#স্রোতের_টানে
লেখিকা:#Tarin_Niti
পর্ব:১৭
ফারিহা আর আয়ান খাবার টেবিলে বসে নাস্তা করছে।ওদের বিয়ের অনেকদিন হয়ে গিয়েছে।এই কয়েকদিনে আয়ান প্রথম প্রথম ফারিহার সাথে খারাপ ব্যবহার করলেও পরে আর ফারিহাকে কষ্ট দেয়নি।আয়ান বলতে গেলে ফারিহার মায়ায় পড়ে গিয়েছে।এরকম মিষ্টি একটা মেয়ের মায়ায় না পড়ে থাকা যায়?তবে হ্যাঁ আয়ান মিস্টার আজাদ এর থেকে প্রতিশোধ নেওয়ার কথা ভুলেনা।মিস্টার আজাদকে তো ও বরবাদ করবেই কিন্তু তার জন্য ফারিহাকে ব্যবহার করবে! আয়ানের মন এক কথা বলছে,মস্তিষ্ক আরেক কথা বলছে।নাস্তা খেতে খেতে ফারিহা বললো,
“ইয়ে মানে আপনাকে একটা কথা বলার ছিল”
আয়ান একহাতে খাচ্ছে আর এক হাতে মোবাইল স্ক্রল করছে।আয়ান সেভাবেই মোবাইল দেখতে দেখতে বললো, “হুম বল”
ফারিহা আসলে কিভাবে কথাটা বলবে বুঝতে পারছে না।ফারিহা জানি এটা শুনলে হয়তো আয়ান প্রচুর রেগে যাবে। কিন্তু ওকে তো বলতেই হবে। ফারিয়াকে একটু উসখুস করে নিচু কন্ঠে বললো,
“আমি ভার্সিটি শেষে বাপির বাসায় যাবো”
ফারিহার কথা শেষ হতে না হতেই আয়ান চোখ তুলে ওর দিকে তাকালো।আয়ানের চাহনি দেখে ফারিহা থতমত খেয়ে গেলো।তারপর কোনরকমে তাড়াতাড়ি করে বললো,
“আগামীকাল মাম্মার মৃত্যুবার্ষিক। প্রতিবছরই মাম্মার মৃত্যুবার্ষিকীতে বাপি গরিব-দুঃখীদের খাওয়া-দাওয়ার ব্যবস্থা করে,মিলাদ পড়ায়।আমি যেতে চাই প্লিজ বারন করবেন না”
আয়ান শান্ত কন্ঠে বললো, “এবারো এসবের আয়োজন করা হবে তুমি কিভাবে জানলে?”
আয়ানের কথা শুনে ফারিহা ভয় পেয়ে গেলো। ফারিহার যে মিস্টার আজাদের সাথে কথা হয় এটা আয়ানকে বলা যাবে না।ফারিহা আমতা আমতা করে বললো,
“প্রতি্ প্রতি বছরই তো হয়।এবারও হবে”
ফারিহার কথা শুনে আয়ান বাঁকা হাসলো।ফারিহা ওর থেকে কথা লুকানোর চেষ্টা করছে!কিন্তু ফারিহা জানেনা আয়ান ওর থেকেও এক লেভেল এর উপরে।আয়ান সব জানে!
আয়ান কিছু বলছে না দেখে ফারিহা আবার বললো,
“দেখুন আগামীকালকে আমার মাম্মার মৃত্যুবার্ষিক।প্লিজ আমাকে আগামীকাল আটকাবেন না।আমার আমার..”
কান্নার কারণে ফারিহার গলায় কথা আটকে গেলো। ও শুধু ভাবছে আয়ান যদি ওকে যাতে না দেয়!আয়ান স্বাভাবিকভাবেই খেতে খেতে বললো,
“কয়দিন থাকার প্ল্যান করছো?”
“না না আমি থাকবো না।আজকে ভার্সিটি শেষে যাবো আগামীকালকে মিলাদ শেষে বিকেলে চলে আসবে। আপনি চাইলে আপনার বডিগার্ডের আমার সাথে পাঠাতে পারেন”
“এমনিতে তো আমি তোমাকে ওই বাড়িতে যেতে দিতাম না।কিন্তু আমার শ্বাশুড়ি মা এর মৃত্যুবার্ষিক!ওকে ঠিক আছে।তুমি যেতে পারো..
ভার্সিটির শেষে আমার বডিগার্ড আর তোমাকে পৌঁছে দেবে”
আয়ানের কথা শুনে ফারিহার মুখে হাসি ফুটলো। ফারিহা খুব চিন্তায় ছিলো, আয়ান পারমিশন দে কিনা।আয়ান আবার বললো,
“আর হ্যাঁ তোমাদের বাড়িতে বডিগার্ড পাঠাবো না। কিন্তু এই সুযোগে আবার পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করো না!”
“না না আমি পালানোর চেষ্টা করবো না। আপনি নিশ্চিন্তে থাকুন।পারমিশন দেওয়ার জন্য ধন্যবাদ”
__________
ভার্সিটি শেষে আয়ানের বডিগার্ডরা ফারিহাকে ওর বাসায় পৌঁছে দিলো। ফারিহা, নওশীন আর শিহাবকে ও বলেছে। ওরা আগামীকাল আসবে।ফারিহা আজকে অনেক খুশি, প্রায় একমাস পর বাড়িতে এসেছে।যেদিন ফারিহা আর আয়ানের বিয়ে হয়েছিলো সেদিন সকালে ফারিহা জানতো না যে এতদিন পর আবার বাসায় ফিরতে পারবে!ফারিহা ওর বাপীকে বলেনি আজকে যে অাসবে,ফারিহা মিস্টার আজাদকে সারপ্রাইজ দিতে চেয়েছিলো।ফারিহা আস্তে আস্তে গেট ঢেলে ভেতরে ঢুকলো।
দারোয়ান আঙ্কেল ফারিহাকে দেখেই ফোকলা দাঁতে হেসে ভালো-মন্দ জিজ্ঞেস করলো। ফারিহা ও দারোয়ান আঙ্কেলের সাথে কথা বলে ভেতরের দিকে এগোয়।
ভিতরে গিয়ে দেখে মিস্টার আজাদ বসার ঘরে সোফায় বসে ফাইল দেখছে আর হানিফ আহমেদ পাশে বসে কি যেন কথা বলছে।
ফারিহা আস্তে আস্তে মিস্টার আজাদের পেছনে গিয়ে চোখ ধরলো।ফারিহাকে দেখে হানিফ আহমেদ কিছু বলতে যাচ্ছিল কিন্তু ফারিহা ইশারায় চুপ থাকতে বললো। হঠাৎ চোখ ধরায় মিস্টার আজাদ হকচকিয়ে গেলো। তারপর ফারিহার হাতের উপর হাত রেখে বললো,
“কে?”আরে কে এভাবে হঠাৎ এসে চোখ ধরলো?”
ফারিহা অভিমানী মুখ ছোট করে ফেললো।ওর বাপী ওকে চিনতে পারছে না।আগেতো ভার্সিটি থেকে এসে প্রায় সময় এভাবে চোখ ধরতো,তখন তো ঠিকই চিনতো। বিয়ে হয়েছে বলে কি ভুলে গিয়েছে! কিছুক্ষণ পর মিস্টার আজাদ কাঁপা কাঁপা কন্ঠে বললো, “ফাৃ ফারিহা..”
ফারিহা হেসে চোখ ছেড়ে মিস্টার আজাদের সামনে দাঁড়িয়ে কোমড়ে হাত রেখে বললো, “হ্যাঁ আমি।এতক্ষনে চিনতে পারলে?বিয়ে হয়েছে বলে কি ভুলে গেলে নাকি?”
মিস্টার আজাদ এক মুহূর্তও দেরি না করে ফারিহাকে বুকে জড়িয়ে নিলো।তারপর ফারিহার মাথায় হাত বুলিয়ে বললো, “তুই?এ বাসায়?আয়ান আসতে দিলো?”
“হুম মাম্মার মৃত্যুবার্ষিকীর কথা বলেছিলাম।তারপর পারমিশন দিয়েছে। আমি আসছি বলে তুমি খুশী হওনি?”
“কি বলছিস?খুশি হবো না কেনো?আমি তো অনেক খুশি।জানিস আমি ভেবেছিলাম এবার তোর মায়ের মৃত্যুবার্ষিকী তে তোকে ছাড়া থাকতে হবে”
ফারিহা হেসে বললো, “আর আমাকে ছাড়া থাকতে হবে না। আমি এসে পড়েছি”
তারপর হানিফ আহমেদ এর দিকে তাকিয়ে বললো,
“আঙ্কেল কেমন আছেন?”
হানিফ আহমেদ এতক্ষণ ফারিহাকে দেখছিলো।ফারিহার কথায় উত্তর দিলো, ” হ্যাঁ ভালো আছি।তুমি কেমন আছো মামনি?”
“ভালো আছি আঙ্কেল।মনি কোথায়?”
হানিফ আহমেদ হেসে বললো, “রান্নাঘরে মনে হয়”
“আমি মনির সাথে দেখা করে আসছি”
বলে ফারিহা দৌড়ে রান্না ঘরের দিকে চলে গেলো। ফারিহা চলে গেলে হানিফ আহমেদদ মিস্টার আজাদকে বললো,
“স্যার আয়ান হঠাৎ মামনিকে এ বাড়িতে আসতে দিলো? অন্য কোন উদ্দেশ্য নেই তো?”
“আরে না! কি বলছো?শুনলেই তো ফারিহা মায়ের মৃত্যুবার্ষিকীতে আসতে চেয়েছিলো তাই হয়তো পারমিশন দিয়েছে”
“কিন্তু আমার অন্য কিছু মনে হচ্ছে স্যার।আপনিও জানেন আর আমিও জানি আয়ান এতো ভালো ছেলে না যে মামনি ওর কথায় আসতে দেবে”
“কি জানি!” মিস্টার আজাদ চিন্তিত হয়ে বললো
.
ফারিহা কিচেনে গিয়ে দেখলো হনুফা বেগম রান্না করছে।ফারিহা মনি বলে চিৎকার করে গিয়ে হনুফা বেগমকে জড়িয়ে ধরলো।ফারিহাকে দেখে হনুফা বেগম কেঁদে দিলো।এই মেয়েটাকে ছোট থেকে নিজের মেয়ের মতো ভালোবাসা দিয়ে বড় করেছে।আজ প্রায় এক মাস পর দেখলো তাই কান্না আটকে রাখতে পারেনি।ফারিহা হনুফা বেগম কে ছেড়ে চোখের পানি মুছে দিয়ে বললো,
“কাঁদছো কেনো? আমি এসে পড়েছি তো”
“তুই কেমন মেয়ে রে?আমার কথা কি একটুও মনে পড়লো না?এই এক মাসে একবারও কথা বললি না?”
“মনি আমি তোমাকে খুব মিস করেছি।কিন্তু বাপির সাথে অনেক ভয় ভয়ে কথা বলতাম কখন উনি দেখে ফেলে আর তাছাড়া তোমার কথা মনে পড়লে আমার কান্না পেতো তাই ফোনে কথা বলতে চাইনি।দেখো আজকে তো এসে পরেছি আর রাগ করো না প্লিজজজজ…”
“যাক আজকে এসেছিস।আমিতো ভাবলাম এবার হয়তো তোর মায়ের মৃত্যুবার্ষিকীতে তুই থাকবি না। আচ্ছা আয়ান তোকে আসতে দিলো?”
“হুম মনি। উনি কিছু বলেনি”
হনুফা বেগম ফারিহার চুলে হাত বুলিয়ে বললো,
“তুই ভালো আছিস তো?”
“আমি অনেক ভালো আছি।আমি এসে গেছি তোমার আজকে কোন কাজ করতে হবে না।তুমি আজকে সারা দিন আমাকে সময় দেবে”
“আরে কি বলছিস? কাজ করতে হবে না মানে?তুই এতদিন পর আসলি আজকে তোর সব পছন্দের রান্না করবো”
“না মনি আর কোন কথা নয়”
“আজকে এক মাস আমার মেয়েটাকে নিজ হাতে রেঁধে খাওয়াতে পারি না। আমারও তো ইচ্ছে করে নাকি?”
ফারিহা হেসে বললো, “আচ্ছা ঠিক আছে।তুমি রান্না করো আমি ফ্রেশ হয়ে আসছি”
ফারিহা কিচেন থেকে আবার বসার ঘরে আসলো ফারিহাকে দেখে মিস্টার আজাদ বললো,
“ফারিহা যা নিজের রুমে গিয়ে ফ্রেশ হয়ে আয়।তারপর একসাথে লাঞ্চ করবো”
ফারিহা হেসে বললো, “যাচ্ছি বাপি”
তারপর উপরে ফারিহা ওর রুমে চলে আসলো। আজকে এতদিন পর রুমে এসে ফারিহা অবাক হয়ে গেলো।ওর রুম একদম পরিপাটি। মনে হয় যেন এখানে কেউ প্রতিদিন থাকে।ফারিহা বুঝতে পারে মনি হয়তো প্রতিদিন রুম পরিস্কার করে।ফারিহা পুরু রুম থেকে ঘুরে ঘুরে দেখছে।ও এতদিন পর নিজের রুমে এসে আলাদা অনুভূতি হচ্ছে।
ফারিহা ছোট থেকে আলাদা রুমে থাকতো।এই রুমটা ও নিজ হাতে সাজিয়েছে।দেয়ালের রঙ গোলাপী কালার পর্দাগুলো সাদা।সব ফার্নিচার,।কার্পেট সাদা গোলাপি রঙ্গের মিশ্রণে।বেডে অনেকগুলো পুতুল,কোলবালিশ।দেয়ালে দেয়ালে ফারিহার আর ওর মা বাবার ছবি। তাছাড়া ফারিহার নিজ হাতে বানানো অনেকগুলো কাগজের ফুল আছে।পুরো রুমটা একদম বাচ্চাদের রুমের মতো দেখতে।
ফারিহা মুচকি হেসে ব্যাগটা বিছানার উপর রেখে কাবার্ড থেকে একটা থ্রি-পিস নিয়ে ওয়াশ রুমে চলে গেলো।ফারিহার সব জামাকাপড় এই বাড়িতে আছে।
অনেকক্ষণ পর ফারিহা গোসল করে রুমে এসে ভেজা চুলগুলো ছেড়ে দিলো।তারপর কিছুক্ষণ পর নিচে নেমে ওর বাপির সাথে লাঞ্চ করতে বসলো।আজকে অনেকদিন পর ওরা দুজন একসাথে বসে খাচ্ছে।ফারিহা আর মিস্টার আজাদ একজন আরেকজনকে খাইয়ে দিচ্ছে।ওরা প্রায় সময়ই কাজটা করে থাকে।ফারিহা এটা খাব না,ওটা খাবো না বলে আবদার করছে আর মিস্টার আজাদ বেছে বেছে ফারিহার পছন্দের খাবার গুলো মুখে তুলে দিচ্ছে। হানিফ আহমেদ আর হনুফা বেগম ওদের কান্ড দেখে হাসছে।
খাওয়া-দাওয়া শেষে ফারিহা মিস্টার আজাদের সাথে বসে গল্প করতে থাকলো।মিস্টার আজাদ সব কাজ ফেলে রেখে ফারিহার সাথে কথা বলতে থাকলো। মেয়েকে এতদিন পর কাছে পেয়েছে এখন কি কাজ করলে হয় নাকি?
এই বাড়িতে এসে ফারিহার মনটা ভালো হয়ে গিয়েছে।
চলবে…