স্রোতের টানে পর্ব-৩৬

0
3100

#স্রোতের_টানে
লেখিকা:#Tarin_Niti
পর্ব:৩৬

আয়ান অনেকক্ষণ ধরে ফারিহার গলায় মুখ করে দাঁড়িয়ে আছে।কোন কিছু বলছেনা নড়াচড়াও করছে না।চুপচাপ ফারিহার শরীরের গন্ধ নিচ্ছে ফারিহা জামা হাতের মুঠোয় করে দাঁড়িয়ে আছে।ফারিহা আয়ানকে দেখছে কালো শার্ট আর কালো প্যান্টে আয়ানকে অনেক হ্যান্ডসাম লাগছে।চুলগুলো উসখু শুসখু।ফারিহা কিছুক্ষণ আয়ানকে দেখে এবার আর থাকতে না পেরে আয়ানের কাঁধ ধরে একটু সরিয়ে দিয়ে বললো,

“আপনি এখানে?এ বাড়িতে কেনো এসেছেন?”

ফারিহা সংস্পর্শে এসে আয়ানের রাগ কিছুটা কমেছে।তাই শান্ত কন্ঠে ফারিহার চোখের দিকে তাকিয়ে বললো,

“তোমাকে দেখতে।”

“আমাকে?আমাকে দেখতে? আপনি জানেন বাপি জানতে পারলে কি হবে?ভাগ্যিমান বাপি বাড়িতে নেই”

“তো থাকলে কি হতো?আমি তোমার বাপিকে ভয় পাই নাকি?”

ফারিহা বিরক্তি নিয়ে বললো, “আমাকে দেখা হয়ে গিয়েছে?আবার চলে যান”

“না,যাবো না।তোমার সাথে আমার কথা আছে”

ফারিহা আমতা আমতা করে বললো, “কি্ কি কথা?”

আয়ান বিরক্তি নিয়ে বললো, “কি তখন থেকে আমতা আমতা করে যাচ্ছো।আমাকে ভয় পাচ্ছো নাকি?স্বাভাবিকভাবে কথা বল”

আয়ানের ধমকে ফারিহা চুপ করে গেল।আয়ান নিজেকে শান্ত করে আবার বললো,
“তোমার সাথে আমার ইম্পরট্যান্ট কথা আছে তাই এসেছি।আর তোমার বাপি আমাকে কি বলবে?আমি আমার বউয়ের কাছে এসেছি,,অন্য কোনো মেয়ের কাছে নয়।”

ফারিহা চুপ করে দাঁড়িয়ে আছে।আয়ান ফারিহাকে দেখে ভ্রু কুঁচকে বললো,
“কী হলো?কিছু বলছো না কেন?”

ফারিহা আয়ানের দিকে তাকিয়ে বললো, “আপনিই তো কথা বলতে বারণ করলেন।”

ফারিহার কথায় আয়ান জোরে হেসে দিল।তারপর বললো,
“আমি কথা বলতে বারণ করিনি।স্বাভাবিক ভাবে কথা বলতে বলছি।তুমি আমতা-আমতা করে কথা বলছো মনে হচ্ছে যেন আমাকে ভয় পাচ্ছো!”

“আচ্ছা আপনি কি বলতে এসেছেন বলুন”

আয়ান এবার মুখটা গম্ভীর করে বললো,
“তুমি তখন ফোনে ঐ কথাটা বললে কেনো?”

ফারিহা বুঝেও না বুঝার ভান করে বললো, “কোন কথা?”

“কোন কথা?তুমি বুঝতে পারছোনা?ডিভোর্সের কথা কেন বললে?”

যদিও ফারিহা আয়ানকে ভয় পাশ তবুও মনে সাহস সঞ্চার করে বললো,
“আমরা তো এখন থেকে আলাদা থাকবো।তাহলে আইনগতভাবে আলাদা হয়ে যাওয়া কি ভালো নয়?”

ফারিহার কথা শুনা আয়ান চমকে উঠে ফারিহার চোখের দিকে তাকাল।আর ফারিহা আয়ানের চোখের দিকে তাকানোর সাহস পাচ্ছে না এদিক ওদিক তাকাচ্ছে।আয়ান ফারিহার গাল ধরে ফারিহাকে ওর দিকে ফিরিয়ে ফারিহার চোখে চোখ রেখে বললো,
“পারবে আমাকে ছাড়া থাকতে?”

ফারিহা আয়ানের চোখে দিয়ে তাকিয়ে কখনো মিথ্যা বলতে পারে না।তাই অন্য দিকে তাকিয়ে বললো,
“হ্যাঁ পারবো।”

আয়ান আবার ফারিহার গাল ধরে ফারিহা কে ওর দিকে ঘুরিয়ে বললো, “বারবার ওই দিকে তাকাচ্ছো কেনো?আমার চোখের দিকে তাকিয়ে বলো,পারবে আমাকে ছাড়া থাকতে?”

ফারিহা ওর গাল থেকে আয়ানের হাত সরিয়ে দিতে দিতে বললো, “আমিতো যা বলার গতকালকে বলে দিয়েছি”

আয়ান ফারিহার কাঁধ ধরে বললো, “না এভাবে হবে না।তুমি আমার চোখে চোখ রেখে বলো যে তুমি আমাকে ভালোবাসো না”

ফারিহা কিছু বলছে না শুধু আয়ানের কাছ থেকে ছোটার জন্য মুচড়ামুচড়ি করছে আর এদিক ওদিক তাকাচ্ছে।আয়ান কিছুক্ষণ ফারিহার দিকে তাকিয়ে থেকে হেসে বললো,

“কি হলো এরকম করছ কেনো?তোমার কাছে উত্তর নেই তাইতো??”

“ছাড়ুন আমাকে।”

“আমি আমার উত্তর চাই।”

“কি জানতে চান?”

“তুমি আমাকে ছাড়া থাকতে পারবে?”

ফারিহা শক্ত কন্ঠে বললো, “না পারলে তো আর ডিভোর্সের কথা বলতাম না।”

আয়ান ফারিহার কাঁধ ধরে বললো, “আমি জানি এটা তোমার কাজ না। নিশ্চয়ই তোমার বাপি তোমাকে বুঝিয়েছে তাই না?”

ফারিহা আয়ানের থেকে দূরে যাওয়ার চেষ্টা করতে করতে বললো, “আমি ছোট বাচ্চা না যে আমাকে বোঝালে আমি বুঝে যাবো! যা বলার আমি নিজ থেকে বলেছি”

ফারিহার কথা শুনে আয়ানের রাগ হচ্ছে তবুও নিজেকে সামলে নিলো।এখন রেগে যাওয়াটা ঠিক হবে না।আয়ান ফারিহাকে ঠান্ডা মাথা বললো,

“কিন্তু আমি তোমাকে ডিভোর্স দিবো না।”

“কেনো?দিবেন না কেনো?আপনার প্রতিশোধ নেওয়া তো হয়ে গিয়েছে এবার আমাকে মুক্তি দিন প্লিজ”

ফারিহা আয়ানের ছুটার জন্য মুচরামুচরি করছে দেখে আয়ান শক্ত করে ফারিয়ার দু কাঁধ ধরে ফারিহার চোখের দিকে তাকিয়ে বললো,

“আমার থেকে তোমার কোনো মুক্তি নেই।তোমায় সারা জীবন আমার সাথেই থাকতে হবে।সেটা তুমি চাও বা না চাও।”

“ছাড়ুন আমাকে আপনি কি এখন আমাকে জোর করবেন নাকি?”

“দরকার হলে তাই করবো!তুমি আমার বউ তোমাকে আমার সাথেই থাকতে হবে।এখন কিছুদিন এই বাড়িতে বেড়াও সমস্যা নেই কিন্তু সারা জীবন থাকার কথা চিন্তাও করোনা।আমি কিছুদিন পর তোমাকে নিতে আসবো”

আয়ানের কথা শুনে ফারিহার রাগ উঠছে।কি পেয়েছেটা কি ওকে?ফারিহা কি পুতুল নাকি যে যেভাবে ইচ্ছা নাচাবে।এতদিন তবুও ফারিহা মুখ বুজে সব সহ্য করেছে শুধুমাত্র সত্যিটা জানার জন্য। আজকে সব সত্যি জানার পরও আয়ান ওর সাথে জোর জবরদস্তি করছে।ওর ইচ্ছার কি কোনো দাম নেই নাকি?ফারিহা আয়ানকে ঝটকা মেরে সরিয়ে দিয়ে চিৎকার করে বললো,

“আমি যাবো না,যাবো না,যাবো না।আমি এখানেই থাকব আর ডির্ভোস পেপারে সাইন করে আপনার কাছে পাঠিয়ে দেবো আপনি সাইন করে দিয়েন”

আয়ান কিছুক্ষণ অবাক চোখে ফারিহাকে দেখে।তারপর ওকে ছেড়ে একটু দূরে গিয়ে এদিক ওদিক তাকিয়ে নিজের চুল টেনে নিজেকে শান্ত করার চেষ্টা করে।আয়ান বুঝে গিয়েছে এখন ফারিহা সাথে রাগ দেখালে হিতে বিপরীত হবে।এতদিন তবুও ফারিহা সব মুখ বুজে সহ্য করেছে।কিন্তু এখন ফারিহা আর এসব সহ্য করবে না।আয়ান নিজেকে শান্ত করে ঠান্ডা মাথায় বললো,

“ফারিহা দেখো আমি জানি তুমি এখনো আমার উপর রেগে আছো।কিন্তু ঠান্ডা মাথায় একবার ভাবো, বললেই কি ডিভোর্স হয়ে যাবে নাকি?আমরা দুজন স্বামী স্ত্রী এতদিন একসাথে ছিলাম এখন সামান্য একটা কারণে আলাদা হতে পারিনা।তাছাড়া আমি তোমাকে ভালোবাসি আর আমি জানি তুমিও আমাকে ভালোবাসো।তাহলে আলাদা হওয়ার প্রশ্ন আসছে কেনো?”

ফারিহা কিছু বলতে যাবে কিন্তু আয়ান ফারিহাকে থামিয়ে দিয়ে আবার বললো, “হ্যাঁ আমি জানি এখন তুমি বলবে যে আমি তোমার উপর অনেক অত্যাচার করেছি,তাই তুমি আমার সাথে থাকতে চাও না।কিন্তু তুমি একবার আমার দিকটা বোঝার চেষ্টা করো। আমি নিজের বাবা-মার মৃত্যু প্রতিশোধের নেশায় অন্ধ হয়ে গিয়েছিলাম।কি করেছি নিজেও জানিনা! তোমাকে অনেক কষ্টও দিয়েছি।কিন্তু আমাকে একটা সুযোগ দাও”

আয়ানের অসহায় কন্ঠে বলা কথাগুলো শুনে ফারিহার মন নরম হয়ে যায়।কিন্তু তবুও ফারিহা না সুচক মাথা নাড়ালো।আয়ান ফারিহার দিকে অসহায় দৃষ্টিতে তাকালো।দরজার আওয়াজে ফারিহার ধান ভাঙ্গে।মিস্টার আজাদ দরজার ওপাশ থেকে দরজা ধাক্কাচ্ছে আর বলছে,

“ফারিহা,,ফারিহা দরজা খোল।আয়ান নাকি এসেছে?ওকি আবার তোর সাথে কিছু করেছে?ফারিহা দরজা খোল মা।আয়ান আয়ান…”

ফারিহা একবার আয়ানের দিকে তাকিয়ে একপ্রকার দৌড়ে গিয়ে দরজা খুললো।দরজা খোলার সাথে সাথেই মিস্টার আজাদ ভেতরে আসে।রুমে ঢুকেই দেখি আয়ান বিছানায় বসে হাটুর উপর দুই হাত ভাজ করে হাতের উপর মাথাটা ঠেকিয়ে বসে আছে।ফারিহাকে দেখে মিস্টার আজাদ শান্ত হলো!
হনুফা বেগম যখন ফোন করে বলেছিল যে আয়ান এসেছে তখনই মিস্টার আজাদ কাছে পেলে হন্তদন্ত করে বাড়িতে চলে আসে।হনুফা বেগম ওই সার্ভেন্টটার কাছ থেকে শুনেছিল আয়ান এসেছে তারপর ফারিহার রুমে ঢুকেই দরজা লাগিয়ে দিয়েছে।তাই উনি ভয় পেয়ে মিস্টার আজাদকে সাথে সাথে কল করে।মিস্টার আদার চায়না ফারিহা আয়ানের সংস্পর্শে আসুক। মিস্টার আজাদ জানে আয়ান এখন আর ফারিহার উপর জোর খাটাতে পারবেনা তাই সেটা নিয়ে চিন্তা নেই।কিন্তু মিস্টার আজাদ যার চিন্তা করছে যে আয়ান যদি কোন রকমে ফারিহাকে ইমোশনাল ব্ল্যাকমেইল করে তাহলে ফারিহা আয়ানের কাছে চলে যাবে।কারন ফারিহা অনেক ইমোশনাল একটা মেয়ে।ফারিহা আয়ানের কথা মেনে নিতে পারে যেটা হতে দেওয়া যাবে না। তাই উনি তাড়াতাড়ি বাড়িতে ছুটে আসে।মিস্টার আজাদ একটু রাগী মুখে বেডের কাছে গিয়ে আয়ানের দিকে তাকিয়ে বললো,

“তুমি এখানে কেন এসেছো? আর তোমার সাহস তো কম না আবার আমার মেয়ের কাছে এসেছো!”

আয়ান মাথাদুলিয়ে মিস্টার আজাদের দিকে তাকালো।তারপর তাচ্ছিল্য হেসে বললো, “মেয়ে তো আমার বিরুদ্ধে ভালোই বুঝিয়েছেন দেখছি”

আয়ানের কথা শুনে মিস্টার আজাদ রাগী চোখে আয়ানের দিকে তাকালো।আর এদিকে ফারিহা অবাক হয়ে আয়ানের দিকে তাকায়।মিস্টার আজাদ রাগি স্বরে বললো,
“জাস্ট শাট আপ! কি বলছো এসব তুমি?এখনি আমার বাড়ি থেকে বেরিয়ে যাও”

মিস্টার আজাদের ধমকে আয়ানের কোনো ভাবান্তর হলো না।আয়ান সেভাবেই মিস্টার আজাদের দিকে তাকিয়ে বললো,
“আমি যা বলেছি ঠিকই বলেছি। আমি জানি ফারিহা আমার কাছে ফিরতে চায় কিন্তু আপনি ওকে আসতে দিচ্ছেন না।কেনো আমাদের স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে আসছেন?”

আয়ানের কথা শুনে ফারিহা অবাক হয়ে আয়ানের দিকে তাকাল। তারপর বললো,
“আমি আপনাকে আগেও বলেছি এরমধ্যে বাপিকে টানবেন না। যা সিদ্ধান্ত নেওয়ার আমি নিয়েছি। বাপি তো জানেও না আমি আপনাকে ডিভোর্স দেয়ার কথা বলেছি”

মিস্টার আজাদ অবাক হয়ে ফারিহার দিকে তাকিয়ে বললো, “ডিভোর্স?”

ফারিহা মাথা নিচু করে মিস্টার আজাদকে বললো,
“হ্যাঁ বাপি আমি ওনাকে ডিভোর্স দিতে চাই।আমরা যখন একসাথে থাকবো না তাহলে আইনগত ভাবে আলাদা হয়ে যাওয়া টাই ভালো”

ফারিহার কথা শুনে মিস্টার আজাদ হাসলো।তারপর ফারিহার কাছে গিয়ে মাথায় হাত বুলিয়ে বললো,

“একদম সঠিক সিদ্ধান্ত নিয়েছিস”

আয়ান রেগে বলল, “কিসের সঠিক সিদ্ধান্ত?আপনারা বুঝতে পারছেন না কেন আমি ফারিহাকে ছাড়া বাঁচতে পারব না।ফারিহাকে আমার চাই”

মিস্টার আজাদ শক্ত কণ্ঠে বললো, “আমি আমার মেয়েকে দ্বিতীয়বারের মতো নরকের ঠেলে পাঠাতে চাই না।আমার মেয়ে সুখ সবার আগে।ফারিহার ভালোর জন্য তোমাদের ডিভোর্স হয়ে যাওয়াটাই ভালো।”

আয়ান জানে এখন ক্ষমতার জোরে ফারিহাকে ওর কাছে আনতে পারবে না।ফারিহা যদি না মানে তাহলে ওদের একসাথে হওয়া কখনোই সম্ভব না! তাই রাগ হলেও আয়ান নিজেকে যথাসম্ভব শান্ত রাখে।আয়ান কিছুক্ষণ ফারিহা দিকে তাকিয়ে থেকে তারপর বললো,
“তাহলে এটাই তোমার শেষ কথা?”

আয়ানের কথা শুনে ফয়রিহার বুকটা মোচড় দিয়ে উঠলো।এমনিতে তো ভালোবাসা মানুষটা কাছ থেকে দূরে সরে এসেছে এবার আইনগতভাবেই দূরে সরে আসবে।ফারিহার খুব কষ্ট হচ্ছে তবুও কষ্টটা বুকে চেপে রেখে নিচু কন্ঠে বললো,

“হ্যাঁ”

আয়ান ফারিহার দিকে তাকায়।মেয়েটা অনেক বদলে গিয়েছে যেই ফারিহা আয়ানের ভয়ে গুটিসুটি মেরে থাকত সে এখন আয়ানের মুখের উপর কথা বলছে।আয়ানকে ছেড়ে যাওয়ার কথা বলছে?আয়ান কিছুক্ষণ শান্ত দৃষ্টিতে ফারিহাকে পর্যবেক্ষণ করলো।তারপর বললো,

“তাহলে শুনে রাখো আমি কখনও তোমাকে ডিভোর্স দিবো না। আমার হাত থেকে তোমার মুক্তি নেই”

আয়ান আর কিছু না বলে হনহন করে রুম থেকে বেরিয়ে গেল।ফারিহা আয়ানের যাওয়ার দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো।

চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here