#উড়ো_পাতার_ঢেউ
#লেখা: ইফরাত মিলি
#পর্ব: ৫৭
_________________
ইরতিজা আজাদ চৌধুরীর আপন মেয়ে নয়। ইরতিজার জন্মদাতা পিতার নাম হাবিব মির্জা। শারমিন আহমেদ যখন দুই মাসের অন্তঃসত্ত্বা ছিলেন তখন হাবিব মির্জা এক পরনারীর প্রতি আকৃষ্ট হয়ে ঘর ছাড়েন। পরে এক সময় ডিভোর্স হয়ে যায় দুজনের।
আজাদ চৌধুরীর স্ত্রীর নাম ছিল রেহনুমা চৌধুরী। রোড এক্সিডেন্টে মারা যান তিনি। তাদের এক সন্তান ছিল। নওরিন। নওরিন তখন বেশি বড়ো নয়। মাত্র ছয় বছর বয়স ছিল নওরিনের। নওরিনের দেখাশোনার জন্য কাউকে প্রয়োজন ছিল। সহজ ভাষায় বলতে গেলে ওর জন্য একটা মা প্রয়োজন ছিল। আজাদ চৌধুরীর পরিবারের লোকেরা চাইছিলেন আজাদ চৌধুরীর দ্বিতীয় বিয়ে দিতে। আজাদ চৌধুরীও তাই চিন্তা করেন। শারমিন আহমেদকে আজাদ চৌধুরী এবং তার বাবা পছন্দ করেছিলেন। তারা জানতেন শারমিন আহমেদের সাথে ঘটে যাওয়া ঘটনা সম্পর্কে। শারমিন আহমেদ অন্তঃসত্ত্বা তাও জানতেন। হাবিব মির্জার সাথে তালাক হয়ে যাওয়ার পর শারমিন আহমেদ যখন বাবার সংসারে এসে ওঠে, তখন তার ভাই-ভাবিরা উঠতে-বসতে তাকে যা নয় তা বলে খোঁটা দিতে আরম্ভ করে। পেটে সন্তান থাকলে কারো কাছে বিয়ে দিতে পারবে না, আর বিয়ে না হওয়া পর্যন্ত তাদের ঘাড়ে ঝুলে থাকবে এটা নিয়ে তাদের কথার শেষ ছিল না। তার পেটের সন্তানকে অভিশাপ বলতো সবাই! এবর্শন করে ফেলতে বলতো। শারমিন আহমেদ এসব সহ্য করতে পারতেন না। পরিবারের পাশাপাশি এক সময় প্রতিবেশিদেরও নানান কথায় তার নিজেরও একসময় ধারণা হয়ে গিয়েছিল এই সন্তান এক অভিশাপ। অভিশাপ স্বরূপ দেওয়া হয়েছে তাকে এই সন্তান! এই সন্তান তার জীবনের বড়ো এক খুঁত! অতিষ্ঠ হয়ে এক পর্যায়ে তিনি এবরশন করার সিদ্ধান্ত নেন। তখন পরিবারে তার এবং আজাদ চৌধুরীর বিয়ের কথাবার্তা চলছিল। শারমিন আহমেদ আজাদ চৌধুরীকেও জানান তিনি এবরশন করে ফেলবেন। কিন্তু আজাদ চৌধুরী তাকে অবাক করে দিয়ে বলেন,
“অবশ্যই এটা করবে না তুমি। কেন করবে এটা? আমি তো বলিনি যে এই বাচ্চার জন্য আমি বিয়ে করবো না তোমাকে। বলিনি তো আমাদের বিয়ের মধ্যে এই বাচ্চা বাধা। আমি কি কখনও বলেছি এই বাচ্চা নিয়ে আমার সমস্যা আছে বা সমস্যা হবে? তাহলে তুমি হুট করে কেন এই সিদ্ধান্ত নিয়েছো? এই বাচ্চাটার কী দোষ? কেন বাচ্চাটা পৃথিবীর আলো দেখতে পাবে না? বাচ্চাটা তো নিষ্পাপ! আমি সব জেনেশুনেই তোমাকে বিয়ে করতে রাজি আছি। এই বাচ্চা সম্পর্কে আমার কোনো আপত্তি নেই। আমারও একটি সন্তান আছে। আমার সন্তান যেমন সন্তান, এটিও তো তেমন। মনে করো এই বাচ্চার বাবা আমি। এই বাচ্চা জন্ম থেকেই আমার পরিচয়ে বড়ো হবে। ও আমার ছোটো সন্তান।”
এরপর আর এই বাচ্চা এবরশন করার চিন্তা মাথায় আনা দোষ মনে করতেন শারমিন। ইরতিজা জন্ম নেওয়ার পর শারমিন আহমেদ আর আজাদ চৌধুরীর বিয়ে হয়েছিল। ইরতিজাকে প্রথম দেখার দিনই আজাদ চৌধুরী ইরতিজার জন্য প্রবল মায়া অনুভব করেছিলেন। যে মায়া এখনও কাটিয়ে উঠতে পারেননি তিনি। তার মনে হয়েছিল এ সন্তান বুঝি তারই। ইরতিজাকে প্রথম কোলে নেওয়ার অনুভূতি শ্রেষ্ঠ এক অনুভূতি ছিল। যে মেয়ের জন্য তার এত ভালোবাসা, এত হৃদয় ব্যাকুল, কে বলবে সেই মেয়ে তার রক্তের সম্পর্কিত কেউ নয়? ইরতিজা তার রক্তের সম্পর্কিত কেউ না হয়েও তার প্রতি রক্ত কণায় মিশে আছে। সৃষ্টিকর্তাই তাদের বাবা-মেয়ের এমন সম্পর্কে আবদ্ধ করেছেন। এটা এক পরম পাওয়া!
তবে আজাদ চৌধুরীর বাবা ব্যতীত অন্যান্য আত্মীয়দের শারমিন আহমেদের সাথে আজাদ চৌধুরীর সম্পর্ক মেনে নিতে দ্বিমত ছিল। কেউই তাদের সম্পর্ককে প্রসন্ন দৃষ্টিতে দেখেনি। কেন আজাদ চৌধুরীকে এক ডিভোর্সি এবং অন্য সন্তানের মাকে সন্তান সহ বিয়ে করতে হবে? এই নিয়ে তাদের অভিযোগের শেষ ছিল না। সবচেয়ে বেশি অমত করেছিলেন আজাদ চৌধুরীর মা এবং অহনা চৌধুরী!
ইরতিজা যখন তার আসল পরিচয় সম্পর্কে স্পষ্টভাবে অবগত হয়েছিল তখন তার বয়স দশ। এই বয়সে তার আসল পরিচয়ের তাৎপর্য বোঝার জ্ঞান ভালোই হয়েছিল।
সবটা জানা-বোঝার পর ইরতিজা যে কী পরিমাণ কেঁদেছিল! তার মনে সবচেয়ে বেশি যে কথাটা আঘাত হেনেছিল সেটা হলো আজাদ চৌধুরী তার বাবা নয়! ইরতিজা তখন বুঝতে পেরেছিল সবাই কেন তাকে অপছন্দ করে, তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করে! বাবা আর দাদা ছাড়া তাকে কেউ ভালোবাসতো না। ইরতিজা কোনো একটু ভুল করলে শ্বশুর বাড়ির মানুষ যখন ইরতিজাকে কথা শোনাতো, তখন শারমিন আহমেদও রেগে গিয়ে ওকে কথা শোনাতেন। মারধরও করতেন। ধৈর্য হারা হয়ে বলতেন, ‘তুই আমার জীবনের অভিশাপ! কেন আমার জীবন নরক করছিস? কেন এলি আমার জীবনটা নরক করতে?’
ইরতিজা দেখেছে মা তার চেয়ে তার বড়ো বোনকে বেশি আদর যত্ন করে। অথচ নওরিন না কি তার মায়ের আপন সন্তান না। সৎ! তবুও কেন তার চেয়ে নওরিনকে এত বেশি ভালোবাসে মা? আর সে কেন এত অবহেলা কুঁড়ায়?
ইরতিজার অতীতে এমন অনেক দিন আছে, যে দিনগুলোতে সে প্রচুর কেঁদেছে! প্রচুর!
এত কান্নাকাটির মাঝে তার প্রশান্তির যে বিষয়টুকু ছিল, তা হলো, আর কেউ ভালো না বাসলেও তার বাবা তাকে ভালোবাসে। বাবার ভালোবাসাতেই বেঁচে আছে সে, নয়তো কবেই মরে যেত!
__________________
এই মুহূর্তে শারমিন আহমেদের উঠানো এই টপিকটা একেবারেই পছন্দ হয়নি নওরিনের। সে বললো,
“কখন কী কথা বলো সেটা কি ভেবে চিন্তে বলো? কী প্রয়োজন ছিল এখন এই কথা উঠানোর? এই কথা বলে ইরতিজাকে এত হার্ট করার কি আসলেই কোনো দরকার ছিল?”
শারমিন আহমেদ নওরিনের দিকে রাগান্বিত দৃষ্টি নিক্ষেপ করে বললেন,
“তুমি চুপ করো। অত দরদ দেখিয়ো না। কী ভেবেছো? ভুলে গেছি সব? কিছু ভুলিনি। সবকিছু স্পষ্ট মনে আছে। আমার মেয়েটা তোমাদের কাছ থেকে কী পরিমাণ অবহেলা পেয়েছে, কী পরিমাণ অবহেলা তোমরা করেছো, সব ভুলে গেছো? কাউকে কিছু বলিনি কখনও। তোমরা এমন করতে বলে আমিও মেয়েটার প্রতি যত্ন দেখাতে পারতাম না। মা হয়ে মেয়ের প্রতি একটু যত্ন নিতে গেলেও তোমরা সবাই বলতে নিজের মেয়ের প্রতি দরদ শুধু। সৎ মা তো সৎ মা’ই হয়। তোমার আব্বু চরম ভুল করেছে আমাকে বিয়ে করে! ইরতিজার থেকে সব সময় তোমায় বেশি যত্ন করেছি, কিন্তু কী পেয়েছি বিনিময়ে? কখনও তো তুমি আমাকে মা ভেবেই উঠতে পারোনি! কেয়ারটেকার মনে করতে শুধু। তোমার আব্বু ব্যতীত আমাকে এবং ইরতিজাকে আর কেউ ভালোবাসোনি তোমরা। কেউ না।”
নওরিনের দু চোখেও পানির রেখা। সে চেঁচিয়ে বলে উঠলো,
“হ্যাঁ ভালোবাসিনি। ভালোবাসিনি তোমাদের। ভালোবাসি না সেটা জানি। তোমাকে আমার মায়ের স্থান দিতে পারিনি সেটাও জানি। তোমাকে আমার মা ভেবে উঠতে পারিনি সেটা ঠিক, কিন্তু ইরতিজাকে আমার বোনই মনে হতো। আমি ইরতিজার সাথে যখন যা ইচ্ছা তাই ব্যবহার করি না কেন, যত খারাপ আচরণ করি না কেন, তবে ইরতিজাকে নিয়ে অন্য কেউ কিছু বললে সেটা সহ্য হতো না আমার। ওকে বোন না ভাবলে কি এমন হতো? আর তুমি বলছো আমাদের কারণে ইরতিজার যত্ন নিতে পারোনি। তাহলে তুমি ইরতিজাকে ঘৃণা কেন করো? ওই লোকটার জন্য ওকে কেন ঘৃণা করো? ওর কী দোষ? তুমি ঘৃণা করো বলে ও যে কষ্ট পায় সেটাকে কী বলবে?”
“হ্যাঁ ওকে ঘৃণা করি। কারণ ও ওই পাপী লোকটার রক্ত! পাপী লোকটার প্রতি অনুভব হওয়া ঘৃণার ধারাটা ওর উপরও এসে পড়ে। পাপীটা চলে গিয়ে ওকে ফেলে রেখে গেছে। মানুষজনের কথা শুনতে শুনতে আমারও মনে হয় ও আমার জীবনের খুঁত! কিন্তু তাই বলে ওকে ভালোবাসি না সেটা নয়। যতটা ঘৃণা করি তারচেয়ে বেশি ভালোবাসি ওকে। ও আমার মেয়ে। আমি আমার দুই মেয়েকেই প্রচণ্ড ভালোবাসি!”
নওরিনের দু চোখ দিয়ে জল ঝরতে থাকে। অতীতের দিনগুলো মনে হলে সে অনুতপ্ত ছাড়া আর কিছুই অনুভব করতে পারে না!
আজাদ চৌধুরী এই স্থানটাকে আর দাঁড়িয়ে থাকার উপযোগী মনে করছেন না। তিনি বেডরুমে চলে গেলেন। তার ভাবনা ইরতিজাকে নিয়ে। মেয়েটা কোথায় গেল এই বৃষ্টির রাতে? সাজিদ ধরতে পেরেছে তো ওকে?
_______________
আকাশের বুক ছ্যাঁদা করে বৃষ্টি ঝরছে। বৃষ্টির ঝুমঝুম শব্দ অসহ্য করে তুলছে কানকে। একটুর ভিতর কোথায় গেল মেয়েটা? সাজিদ আশেপাশে খুঁজে পেল না। গাড়িতে উঠে বসলো। গাড়ির জানালা দিয়ে এদিক ওদিক দৃষ্টি ফেলতে লাগলো ইরতিজাকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখার আশায়। কিন্তু দেখতে পাচ্ছে না। এক জায়গায় এসে তাকে গাড়িতে ব্রেক কষতে হলো। রাস্তাটা দুই দিকে চলে গেছে। এখন কথা হচ্ছে ইরতিজা কোন দিকে গেছে? ডান দিকে? না বাম দিকে? সাজিদ দোনামনা করে বাম দিকে গেল। বাম দিকে না পেলে ডানদিকে আসবে একবার। বামের রাস্তায় খুঁজলো, কিন্তু কোথাও ইরতিজার চিহ্ন নেই। সে ফেরত এসে ডানদিকের রাস্তায় ঢুকলো। কতদূর এসে দেখলো ইরতিজা গুটিশুটি মেরে বসে আছে রাস্তার উপর। বৃষ্টিতে ভিজে একাকার। সাজিদও অবশ্য ভিজে একাকার হয়ে গেছে। সে নামলো গাড়ি থেকে। ইরতিজা কাঁদছিল। আকাশের কান্নার সাথে সাথে এক মানবীর কান্নার শব্দ দারুণ মানিয়ে গেল প্রকৃতির বুকে। সাজিদ কাছে এসে দাঁড়িয়ে বললো,
“বাসায় চলুন।”
ইরতিজা একবার চোখ তুলে তাকালো সাজিদের দিকে। তারপর আবার চোখ সরিয়ে নিয়ে বললো,
“আপনি যান এখান থেকে, আমি যাব না।”
“পাগল হয়ে গেছেন? যেমন ভাবে বৃষ্টির মধ্যে রাস্তায় বসে আছেন তাতে লোকে পাগল ছাড়া আর তো কিছু ভাববে না আপনাকে।”
“ভাবলে ভাবুক। আমার ইচ্ছা-অনিচ্ছার দাম দেয় কে? আমিও কারো ভাবনার দাম দিই না।”
“বৃষ্টিতে ভিজলে অসুখ করবে।”
“আপনার অসুখ করবে না? চলে যান আমার কাছ থেকে।”
সাজিদ ইরতিজার ত্যাড়া ভাব দেখে দীর্ঘশ্বাস ফেললো। গায়ের কোটটা খুলে ইরতিজার মাথার উপর ফেলে বললো,
“নিজ থেকে চলবেন? না কি তুলে নিয়ে যাব?”
ইরতিজা কিছু বললো না। সাজিদের কোটটা মাথা থেকে সরিয়ে ছুঁড়ে ফেললো রাস্তায়। সাজিদ এবার ইরতিজার এক হাত ধরে টেনে ওকে দাঁড় করালো। ইরতিজা হাতটা ছাড়িয়ে নিয়ে বললো,
“খবরদার! স্পর্শ করবেন না আমায়!”
“তাহলে নিজ থেকে গিয়ে গাড়িতে বসুন।”
ইরতিজা কিছু বলার জন্য মুখ খুলতে নিলেই সাজিদ থামিয়ে দিয়ে বললো,
“আপনার আব্বু চিন্তা করছে।”
ইরতিজা আর কিছু বললো না। গাড়িতে গিয়ে বসলো। সাজিদও উঠে বসলো। তার কোটটা পড়ে রইল রাস্তার জলে। গাড়ি ঘুরালো সাজিদ। ইরতিজা এখনও ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে। সাজিদ শুনতে পাচ্ছে ফোঁপানোর শব্দ। হঠাৎ অপরাধ বোধে ছাইলো তার হৃদকাশ। চিনচিন একটা ব্যথা অনুভব হতে লাগলো। বললো,
“স্যরি! তখন চড় মারার জন্য ভীষণ স্যরি! আপনি চাইলে আমাকে এখন চড় মারতে পারেন। চড়ের বদলে একটা চড়, আর চুমুর বদলে দুটো চড়। আমি কিছু মনে করবো না। জানি চড়ের চেয়ে চুমুতে বেশি আঘাত পেয়েছেন!”
ইরতিজা কান্নায় লাল হওয়া চোখে তাকালো। সাজিদ বললো,
“আপনার কোনো দোষ নেই, আপনি বলেছিলেন আপনি অন্য কাউকে ভালোবাসেন। আমি আপনার কথাকে মজা ভেবেছিলাম। কিন্তু দোষ না থাকলেও চড়টা আপনি খেয়েছেন। আমি রেগে গিয়ে করেছিলাম অমন। রাগ নিয়ন্ত্রণ করা কঠিন। যদি এটা কঠিন না হতো আমি কখনও নিজ চৈতন্যে আপনাকে চড় মারার কথা চিন্তাও করতাম না। দুঃখিত!”
ইরতিজা চোখ সরিয়ে নিলো। জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে বললো,
“এখন আমার জীবনের বড়ো কষ্টের কারণ আপনি সাজিদ। আপনি সবচেয়ে অগোছালো দিক আমার জীবনে। আপনি চলে যেতে পারেন না আমার জীবন থেকে? প্লিজ চলে যান। আমায় কষ্ট থেকে মুক্তি দেন। শান্তিতে থাকতে দেন। চলে যান।”
সাজিদ একটা দীর্ঘশ্বাস গোপন রেখে বললো,
“আমি আপনাকে কষ্ট দিতে চাইনি ইরতিজা। আমি আপনাকে কষ্ট দিয়ে আপনার অমতে আপনাকে বিয়ে করতে চাইনি। কিন্তু মনে হচ্ছে আমাকে তাই করতে হবে। এগিয়ে আসতে হবে আমার। কিন্তু আমি যথেষ্ট সংশয়ে আছি নিজের এগিয়ে আসার ব্যাপারে। আমি আসলেই আপনাকে কষ্ট দিতে পারবো তো? আমি তো আপনার এটুকু কষ্টেই কষ্ট পাচ্ছি। তাহলে অত কষ্ট কীভাবে দেবো?”
ইরতিজা দাঁত দিয়ে ঠোঁট কামড়ে ধরে কান্না চেপে রাখলো। কেটে গেল কিয়ৎক্ষণ।
ইরতিজা এক সময় বললো,
“ওই ছবিতে যেটা দেখাচ্ছে আসলে তেমন কিছুই ঘটেনি।”
“ঠিক আছে, ঘটেনি অমন কিছু। কিন্তু ছেলেটা যদি অমন কিছু করতে চাইতো তখন কী করতেন? বাধা দিতেন?”
“আমি জানি ও ওরকম করবে না, তাই বাধা দেওয়ারও প্রয়োজন পড়বে না।”
“ব্যাপারটার জন্য আমি আবারও স্যরি জানাচ্ছি।”
“স্যরি জানানোর দরকার নেই। কারণ আমি ক্ষমা করবো না আপনাকে।”
আর কথা হলো না সাজিদ-ইরতিজার। ইরতিজাকে বাসায় নামিয়ে দিয়ে সাজিদ সোজা সিয়াটলের দিকে যেতে লাগলো। বুকে ভয়। কিছু হারিয়ে ফেলার ভয়। এই ভয় এতদিন ছিল না। কিন্তু আজ এই ভয়টা তার হৃদয়কে ভয়ে কাঁপাচ্ছে! নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসছে।
______________
মুষলধারায় বৃষ্টি পড়ছে। থামার বদলে আরও ভারী হচ্ছে বৃষ্টির নৃত্য। মিরান্ডার মনটা আজ সন্ধ্যা থেকে হাঁসফাঁস করে যাচ্ছিল কেন জানি। তাই সে চলে এলো এন্ডারসন হাউজে। ক্যানিয়ল পরশু রাত থেকে এখানেই আছে। মিরান্ডা একাই গাড়ি চালিয়ে এসেছে, কোনো ড্রাইভার আনেনি। ছাতা মেলে গাড়ি থেকে নামলো সে। এন্ডারসন হাউজের ঘাসে মোড়া লনখানা ডিঙিয়ে দরজার সামনে এসে দাঁড়ালো। হাতের উল্টো পিঠ দিয়ে টোকা দিলো দরজায়। দরজা খুলে গেলে সামুরাকে দেখতে পেল। মিরান্ডা হেসে জানতে চাইলো,
“কেমন আছো সামুরা?”
সামুরাও হাসার চেষ্টা করে বললো,
“আলহামদুলিল্লাহ!”
মিরান্ডা ভিতরে ঢুকলো।
“ক্যানি আছে তো, তাই না?”
“হুম, বেডরুমে।”
“থ্যাঙ্ক ইউ।”
মিরান্ডা বিনা অনুমতিতে বেডরুমে প্রবেশ করলো। দরজা আনলক ছিল। দেখলো ক্যানিয়ল ঘুমাচ্ছে। সাদা বিছানায় ওর সাদা মুখ ডুবে আছে। মিরান্ডা ওর কাছে এসে বসলো। গুনগুন সুরে গান গাইতে গাইতে আঙুল বুলালো ক্যানিয়লের চুলে। এরপর ক্যানিয়লের চেহারায় পূর্ণ দৃষ্টি দিয়ে ভালো করে দেখলো ক্যানিয়লকে। আপন মনে বলে উঠলো,
“কত সুন্দর! এই সৌন্দর্যের জন্যই কি ওর প্রেমে পড়েছি?”
মিরান্ডা হাত ছুঁয়ে দিলো ক্যানিয়লের মুখে। ক্যানিয়লের চোখের পাতা কেঁপে উঠলো। ভেঙে গেল ঘুম। মিরান্ডাকে দেখে উঠে বসলো সে। ঘুম ঘুম চোখে প্রশ্ন করলো,
“তুমি?”
“সারাদিন ধরে কেঁদেছো না কি? চোখ দুটো কেমন লাল হয়ে ফুলে আছে!”
মিরান্ডা চোখের দিকে হাত বাড়ালেই ক্যানিয়ল ওর হাতটা ধরে ফেলে বললো,
“আমি এই মুহূর্তে কারো সাথে কথা বলতে চাই না, তুমি চলে গেলে খুশি হবো।”
“আমি তোমাকে খুশি করতে এখানে আসিনি। অযথা বকবকও করতে আসিনি। আমি একটা বিষয়ে কনফার্ম হতে এসেছি।”
“কী সেটা?”
মিরান্ডা ক্যানিয়লের দু চোখ দেখতে দেখতে বললো,
“তুমি কি সত্যিই আমাকে বিয়ে করবে না?”
ক্যানিয়ল বিরক্তির নিঃশ্বাস ত্যাগ করে বললো,
“মি. হেনরিকে বলবো পেপার রেডি করতে, আমি পেপারের গায়ে লিখে দেবো। যাতে বার বার আমাকে একই কথা মুখে বলতে না হয়।”
“ভণিতা না করে সহজভাবে কথাটা মুখে বলো। বিয়ে করবে? না করবে না?”
“করবো না, আগেও বলেছি এটা। তুমি শুনেছিলে, বুঝেছিলে, তাহলে আজ আবার জিজ্ঞেস করছো কেন?”
“তার মানে তুমি চাও না আমাদের মাঝে সু সম্পর্ক থাকুক?”
“বিয়ে না হলে যদি সু সম্পর্ক বজায় না থাকে, তাহলে আমি চাই না সু সম্পর্ক থাকুক। দুই ফ্যামিলির সম্পর্ক ভেঙে যাক, আমাদের বন্ধুত্বও ভেঙে যাক।”
মিরান্ডা হাসলো। অবিশ্বাস্য হাসি। ক্যানিয়ল এমনই এক মানুষ যে কোনো কিছুর পরোয়া করে না। মিরান্ডা বললো,
“ভুল তুমি করছো, আর এই ভুলের শাস্তি বেচারা ওই মেয়েটাকে পেতে হবে, যার কারণে তুমি ভুল করছো।”
ক্যানিয়ল মিরান্ডার উপর থেকে চোখ সরিয়ে নিয়ে বললো,
“আমার হৃদয়ে এখন প্রচুর কষ্ট মিরান্ডা! আমি তোমায় উপদেশ দেবো, এখন আমার এই ব্যথিত হৃদয়ে আর ব্যথার সৃষ্টি করিয়ে দিয়ো না। কষ্টের স্বাদ ভয়ংকর হয়! এই স্বাদ তুমি নিতে চেয়ো না।”
“আমাকে নিয়ে তুমি কত ভাবো ক্যানি। কিন্তু আমি স্যরি, আমি নিজের ভাবনা নিজে ভাবতে পছন্দ করি।”
মিরান্ডা চলে যেতে নিয়ে আবার বললো,
“ওহ হ্যাঁ, একটা বিষয় জানার ছিল। ইরঠিঝার কোন অংশটা তোমার বেশি প্রিয়? মাথা? শুনেছি তুমি ওকে হিজাব পরিহিত দেখতে পছন্দ করো। সে হিসেবে মাথাই তোমার সবচেয়ে বেশি পছন্দের। কেমন লাগবে যদি দেখো ওর মা’থা’টা হা’তু’ড়ি দিয়ে থেতলে দেওয়া হয়েছে?”
কথাটা শোনা মাত্র ক্যানিয়লের চোখ-মুখে হিংস্র প্রতিচ্ছবি ফুঁটে উঠলো। যেন তা মিরান্ডাকে সাবধান করে দিচ্ছে। মিরান্ডা দুর্বোধ্য হেসে বললো,
“তখন তোমার অবস্থা দেখে নিশ্চয়ই আমি মনে শান্তি পাবো।”
(চলবে)