#স্রোতের_টানে
লেখিকা:#Tarin_Niti
পর্ব:২০
ফারিহা অবাক হয়ে আয়ানকে দেখছে।এই আয়ানকে ফারিহা চিনতে পারছে না।আয়ান সবার সাথে হেসে কথা বলছে।সবার সাথে আপন জনের মত আচরন করছে। মনে হয় সবাইকেও কত যুগ ধরে চিনে।খাওয়া-দাওয়ার ওখানে তদারকি করছে।দ্য গ্রেট গ্যাংস্টার আয়ান খান কি না সবাইকে খাবার বেড়ে দিচ্ছে?
মিস্টার আজাদ ও আয়ানের আচরণে প্রচন্ড অবাক হয়।উনার জানামতে আয়ান রাগী বদমেজাজি অসভ্য একটা ছেলে কিন্তু আজকে আয়ানের আচরণ একেবারে ভিন্ন।
আয়ান বাগানের দিকে সবকিছু দেখে বাড়ির ভিতরে আসছিলো। এসে দেখে ফারিহা ডাইনিং টেবিলের সামনে দাঁড়িয়ে কি যেন করছে।এখানে আরো অনেক বিজন্যাসমেন আছে।যারা আয়ানের সাথে কাজ করে।আয়ান গিয়ে ওদের সাথে কথা বলছে আর একটু পর পর ফারিহার দিকে তাকাচ্ছে।
হঠাৎ মিস্টার আজাদের চিৎকারে আয়ান সেদিকে তাকালো।মিস্টার আজাদ জোরে জোরে বলছে,
“ওকে কে কাজ করতে দিলো?তোমাদের কে এত টাকা দিয়ে দেখেছি আমার মেয়েকে কাজ করার জন্য?এই দেখো কতখানি হাত কেটে গেল! তোদের সবকটাকে আমি একটা টাকাও দিব না।
আর তুই,,তোকে বলেছি না এসব করতে হবে না চুপচাপ বসে থাক।আমার কথা কেন শুনিস না? এই তাড়াতাড়ি ফাস্টেড বক্স টা আন”
একটা সার্ভেন্ট দৌড়ে গেল ফার্স্ট এইড বক্স আনতে। আয়ান ফারিহার কাছে গিয়ে দেখল মিস্টার আজাদ ফারিহার হাত ধরে আছে।ফারিহার হাত থেকে রক্ত পড়ছে যদিও মিস্টার আজাদ যতটা অস্থির হয়েছে ততটা অস্থির হওয়ার মতো কিছু হয়নি তবু আয়ানের ফারিহার জন্য কষ্ট হচ্ছে।আয়ান তড়িঘড়ি করে গিয়ে ফারিহার হাত ধরে বললো,
“হাত কাটলে কিভাবে?”
মিস্টার আজাদ আয়ানকে একটা ধমক দিয়ে বললো,
“কোথায় থাকো তুমি?স্ত্রী খেয়াল রাখতে পারো না আবার বড় বড় কথা বলো।দেখো কি হয়েছে,আমার মেয়েটা কতটা কষ্ট পাচ্ছে”
মিস্টার আজাদের রাগ দেখে ফারিহা চুপ করে আছে।এবার থাকতে না পেরে কাঁপা কাঁপা কন্ঠে বলল,
“বাপি আমার কিছু হয়নি। তুমি শান্ত হও..”
মিস্টার আজাদ ফারিহাকে একটা ধমক দিয়ে বললো, ” কিছু হয়নি মানে?তো হাত থেকে রক্ত পড়ছে”
“অল্পই তো কেটেছে”
“চুপ আর একটাও কথা না।এই ফাস্টেড বক্স আনতে এতক্ষণ লাগে?”
একটা সার্ভেন্ট তাড়াতাড়ি করে ফাস্ট এইড বক্সটা এনে মিস্টার আজাদ এর হাতে দিলো।মিস্টার আজাদ ফারিহাকে পাশে একটা সোফায় বসিয়ে খুব যত্ন করে হাতে ব্যান্ডেজ বেধে দিতে লাগলো।
আয়ান তো এখনো অবাক হয়ে বাবা-মেয়েকে দেখছে।ফারিহার সামান্য হাত কাটাতে মিস্টার আজাদ এতটা অস্থির হয়ে পড়ছে আয়ানের এখন ফারিহাকে দেখে রীতিমতো হিংসা হচ্ছে।কারণ আয়ান কখনো বাবার আদর পায়নি।আয়ান ছোট থাকতেই তো বাবা মারা যায়।
মিস্টার আজাদ ফারিহার হাতে ব্যান্ডেজ করে পকেট থেকে ফোন বের করে কাকে যেন কল করলো।ফারিহা মিস্টার আজাদের কথা শুনে ভ্রু কুঁচকে বললো,”কাকে কল করছ?”
“কাকে আবার,ডাক্তার কে”
ফারিহা অবাক হয়ে বললো, “ডাক্তার কেনো?”
“কেন মানে?তোর হাত কেটেছে ডাক্তার দেখাবো না?আমিতো জাস্ট ব্যান্ডেজ বেধেঁ দিলাম যদি কিছু হয়ে যায়!”
“বাপি আমার সামান্য হাত কেটেছে।এটা নিয়ে তো অস্থির হইও না তো।দেখো আমি একদম ঠিক আছি”
“আমি তোকে ডাক্তার দেখাবো ব্যস আর কোন কথা না।তুই চুপচাপ বসে থাক”
মিস্টার আজাদ বাহিরে চলে গেলো।আয়ান এখনও একটা ঘোরের মধ্যে আছে এখানে কি হচ্ছে কিছু বুঝতে পারছেনা।আয়ানকে দেখে ফারিহা হেসে দিল তারপর বললো,
“কী হলো অবাক হচ্ছেন?”
আয়ান ফারিহার পাশে বসে ফারিহার হাতটা নিজের কাছে টেনে নিয়ে দেখতে দেখতে বললো, “কিছুটা…”
“আসলে বাপি এমনি আমার কিছু হলে বাপি শান্ত থাকতে পারেনা।আর বিশেষ করে আজকের দিনে বাপি আমাকে সবসময় চোখে চোখে রাখে”
“কেনো?আজকের দিনে এত খেয়াল রাখে কেনো?”
“১৬ বছর আগে আজকের দিনেই তো আমাদের গাড়ি এক্সিডেন্ট করে মাম্মা মারা গিয়েছিলো।আর সেই গাড়িতে আমাদের ড্রাইভার আমি আর মাম্মা ছিলাম।ড্রাইভার আঙ্কেল স্পট ডেড!মাম্মা আর আমাকে আইসিউতে রাখা হয়েছিলো।আমি মৃত্যুর সাথে লড়াই করে বেঁচে উঠতে পারলেও মাম্মা পারেনি।তাই বাপি এইদিনটাতে বিশেষ করে আমার খেয়াল রাখে।বাপি সবসময় ভয়ে ভয়ে থাকে,বাপির চায়না আমার কিছু হোক”
আয়ান ফারিহার কথা শুনে শুধু অবাকই হচ্ছে।আয়ান জানতো মিস্টার ফারিহাকে অনেক ভালোবাসে।কিন্তু আজকের দিনে কান্ড দেখে আয়ান বুঝতে পারে মিস্টার আজাদ ফারিহাকে শুধু ভালোইবাসে না ফারিহা মিস্টারদের প্রাণ ভোমরা!
ফারিহা হেসে আবার বললো, “জানেন আগে ছোটবেলায় বাপি এইদিন আমাকে সবসময় বুকে জড়িয়ে রাখতো,ছাড়তেই চাইতোনা আমার যদি কিছু হয়ে যায়”
ফারিহা নিজের কথায় নিজেই হেসে দিলো।আয়ান ফারিহার কাটা হাতটা কোলের উপর নিয়ে বললো,
“ব্যথা করছে?”
“আরে না।আপনি তো দেখলেন সামান্য একটু ফল কাটার ছুরি দিয়ে কেটেছে।বাপি এরকমই আপনি চিন্তা করবেন না তো”
হনুফা বেগম এসে ফারিহাকে বললো, “তোকে বারণ করেছিলাম কিছু করতে হবে না।দেখলি তো সার কিভাবে রেগে গেলো?”
“মনি তুমি তো জানো বাপি আমায় নিয়ে কতটা পজেসিভ।তাইতো অল্পতে রেগে যায়।তুমি চিন্তা করো না তো আমি ঠিক আছি”
“হ্যাঁ ঠিক আছিস।আজকে যদি গুরুতর কিছু একটা হতো স্যার তো আমাদের গর্দান নিতো”
“হাহাহা….”
কিছুক্ষণ পর মিস্টার আজাদ সাথে করে একজন ডাক্তার নিয়ে আসলো।এতো তাড়াতাড়ি ডাক্তার এসে পড়েছে দেখে ফারিহা একটু বেশিই অবাক হলো। তারপর বললো, “বাপি এর মধ্যে ডাক্তারও চলে এসেছে?”
ফারিহার কথায় হানিফ আহমেদ হেসে বললো, “তো আসবে না?স্যার তো ডাক্তারকে একদম থ্রেট দিয়ে ফোন করে নিয়ে আসলো”
ডাক্তার আঙ্কেল এসে ফারিহার কাছে বসে বললো, “মামনি কি হয়েছে?”
ফারিহা হাত উঁচু করে ডাক্তারকে আঙ্কেলকে দেখালো। ফারিহার ব্যান্ডেজ দেখে ডাক্তার ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেলো।সামান্য এই কারণে ওনাকে এভাবে থ্রেট দিয়ে নিয়ে আসলো?ডাক্তার ভেবেছিল গুরুতর কিছু!ডাক্তার আঙ্কেল মিস্টার আজাদ কে বললো,
“এটাতো সামান্য একটু কাটেছে।ব্যান্ডেজ করে দিয়েছেন ঠিক হয়ে যাবে”
“সামান্য মানে? এটা থেকে যদি ইনফেকশন হয়ে বড় কিছু হয়?আপনি হাতটা ভালো করে দেখুন”
ফারিহা ইশারায় ডাক্তারকে আঙ্কেল কে হাত দেখতে বললো।ডাক্তার আঙ্কেল আর কি করবে!উপায় না পেয়ে হাতটা দেখে।কাটা জায়গা শুকানোর জন্য কিছু ওষুধ লিখে দিলো।তারপর মিস্টার আজাদকে বললো,
“চিন্তা করবেননা। দুটি তিনদিনের মধ্যে ঠিক হয়ে যাবে”
“তাই যেন হয়। আর আমার মেয়ে হাত যদি ভালো না হয় তাহলে আপনার খবর আছে”
ডাক্তার আঙ্কেল একটা শুকনো ঢুক গিললো।হানিফ আহমেদ ডাক্তারকে সাথে নিয়ে বেড়িয়ে গেল। ডাক্তার চলে গেলে মিস্টার আজাদও ফারিহাকে সাবধানে থাকতে বলে কাউকে ডাক দিতে চলে গেলো।
কিছুক্ষণ পর নওশীন আর শিহাব আসলো।এসে দেখলো ফারিহা চুপচাপ সোফায় বসে আছে।আর ওকে ঘিরে কয়েকজন মানুষ বসে আছে।শিহাব ডাক্তার আঙ্কেলকে বেরিয়ে যেতে দেখেছিলো। নওশীন এসে ফারিহার পাশে বসে বললো,
“ফারিহা কি হয়েছে রে?”
ফারিহা নওশীনকে দেখে হাসিমুখে বললো,
“তোরা কখন এসেছিস?”
“একটু আগে।কি হয়েছে?ডাক্তার আঙ্কেলকে বেরিয়ে যেতে দেখলাম।কারো কিছু হয়েছে?”
নওশিনের কথায় আয়ান হেসে জবাব দিলো,
“আমার বউয়ের হাত কেটে গেছে তাই শ্বশুরমশাই ডাক্তার নিয়ে এসেছে”
শিহাব একটু উত্তেজিত হয়ে বললো, “হাত কেটেছে?কোথায়?কতটা?ফারিহা তুই ঠিক আছিস তো?”
ফারিহা ওর কাটা হাতটা দেখিয়ে বললো, “হ্যাঁ আমি ঠিক আছি।আর তোরা তো জানিস বাপি কেমন”
ফারিহার হাতটা দেখে শিহাব হেসে বললো, “আঙ্কেল তোকে নিয়ে কতোটা পজেসিভ।তোকে দেখলে মাঝে মাঝে হিংসা হয়।আর তাছাড়া তুই তো জানিস আজকের দিনে আঙ্কেল একটু বেশি তোকে নিয়ে চিন্তিত থাকে তাহলে সাবধানে থাকতে পারিস না?”
“আমি তো সাবধানেই ছিলাম।এটা কিভাবে হলো বুঝতে পারছিনা।আচ্ছা এসব বাদ দে তোরা এসেছিস আমি খুব খুশি”
“তো আমরা আসবো না?আজকের দিনে তোর পাশে আমরা না থাকলে আর কে থাকবে?”
নওশীন আয়ানকে দেখে ফারিহার কানে কানে নিচু কন্ঠে বললো, ” আয়ান ভাইয়া এসেছে!আঙ্কেল রাগ করেনি?”
“করে নি আবার!বাপি তো ওনাকে বেরিয়ে যেতে বলেছিলো।আমি বাপিকে বুঝালাম”
আয়ান নওশীনের কথা শুনে নওশীনের কানের কাছে এসে বললো, “আস্তে বলার কি আছে? যা বলার জোরে বলো”
নওশীন আসলে আয়ানকে শুনিয়ে কথাটা বলতে চায় নি।কিন্তু আয়ান যখন শুনে ফেলেছে তাই নওশীন একটু লজ্জা পেল।
ফারিহা নওশীন আর শিহাবকে বললো, “তোরা খাওয়া-দাওয়া করবি না? চল..”
শিহাব বললো, “মাত্রই তো আসলাম।কিছুক্ষণ বসি”
শিহাবের কথায় ফারিহা আর কিছু বললো না।কিছুক্ষণ পর শিহাব আর কৌতুহল দমিয়ে রাখতে না পেরে আয়ানকে বলে ফেললো,
“আপনি এখানে এসেছেন?না মানে আপনাকে আজকে ফারিহার বাড়িতে আশা করিনি”
শিহাবের কথা শুনে আয়ান হেসে বললো, “আমার শাশুড়িমায়ের মৃত্যুবার্ষিকী আর আমি আসবো না?”
“কিন্তু আমি যতোটুকু জানি আপনার আর ফারিহার সম্পর্কটা স্বাভাবিক না!”
“কে বলেছে স্বাভাবিক না?আমরা তো খুব সুখে আছি।তাইনা বউ?”
আয়ানের কথা ফারিহা চমকে উঠলো।আয়ান এমন ভাব করছে মনে হয় যেন আয়ান আর ফারিহা কত সুখী দম্পতি।কিন্তু আসলে বাসায় আয়ান ফারিহার সাথে কি রকম আচরণ করে সেটা শুধু ফারিহাই জানে।আর ফারিহা সেসব কথা শিহাব আর নওশীনকে জানাতে দিতে চায় না।তাই মুচকি হেসে হেসে হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়লো।
কিন্তু শিহাবের সন্দেহ দূর হলো না।যদিও শিহাব আয়ানকে কিছুটা ভয় পায়। তবু এবার বলেই ফেললো, “আপনাদের সম্পর্ক যদি স্বাভাবিক হয়।তাহলে আপনার প্রতিশোধের কি হবে?”
আয়ান সেভাবেই ফোন স্ক্রল করতে করতে বললো,
“সেটা আমার ব্যাপার আমি বুঝে নিবো”
“একটা কথা বলবো?”
আইয়ান ফোন থেকে মাথা উঠিয়ে শিহাবের দিকে তাকিয়ে বলল, “আমি কি কারনে ফারিহাকে বিয়ে করেছি সেটা বাদে অন্য কিছু বলার থাকলে বল”
আয়ানের কথার শিহাব একটু লজ্জা পেল।কারণ শিহাব আয়ানকে এটাই জিজ্ঞেস করতে চেয়েছিল।শিহাব আয়ানের তুখোড় বুদ্ধিতে অবাকও হলো। আয়ান কিভাবে প্রশ্ন করার আগে প্রশ্ন বুঝে গেল!শিহাব বুঝে গেল আয়ানের সাথে ও কথায় পারবেনা।
চলবে…