#স্রোতের_টানে
লেখিকা:#Tarin_Niti
পর্ব:৩৭
কেটে গিয়েছে দুই মাস।ঐদিনের পর আয়ান মাঝে মাঝেই ফারিহাদের বাড়িতে আসতো।কিন্তু ফারিহা কখনো আয়ানের সাথে ঠিকভাবে কথা বলেনি।সেই এক উত্তর,ফারিহা আর আয়ানের কাছে ফিরবে না। কিন্তু আয়ান হাল ছাড়ার পাত্র নয়।মাঝে মাঝেই ফারিহার সাথে দেখা করতে আসে।ভার্সিটির সামনে গাড়ি নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে।আর ফোনে কথা বলা তো আছেই।আয়ান প্রায় সময় ফারিহাকে কল করে। যদিও ফারিহা আয়ানের সাথে ফোনে কথা বলতে চায় না তবু আয়ান বারবার কল করে।তাই ফারিহা বিরক্তি নিয়ে কথা বলে।তবে এটাকে বিরক্তি বলা ও ঠিক না কারন ফারিহার ও আয়ানের সাথে কথা বলতে ভালো লাগে!
ফারিহা যখনই ভাবে আয়ানের থেকে দূরে সরে যাবে,আয়ানের সাথে আর যোগাযোগ রাখবে না ঠিক তখনই আয়ান ফারিহার সামনে এসে ফারিহার মনটা নাড়িয়ে দে।ফারিহা আয়ানের থেকে দূরে গিয়েও মন থেকে আয়ানকে সরাতে পারছে না।
ফারিহা,নওশীন আর শিহাব ক্যাম্পাসের মাঠে ঘাসের উপর বসে আছি।নওশীন আর শিহাব কথা বলছে কিন্তু ফারিহা অন্যমনস্ক হয়ে বসে আছে দেখে নওশীন ফারিহার কাঁধে ধাক্কা দিয়ে বললো,
“এই ফারিহা কি ভাবছিস?”
নওশীনের ধাক্কায় ফারিহা হুস আসলো।তারপর নওশীনের দিকে তাকিয়ে একটু হেসে বললো,
“না না কিছু না। কিছু বলছিলি?”
নওশীন কোমড়ে হাত রেখে বললো, “আমি তখন থেকে কথা বলে যাচ্ছি আর তুই কিছু শুনিস নি?”
“তোদের প্রেমের কথা শুনে আমি কি করবো বল? আমি তো চাইছিলাম না তোদের মধ্যে এখানে বসে থাকতে।তুই তো জোর করে আনলি”
শিহাব বললো, “ফারিহা এটা কিন্তু ঠিক হচ্ছে না। আমরা প্রেম করছি তাই বলে তুই আমাদের থেকে আলাদা হবি কেন?তুই আমাদের সাথেই বসে কথা বলবি।আগে তুই পরে বাকি সব”
ফারিহা একটু দুষ্টু হেসে বললো, “শিহাব আমি তো তোর ফ্রেন্ড।ফ্রেন্ডকে গার্লফ্রেন্ডের থেকে বেশি গুরুত্ব দিলে কিন্তু গার্লফ্রেন্ড ব্রেকআপ করে দিবে”
নওশীন বোকা হেসে বললো, “বলেছে তোকে?উল্টো ও যদি তোকে ইগনোর করে তাহলে আমি ওর সাথে ব্রেকআপ করে দেবো। আমাদের দুজনের কাছে তুই সবার আগে”
“হয়েছে হয়েছে,,এবার বল কি বলছিলি?”
নওশীন এবার আসন পেতে বসে ফারিহার সাথে বকবক করা শুরু করলো।নওশীন আর শিহাবের এখন রিলেশন চলছে।ওদেরকে এক করতে ফারিহার অবদানই সবচেয়ে বেশি।ফারিহা তো ভেবে নিয়েছিল এই দুটো কখনো নিজের মনের কথা বুঝতে পারবে না।নওশীনকে ভার্সিটির এক বড় ভাই প্রোপোজ করেছিল কিন্তু নওশীন তো শিহাবকে মনে মনে পছন্দ করে তাই রিজেক্ট করে দে।কিন্তু ফারিহা এই সুযোগে নওশীনের সাথে প্ল্যান করে যে,নওশীন ওই বড় ভাইয়ের প্রপোজ একসেপ্ট করবে তখন শিহাবের কি রিয়েকশন হয় দেখার জন্য।ফারিহার কথায় নওশীন রাজি হয়ে যায়।
যদিও আসলে নওশীন প্রপোজ একসেপ্ট করেনি কিন্তু ফারিহা শিহাব কে বলেছে যে নওশীন প্রপোজ একসেপ্ট করেছে।সব শুনে তো শিহাব রেগে যায়। তখন নওশিনের কাছে গিয়ে বলে,ওই বড় ভাইয়ের সাথে ব্রেকাপ করতে ও নওশীনকে ভালবাসে।নওশীন সেদিন খুশিতে কান্না করে দিয়েছিল।শিহাবও নওশীনকে জড়িয়ে ধরে কান্না করেছে। বেস্ট ফ্রেন্ড কে নিজের করে নেওয়া মানে জীবনের অর্ধেক সফলতা অর্জন করা।
ফারিহা ও সেদিন দূর থেকে দাঁড়িয়ে চিকচিক করা চোখে ওদের ভালোবাসা দেখেছে। তারপর থেকেই আজকে দুই মাস ওদের ভালোবাসা যেন দিন দিন বাড়ছে।শিহাব আর নওশীনকে দেখলেই ফারিহার আয়ানের কথা মনে পড়ে।তাই মাঝে মাঝেই অন্যমনস্ক হয়ে আয়ানের কথা ভাবতে বসে।কিন্তু নওশীন বেশিক্ষণ ফারিহাকে আয়ানের কথা ভাবতে দে না।নওশীন আর শিহাব সবসময় ফারিহার খেয়াল রাখে।ফারিহাকে হাসিখুশি রাখার চেষ্টা করে।ফারিহা সত্যিই লাকি এমন দুজন বেস্ট ফ্রেন্ড পেয়ে।
ওরা অনেকক্ষণ আড্ডা দিয়ে ফারিহা ক্লাস শেষে বাড়ি ফিরে আসে।আর নওশীন শিহাব রেস্টুরেন্টে যায়।ফারিহা প্রতিদিন রেস্টুরেন্টে যাই কিন্তু আজকে শরীর ভালো লাগছে না তাই বাসায় ফিরে যাচ্ছে।ফারিহা আবার সেই আগের মত স্বাধীনভাবে চলাফেরা করে।এতকিছুর পরে মিস্টার আজাদ ফারিহাকে নিয়ে ভয়ে ছিলো।চেয়েছিল ফারিহার সাথে বডিগার্ড দিতে।কিন্তু ফারিহা বারণ করেছে বলেছে, ও স্বাধীনভাবে চলাফেরা করতে চায় তাহলে হয়তো ভালো থাকবে।তাই মিস্টার আজাদ আর বারণ করেনি।ফারিহা ওর স্কুটি টা দিয়েই ভার্সিটিতে আসা-যাওয়া করে।
বাসায় এসে ব্যাগটা রেখে ফারিহা ড্রয়িংরুমে সোফায় বসে তারপর জোরে জোরে হনুফা বেগম কে ডাকতে থাকে।হনুফা বেগম কিচেন থেকে এসে দেখে ফারিহা সোফায় হেলান দিয়ে বসে আছে।হনুফা বেগম কে দেখে ফারিহা ক্লান্ত মুখে হেঁসে বললো,
“মনি মাথাটা ঘুরাচ্ছে।একটু লেবুর শরবত বানিয়ে দাও তো”
ফারিহার কথা শুনে হনুফা বেগম হন্তদন্ত করে এসে ফারিহার কাছে বসে বললো,
“সে কি!মাথা ঘুরাচ্ছে কেন?তুই অসুস্থ বলিস নি তো”
ফারিহা একটু হেসে বললো, “মনি এত অস্থির হচ্ছো কেনো?আমি ঠিক আছি।রোদ থেকে আসছি তো তাই মনে হয় মাথা ঘুরাচ্ছে”
হনুফা বেগম শাড়ির আঁচল দিয়ে ফারিহার মুখের ঘাম মুছে দিতে দিতে বললো, “কতবার বলেছি এত কাজ করিস না। ভার্সিটি,রেস্টুরেন্ট, অনাথাশ্রম এত কিছু একসাথে সামলাশ কিভাবে?”
“এই দেখো!মনিইই সামান্য একটু মাথা ঘুরাচ্ছে।তুমি অস্থির হয়ে পড়লে!আমি ঠিক আছি তোমাকে বলাই ভুল হয়েছে”
“তুই বুঝবি নারে মা।আমার অনেক চিন্তা হয় তোর জন্য।আচ্ছা তুই তাড়াতাড়ি উপর গিয়ে ফ্রেশ হয়ে নে।আমি লেবুর শরবত আনছি,খেলে ভালো লাগবে”
ফারিহা ক্লান্ত মুখে হেসে ব্যাগ নিয়ে উপরে চলে যায়। এই 2 মাসে ফারিহা যতসম্ভব নিজেকে কাজের মধ্যে নিজেকে ডুবিয়ে রাখার চেষ্টা করেছে।একা থাকলেই আয়ানের কথা মনে পড়ে।ভার্সিটিতে পড়াশোনা, রেস্টুরেন্টে কাজ তো আছেই ছুটির দিনে ফারিহা অনাথ আশ্রম এ চলে যায়।সেখানে বাচ্চাদের সাথে সময় কাটালে মন ভালো থাকে।আর রিমঝিমকে পেলে তো ফারিহা অন্য সবকিছু ভুলে যায়।অনাথ আশ্রমের যতক্ষণ থাকে ততক্ষণ আয়ানকে ভুলে থাকতে পারে।তাই ফারিহার যখনই আয়ানের জন্য বেশি মন খারাপ হয় তখনই ওই বাচ্চাদের মাঝে আনন্দ খুঁজে নে।
ফারিহা ফ্রেশ হয়ে ওয়াশরুম থেকে বেরিয়ে দেখল হনুফা বেগম লেবুর শরবত নিয়ে ওর রুমে আসছে। ফারিহা হনুফা বেগমের হাত থেকে গ্লাসটা নিয়ে গ্লাসে চুমুক দিলো।হনুফা বেগম ফারিহার মাথায় হাত বুলিয়ে বললো,
“তাড়াতাড়ি নিচে আয়।আমি দুপুরের খাবার দিচ্ছি”
“না না মনি।আমি ভার্সিটির ক্যান্টিনে শিহাব আর নওশীনের সাথে খেয়েছি এসেছি”
“খাস তো কি সব বাহিরে আজেবাজে খাবার।তার জন্যই তো শরীর খারাপ হয়। দুপুরে ভাত না খেলে চলে নাকি?”
হনুফা বেগম বলা হয় শুরু করেছে ফারিহা কোন দিন দুপুরে বাসায় খাবার খেতে চায় না।প্রতিদিন ভার্সিটি থেকে বাহিরের খাবার খেয়ে আসে।আজকে মিস্টার আজাদের কাছে ফারিহার নামে নালিশ করবে।এসব শুনতে শুনতে ফারিহা লেবুর শরবত শেষ করলো।তারপর হেসে বললো,
“আচ্ছা আচ্ছা ঠিক আছে।বেশি খাবো না অল্প কিন্তু তোমাকে খায়িয়ে দিতে হবে”
হনুফা বেগম হেসে বললো, “ঠিক আছে আমি খায়িয়ে দিবো”
ফারিহা হনুফা বেগমের সাথে নিচে যায়। হনুফা বেগম খাবার বেড়ে ফারিহাকে নিজের হাতে তুলে খাইয়ে দে।
রাতে মিস্টার আজাদ বাড়িতে এলে ফারিহা মিস্টার আজাদের সাথে অনেকক্ষণ গল্প করে।মিস্টার আজাদ সবসময় ফারিহার মন ভালো রাখার চেষ্টা করে।কখনও আয়ানের কথা বলে না।আয়ান অনেকবার মিস্টার আজাদের অফিসে গিয়েছিল কিন্তু মিস্টার আজাদ ফারিহাকে বলেনি।মিস্টার আজাদ আর ফারিহা প্রতিদিন একসাথে ডিনার করি আজকের ডিনার করে।আজকেও ডিনার করে ফারিহা ওর রুমে চলে আসে।বিছানায় শুয়ে ফারিহা একদৃষ্টিতে উপরে দেয়ালের দিকে তাকায়।প্রতিদিনের মত আজকে রাতেও আর ঘুম আসবে না।সারারাত আয়ানের কথা ভাবতে ভাবতে হয়তো ভোরের দিকে চোখ লেগে আসবে।
.
সকালে মিস্টার আজাদ ব্রেকফাস্ট টেবিলে বসেই হনুফা বেগম কে বললো,
“কি হলো ফারিহা আসছে না কেনো?”
হনুফা বেগম মিস্টার আজাদকে নাস্তা দিতে দিতে বললো, “ফারিহা এখনো ঘুমোচ্ছে”
মিস্টার আজাদ চমকে উঠে চিন্তিত মুখে বললো,
“ঘুমাচ্ছে মানে?ওতো অনেক সকালে ঘুম থেকে উঠে পড়ে।আজকে এখনো ঘুমাচ্ছে কেনো?ফারিহা শরীর খারাপ?”
হনুফা বেগম চিন্তিত মুখে বললো, “জানিনা ওর কি হয়েছে!কালকে রাতে ডিনার করে রুমে যাওয়ার পর বমি করেছে। আবার গত কালকে দুপুরে ভার্সিটি থেকে এসে বলছে ওর নাকি মাথা ঘুরাচ্ছে।আমার মনে হয় ওকে একটা ভালো ডাক্তার দেখানো উচিত”
মিস্টার আজাদ অবাক হয়ে বললো, “কি বলছো এসব?ফারিয়ার শরীর খারাপ আর তুমি আমাকে এতক্ষণে জানাচ্ছো?”
“স্যার আমিও তো জানতাম না ফারিহা আমাকে বলেনি।কালকে খেয়াল করে দেখলাম ওর যখন তখন মাথা ঘুরায়।আর আমি যদি রাত্রে ওর রুমে পানি দিতে না যেতাম তাহলে ও যে বমি করেছে দেখতে পেতাম না।আর ফারিহা আমাকে কিছু বলে না”
মিস্টার আজাদ কিছু বলতে যাবে তখন দেখে ফারিহা সিঁড়ি দিয়ে নামছে।ফারিহার ক্লান্ত চোখ মুখ দেখে মিস্টার আজাদ অবাক হয়।উনি নিজে নিজেকে ধিক্কার দেয় কাজের ফাঁকে মেয়েটা খেয়াল রাখতে পারেনা!
ফারিহা ব্রেকফাস্ট টেবিলে এসে চেয়ার টেনে বসে হাসিমুখে মিস্টার আজাদ কে গুড মর্নিং জানালো। মিস্টার আজাদ কিছুক্ষণ ফারিহাকে দেখে তারপর গম্ভীর মুখে বললো,
“কতদিন ধরে তোমার শরীর খারাপ? আর আমাদের কিছু বলো না কেনো?”
ফারিহা ভীত চোখে হনুফা বেগমের দিকে তাকালো। ফারিহা বুঝে গিয়েছে যে হনুফা বেগম মিস্টার আজাদ কে সব বলে দিয়েছে।মিস্টার আজাদ রেগে গেলে ফারিহাকে তুমি করে বলে।ফারিহা নিচের দিকে তাকিয়ে মিস্টার আজাদ কে বললো,
“কিছু না বাপি।সামান্য কারণে কালকে একটু মাথা ঘুরেছে”
“আর রাতে বমি করলে কেনো?”
ফারিহা জোরপূর্বক হেসে বললো, “আরে বাপি কালকে একটু বেশি খেয়ে ফেলেছিলাম তাই বমি হয়েছে।তুমি চিন্তা করো না তো”
“চিন্তা করবোন না মানে?তোমার শরীর খারাপ আর তুমি আমাদের বলছো চিন্তা না করতে?”
“তার জন্য তোমাদেরকে কিছু জানাতে চাই না।শুধু শুধু আমাকে নিয়ে বেশি চিন্তা করো।খাও তো তোমার দেরি হচ্ছে?”
মিস্টার আজাদ কিছু বলতে যাবে তখন ফারিহা তাড়াহুড়ো করে হনুফা বেগম কে বললো,
“মনি তাড়াতাড়ি খাবার দাও আমার ভার্সিটিতে দেরি হয়ে যাচ্ছে”
মিস্টার আজাদ কিছুক্ষণ ফারিহাকে দেখে কিছু না বলে খাবার খাওয়ায় মন দিল।ফারিহা অর্ধেক খেয়ে চুপচাপ বসে আছে দেখে হনুফা বেগম বললো,
“কি?খাচ্ছিস না কেনো?”
ফারিহা জোরপূর্বক হেসে বললো, “আসলে মনি ভালো লাগছে না।আর খাবো না”
হনুফা বেগম মিস্টার আজাদকে বললো, “দেখলেন তো স্যার!আমি বললাম না, ওর শরীর খারাপ। দেখেছেন এখম খাবারটাও খাচ্ছে না”
ফারিহা বুঝে গিয়েছে এখন মিস্টার আজাদ আর হনুফা বেগম মিলে ওকে বকাবকি শুরু করবে।ফারিহা মেকি হেসে চেয়ার থেকে উঠে বললো,
“আমার দেরি হয়ে যাচ্ছে আমি গেলাম।টাটা..”
মিস্টার আজাদ খাবার রেখে বললো, “ফারিহা শোন ফারিহা..”
ফারিহা কিছুদুর গিয়ে হঠাৎ মাথায় হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে পরল। মিস্টার আজাদ তাড়াতাড়ি করে চেয়ার থেকে উঠে দৌড়ে গিয়ে ফারিহাকে ধরল। তারপর তাকিয়ে দেখে ফারিহা অজ্ঞান হয়ে গিয়েছে।
মিস্টার আজাদ ফারিহা গালে হালকা থাপ্পড় দিয়ে ডাকছে।হনুফা বেগম হন্তদন্ত করে ফারিহার কাছে আসলো।
চলবে….