স্রোতের টানে পর্ব-৩৩

0
3630

#স্রোতের_টানে
লেখিকা:#Tarin_Niti
পর্ব:৩৩

সকালে সূর্যের আলো চোখে পড়তেই ফারিহা চোখ খুললো।রাতে এভাবে ডাইরিটা বুকে নিয়েই দোলনায় বসে ঘুমিয়ে গিয়েছিলো।ফারিহা চোখ ডলে এদিক ওদিক তাকালো।তারপর সোজা হয়ে বসে সামনের দিকে তাকালো।একটু বেলা হয়ে গিয়েছে।ফারিহা কিছুক্ষণ চুপচাপ বসে থেকে রুমে এসে ডায়রিটা রেখে ওয়াশরুমে গেলো ফ্রেশ হওয়ার জন্য।ফারিহা চোখে মুখে বেশি করে পানির ঝাপটা দিলো।রাতে ফারিহার শরীর অনেক দুর্বল ছিল কিন্তু এখন একটু সুস্থ বোধ করছে।
ফারিহা ফ্রেশ হয়ে রুমে এসে বিছানায় বসলো ফারিহার কিছু ভালো লাগছেনা। আবার আজকে দেরিতে ঘুম ভাঙ্গার কারণে নামাজ পড়তে পারেনি।ফারিহা চুপচাপ কিছুক্ষণ বিছানায় বসে থাকলো। তারপর টেবিলের ওপর ওর ফোন টা দেখে ফোনটা হাতে নিলো।ফারিহা বর্তমানে যেই ফোনটা ব্যবহার করতো,মানে যেই ফোনটা বিয়ের পর আয়ান ফারিহাকে দিয়েছিল সেটা কিডন্যাপারদের সাথে ধ্বস্তাধ্বস্তি করার সময় হয়তো কোথাও পড়ে গিয়েছে।কিন্তু এই ফোনটা ফারিহাকে মিস্টার আজাদ দিয়েছিলো ফারিহা যখন কলেজে উঠেছিল তখন। বিয়ের পর ফোনটা এই বাড়িতেই ছিল তবে আয়ান এটার নাম্বার জানতো।তাই হয়তো জিহাদ ও জানতো।
ফারিহা ফোন হাতে নিয়ে দেখে অনেকগুলো মিসকল।ফারিহার জিহাদের নাম্বার চিনতে অসুবিধা হলো না।ফারিহা ভ্রু কুঁচকে জিহাদের পাঠানো ভিডিওটা চালু করলো। ভিডিওটা দেখে ফারিহার চমকে উঠলো আয়ান বিছানায় শুয়ে বিড়বিড় করে মাথা নাড়ছে আর ফারিহার নাম বলছে।দেখেই বুঝা যাচ্ছে ড্রিঙ্কস করে মাতাল হয়ে আছে।আয়ানের এই অবস্থা দেখে ফারিহা প্রচুর অবাক হল।কেননা বিয়ের পরপর ফারিহা আয়ানকে কখনো ড্রিঙ্কস করতে দেখেনি।হ্যাঁ হয়তো মাঝেমাঝে ড্রিংস করতে তবে এতো বেশি না।আর ফারিহা সামনে তো কখনোই না।ভিডিওটা দেখে ফারিহার হাত,ঠোঁট প্রচণ্ড রকমে কাঁপছে।আয়ানের এই অবস্থা দেখে ফারিহা নিজেকে সামলাতে পারছে না।ফারিহা ধপ করে বিছানায় বসে পড়লো তারপর আবার ভিডিওটা দেখলো।আয়ান বিছানায় ওপর উপুর হয়ে শুয়ে ফারিহার নাম বিড়বিড় করছে।ফারিহা ফোনের উপর কাঁপা কাঁপা হাত রেখে আয়ানকে ছোঁয়ার চেষ্টা করলো।কিন্তু আয়ান তো অনেক দূরে।
অনেক দূরে…
কখন ফারিহার চোখ বেয়ে পানি পড়ছে ফারিহা নিজেও জানেনা।ফারিহা আর থাকতে না পেরে জিহাদের নাম্বারে কল দিল।

.
জিহাদ আয়ানের বাসার ড্রয়িংরুমের সোফায় বসে কাজ করছিল।মাফিয়া জগতে আয়ানের পরে জিহাদই প্রধান। তাই ওর অনেক কাজ থাকে।জিহাদ কাজ করতে করতে হঠাৎ উপরের দিকে তাকালো।আয়ান শার্টের হাতা ফোল্ড করতে করতে সিঁড়ি দিয়ে নিচে নামছে।আয়ানকে এখন অনেক স্বাভাবিক লাগছে।কালো প্যান্ট সাথে কালো শার্ট।শার্টের উপরের দুটো বোতাম খোলা হাতা।হাতা ফোল্ড করছে আর চুলগুলো নেড়ে ঠিক করছে।
আয়ান নিচে নেমে একটা সার্ভেন্ট কে বলল কফি দিতে।সার্ভেন্টটা মাথা নেড়ে কিচেনের দিকে চলে গেল।তারপর আয়ানয় গিয়ে জিহাদের কাছে সোফায় বসল।জিহাদ বলল,

“স্যার আপনি এখন ঠিক আছেন?”

আয়ান সোফার সাথে হেলান দিয়ে বসে কিছু না বলে শুধু মাথা নাড়লো।সকালে ঘুম থেকে উঠে আয়ানের প্রচণ্ড মাথাব্যথা ছিল।আয়ান বুঝতে পারে কালকে রাতে অনেক বেশি নেশা করেছিল।আয়ানের খুব অপরাধবোধ হচ্ছে কারণ ফারিহা এসব নেশা করা একদম পছন্দ করে না।আর আয়ান ফারিহার অপছন্দের কাজটাই করলো।আয়ান জানে এভাবে নেশা করে কষ্ট উড়িয়ে দেওয়া যাবে না,নিজেকে স্বাভাবিক রেখে ফারিহাকে মানাতে হবে।তাই আয়ান ভেবে নিয়েছো আর এরকম ভুল করবেনা।জিহাদ আয়ানের মুড বোঝার চেষ্টা করলো মনে হচ্ছে না আয়ান এখন রেগে আছে।তাই জিহাদ বলল,

“স্যার রাকিব অফিসের এই ফাইল গুলো পাঠিয়েছে।আপনার সাইন লাগবে”

একটা সার্ভেন্ট এসে কফি দিয়ে গেল।আয়ান কফির মগে চুমুক দিয়ে মগটা সাইডে রেখেছে হাত বাড়িয়ে বললো,
“হুম ফাইল গুলো দাও”

জিহাদ ফাইলগুলো এগিয়ে দিল।আয়ান সাইন করতে করতে বললো,

“রাকিব ওইদিকে অফিসের কাজ গুলো ঠিকভাবে সামলাচ্ছে তো?”

“জি স্যার আমার রাকিবের সাথে কথা হয়েছে। অফিসের সব কাজ সব ঠিকঠাক ভাবে চলছে।স্যার আপনি আজকে অফিসে যাবে না?”

“হুম দেখি”

আয়ান জিহাদের সাথে কথা বলতে বলতে হঠাৎ জিহাদের ফোন বেজে উঠলো।কাজের কথা সময় কেউ ডিস্টার্ব করলে আয়ান অনেক বিরক্ত হয়।আয়ান বিরক্তি নিয়ে বললো,

“ফোন সাইলেন্ট করে রাখতে পারো না?”

“সরি স্যার!”

জিহাদ তাড়াতাড়ি করে ফোন বের করে কল কাটতে গিয়ে ফারিহার নাম্বার দেখে হাত থেমে গেল।জিহাদকে এভাবে ফোনের দিকে তাকিয়ে থাকতে দেখে আয়ান বিরক্তি নিয়ে বললো,

“কি হলো?গার্লফ্রেন্ড ফোন করেছে নাকি?আমি বলেছি না সবার আগে কাজ,পরে অন্য কিছু।এখন ফোন অফ করো”

জিহাদ কাঁপা কাঁপা কন্ঠে বলল, “স্যার ম্যাডাম কল করেছে”

আয়ান ফাইলে সাইন করছিল কিন্তু জিহাদের কথায় আয়ানের হাত থেমে গেল। যদিও ফারিহা আয়ানের ফোনে না জিহাদের ফোনে কল করেছে তবুও আয়ান অনেক খুশি হলো।আয়ান নিজেকে সামলে নিয়ে বললো,

“কল রিসিভ করে লাউড স্পিকারে দাও”

জিহাদ মাথা নেড়ে কল রিসিভ করে স্পিকারে দিল। কল রিসিভ করার সাথে সাথে ফারিহা অস্থির হয়ে বলতে লাগল,
“জিহাদ ভাইয়া উনি কোথায়?উনি ঠিক আছে তো?আপনি উনাকে দেখে রাখবেন তো। আমি চলে আসার পর আপনার উচিত ছিল উনাকে চোখে চোখে রাখা।দেখলেন তো নিজের কী অবস্থা করলো।এখন কোথায় আছে?লেবু পানি খায়িছেন তো?এত নেশা করার কারনে উনার শরীরে কিন্তু খারাপ প্রভাব ফেলতে পারে।কি হলো কিছু বলছেন না কেন?’

ফারিহার কথায় আয়ান থতমত খেয়ে গেল। অনেক অবাকও হলো।আসলে ফারিহা কি বলছে আয়ান বুঝতে পারছে না।তবে এটা বুঝতে পারছে যে ফারিহা হয়তো জানে ও কালকে রাত্রে ড্রিংক করেছিল।জিহাদ ভয়ে ভয়ে আয়ানে দিকে তাকিয়ে আয়ানের রিয়েকশন বোঝার চেষ্টা করছে।কিন্তু আয়ান কিছু বলছে না দেখে জিহাদ বললো,

“ম্যাডাম আপনি চিন্তা করবেন না।স্যার এখন ঠিক আছে”

জিহাদের কথায় ফারিহা একটু শান্ত হল।তারপর শান্ত কণ্ঠে বললো,
“উনি কি এখনও ঘুমিয়ে আছে?”

আয়ান ইশারায় জিহাদকে ওর কথা বলতে বারণ করল।তাই জিহাদ বলল,
“হুম এখনো ঘুমিয়ে আছে”

“ও ঘুম থেকে উঠলে কিন্তু সবার আগে কফি চাইবে।আর ও তো এখন আমার হাতে কফি ছাড়া খেতে পারে না।আচ্ছা জিহাদ ভাইয়া আপনি একটা সার্ভেন্টকে ফোনটা দিন।আমি কিভাবে কফি বানাতে হবে বলে দিচ্ছি”

আয়ান অবাক হয়ে ফারিহার কথা শুনছে আর হাসছে।ফারিহা দূরে গেলেও আয়ানের জন্য চিন্তা করছে।কি খেলে আয়ানের শরীরে খারাপ প্রভাব ফেলবে আবার সকালে উঠে ফারিহার হাতে কফি না খেলে আয়ানের ভালো লাগেনা সব দিক খেয়াল রাখছে।আয়ান ফারিহা কথা শুনে মুচকি মুচকি হাসছে আর ফারিহার কথা ভাবছে।জিহাদ ফারিহার কথা শুনে বললো,

“ম্যাম এভাবে কতদিন সার্ভেন্ট কে বলে কফি বানাবেন?তার চেয়ে ভালো আপনি এসে সারাজীবন স্যারের কফি বানানোর দায়িত্ব নিন”

জিহাদের কথা শুনে ফারিহা চুপ করে গেল আর আয়ান ফারিহার উত্তর শোনার জন্য অপেক্ষা করছে।ফারিহা কিছুক্ষণ চুপ থেকে তারপর বললো,

“এটা কখনো সম্ভব না।আমি আর ঐ বাড়িতে ফিরব না।যাই হোক আপনার কাছে আমার শেষ রিকুয়েস্ট আপনি প্লিজ সবসময় উনার খেয়াল রাখবেন।রাখছি আর আমি যে কল করেছিলাম সেটা উনাকে বলবেন না”

“ম্যাম ম্যাম শুনুন…”

ফারিহা আর এক মুহূর্ত দেরি না করে কল কেটে দিলো।আয়ান ফারিহার উত্তর শুনে কিছুক্ষণ থম মেরে বসে থাকল তারপর কিছু না বলে বসা থেকে উঠে হন হন করে উপরে রুমে চলে গেলো।
কিছুক্ষণ পর আয়ানের রুম থেকে কিছু ভাঙ্গার আওয়াজ আসলো।ফারিহার কথার শুনে আয়ান প্রচুর রেগে যায়।ফারিহা জিহাদকে ওর খেয়াল রাখতে বলছে?কেনো নিজে এসে খেয়াল রাখতে পারে না?আয়ান তো ফারিহার কাছে ক্ষমা চেয়েছে। দরকার হলে ফারিহা এই বাড়িতে এসে ওকে শাস্তি দিক কিন্তু ফারিহার দূরে যাওয়াটা আয়ান মানতে পারছে না।খুব কষ্ট হচ্ছে।তাই এখন জিনিসপত্র ভেঙ্গে রাগ কমানোর চেষ্টা করছে।
জিহাদ জানে এখন আয়ানের কাছে গেলে ওর উপর দিয়ে টর্নেডো বয়ে যাবে তাই এখানেই অসহায়ের মতো বসে রইল।

ফারিহা কল কেটে কিছুক্ষণ চুপচাপ বসে থাকলো। আয়ানের ভিডিওটা দেখে ফারিহা অস্থির হয়ে গিয়েছিল কিন্তু এখন আয়ান ঠিক আছে শুনে ফারিহা কিছুটা শান্ত হলো।তারপর আরো কিছুক্ষণ বসে থেকে ফোন রেখে ফারিহা নিচে গেল।
ফারিহা নিচে এসে দেখল মিস্টার আজাদ সোফায় বসে চা খাচ্ছে আর খবরের কাগজ পরছে।ফারিহাকে দেখে মিস্টার আজাদ হেসে বলল,

“তুই উঠে পড়েছিস?আমি একটু পর তোকে ডাক দিতে যেতাম।এখন শরীর ঠিক আছে তো?”

ফারিহা একটু হেসে বললো, “হ্যা আমি ঠিক আছি”

“আয়,আমার কাছে এসে এখানে বস”

ফারিহা মিস্টার আজাদের কাছে বসলে মিস্টার আজাদ একটা সার্ভেন্ট কে ডাক দিয়ে ফারিহাকে কফি দিতে বলল। তারপর মিস্টার আজাদ ফারিহার মুখের দিকে তাকিয়ে বললো,

“তোকে কেমন অন্যরকম লাগছে।শরীর ঠিক হয়েছে তো?”

আয়ানের ভিডিওটা দেখার পর ফারিহা কান্না করেছে।তাই ফর্সা চেহারা কান্নার কারণ একটু লাল হয়ে আছে।ফারিহা নিচে নামার সময় চোখে মুখে পানি দিয়ে স্বাভাবিক হয়ে এসেছিল।কিন্তু মিস্টার আজাদ কি করে বোঝা গেল! ফারিহা জোরপূর্বক হেসে বললো,

“ক্ কই কিরকম লাগছে?এই দেখো আমি একদম ঠিক আছি”

হনুফা বেগম এসে ফারিহাকে কফি দিয়ে ফারিহার শরীর কেমন আছে জিজ্ঞেস করলো।ফারিহাও হেসে বললো ও ভালো আছে। তারপর হনুফা বেগম নাস্তা তৈরি করার জন্য চলে গেল।কফি খেতে খেতে ফারিহা বলল,

“বাপি তোমাকে একটা কথা জিজ্ঞেস করবো?”

মিস্টার আজাদ খবরের কাগজে থেকে চোখ খুলে ফারিহার দিকে তাকিয়ে বলল, “হ্যাঁ বল”

ফারিহা কফির মগটা শক্ত করে চেপে ধরে একটু উসখুস করে বললো,
“তোমরা আমার খবর কিভাবে পেলে? মানে আমাকে যে হানিফ আঙ্কেল ওখানে নিয়ে গিয়েছিল সেটা কিভাবে জানতে পারলে?কালকে আমি অসুস্থ ছিলাম বলে আমি জিজ্ঞেস করাতেও তুমি আমার কথার উত্তর দাওনি। কিন্তু আজকে আমি জানতে চাই”
ফারিহার কথা শুনে মিস্টার আজাদ একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললো।

চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here