#স্রোতের_টানে
লেখিকা:#Tarin_Niti
পর্ব:১৮
রাত আটটা,,
ফারিহা ব্যালকনিতে গিয়ে দাঁড়ালো।ফারিহার ব্যলকনি টা অনেক সুন্দর।চারদিকে বিভিন্ন টবে শুধু ফুলগাছ। সবগুলো ফারিহার নিজের হাতে লাগানো।ফুলগাছ ফারিহার অনেক পছন্দের কিন্তু আয়ানের ব্যালকনিতে কোন ফুল গাছ নেই।আর ফারিহার সাহস হয়নি ফুল গাছ লাগানোর। যদি আয়ান রাগারাগি করে!
ফারিহা ব্যালকনি থেকে দাঁড়িয়ে দেখে নিচে সবাই কাজ করছে। মিস্টার আজাদ দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখছে আর সবাইকে এটা বলে দিচ্ছে। এক পাশে আগুন জেলে ডেকোরেশন এর বড় বড় পাতিল গুলোতে বাবুর্চিরা রান্না করছে।ফারিহাদের তেমন কোন আত্মীয় নেই।মিস্টার আজাদন এর কোন ভাইবোন নেই আর মা-বাবা মারা গিয়েছে।আর ফারিহার মায়ের পরিবারের কেউ নেই।তাই আজকে কোন আত্মীয়-স্বজন আসেনি।আগামীকাল মিস্টার আজাদের বন্ধুরা আসবে আর গরিব-দুঃখীদের খাওয়ানো হবে।
ফারিহা চেয়েছিল ওর অনাথ আশ্রমের বাচ্চাদের এনে খাওয়াতে। কিন্তু এতগুলো বাচ্চা একসাথে আনলে সমস্যা হবে, এগুলো এক একটা যে দুষ্টু ওদের সামলাতে প্রচুর হিমশিম খেতে হবে।তাই মিস্টার আজাদ প্রতি বছর এই দিনে অনাথ আশ্রমে ও খাবারের আয়োজন করে।মিস্টার আজাদ টাকা দেয় আর অনাথ আশ্রমের লোকেরা সব আয়োজন করে।
ফারিহা ব্যালকনি থেকে একবার নিচের দিকে তাকিয়ে বাগানে যাওয়ার জন্য রুম থেকে বের হলো। হনুফা বেগম কিচেনে আরো সব মহিলা সার্ভেন্টদের সাথে কাজ করছিলো।ফারিহা একবার সেদিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে বাগানের দিকে চলে গেল। বাগানে গিয়ে দেখি মিস্টার আজাদ একটা লোককে কি যেন বলছে।হানিফ আহমেদ কাজ করছে। ফারিহা গিয়ে ওর বাপির পাশে দাঁড়ালো।
ফারিহাকে দেখে মিস্টার আজাদ একটা ধমক দিয়ে বললো,
“ফারিহা এই শীতের রাতে তুই এভাবে বের হয়েছিস কেনো?তোর সোয়েটার কই? ঠান্ডা লাগবে তো”
ফারিহা একটু হেসে বললো, “না বাপী আমার ঠান্ডা লাগছে না।ঠিক আছি আমি। আমি একটু দেখতে আসছি তুমি এভাবে ধমকাচ্ছো কেনো?”
“তুই দেখ তাতে কোন সমস্যা নেই কিন্তু এভাবেই শুধু একটা জামা পড়ে থাকলে তো ঠাণ্ডা লাগবে নাকি?”
মিস্টার আজাদ জোরে একটা সার্ভেন্টকে ডাক দিলো।মহিলাটা মিস্টার আজাদের কাছে আসলেই মিস্টার আজাদ বললো,
“ফারিহার রুম থেকে ওর জন্য একটা সোয়েটার বা শাল নিয়ে আসো”
মহিলাটা মাথা নাড়ে চলে গেলো। ফারিহা বললো,
“আমার ঠান্ডা লাগছে না বাপী”
“চুপ আর কোন কথা নাই। আমার সোয়েটার পরে ঠান্ডা লাগছে আর তোর নাকি ঠান্ডা লাগছে না!”
মিস্টার আজাদ ফারিহার হাত ধরে বললো,
“দেখ তোর হাত কেমন ঠান্ডা হয়ে আছে!”
কিছুক্ষণ পর মহিলাটা একটা শাল এনে মিস্টার আজাদ এর কাছে দিলো।মিস্টার আজাদ শালটা নিয়ে ফারিহার গায়ে জড়িয়ে বললো,
“নিজেকে এতো অবহেলা করিস কেনো বলতো? নিজের যত্ন নিতে পারিস না?তুই জানিস না তুই অসুস্থ হলে আমার কি অবস্থা হয়?”
ফারিহা হেসে বললো,”জানি বাপি। তুমি আমার জন্য এত চিন্তা করো না তো”
“চিন্তা কি আর সাধে করি? তুই নিজের খেয়াল রাখতে হলে তো আমার চিন্তা করতে হয় না।আয় এখানে বস”
“না না বাপি বসবো না।আমি দাঁড়িয়ে দেখছি”
ফারিহা যেখানে রান্না হচ্ছে সেদিকে একটু এগিয়ে গেলো।তারপর আগুন থেকে স্বাভাবিক দূরত্বে দাঁড়ালো।কেউ রান্না করছে কেউ যেখানে খাওয়ানো হবে সেই জায়গার আয়োজন করছে। সবাই খুব ব্যস্ত।
ফারিহা বুকের কাছে হাত গুজে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কিছুক্ষণ এই দিকে তাকাচ্ছে আবার কিছুক্ষণ ওইদিকে তাকাচ্ছে।
.
আজকে আয়ান বাসায় ফিরে রুমে এসেই মনটা খারাপ হয়ে যায়।কারণ আজকে তো ফারিহা বাসায় নেই।আয়ান ফারিহা কে খুব মিস করছে।একদিন ফারিহা নেই বলে আয়ানের মনে এতো অস্থির হচ্ছে কেন আয়ান বুঝতে পারছে না।
আয়ান রুমে আসলে একটা সার্ভেন্ট কফি দিয়ে যায়।আজকে আয়ানের কাছে কফিটা ও বিষাক্ত মনে হচ্ছে।কারণ এতোদিন ফারিহার হাতের কফি খেতে খেতে অভ্যেস হয়ে গিয়েছে।ফারিহা দারুন কফি বানায়।আয়ান ভাবছে ফারিহা আসার আগে তো সার্ভিন্টের হাতেই কফি খেত কিন্তু এখন ফারিহার হাতে কফি খেয়ে, এতদিনের খাওয়া সার্ভেন্টের হাতের কফি ভালো লাগছে না।
আয়ান ডিনার করে রুমে এসে ব্যালকনিতে গিয়ে দাঁড়ালো।ফারিহা প্রায় সময় ব্যালকনিতে আর ছাদে দাঁড়িয়ে আকাশ দেখতো।আয়ান বোঝেনা মেয়েটা এভাবে এক দৃষ্টিতে আকাশের দিকে তাকিয়ে কি দেখে!
আয়ান ব্যালকনি থেকে রুমে এসে ল্যাপটপ নিয়ে অফিসের কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়লো।কিন্তু আয়ানের কাজে মন বসছে না।ফারিহাকে ভীষণভাবে মিস করছে।ফারিহা থাকলে এখন গুটিগুটি পায়ে সারা বাড়ি হেঁটে বেড়াতো। রুমে এসে এটা সেটা কাজ করতো।আয়ানের সামনে ঘুরঘুর করতো অথবা স্টাডি টেবিলে বসে বসে পড়তো। আর আয়ান কাজ করার ফাঁকে ফাঁকে ফারিহাকে দেখতো।
আয়ান আর থাকতে না পেরে ল্যাপটপে নিয়ে ফারিহাকে ভিডিও কল দিলো।কিন্তু ফারিহা কল রিসিভ করছে না।আয়ান একবার, দুইবার প্রায় দশ বার করে দিলো।কিন্তু রিং বেজে যাচ্ছে কেউ কল রিসিভ করছে না।আয়ান এবার রেগে ল্যাপটপটা পাশে সোফায় ছুড়ে মেরে মাথায় হাত দিয়ে চুপচাপ বসে থাকলো।
আর ফারিহা এইদিকে মিস্টার আজাদের সাথে কথা বলছে আর সবার কাজ দেখছে।মোবাইল তো রুমে বেজেই চলেছে!
.
রাত 11 টার দিকে ফারিহা অনেকক্ষণ বাগানে ঘোরাঘুরি করে নিচ থেকে ডিনার করে একবারে উপরে আসলো।রুমে এসে মোবাইল হাতে নিয়ে ফারিহা চমকে উঠলো।আয়ানের প্রায় 50 প্লাস কল।আয়ান এতগুলা কল দিয়েছে কিন্তু ফারিহা রিসিভ করেনি!এবার আয়াত যদি রেগে যায়। ফারিহা কল ব্যাক করতে যাবে তখন আবার মোবাইল বেজে ওঠলো।ফারিহা কাঁপা কাঁপা হাতে কল রিসিভ করে কানে ধরতেই ওইপাশ থেকে আয়ান বলে উঠলো,
“এতক্ষণ কোথায় ছিলে? কল রিসিভ করছিলে না কেন? আমি কখন থেকে তোমাকে কল দিয়ে যাচ্ছি। ফোনে যদি কথাই না বলো তাহলে ফোন ব্যবহার করে কেনো? কি সমস্যা তোমার?কথা বলছো না কেনো? আনসার মি ডেম ইট”
“আৃ আপনি কথা বলার সুযোগ দিলে তো কথা বলবো”
আয়ান এবার শান্ত কন্ঠে বললো, “কল রিসিভ করছিলে না কেনো?”
“সরি আমি রুমে ছিলাম না আর ফোন এখানে ছিলো”
“কোথায় গিয়েছিলে?বাবার বাড়ি যাওয়ার সাথে সাথে পাখনা গজিয়েছে তাইনা?কার সাথে দেখা করতে গিয়েছো?”
আয়ানের কথা শুনে ফারিহা থতমত খেয়ে গেলো। কার সাথে দেখা করতে গিয়েছে মানে?আয়ান কি ফারিহাকে এরকম মেয়ে ভাবে নাকি! কি আলতু ফালতু কথা বলছে।ফারিহা বিরক্তি নিয়ে বললো,
“আরে কার সাথে দেখা করতে যাবো!নিচে গিয়েছিলাম বাপির কাছে”
“হ্যাঁ এখন বাপিকে পেয়ে তো আমাকে ভুলে গিয়েছো।তোমাকে ওই বাড়িতে পাঠানো টাই ভুল হয়েছে”
“আচ্ছা সরি আর কখনো এরকম হবে না। আপনি কিছু বলবেন?কল দিলেন যে..”
আয়ান একটু রেগে বললো, “কেনো?আমি তোমাকে কল দিতে পারিনা?”
“না না আমি সে ভাবে বলতে চাইনি।আপনি..”
“ভিডিও কলে আসো”
“হ্যাঁ???”
“কি বলছি শুনতে পাওনি?আরেকবার বলবো?”
এটা বলে আয়ান কল কেটে দিয়ে ফারিহাকে ভিডিও কল দিলো।ফারিহা অস্বস্তিতে পড়ে গেলো। ভিডিও কলে কথা বলতে ফারিহার খুব লজ্জা লাগে।আগে কখনো কারো সাথে তেমন ভিডিও কলে কথা বলেনি।আর তাছাড়া আয়ানের সাথে এমনিতেই কথা বলতে ভয় ভয় লাগে, ভিডিও কলে কিভাবে কথা বলবে!ফারিহা কল রিসিভ করলে স্ক্রিনে আয়ানের মুখটা ভেসে উঠলো।
আয়ান একটা পাতলা টি-শার্ট পড়ে আছে। ফারিহা ভাবছে এই লোকটার কি শীত লাগে না নাকি?আর আয়ান একদৃষ্টিতে ফারিহাকে দেখছে। আগে প্রতিদিন অফিস থেকে বাসায় ফিরে আয়ান ফারিহাকে দেখতো।আর আজকে কিছুক্ষণ ফারিহাকে না দেখে আয়ান অস্থির হয়ে পড়েছিলো।ফারিহা একটা গ্রে রঙ্গের শাল পড়ে আছে,চুলগুলো ঢিলে করে ঝুটি বাধা তাই সামনের চুলগুলো মুখে এসে লেপ্টে রয়েছে।ফারিহা বারবার হাত দিয়ে চুলগুলো কানের পেছনে গুঁজে দিচ্ছে আর অস্বস্তি নিয়ে এদিক ওদিক তাকাচ্ছে।
আয়ান কিছুক্ষণ ফারিহাকে দেখে বললো,
“ডিনার করেছো?”
ফারিহা নিজ কন্ঠে বললে, “হুম..”
“আমি ডিনার করেছি কিনা জিজ্ঞেস করবে না?”
আয়ানের কথয় শুনে ফারিহা চোখ তুলে ওর দিকে তাকালো। তারপর বললো, “আপনি ডিনার করেছেন?”
ফারিহার কথা শুনে আয়ান ঠোঁট কামড়ে হাসলো।
তারপর বললো, “হুম,,নিচে এতক্ষণ কি করছিলে?”
“আসলে আগামীকালকে যে সবাইকে খাওয়ানো হবে তার জন্য সব রান্নার আয়োজন করছিল।সেগুলো দেখছিলাম”
“আর বাপির সাথে গল্প করছিলে সেটা কেনো লুকাচ্ছো?”
আয়ানের কথা শুনে ফারিহা চুপ করে গেলো।আয়ান আরো কিছুক্ষণ ফারিহাকে মন ভরে দেখে তারপর বললো,
“অনেক রাত হয়েছে এবার ঘুমিয়ে পর”
ফারিহা কিছু বলতে নিলে আয়ান ফারিহাকে থামিয়ে দিয়ে বললো,
“আর কোন কথা নেই এখন চুপচাপ গুডগার্লদের মতো শুয়ে পরো যাও”
ফারিহা ভদ্র মেয়ের মত হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়লো। তারপর কল কেটে দিল।আয়ান ফারিহার ভঙ্গিমা দেখে ঠোঁট কামড়ে হাসলো।
এখন যদি ফারিহার সাথে না কথা বলতো তাহলে হয়তো আয়ানের আজকে সারারাত ঘুম হতো না।আয়ান এতক্ষণ অস্থির অস্থির করছিল কিন্তু এখন ফারিহার মায়াবী মুখটা দেখে শান্ত হয়েছে।
আয়ান আরো অনেকক্ষণ কাজ করে তারপর ঘুমোতে গেলো।
আজকে বিছানাটাও ফাঁকা। কক্সবাজারের থেকে আসার পর থেকে আয়ান ফারিহাকে আর সোফায় শুতে দেয়নি।প্রতিদিন ফারিহাকে জড়িয়ে ধরে ঘুমাতো।যদিও ওই দিনের পর থেকে আর কখনো ফারিহার সাথে জোর করে নি। কিন্তু যখন তখন ফারিহাকে জরিয়ে ধরা,কিস করা এগুলো তো চলতোই। আজকে ফাঁকা বিছানায় শুয়ে আয়ান ফারিহাকে খুব মিস করছে!
চলবে…