স্রোতের টানে পর্ব-৪০

0
4166

#স্রোতের_টানে
লেখিকা:#Tarin_Niti
পর্ব:৪০

কেটে গেছে এক সপ্তাহ ফারিহা এখন একটু সুস্থ আছে।তাই আগের মতো ভার্সিটিতে আসা-যাওয়া করে।তবে এখন মিস্টার আজাদ ফারিহাকে প্রতিদিন রেস্টুরেন্টে যেতে দেয় না।আর তাছাড়া ফারিহা স্কুটি দিয়ে চলাফেরা করেও না।মিস্টার আজাদের কঠিন আদেশ রয়েছে এখন এই রোদের মধ্যে স্কুটি দিয়ে ভার্সিটিতে আসা-যাওয়া করা চলবে না।ফারিহাকে প্রতিদিন ওদের বাড়ির ড্রাইভার ভার্সিটিতে দিয়ে আসে,আবার নিয়েও আসে।ফারিহা মিস্টার আজাদের কথার উপর কিছু বলতে পারেনি সব মেনে নেয়।আর আয়ান তো এখন আরো পাগল হয়ে গিয়েছে।প্রতিদিন ফারিহাদের বাড়িতে যায়
ফারিহার সাথে দেখা করার জন্য।বলতে গেলে
এখন আয়ান নিজের বাড়িতে খুব কমই থাকে।ফারিহাদের বাড়িটাই ওর নিজের বাড়ি মনে করে যখন তখন গিয়ে ফারিহার সামনে হাজির হয়।মিস্টার আজাদ একবার আয়ানকে বারণ করেছিল এভাবে যখন তখন ফারিহার কাছে না আসতে।কিন্তু কে শোনে কার কথা!আয়ান মিস্টার আজাদের কথায় পাত্তা না দিয়ে সেই আগের মতই প্রতিদিন ফারিহার সাথে দেখা করতে আসে।মিস্টার আজাদ কিছু বলতে পারে না শুধু বসে বসে আয়ানের পাগলামি দেখে।
ফারিহা,নওশীন আর শিহাব কথা বলতে বলতে ভার্সিটি থেকে বের হচ্ছে।নওশীন আর শিহাব ভার্সিটিতে ফারিহার অনেক খেয়াল রাখে।ফারিহার সত্যি মাঝে মাঝে নিজেকে পৃথিবীর সবচেয়ে সুখী মানুষ মনে হয়।বাড়িতে মিস্টার আজাদ আর হনুফা বেগম ওর প্রচুর খেয়াল রাখে।আর আয়ান তো আছেই।আর ভার্সিটিতে নওশীন শিহাব,সবাই ফারিহাকে কত ভালবাসে!তবে এতো কিছুর মাঝেও ফারিহা ওর মাম্মাকে খুব মিস করে আচ্ছা।ফারিজা যখন ওর মাম্মার পেটে ছিল তখন পর মাম্মার কি রকম অনুভূতি হতো ফারিহার খুব জানতে ইচ্ছে করে।প্রতিটা মেয়েই এই সময় মাকে পাশে চায়।ফারিহা ভাগ্যে মা না থাকলেও হনুফা বেগম ওকে কখনো মায়ের অভাব বুঝতে দেয় না।সবসময় ফারিহার পাশে পাশে থাকে।

ফারিহা,নওশীন শিহাব গেটের বাইরে এসে দাঁড়ায়। ফারিহা চলে গেলে তারপর নওশীন আর শিহাব রেস্টুরেন্টে যাবে।ফারিহা দাঁড়িয়েছে তখন পিছন থেকে কেউ ওর নাম বলে উঠলো,

“আরে তুমি ফারিহা না?”

অচেনা কণ্ঠ শুনে ফারিহা পেছনে তাকালো।পেছনে ফিরে দেখে হিমেল পকেটে হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে।ফারিহা অবাক চোখে হিমেলের দিকে তাকালো।হিমেল দু’কদম এগিয়ে ফারিহার সামনে এসে বললো,

“হেই আমাকে চিনতে পারছোনা?ওই যে কক্সবাজারে পার্টিতে দেখা হয়েছিল”

ফারিহা হিমেলকে দেখেই চিনতে পেরেছে।তাই একটু হেসে বললো, “হুম চিনছি”

ফারিহার কথা শুনে হিমেল হেসে বললো,
“তুমি এখানে?এখানে এসে তোমার সাথে দেখা হবে আশা করিনি”

ফারিহা একটু হেসে বললো, “আমি এই ভার্সিটিতেই পড়াশোনা করি”

নওশীন আর শিহাব অবাক চোখে হিমেলের দিকে তাকালো।তারপর নওশীন ফারিহাকে জিগ্যেস করলো,
“ফারিহা উনি কে?”

নওশীনের কথা শুনে হিমেল একটু জোরে হাসলো।তারপর বললো,
“ফারিহা কি বলবে?আমি কে?তোমার হাজবেন্ডের শত্রু?”

হিমেলের কথা শুনে নওশীন ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে কিছু বলতে যাবে তখনই হিমেল আবাস বললো,
“আসলে আমি আর আয়ান বিজনেস পার্টনার ছিলাম।একটা কারণে আয়ানের সাথে আমার ঝামেলা হয়েছে সেই থেকে ও আমাকে শত্রু মনে করে,তবে আমি আয়ানকে কখনো শত্রু ভাবি না। আর তাছাড়া সবচেয়ে বড় কথা হল কক্সবাজারে পার্টি তে আমি একটু ড্রাংক ছিলাম তাই হয়তো ফারিহাকে কিছু বলেছিলাম।যার জন্য আয়ান এখন আমাকে ওর সবচেয়ে বড় শত্রু মনে করে।হাহাহা….”

হিমেলের কথা শুনে নওশীন আর শিহাব সবটা বুঝতে পারলো।ফারিহা একটু হেসে বললো,
“না না ব্যাপারটা সেরকম নয়।”

“সেরকমই!তুমি জানোনা তোমার নামে কেউ কিছু বললে আয়ান তাকে আস্ত রাখেনা।আর আমি তো মাতাল হয়ে কিনা কি বলেছিলাম।ভাগ্যিস আয়ান আমাকে মেরে ফেলেনি!”

কথাটা বলে হিমেল জোরে জোরে হেসে দিলো।ফারিহা হিমেলের কথা শুনে মুচকি হাসছে।আয়ান ভার্সিটিতে এসে দেখি দূরে দাড়িয়ে ফারিহা একটা ছেলের সাথে মুচকি মুচকি হেসে কথা বলছে।এটা দেখে আয়ান রেগে বড় বড় পা ফেলে কাছে গিয়ে দেখে ছেলেটা হিমেল!
আয়ান হিমেলের কাছে গিয়ে ঝাড়ি দিয়ে বললো,

“তুই এখানে?আর ওর সাথে কি কথা বলছিস?”

আয়ানের ঝাড়ি খেয়ে হিমেল হাসি থামিয়ে দিলো।
তারপর বললো,
“এখানে একটা কাজে এসেছিলাম তখন দেখলাম তোর বউ।তাই একটু কথা বলছিলাম”

“তোকে আমি কক্সবাজারেই বলে দিয়েছি ফারিহার থেকে দূরে থাকবি।আবার ওর সাথে কি কথা বলছিস?”

হিমেল একটু দুষ্টুমি করে বললো, “আরে তোর বউকে আমি নেবো না।আমি তো তোর বউয়ের বান্ধবীর কথা বলছিলাম।”

হিমেলের কথা শুনে নওশীনের মুখ হা হয়ে গেল।আর এদিকে শিহাব তো রেগে গেল।তারপর রেগে বললো,
“হেই ইউ ওর দিকে নজর দিবে না ও আমার।”

হিমেল মুখে হাত দিয়ে বললো, “এখানে তো দেখছি সব বুকিং!”

“তুই আর মেয়ে পাস না?আমার বউ আর ওর বান্ধবীর কাছেই আসতে হলো?”

হিমেল হেসে বললো, “আরে ভাই রেগে যাচ্ছিস কেনো?এই তুই কি আমাকে সারাজীবন শত্রু ভাববি নাকি?আমি কিন্তু আজকে ফারিহার সাথে উল্টাপাল্টা কোন কথা বলিনি জিজ্ঞেস কর”

আয়ান ফারিহার দিকে তাকালে ফারিহা বললো,
“হ্যাঁ উনি আজকে আমাকে অন্য কিছু বলেনি।ভালো কথাই বলছিলো।”

“ভালো হোক বা খারাপ হোক।তুমি কোন ছেলের সাথে কথা বলবে না!”

হিমেল মাথা দুলিয়ে হেসে বললো, “ফারিহা দেখেছো?তোমার হাজব্যান্ড তোমাকে কত ভালবাসে!যয়ইহোক আয়ান তুই রাগ করিস না আমি ফারিহাকে কক্সবাজারের করা ব্যবহারের জন্যে সরি বলতে এসেছি।আসলে ফারিহাকে এখানে দেখবো ভাবি নি,তাই দেখা যখন হয়ে গিয়েছে তাই ভাবলাম সরি বলে দিই”

আয়ান গম্ভীর মুখে বললো, “সরি বলা শেষ হয়েছে?

ফারিহার সাথে একটু কথা বলছে দেখে আয়ানের এতো রাগ!হিমেল মুচকি হাসছিলো তারপর কিছু বলতে যাবে তখন একটা মেয়ে এসে হিমেলকে বললো,
“হিমেল ভাইয়া”

মেয়েটাকে দেখে হিমেলের হাসি প্রসারিত হলো।তারপর মেয়েটার হাত ধরে ফারিহার কাছে এনে বললো,
“ফারিহা ও নীলা,আমার মামাতো বোন।এই ভার্সিটিতে পড়ে ওকে নিতেই এসেছিলাম”

ফারিহা হেসে নীলার সাথে পরিচিত হলো।তারপর আয়ানের দিকে বাঁকা চোখে তাকিয়ে আয়ানকে শুনিয়ে শুনিয়ে বললো, “আর হ্যাঁ ওর আরো একটা পরিচয় আছে,ও আমার হবু স্ত্রী।কিছুদিন আগে আমাদের এনগেজমেন্ট হয়েছে।আমি অন্য কারো বউ নিয়ে টানাটানি করি না”

শেষের কথাটা শুনে আয়ান রাগী চোখে হিমেলের দিকে তাকালো।তবে নীলা হিমেলের হবু স্ত্রী শুনে আয়ানের রাগ কিছুটা কমেছে।হিমেল নওশীনের দিকে তাকিয়ে হেসে বললো,
“আর তোমার সাথে মজা করছিলাম কিছু মনে করো না।তোমার বয়ফ্রেন্ড তো আরেকটু হলে আমাকে মারতে আসতো।তোমরা দুই বান্ধবীই দুটো পাগল লাইফ পার্টনার পেয়েছো।হাহাহা…”

নীলা চোখ ছোট ছোট করে বললো, “তুমি ওনাদের সাথে কি মজা করেছো?”

হিমেল হেসে বললো, “যেতে যেতে বলছি আসো”

তারপর হিমেল আর নীলা ফারিহাদের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে চলে গেল।হিমেল চলে গেলে আয়ান ফারিহার হাত ধরে বললো, “চলো।”

ফারিহা বুঝে গিয়েছে এখন না বললেও আয়ান শুনবে না।আজকে আয়ানই ওকে বাসায় পৌঁছে দেবে তাই নওশীন আর শিহাবকে বলে চুপচাপ আনের সাথে যেতে লাগলো।
শিহাব আর নওশীন যেখানে শিহাবের বাইক পার্ক করা সেদিকে এগুলো।শিহাব হঠাৎ শিহাব নওশীনের হাত ধরল।নওশীনের নামে কেউ কিছু বললে ওর রাগ উঠে যায় আর এই ছেলে তোর নওশীনের সাথে ফ্লার্টিং করছিল!নওশীনকে যে শিহাব ওর জীবনের থেকেও বেশি ভালোবাসে আর নওশীন একবার শিহাবের দিকে আরেকবার শিহাবের ধরা পর হাতের দিকে তাকিয়ে মুচকি মুচকি হাসছে।

গাড়িতে বসে আয়ান গাড়ি স্টার্ট দিল।এখন আর এখন আয়ানের একটুও রাগ নেই একদম শান্ত হয়ে গিয়েছে।ফারিহা একটু এদিক-ওদিক তাকিয়ে তারপর বললো,
“আপনি হিমেল ভাইয়ার সাথে এরকম ভাবে কথা বলেন কেনো?”

আয়ান ড্রাইভ করতে করতে বললো “তো কিভাবে কথা বলবো?তুমি একটা ছেলের সাথে মুচকি মুচকি হেসে কথা বলছিলে দেখে রাগ উঠে গিয়েছিল ”

আয়য়নের কথা শুনে ফারিহা ফিক করে হেসে দিল।আয়ান ফারিহার দিকে তাকিয়ে বললো, “আজব!হাসছো কেনো?”

ফারিহা হাসি থামিয়ে বললো, “না এমনিই।আচ্ছা আমি কোন ছেলের সাথে কথা বলতে পারবো না!তাহলে শিহাবের সাথে যে কথা বলি?”

আয়ান একটু হেসে বললো, “শিহাব তো তোমার বেস্ট ফ্রেন্ড।আর আমি জানি শিহাব সবসময় তোমাকে বোনের মত ভালবাসে।তাই ওর সাথে কথা বললে কোন সমস্যা নেই কিন্তু আর কোন ছেলের সাথে তুমি কথা বলতে পারবে না!”

ফারিহা হেসে বললো, “আপনি না পাগল একটা”

আয়ান ড্রাইভ করতে করতে মুচকি হেসে বললো,
“হুম তোমার জন্য”

ফারিহা মুচকি হেসে বাইরের দিকে তাকালো।তারপর কিছুক্ষণ পরে বললো, “যাই বলেন হিমেল ভাইয়া কিন্তু অতোটা খারাপ না!”

“হুম জানি কিন্তু মেয়েদের সাথে ফ্লার্টিং করতে ওস্তাদ।তোমার সাথেও মজা করতে চেয়েছিল রাগি স্বরে কথা না বলে সোজা পথে আসতো না।”

আয়ানের কথা শুনে ফারিহা মুচকি হাসলো।কিছুক্ষণ আয়ান ড্রাইভ করতে করতে বললো,
“আমার বেবি কেমন আছে?”

আয়ানের কথা শুনেই ফারিহা চমকে উঠলো।আয়ান এমনভাবে বলছে মনে হচ্ছে যেন বেবি ফারিহার কোলে!ফারিহা ওর পেটে এক হাত রেখে বললো,
“হ্যাঁ আপনার বেবি অনেক ভালো আছে।”

“যতদিন আমার বেবি পৃথিবীতে না আসছে ততদিন তুমি ওর খেয়াল রাখবে!”

আয়ানের পরের কথাটা শোনার জন্য ফারিহা প্রশ্ন করলো, “আর পৃথিবীতে আসার পর?”

“তখন আমার বাচ্চার মা কে রানীর মত সিংহাসনে বসিয়ে রাখবো আর আমি বাচ্চাকে সামলাবো।”

আয়ানের কথা শুনে ফারিহা একপ্রকার জোরে হেসে দিল।যেদিন থেকে শুনেছে ফারিহা মা হতে চলেছে সেদিন থেকে আয়ানের সব পাগলামি দেখে আসছে।ফারিহার এসব ভালোই লাগে।অবাক চোখে দেখল পৃথিবীতে আসার আগেই আয়ান নিজের বাচ্চার কতো খেয়াল রাখছে।আয়ান সত্যি খুব ভালো বাবা হবে।

চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here