মেঘে ঢাকা চাঁদ পর্ব-২৭

0
1010

#মেঘে_ঢাকা_চাঁদ (পর্ব ২৭)
সায়লা সুলতানা লাকী

সকাল সাতটার দিকে ডোরবেল বেজে উঠল। দরজা খুলতেই ভেতরে ঢুকল হিমেল। লাবন্য নিজের রুম থেকে ওর কণ্ঠ শুনে বিদ্যুৎ বেগে বের হয়ে এল।

“তুমি? তুমি এ বাসায় আসছো কেন? কে তোমাকে এখানে আসার পারমিশন দিয়েছে? কোন সাহসে তুমি আসছো?”

“দম নে, দম নে। এমন হিংস্র হয়ে ঝাপিয়ে পড়ছিস কেন? তোর সমস্যা কি? ” হিমেলও একটু রেগে উত্তর দিল।

“আমার সমস্যা কি তা তোমার জানার দরকার নাই। তুমি এক্ষুনি বের হয়ে যাও। আর কোনদিনও আসবা না বলে দিলাম।”

“আমি আসব। দরকার হলেই আসব।আমার ইচ্ছে হলেই আসব। তুই কি করবি? তোকে আমি ভয় পাই নাকি?”

“বুঝছিতো কেন আসছো? তোমার বোনকে কি বলছি তার জের ধরে আসছো, তাই না? ভালোইতো! তোমরা পারোও বটে। তোমারদের লোকবল আছে যখন তখন তা খাটাবা তাইতো স্বাভাবিক …”

“আজাইরা লেকচার বন্ধ কর। তোরতো দেখি মাথার সব স্ক্রু ঢিলা হয়ে গেছে। আবোল তাবোল যা মুখে আসে তাই বলিস, তাই ভাবিস। কাউকে কিছু বলার আগে নিজেকে একটু টাইট দে।”

“একদম বাজে কথা বলব না। আমি মোটেও তোমার বাজে কথা শুনতে প্রস্তুত না। তুমি এক্ষুনি বের হবা আর কক্ষনও এই বাসায় আসবা না। এখানে তোমার কেউ থাকে না।”

“এক চড় দিয়ে দাঁত ফেলে দিতে পারলে ভালো হতো। অনবরত চিৎকার করেই যাচ্ছে। পুরাই পাগল হইছিস দেখি, দ্রুত ট্রিটমেন্ট দরকার তোর।”

“হ্যা আমি পাগল, হইছি? আমি শয়তান আমি বদমাশ, আমি মা হারা মেয়ে, আমার আব্বুর দুই বিয়ে……”

“উফফফ…..”

“কিরে তোদের ঝগড়া শেষ হয়েছে? হলে চল বের হই। আর হ্যা লাবু আজকে রুশকে স্কুলে তুই নামিয়ে দিস। আমি ফেরার সময় নিয়ে আসব,কেমন।” নানি রেডি হয়ে নিজের রুম থেকে বের হয়ে আসতে আসতে বললেন।

“তুমি আবার এখন কোথায় যাচ্ছো?” লাবন্য কিছুটা অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল।

“বারডেমে, আজকে ডাক্তার দেখানোর ডেট।সাথে কিছু টেস্ট ও করাতে হবে। সকাল সকাল সিরিয়াল না দিলে দেরি হয়ে যাবে। তাই রুশকে তুই নিয়ে যাবি, বুঝলি?”

“আমাকে আগে বলতা, আমি তোমাকে নিয়ে যেতাম। তোমার ভালোমন্দ দেখাটাতো আমার কাজ। আমার দায়িত্ব, তাই না? ”

“কেন নানুমনি কি তোর একলার? আমার না? আমি থাকতে তুই কেন?”

“আহা হইছেতো হিমু! একটু ছাড় দিতে শিখরে ভাই।শোন লাবু, আজ রুশের সিটি আছে ওর স্কুলে যাওয়াটা জরুরি। তাই তোকে বলিনি। একজন রুশকে স্কুলে নিয়ে যাওয়ার জন্য ওর পাশে থাকা দরকার। তাই ওকে খবর দিয়েছি, বুঝলি? শুধু শুধু মাথা গরম করিস না। রুশকে নিয়ে সাবধানে যাস কেমন?”

“তুমিও সাবধানে যেও।”

“আমার সাথে যাচ্ছে, আমি দেখে রাখব, তোকে আর নাক গলাতে হবে না।”

“আমার নানি আমিতো বলবোই।”

“এই কি নানি নানি করিস ছোটবেলা থেকে, শুনতেই বিরক্ত লাগে, মনে হয় মুখে একটুও রস নাই।একটু সুন্দর করে বলতে পারিস না, নানু মনি যেমনটা আমরা বলি তাও বলতে পারে না। পুরাই খাইস্টা একটা।”

“এই কি হচ্ছে, শেষ হয়নাই হিমু? ”

হ্যা, শেষতো চলো। বলে সেই চেনা মিষ্টি হাসিটা হাসলো লাবন্যের দিকে তাকিয়ে। লাবন্য অবাক হল। এই হাসির জন্য ও এতটা পাগল ছিল কিন্তু আজ কেনজানি সেই হাসিতে ওর মন নরম হলো না বরং মেজাজ আরও বেশি গরম হয়ে গেল। কিন্তু নানির জন্য আর বাড়তি কিছু বলল না।

নানি বের হতে হতে হিমেলকে বললেন, “কিরে তুই এমন করে কেন বলছিস সবার সামনে? হোমাতো আবোল তাবোল যা পাড়ল তাই বলল।”

“মিথ্যা কি বলছি? আমি জানি বন্য কোন ভুল করে নাই। বড়পু পানির ছিটা দিয়েছে বলেই এত গুতা খেয়েছে। সোজা হিসাব আমার।” বলতে বলতে দুজন দরজা ক্রস করে বের হয়ে গেল। হিমেলের শেষ কথাটা সরাসরি লাবন্যের বুকে গিয়ে বিঁধল। মনে হল জমে থাকা রাগগুলো আরও বেশি জ্বলে উঠল বুকের ভেতর। এতটাই যদি সে জানে বুঝে, তবে ওর কষ্টের সময় কেন পাশে থাকল না। পুরুষগুলো সবই এমন ভন্ড হয় নাকি? ভালোবাসার জাল ফেলে রাখে কিন্তু নিজেরা থাকে মুক্ত। যখন যেমন প্রয়োজন তখন তেমন সাঁচে ফেলে নিজেদের জন্য ভালোবাসাকে সাজিয়ে নেয়। অদ্ভুত লাগে এদের মতিগতি।লাবন্য প্রচন্ড রকমের বিরক্ত হল হিমেলের শেষ কথাতে আরও।

হিমেল ও নানুকে নিয়ে সব কাজ শেষ করে যখন রুশের স্কুলে এসে পৌছালো তখন দেখল গেইটের কাছে লিখন দাঁড়ানো। হিমেল নিজের মেজাজকে খুব সাবধানে কন্ট্রোল করে রাখল। সালাম দিয়ে মুখ ঘুরিয়ে কিছুটা দুরত্বে গিয়ে দাঁড়াল। কিন্তু ওর নানুর মুখোয়বে বিরক্তের বিন্দুমাত্র রেশ দেখতে পেলো না লিখনের উপস্থিতিতে।মনে হল উনি বিষয়টা জানতেন। হিমেল উনার ভেতরে তেমন কোন প্রতিক্রিয়া না দেখে বেশ অবাকই হল। সামনে আসতেই নানু বলে উঠলেন

“মিসের সাথে দেখা করেছো?”
“জি আম্মা।”
“রুশের সাথে দেখা হয়েছে?”
“জি।”
“তাহলে দাঁড়িয়ে আছো কেন?”
“শুনলাম আপনি হাসপাতালে গিয়েছেন, তাই ভাবলাম আপনার সাথে দেখা করে যাই। আপনার শরীর এখন কেমন? ডাক্তার কি বললেন?”
“দেখো লিখন একটা কথা খুব ক্লিয়ার করে বলে দেওয়ায় ভালো। তোমাকে তোমার ছেলেমেয়েদের সান্নিধ্যে রাখার জন্য যে সাহায্য আমি করছি তা নিতান্তই মানবিক কারনে। রুশের সেদিনের কান্না
আমি সহ্য করতে পারিনি। মেয়েটার মন কুঁড়িতে যেন বিনষ্ট না হয় সে জন্য। তুমি এরচেয়ে আর বেশি কিছু মনে করো না। আমি রেশমার মা হিসেবে কোনদিনও তোমাকে ক্ষমা করতে পারব না। আমার কোনো খোঁজ খবর তোমাকে নিতে হবে না। এরপর আর কখনও অনাধিকার চর্চা করবে না। আশা করব তুমি বিষয়টা বুঝতে পারছো। ”
“জি আম্মা। কোন প্রয়োজন হলে আমাকে জানিয়েন।”
“ছেলে মেয়ে দুটো যখন তোমার তখন সমস্যা হলেতো অবশ্যই তোমাকে জানাবো, তাতে নিশ্চিত থাকো।”
“জি আম্মা, আমি তাহলে আসি।”
“হুমম, ফ্ল্যাটের সভাপতির সাথে যোগাযোগ করো।”
“জি করব। আসি তাহলে এখন।” বলে আর দাঁড়ালো না। লিখন ফিরে এল।

হিমেল অবাক হয়ে গেল ওর নানুর আচরনে।এতটা ঠান্ডা মাথায় যে এমন লোকের সাথেও সুন্দর প্রতিবাদ করা যায় তা এই প্রথম ও বুঝল। নিজ থেকে নানুকে কিছু বলতে সাহস পেলো না। হঠাৎ নানুর কথাতেই সম্বিত ফিরল

“আজ এমন অহেতুক ঝগড়া করলি কেন লাবুর সাথে?”
“দেখলাম এখন আগের বন্যটা কেমন আছে?”
“তা কেমন দেখলি?”
“একদম ঝাক্কাস!” বলে মুচকি একটা হাসি দিল।
“এসব হাসিতে আমার কোন কাজ নাই। আমার বড় মেয়েকে কষ্ট দিয়ে তুমি কিছু করতে পারবা না। নিজের মা’কে কীভাবে বুঝিয়ে শুনিয়ে মানিয়ে আনবা তা দেখার প্রত্যাশায় রইলাম।”
“হুমম, বিশাল দায়িত্বের বোঝা চাঁপিয়েছো ঘাড়ে।এখন ঠিক মতো ঘুমাতেও দেয় না সেই বোঝা। দেখি বড়পু চলে গেলে পরে কীভাবে কি করা যায়!”
“চেলে গেলে কী হবে? এরাতো সারাক্ষণই ভিডিও কলে কানেক্টেড থাকে। মন পরিবর্তন করা খুব কঠিন কাজ।”
“আম্মুর মনটা কিন্তু খারাপ না। কোনো কিছু নেগেটিভ ভাবনাটা প্রথমেই কিন্তু আসে না….”
“ওর সমস্যা, ও মেয়েদের কথা শুনে।”
“হুমম।”
“যা এবার বাসায় যা, রেহেনা আবার রাগারাগি করবে তোর সাথে। দেরি করিস না।”
“নাহ, এখন আর আম্মু রাগারাগি করতে পারে না। এখন আবার আব্বু বাসার বাঘ হয়ে গেছেন। মাঝখানে আব্বু বেশ নরম ছিলেন, কিন্তু হঠাৎ করেই আবার আগের মতো হয়ে গেছেন। এখন আম্মু একটু চুপচাপই থাকেন।” হিমেলের কথা শেষ হতেই স্কুল ছুটি হয়ে গেল। রুশ বের হতেই ওর বাসার জন্য রওয়ানা হয়ে গেল।

ছাদের অনুষ্ঠান নিয়ে পুরো বিল্ডিংএ খুব মাতামাতি শুরু হল। রাতে বারবিকিউ হবে। সাথে নানান ধরনের গেমস হবে। এর আগের বছর গুলোতেও হত এমন অনুষ্ঠান । রেশমা নিজেও খুব মজা করতো সবার সাথে। ভাবিদের গ্রুপগুলো ভালোই এনজয় করতো এই এক রাত। লাবন্যই কেবল খুব একটা মিশতো না কারউ সাথে । ও প্রতিটা রাতেই হিমেলের সাথে চ্যাটিং করে সময় কাটাতো। শুধু মাত্র খাওয়ার সময় গিয়ে খেয়ে আসতো। আজ রুশের জন্য ওদেরকে একটু আগে আগেই ছাদে উঠতে হল। রুশ ওর আম্মুর সাথে গিয়ে ছাঁদে মজা করতো। ওখানে বাচ্চাদেরও অনেক খেলা থাকতো ও ওগুলো খুব এনজয় করতো, গতবার হাটে হাঁড়ি ভাঙাতে জিতে একটা সুন্দর রিস্টওয়াচ পেয়েছিল। ও এবারও সব গেইমসে পার্টিসিপ্যান্ট করতে চায়।

ছাদে উঠার পর সবার মন ভালো হয়ে গেল। আকাশ ভরা ফানুশ উড়ছে। দেখতেই খুব ভালো লাগছে। লাবন্য পাশের ফ্ল্যাটের আন্টির সাথে ওর নানিকে পরিচয় করিয়ে দিতেই ভদ্রমহিলা গিয়ে অন্যদের সাথে নানির পরিচয় করিয়ে দিলেন। আর সেই সাথে ওই একরাম সাহাবের ওয়াইফ আর মেয়ের সাথেও পরিচয় হল গেল। আজ আর এখানে লিখন নাই। পুরুষরা একপাশে বসে গল্পগুজব করছেন বাচ্চারা ওদের খেলায় মগ্ন। প্রতিবার খেলাগুলো পরিচালনায় অন্য মহিলাদের সাথে রেশমাও থাকত। এবার ও না থাকায় এক আন্টি ওর অনুপস্থিতিটা স্মরণ করল, খুব আক্ষেপও করল এত অল্প বয়সে এভাবে দুনিয়ার মায়া ছেড়ে চলে যাওয়া নিয়ে। সবই আল্লাহর ইচ্ছা সেটাও সবাই বলল। কিন্তু একজন দুইজন জোড়ায় জোড়ায় এদিক সেদিক দাঁড়িয়ে ফিসফিসিয়ে বলতে লাগল
” মনেতো হয় ব্যাটার আগে থেকেই পরকীয়া ছিল যা কি না আপা মানতে পারেনি তাইতো এমন হুট করেই স্ট্রোক করে মরে গেল। দেখলেন না আপা মরতেই হারামজাদা ব্যাটা বিয়ে করে বৌ ঘরে তুলল। আগে ভাগে কানেকশন ছিল বলেই এত তাড়াতাড়ি করতে পারল।”
উত্তরে আরেক মহিলা বলল ” ভাবি ব্যাটার চক্ষু লজ্জাটুকুও নাই, এমন করে কেউ বিয়ে করে? একটু সময় নিত! এখন ছেলেমেয়েদের আগে একটু সময় দিত সহজ হতে। একটুও ধৈর্য নাই বদমাশ পুরুষ মানুষ।আপা মরতেই নতুন বৌ ঘরে নিয়ে হাজির। লাবন্য উচিৎ কাজটাই করেছে। এদেরকে এভাবে না ঝাটা পেটা করে বের করে দেওয়া উচিৎ ছিল। ”

লাবন্য হাসতে হাসতে ওর নানিকে ঠেলা দিয়ে বলল “শুনছো নানি, আন্টি গ্রুপের গল্পের টপিকটা। দারুন না! একেবারে রসালো জম্পেশ টপিকটা।”

“হুমম শুনছি আর ভাবছি, আমরা মানুষ কতটা রহস্যপ্রেমী। কতটা অন্ধকারে ডুবে থাকি, সত্য মিথ্যা না জেনেই কত কত মন্তব্য করি ।”

“কিসের মধ্যে কি বলো তুমি?”
“এরা যা বলছে তা কি ঠিক বলছে? এসব কি আদৌ সত্য?”
“তার আমি কি জানি?”
“জানিস, অবশ্যই জানিস। লিখন কোন পরকীয়ায় জড়িত ছিলো না। বিয়েটা ও যাকে করেছে তাকে ও আগে কোনদিনও দেখেনি। এটাই সত্য। ”
“তাতে কি আর আমাদের ভাগ্যে নতুন কিছু হবে? আমাদের আগের আব্বুকে ফিরে পাওয়া যাবে তাতে? পরকীয়াই হোক আর অজানা অচেনাই হোক, সেতো নতুন করে একজনকে বিয়ে করে এনেছে আমাদের মায়ের জায়গাটাকে ভরেছে, খালিতো আর রাখেনি। তাহলে আর এসব কথায় বিশ্বাস আর অবিশ্বাসে আমার কি যায় আসে। যা হওয়ার তাতে লস হয়েই গেছে। মা’ও নাই এখন আব্বু থাকতেও নাই। এটাই সত্য, চরম সত্য।”

“তোর বাপকে যে মহিলারা এত খারাপ গালি দিচ্ছে তাতে তোর মনে কষ্ট হচ্ছে না? ”
“হা হা হা, কি বলো এসব তুমি? যে যেমন কর্ম করবে তেমন ফল পাবে। এটাই স্বাভাবিক। লিখন সাহেব যেমন কাজ করেছেন তেমনটাই পাচ্ছেন।ব্যস এই টুকুই। বাদ দাও চলো রুশের খেলা দেখি বলে নানির হাত টেনে বাচ্চাদের খেলার পাশে চলে গেল।

রুশ বেশ মজা পাচ্ছে এখানে এসে খেলতে। বাস্কেটে বল থ্রোতে ও ঠিকই বল ফেললো প্রতিবার ঠিক মতো। লাবন্য দুষ্টমি করে ইশারা করে কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিস ফিস করে জানতে চাইল “কিরে খবর কি কিভাবে সম্ভব হচ্ছে?” রুশ শুধু হাসল কোন উত্তর দিল না। হটাৎ করেই ভাইয়ের এত আনন্দ দেখে ও নিজেও খুব খুশি হল। ভাইকে উৎসাহ দিতে তাই প্রতিবারই জোরে জোরে চিৎকার করে উঠতে লাগল। ওর নানি পাশে দাঁড়িয়ে ওদের ভাইবোনের আনন্দটাই দেখছিলেন।এরই মধ্যে পাশের ছাঁদের সবার চিৎকার চেচামেচিতে এই ছাঁদের সবার মনোযোগ ওদিকে গেলো। ওই ছাদের উপর কাঠের কবুতরের ঘর ছিল তাতে আগুন লেগে গেছে। এত এত ফানুশ আর পটকা বোমের ভিতর কখন যে কোনটা এই ঘরের উপর পড়েছে তা কেউ খেয়ালই করতে পারেনি। কবুতরগুলো ঘরের ভেতরই ছিল। কিছু কবুতরকে বের করতে পারলের অধিকাংশই ঘরের ভেতর পুড়ে মরল। লোকজন আগুন নেভানোর জন্য দৌড়াদৌড়ি করতে করতেই পাখিগুলো শেষ হয়েগেল। বেশির ভাগ লোকজন কারেন্টর তার আর ডিশের তার সেভ জোনে রাখতেই ব্যস্ত ছিল। আগুন নেভানোর পর পোড়া ঘর থেকে পাখিগুলোর পোড়া দেহগুলো বের করে সাজাতেই সবার মন খারাপ হয়ে গেল। কেউ কেউ বলল “যাক বিপদ আপদ পাখির উপর দিয়েই গেছে মানুষের জানমালতো বেঁচে গেছে। ”
লাবন্য কথাটা হজম করতে পারলো না, এটা কেমন অমানবিক কথা! কিছু একটা বলতে চাইল কিন্তু ওর নানি বাঁধা দিলেন। বললেন চুপ থাকতে। সব জায়গায় সবার কথার জবাব দিতে নাই। তাই আর কিছু বলল না ও।

খাবার যখন খাচ্ছিলো তখন সবাই গোল হয়ে বসেছিল। এরই মধ্যে একরাম সাহেবের সাথে লাবন্যের চোখাচোখি হল। হঠাৎ করেই কি হল ও হিহিহি করে হেসে উঠল। তার পাশে তার ওয়াইফকে দেখেই আরও উৎসাহ নিয়েই জোর গলায় বলে উঠল
“আরে আংকেল আপনিতো আর আমার খোঁজ খবর নিতে আসলেন না? আপনিতো বলেছিলেন রাতে আসবেন বাসায় আমার কি কি লাগবে তা জানার জন্য। কিন্তু আংকেল আপনিতো একদিনও আসলেন না। নানিও বলছিলেন সামনের মাস থেকে আপনাকেই ডাকবেন।”
“না মানে, ইয়ে.. আর কি, আমিতো ব্যস্ত থাকি। ইয়ে মানে.. ” অতর্কিত হামলায় বেচারা বেকায়দায় পড়ে গেলেন বলে মনে হল।
“কিসের কথা বলছো লাবন্য? তোমার আংকেল কবে যেতে চেয়েছিলো তোমাদের বাসায়? ” পাশ থেকে মিসেস একরাম জিজ্ঞেস করল।

“জি আন্টি, আংকেলতো কয়েকদিনই আমার সাথে কথা বলেছেন….. ”

“না মানে, দুইদিন নিচে দেখা হয়েছিলতো তখন বলেছিলাম…. লাবন্যকে থামিয়ে দিয়ে তিনি নিজেই তার ওয়াইফকে জানালো।

“কই তুমিতো আমাকে আগে কখনও বলো নাই এই কথা?
“আন্টি শেষদিনতো আমার নানির সাথেও কথা হয়েছিলো। নানিতো বলেছেন বাজার যা লাগবে তা আপনাকেই জানাবেন। ”

“তাই নাকি! আমিতো এসব কিছুই জানি না। বাসার বাজারতো করি আমি। তখনতো তার অনেক কাজের চাপ বেড়ে যায়। অথচ তোমাদের বাজার করতে চেয়েছিলো। তাই না?”
“ইয়ে মানে আমি আসলে সেটা বলিনি মানে সেটা.. … ”

“আরে আন্টি আংকেলতো এমনি এমনি বলেনি! আমার অনেক কষ্ট হচ্ছিল বলে আংকেল বলছেন। আমার কষ্টটা আংকেলকে খুব কষ্ট দিচ্ছিল মনে। আংকেলেরতো মায়ার শরীর তাই রাতের বেলায় আমার খোঁজ খবর নিতেও আসতে চেয়েছিলেন। ”

“ইয়ে মানে আমার একটা জরুরি কাজের কথা মনে পড়েছে আমি একটু আসছি।” বলে একরাম সাহেব মোবাইল নিয়ে উঠে দ্রুত চলে গেলেন।

“এত কিছু? ও মাই গড! আমিতো কিছুই জানি না। একরাম তুমি আজ আসো বাসায় আসো তোমার সাথে বোঝাপড়া আছে আমার। ” খুব রেগে গেছেন বলেই মনে হল লাবন্যের।

“ভাবি ভাইকে একটু টাইটে রাইখেন, আসলে পুরুষ মানুষকে একটুও বিশ্বাস করা যায় না। এরা এমনই হয়, সুযোগ পেলেই পিছলে যায়।”

লাবন্য খাবারের প্লেট টা হাতে নিয়ে একটু পেছনে সরে এল। ওর খুব মজা লাগছিলো আন্টির চেহারা রং পরিবর্তন দেখে। এখন এখানে এই টপিকে আর কিছু শলাপরামর্শ হবে বলেই ওর ধারনা।

“এটা কি হল লাবু?”

“চোখ বন্ধ করে সীনটা কল্পনা কর নানি। একরাম মিয়ার কি একটা বেহাল অবস্থা। বন্ধ এক ঘরে সে দাঁড়ানো, সামনে বসা তার এই বাঘিনী বৌ । হাতে যা খুশি একটা চিন্তা করতে পারো। যেমন আমার মন চাইছে কারেন্টর তার। আর তাই একরাম মিয়ার চুলগুলো সব খাড়া হয়ে দাঁড়ায় আছে।চক্ষু দুইটা লাল, টিশার্টে একটু জ্বলা।কান দিয়ে ধুঁয়া উড়েতো উড়ে না। অন্তর পুড়েতো পুড়েনা।…..”

“চুপ বদমাশ চুপ, একদম চুপ। বদমায়েশীর একটা লিমিট থাকে, এতদিন বন্ধ ছিলো, আবার শুরু হইছে না? চল বাসায় চল আর খাওয়া লাগবে না তোদের।”
বলতে বলতে নানি উঠে গেলেন, সাথে রুশকেও ডাকতে লাগলেন।

চলবে।

***** আসসালামু আলাইকুম, বছরের শুরুটা হল আমার বিয়োগ দিয়ে। আমার বড় খালা ইন্তেকাল করেছেন পহেলা জানুয়ারি সকাল ৬.৩০ মিনিটে। এখনও শোক কাটিয়ে উঠতে পারিনি। গতকয়দিন শুধু ছুটে ছুটে গিয়েছি খালার বাসায়। পর্ব লিখতেই পারিনি, মন বসছিলো না যেনো কোন কিছুতেই। আশা করি সবাই ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন। ধন্যবাদ সবাইকে পাশে থাকার জন্য।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here