম থেকে বের হওয়ার আগে ক্লোজেট খুলে একটা কোট বের করে পরে নিলো শীঘ্র। তারপর দৌড়ে বাসা থেকে বের হলো। দেখতে পেল রিশনও বের হয়েছে। রিশন নিশ্চয়ই যেখানে যাবে সেখানে গাড়ি নিয়েই যাবে। ইরতিজা উৎকণ্ঠা হয়ে বললো,
“আমাকে একটা জায়গায় পৌঁছে দাও রিশন।”
“কোথায়?”
“যেতে যেতে বলছি তোমায়।”
ইরতিজা দৌড়ে পার্কিং সাইডের দিকে যেতে লাগলো। রিশন কিছু বুঝে উঠতে পারলো না। ইরতিজার পিছন পিছন আসতে আসতে বললো,
“কী হয়েছে? হঠাৎ এরকম করছো কেন? তুমি তো অসুস্থ, বাইরে কেন এসেছো?”
(চলবে)