স্রোতের টানে পর্ব-২৮

0
3785

#স্রোতের_টানে
লেখিকা:#Tarin_Niti
পর্ব:২৮

ফারিহার কথায় হানিফ আহমেদ জোরে হেসে দিলো।তারপর আস্তে আস্তে হেঁটে এসে ফারিহার সামনে একটা চেয়ারে বসে বললো, “হ্যাঁ আমি!”

ফারিহা অবাক হয়ে বললো, “আপনি আমাকে কিডন্যাপ করেছেন?কিন্তু কেনো?এটা কি সত্যি আর আপনি আপনি…”

হানিফ আহমেদ হেসে বললো, “আরে আরে রিলেক্স।একটা একটা প্রশ্ন কর আমি তোমার সব প্রশ্নের উত্তর দিচ্ছি”

“কিন্তু আগে এটা বলেন আপনি আমাকে কেন কিডন্যাপ করেছেন?আপনি মজা করছেন তাই না? আপনি আয়ানের থেকে বাঁচাতে আমাকে লুকিয়ে রাখতে চাইছেন তাই তো? কিন্তু বিশ্বাস করুন আমি আয়ানের কাছে ভালো আছি,, আমাকে লুকিয়ে রাখতে হবে না”

ফারিহার কথায় হানিফ আহমেদ ঘর কাঁপিয়ে হেসে উঠলো তারপর বললো, “তোকে মুক্তি দিতে না! তোকে বন্দী করতে কিডন্যাপ করেছি”

ফারিহা শুধু অবাক হচ্ছে।আজকে হানিফ আহমেদের আচরণ কেমন অদ্ভুত লাগছে।ফারিহা হানিফ আহমেদকে চিনতে পারছেনা।কিন্তু হানিফ আহমেদ কেনো ফারিহাকে কিডন্যাপ করলো! হানিফ আহমেদ তো মিস্টার আজাদের সব কথা মেনে চলে।ফারিহাকে কিছু একটা ভেবে হাসিমুখে বললো,

“বাপি!বাপি আপনাকে বলেছে আমাকে এখানে আনতে?দেখেছেন,বাপি আমার জন্য কত চিন্তা করে কিন্তু আমি তো বাপিকে বললাম আমি আয়ানের কাছে ভালো আছি।বাপি কেন এরকম করলো?বাপি কোথায়?”

হানিফ আহমেদ শয়তানি হাসি হেসে বললো, “তুমি একটু বেশিই বুঝ ফারিহা।মিস্টার আজাদ জানে না যে আমি তোমাকে কিডন্যাপ করেছি”

ফারিহা হানিফ আহমেদের কথা কিছু বুঝতে পারছেনা।তাই বললো, “আমি কিছু বুঝতে পারছি না। প্লিজ আমাকে সব খুলে বলবেন??”

হানিফ আহমেদ ফারিহার দিকে তাকিয়ে বললো,
“বল…কি জানতে চাও বলো”

ফারিহা ফটাফট প্রশ্ন করল, “আপনি আমাকে কিডন্যাপ করলেন কেন?আর এভাবে বেঁধে রেখেছেন কেনো?”

“তোমাকে মেরে ফেলতে এখানে আনা হয়েছে”

ফারিহা চমকে উঠে হানিফ আহমেদের দিকে তাকালো।ফারিহা বুঝতে পারছেনা হানিফ আহমেদ মজা করছে নাকি সত্যি বলছে!ফারিহা কাঁপা কাঁপা কন্ঠে বললো,
“মে্ মেরে ফেলতে?”

“হ্যাঁ মেরে ফেলতে।তোকে মারলে তবেই তো মিস্টার আজাদ কে হাতের মুঠোয় আনা যাবে”

ফারিহা কাঁদো-কাঁদো কন্ঠে বললো, “আপনি কি বলছেন?আমি কিছু বুঝতে পারছিনা আপনি আমাকে কেন মারতে চান আর বাপি কে হাতের মুঠোয় নিবেন মানে?আপনিতো বাপির আন্ডারে কাজ করেন”

হানিফ আহমেদ শয়তানি হেসে বললো,
“সেটাইতো! আমি কারোর আন্ডারে কাজ করতে চাই না। আমি বস হতে চাই!আর মিস্টার আজাদকে ভেঙ্গে গুঁড়িয়ে দেওয়ার একমাত্র উপায় হচ্ছিস তুই। তোকে মেরে ফেলে তোর বাবা এমনিতেই শেষ হয়ে যাবে। তখন আমি মিস্টার আজাদের কোনো সন্তান থাকবে না,উনার সব সম্পত্তির মালিক আমি”

ফারিহা অবাক চোখে হানিফ আহমেদকে দেখছে।ফারিহা এসব কিছু বিশ্বাস করতে পারছে না।যেই লোকটা ওদের বাড়িতে থেকেছে,খেয়েছে সেই এভাবে পেছনে ছুরি মারলো?এটাতো দুধ কলা দিয়ে কালসাপ পোষা হয়ে গেল!
ফারিহার ভাবনার মাঝে হানিফ আহমেদ আবার বললো,
“তোর ভাগ্য ভালো,16 বছর আগে বেঁচে গিয়েছিলি!না হলে এই সব সম্পত্তি কবেই আমার হয়ে যেতো”

এবার যেন ফারিহার মাথায় আকাশ ভেঙ্গে পড়লো। হানিফ আহমেদ কি বলছে এসব?ফারিহা কাঁপা কাঁপা কন্ঠে বললো,
“16 বছর আগে বেঁচে গিয়েছিলাম মানে?সেদিন আমাদের গাড়ি এক্সিডেন্ট…”

হানিফ আহমেদ জোরে হেসে দিয়ে বললো, “হ্যাঁ ঠিকই ধরেছিস।সেদিন তোদের গাড়ি আমি ব্রেক ফেল করেছিলাম।ভেবেছিলাম তুই মরে গেলে মিস্টার আজাদ শেষ হয়ে যাবে কিন্তু তুই বেঁচে গিয়ে আমার সব প্লান নষ্ট করে দিলি”

ফারিহা এবার কান্না করে দিলো। কান্না করতে করতে বললো, “আমার মাম্মাকে আপনি মেরেছে?আপনার জন্য মাম্মা মারা গিয়েছে?আপনি এতটা জঘন্য!কি করে এটা করতে পারলেন?যেই মানুষটা আপনাকে আর মনিকে আমাদের বাড়িতে জায়গা দিল আপনি তাকেই মেরে ফেললেন?আপনি এতোটা অমানুষ ”

হানিফ আহমেদের ফারিহার কথায় কোন ভাবান্তর হলো না।সেভাবেই হাসতে হাসতে বললো, “সম্পত্তি পেতে হলে কিছুটা অমানুষ হতেই হয়”

“শুধুমাত্র সম্পত্তির জন্য আপনি…”

“না না শুধু সম্পত্তি না।মিস্টার আজাদ মরে গেলে তো এমপি পদ টাও আমি পেতাম।তখন শুধু টাকা আর টাকা”

“ছিহ!আমার ভাবতেই ঘৃনা হচ্ছে।মাম্মা এমন একটা মানুষকে বাড়িতে জায়গা দিয়েছিল যার জন্য নিজের প্রাণ দিতে হলো!”

ফারিহার হামিদ আহমেদের উপর প্রচুর ঘৃনা হচ্ছে। একটা মানুষকে কি করে নিজের আশ্রয়দাতা কে মেরে ফেলতে পারে?কতটা জঘন্য লোক!
ফারিহার হাত-পা বাঁধা না হলে এখনি নিজের মায়ের খুন এর প্রতিশোধ নিতো।ফারিহা একদিকে কষ্ট পাচ্ছেন অন্যদিক দিয়ে রেগে আছে।এতদিন ভাবতো একটা এক্সিডেন্টের কারণেই ওর মা ওদের ছেড়ে চলে গিয়েছে।কিন্তু আজকে জানতে পারলো একটা অমানুষের ষড়যন্ত্রের কারণে ফারিহার মাম্মা আজকে ফারিহার কাছে নেই।

ফারিহার হানিফ আহমেদের সাথে কথা বলতে ঘৃণা হচ্ছে তবুও বললো, “আমাকে এখানে কেনো এনেছেন?অহ মেরে ফেলতে তাই তো?কখন মারবেন?”

“মারবো তো।মরার জন্যে এত উতলা হচ্ছিস কেনো? তবে তার আগে একটা সিক্রেট শুনে যা”

ফারিহা হানিফ আহমেদের কথা শুনতে মটেও আগ্রহী না।তাই চুপচাপ বসে আছে। হানিফ আহমেদ হেসে বলতে লাগলো,

“আমি শুধু তোর মাকে মারেনি।তোর আপনজনের মধ্যে আরো কাউকে মেরেছি”

ফারিহা প্রশ্নসূচক দৃষ্টিতে হানিফ আহমেদের দিকে তাকালে হানিফ আহমেদ ফারিহাকে বললো,
“মিস্টার আজাদের সাথে আয়ানের কিসের শত্রুতা সেটা জানতে চাইবি না?”

ফারিহা আবার চমকে উঠলো।এটার পেছনেও কি হানিফ আহমেদের হাত আছে?
হ্যাঁ ফারিহা সত্যিটা জানতে চায়।অনেক চেষ্টা করেছে জানার কিন্তু জানতে পারেনি।
ফারিহা অস্থির হয়ে উঠেছে দেখে হানিফ আহমেদ হেসে বললো,

“আরে শান্ত হ বলছি সব।আমি জানি তোর এটা জানার খুব ইচ্ছা।তাই মরার আগে তোর শেষ ইচ্ছাটা পূরণ করি”

ফারিহা কাঁপা কাঁপা কন্ঠে বললো, “বাপির সাথে আয়ানের কিসের শত্রুতা?”

হানিফ আহমেদ হেসে বললো, “কারণ আয়ানের মা-বাবাকে আমি মেরেছিলাম!”

ফারিহা মনে হচ্ছে এখনই অজ্ঞান হয়ে যাবে। নিজের জীবনে এত বড় সত্যি গুলো সব একসাথে ফারিহা আর নিতে পারছে না।কিছুক্ষণ পর পর মাথায় বাজ পরছে।আয়ানের মা-বাবার সাথে হানিফ আহমেদের কি সম্পর্ক!ফারিহা কিছু বলতে যাবে তখন হানিফ আহমেদ বললো,

“মিস্টার আজাদ আয়ানকে চিনেনা ঠিকই কিন্তু আয়ানের মা বাবার সাথে ভালো সম্পর্ক ছিল।তখন তুই বোধহয় ছোট ছিলি।মিস্টার আজাদের কি পাওয়ার,আয়ানের বাবার তারচেয়ে বেশি পাওয়ার ছিল।আমার তো প্রথম টার্গেট ছিল আয়ানের বাবার সম্পত্তির দিকে যা মিস্টার আজাদের থেকে কয়েক গুণ বেশি”

ফারিহার যত শুনছে ততো হানিফ আহমেদের উপর ঘৃণা বাড়ছে।তবুও মুখ বুঝে চুপচাপ বসে আছে।হানিফ আহমেদ আবার বলতে লাগলো,

“তো একদিন একটা কাজে মিস্টার আজাদ আমাকে আয়ানের বাবা মানে শাহিন খানের বাড়িতে পাঠিয়েছিলো।সেই দিন কোন কারনে বাড়িতে বেশি বডিগার্ড ছিলনা।আয়ানও বাড়িতে ছিলোনা।বাড়িতে শুধু শাহিন খান আর স্ত্রী মানে আয়ানের মা ছিলো। সেইদিনই সুযোগ পেয়ে দুজনকে মেরে দিলাম।আয়ানকে খুঁজেছিলাম কিন্তু পাইনি।পরে শুনেছিলাম আয়ান সেদিন মামার বাড়িতে ছিলো।সেদিন যদি আয়ানকে পেতাম তাহলে ওকেও মেরে ফেলতাম। আসলে তোদের দুজনেরই ভাগ্যটা খুব ভালো।মরতে মরতে বেঁচে গিয়েছিস”

ফারিহার ইচ্ছে করছে এখন হানিফ আহমেদ কিছু দিয়ে ইচ্ছা মতো মারতে কিন্তু ফারিহার হাত বাঁধা।ফারিহা রাগ সহ্য করে বললো,

“এতে আয়ান বাপির শত্রু হলো কেনো?”

ফারিহার প্রশ্ন শুনে হানিফ আহমেদ অনেক জোরে হাসলো।তারপর বললো,

“সেটাই তো মজার কাহিনি।সেদিন শাহিন খান আর ওর স্ত্রীকে মারার পর আমি একটা অন্য নাম্বার থেকে মিস্টার আজাদকে কল করে বলেছিলাম যে এই বাড়িতে কিছু একটা ঘটে মিস্টার আজাদ যেন এসে দেখে।তোর বাপি আমাকে খুব বিশ্বাস করতো তাই সরল মনে এসে নিজেই ফেঁসে গেল।উনি যখন শাহিন খান আর উনার স্ত্রীর লাশের কাছে গিয়েছিল তখন আমি দূর থেকে ছবি তুলেছিলাম।ভেবেছিলাম কখনো কাজে লাগবে। ঠিকই হলো শাহিন খান মৃত্যুর পর আয়ান তো মামার কাছে আমেরিকা চলে গেলো।তারপর কিছুবছর ভালোই যাচ্ছিলো।মধ্য দিয়ে তোর মাকে মেরে ফেললাম!
অনেক বছর পর আয়ান দেশে আসার পর আমি আয়ানের কাছে ছবিগুলো পাঠিয়ে ছিলাম।আমি দেখতে চেয়েছিলাম যে আয়ান মিস্টার আজাদকে নিজের মা-বাবার খুনী ভেবে কিভাবে প্রতিশোধ নিতে চায়!ভেবেছিলাম আয়ান তোমাদেরকে মেরে দেবে তারপর সব আমার হাতের মুঠোয় চলে আসবে।
কিন্তু আয়ান তো তোকে বিয়ে করলো!তবুও সব মুখ বুজে সহ্য করলাম কিন্তু আস্তে আস্তে আয়ান এখন তোকে ভালোবেসে ফেলছে যা আমি একদম সহ্য করবো না।তোদের মধ্যে সব ঠিক হয়ে আমার পরিকল্পনা তো সব জলে যাবে।তাই আজকে তোকে তুলে আনলাম এখন তোকে মেরে ফেললে আমার আরো দ্বিগুন লাভ”

ফারিহা এতক্ষণ অবাক হয়ে চুপচাপ হানিফ আহমেদের কথা শুনছিল।ফারিহা এতোদিনে বুঝলো কেন আয়ানের মিস্টার আজাদের উপর এত রাগ।আয়ান বারবার বলেছিলো মিস্টার আজাদ ওর আপনজন কেড়ে নিয়েছে।
ফারিহা জানতো ওর বাপি কখনো কোন খারাপ কাজ করতে পারে না।আজকে সেটা প্রমাণ হয়ে গেলো যে মিস্টার আজাা আয়ানের কোন আপনজনকে কেড়ে নেয়নি।কিন্তু এখন তো অনেক দেরি হয়ে গেল!
ফারিহা চুপচাপ দেখে হানিফ আহমেদ আবার বললো,

“বলতো কিভাবে আমার দ্বিগুন লাভ?আচ্ছা আমিই বলছি।একেতো তুই মিস্টার আজাদের প্রাণ ভোমরা আর দ্বিতীয়ত আয়ান এখন আস্তে আস্তে তোর ওপর দুর্বল হচ্ছে।এখন যদি তোকে শেষ করে দিই তাহলে মিস্টার আজাদ আর আয়ান দুজনেই ভেঙ্গে পড়বে।দুই রাজ্য আমার হাতের মুঠোয়।হাহাহা…”

হানিফ আহমেদের হাসিশুনে ফারিহার গা জ্বলে যাচ্ছে।ফারিহা ঘৃণায় মুখ ফিরিয়ে নিলো।

চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here