#স্রোতের_টানে
লেখিকা:#Tarin_Niti
পর্ব:৪১
ফারিহা আর মিস্টার আজাদ গাড়িতে বসে আছে।ওরা আজকে অনাথ আশ্রমে যাচ্ছে।প্রেগনেন্ট হওয়ার পর থেকে ফারিহা বেশি অনাথ আশ্রমে যেতে পারেনি,মাসে একবার কি দুইবার যেতো।আজকে অনেকদিন পর যাচ্ছে।
ফারিহার এখন পাঁচ মাস চলছে,পেটটা একটু উঁচু হয়েছে।বাচ্চা পেটে আসার পর থেকেই ফারিহা যেন দিন দিন আরো সুন্দর হচ্ছে দেখতে গুলোমুলো হয়েছে। অনেকদিন পর সব বাচ্চাদের সাথে দেখা হবে ফারিহা অনেক খুশি লাগছে।অনাথ আশ্রমের সামনে এসে গাড়ি থামলে মিস্টার আজাদ ফারিহাকে ধরে গাড়ি থেকে নামালো।তারপর উনার লোকদের বলে বাচ্চাদের জন্য চকলেট গুলো নিয়ে আসতে।ফারিহা আশ্রমে ভেতরে ঢুকে একটু অবাক হয় কারন সামনের মাঠে কেউ নেই!অন্য সময় ফারিহা আসলে বাচ্চারা দৌড়ে ওর কাছে চলে আসতো।আগে এসে দেখতো বাচ্চারা সামনের মাঠে ঘাসে বসে আছে অথবা খেলছে।ফারিহা অবাক চোখে চারদিকে তাকিয়ে মিস্টার আজাদকে কে বললো,
“বাপি বাচ্চাদের কোন আওয়াজ শোনা যাচ্ছে না কেনো?”
মিস্টার আজাদ বললো, “জানি না তো,ভিতরে চল।”
ফারিহা ভিতরে গিয়ে দেখল কয়েকটা মহিলা বাচ্চাদের রান্নার ব্যবস্থা করছে আজ ঝুমা আন্টি সব দেখিয়ে দিচ্ছে।ফারিহা ঝুমা আন্টির কাছে গিয়ে বললো,
“আন্টি বাচ্চারা সব কোথায়?”
ঝুমা আন্টি পেছনে ফিরে ফারিহা দেখে হাসি প্রশস্ত হলো।তারপর তাড়াতাড়ি করে এসে ফারিহাকে ধরে বললো, “আরে তুই?এতদিন পর!দাঁড়িয়ে আছিস কেনো বস বস”
ফারিহা একটু হেসে বললো, “না না বসবো না দাঁড়িয়ে ঠিক আছি।কিন্তু আন্টি বাচ্চারা কই?”
“বাচ্চারা সবাই পেছনের মাঠে খেলছে”
ফারিহা একটু অবাক হলো সবাই ওখানে!ফারিহা জানে বাচ্চারা পেছনের মাঠে খেলাধুলা করে কারন পেছনের মাঠটা অনেক বড়।কিন্তু তাই বলে সবাই একসাথে?ফারিহা বললো,
“সবাই একসাথে খেলতে গিয়েছে?কোনো আয়োজন করেছে নাকি?”
ঝুমা আন্টি একটু হেসে বললো, “আরে না,আসলে আয়ান এসেছে তো তাই বাচ্চারা সব ওর সাথেই আছে!”
মিস্টার আজাদ একটু অবাক হয়ে বললো, “আয়ান এখানে?”
ঝুমা আন্টি হেসে মিস্টার আজাদ কে বসতে দিয়ে বললো, “হ্যাঁ আয়ান তো এখন প্রায় সময়ই এখানে আসে।আগে ফারিহা সপ্তাহে একবার হলেও আসতো আর এখন আয়ান আসে।বাচ্চারা সবাই আয়ানের ভক্ত হয়ে গিয়েছে।আয়ান আসলে সব আয়ানের সাথে খেলার জন্য বায়না করে”
ঝুৃমা আন্টির কথা শুনে ফারিহা একটু অবাক হলো কারণ ফারিহা জানতো না যে আয়ান এখানে আসে।ফারিহা মিস্টার আজাদকে বললো, “বাপি চলো পিছনের মাঠে যাই”
মিস্টার আজাদ মাথা নেড়ে সম্মতি জানাল।তারপর মিস্টার আজাদ,ফারিহা আর ঝুমা আন্টি পেছনের মাঠে আসলো।এসে দেখে আয়ান বাচ্চাদের সাথে ফুটবল খেলছে।
আয়ানের পরনে একটা ব্ল্যাক টি শার্ট আর গ্রে কালারের থ্রি কোয়াটার প্যান্ট।ফুটবল নিয়ে দৌড়াচ্ছে আর হাসছে,সামনের চুলগুলো হাওয়ার তালে তালে উড়ছে।বাচ্চারাও আয়ানের সাথে সাথে ফুটবলের পেছনে দৌড়াচ্ছে।রিমঝিম সহ আরো ওর সমান ছোট ছোট বাচ্চারা পাশে দাঁড়িয়ে লাফাচ্ছে আর হাততালি দিচ্ছে।এই দৃশ্য দেখে ফারিহার মুখে হাসি ফুটে উঠলো।মিস্টার আজাদ ও অবাক চোখে আয়ানকে দেখছে।মিস্টার আজাদের এখন আয়ানের প্রতি রাগ অনেকটাই কমে এসেছে।কারণ এই তিন মাসে আয়ান ফারিহার যথেষ্ট খেয়াল রাখতো।আয়ান পদে পদে বুঝিয়েছে যে ও ফারিহাকে কত ভালোবাসে।মিস্টার আজাদ তো।মেয়ে জীবনসঙ্গী হিসেবে এরকম একটা ছেলেই চেয়েছিলো।
ওরা দাঁড়িয়ে থেকে দেখছে তখন ঝুমা আন্টি হেসে বললো,
“দেখলে তো বাচ্চার আয়ানের সাথে কিভাবে মিশে গিয়েছে?আয়ান যখনই আসে ওদের মনে হয় ঈদের আনন্দ হয়।সবসময় আয়ানের সাথে খেলাধুলা, পিকনিক করা মজা করা তো আছেই।আয়ান কখনো কিছুদিন পর আসতে দেরি হলে বাচ্চারা সব আমাকে পাগল করে দে আয়ান আসছে না কেন বলে বলে।”
ফারিহা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে আয়ান আর বাচ্চাদেরকে দেখছে আর ঝুমা আন্টির কথা শুনছে মুচকি হাসছে।খেলতে খেলতে আয়ানের হঠাৎ ফারিহার দিকে চোখ যায়।আয়ান খেলা থামিয়ে দাঁড়িয়ে পড়ে। আয়ান খেলা থামিয়ে দিয়ে তাকিয়ে আছে দেখে বাচ্চারাও সেদিকে তাকায়।তারপর ফারিহাকে দেখে খেলা রেখে সব ফয়রিহার দিকে ছুটে আসে।বাচ্চারা এই দিকে দৌড়ে আসছে দেখে ফারিহা একটু নিচু হয়ে বসলো।এখনো ফারিজা পেট বেশি বড়ো হয়নি তাই বেশি সমস্যা হলো না।বাচ্চারা সবাই এসে ফারিহাকে জরিয়ে ধরলো।ফারিহাও ওদেরকে জড়িয়ে ধরে।বাচ্চাদের মধ্যে দিয়ে সবাইকে ঠেলে রিমঝিম এগিয়ে আসতে আসতে বললো,
“পিপি এসেছে,,পিপি এসেছে”
ফারিহা হেসে রিমঝিম কে জড়িয়ে ধরলো তারপর রিমঝিমের গালে চুমু খেলো।ফারিহা অনেকক্ষণ বাচ্চাদেরকে আদর করলো তারপর ঝুম আন্টি বললো,
“এই তোরা তো তোদের পিপিকে ময়লা করে দিয়েছিস।সবাইকে পরিষ্কার হতে হবে আমার সাথে আয়”
বাচ্চারা সবাই মাথা নেড়ে ঝুমা আন্টির সাথে যেতে লাগলো।রিমঝিম ফারিহা গালে একটা চুমু দিয়ে দৌড়ে ঝুমা আন্টির কাছে যায়।মিস্টার আজাদ বাচ্চাদের সাথে ভিতরে চলে যায়।সবাই চলে গেলে আয়ান ফারিহার কাছে এগিয়ে এসে হেসে ফারিহার কাঁধ ধরে ভ্রু নাচিয়ে বললো,
“আমার বউটা আজকে এখানে?কি ব্যাপার?”
ফারিহা অবাক হয়ে আয়ানের দিকে তাকিয়ে বললো, “সেটা তো আমার জিজ্ঞেস করার কথা।আপনি এখানে কেনো? আর শুনলাম আপনি নাকি প্রায় সময়ই এখানে আসেন?”
আয়ান ফারিহাকে পাশে নিয়ে হাঁটতে হাঁটতে বললো, “হুম আসি তো।এখন তুমি আসতে পারো না তাই আমি ওদের সাথে দেখা করতে এসেছি”
“আমি আপনাকে এই জায়গাটা চিনালাম আর আপনি এখানে আসেন আমাকে বললেন না?”
“বললে কি হবে? তুমি আমার সাথে আসতে চাইবে কিন্তু তোমার তো এখন প্রচুর রেস্ট নিতে হবে।এই অবস্থা এত ঘুরাঘুরি করা ঠিক না”
ফারিহা কাঁধ থেকে আয়ানের হাত সরিয়ে দিতে দিতে বললো, “হুম আর জ্ঞান দিতে হবে না।আর আপনি আমাকে ধরলেন কেন আপনার গায়ে অনেক ময়লা। ইশশ আমি নোংরা হয়ে যাচ্ছি!”
ফারিহার কথা শুনে আয়ান গোমরা মুখে বললো, “হ্যাঁ আমি ধরলেন নোংরা হয়ে যাও আর তখন যে বাচ্চাদের সবাইকে জড়িয়ে ধরলে?”
“ফারিহা হেসে বললো, “তাতে আপনার কি?”
“ফারিহা তুমি কিন্তু দিন দিন খুব দুষ্টু হয়ে যাচ্ছো।দাঁড়াও তোমাকে এক্ষুনি নোংরা করছি!”
“না না প্লিজ এরকম করবে না।এখন নোংরা করলে আমাকে আবার গোসল করতে হবে।আর দিনে দুইবার গোসল করলে আমার ঠান্ডা লেগে যাবে তখন তো আপনার বেবির কষ্ট হবে”
আয়ান মাথা নেড়ে বললো, “হুম সেটা ঠিক।আচ্ছা যাও আমার বেবির জন্য তোমাকে মাফ করে দিলাম”
ওরা চুপচাপ হাঁটছে কিছুক্ষণ পর ফারিহা বললো,
“আপনি যে ছোট ছোট বাচ্চাদের সাথে খেলতে যান ওরা আপনার সাথে খেলতে পারে?”
আয়ান হাসিমুখে বললো, “কি বলছো?পারে না মানে ওরা তো আমাকে হারিয়ে দে!”
ফারিহা আয়ানের দিকে তাকিয়ে হাসছে দেখে আয়ান বললো, “কি হলো হাসছো কেনো?”
ফারিহা হাসতে হাসতে বললো, “ভাবছিলাম কিছুদিন পর বাচ্চার বাবা হবে আর উনি এখনো থ্রি কোয়াটার প্যান্ট পড়ে বাচ্চাদের মতো খেলাধুলা করে”
আয়ান একটু ভাব নিয়ে বললো, “তো কি হয়েছে?বড় হয়েছি বলে কি খেলতে পারবো না?তুমি জানো আমি প্ল্যান করে রেখেছি আমাদের একটা ফুটবল টিম হবে।আমার বাচ্চাদেরকে আমি খেলা শেখাবো!”
আয়ানের কথা শুনে ফারিহা হা করে আয়ানের দিকে তাকালো। আয়ান হেসে ভ্রু নাচিয়ে বললো,
“চিন্তা করো না,তুমি শুধু নয় মাস আমার ফুটবল টিমের খেয়াল রাখবে পৃথিবীতে আসার পর আমিই ওদের বড় করবো।আমি কিন্তু ভালো বাচ্চা সামলাতে পারি”
ফারিহা আয়ানের থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়ে
বললো, “অসভ্য।”
ফারিহার কথা শুনে আয়ান জোরে জোরে হাসলো। তারপর ফারিহাকে একপাশ থেকে ধরে আয়ান অনাথ আশ্রমের ভেতরে গেল।আয়ান ভেতরে নিয়ে ফারিহাকে একটা চেয়ারে বসলো তারপর ফ্রেশ হতে গেল।তখন ঝুমা আন্টি একটা প্লেটে করে কতগুলো ফল কেটে ফারিহা হাতে ধরিয়ে দিয়ে বললো,
“নেয় বসে বসে এগুলা খা!”
ফারিহা অবাক হয়ে বললো, “আন্টি এতগুলো?আমি আসার সময় খেয়ে এসেছি এখন খাবো না”
“কিছুটা খা, না হলে কিন্তু আমি রাগ করবো।আমার একটু কাজ আছে আমি আসছি।আর এসে যেন দেখি সবগুলো খেয়েছিস”
ঝুমা আন্টি চলে গেল।আয়ান ফ্রেশ হয়ে এসে দেখে ফারিহা ফলের প্লেট হাতে নিয়ে বসে আছে।আয়ান ফারিহার পাশে বসলে ফারিহা আয়ানকে প্লেট দেখিয়ে বললো, “দেখুন আন্টি কতগুলো খাবার দিয়ে গেল!আমি আসার সময় খেয়ে এসেছি”
আয়ান একটু হেসে বললো, “খেয়ে এসেছো তো কি হয়েছে? ফল খেতে হলে খালি পেটে লাগে না, ফল ভরা পেটেও খাওয়া যায়।দাও আমি তোমাকে খাইয়ে দিচ্ছি”
ফারিহা কিছু বলতে যাবে কিন্তু আয়ান প্লেট হাতে নিয়ে একটা আপেলের টুকরো ফারিহার মুখে ঢুকিয়ে দিল।ফারিহা আয়ানের দিকে রাগী রাগী চোখে তাকাচ্ছে আর আপেল চিবুচ্ছে।আর এদিকে আয়ান ফারিহার দিকে তাকিয়ে মুচকি মুচকি হাসছে।
মিস্টার আজাদ বাহিরে দাঁড়িয়ে অনাথ আশ্রমের লোকদের সাথে কথা বলছে।বাচ্চাদের থাকা খাওয়ার কোন সমস্যা হচ্ছে কিনা সেগুলো দেখছে।বাচ্চারা সবাই ফ্রেশ হয়ে এসেই ফারিহার সাথে গল্প করতে বসে।আয়ান ইতিমধ্যে বাচ্চাদেরকে সবাইকে বলে দিয়েছে যে ওদের জন্য ওদের পিপি কিছুদিন পর একটা ছোট্ট বাচ্চা নিয়ে আসবে।বাচ্চারা এটা নিয়ে ফারিহাকে জ্বালিয়ে মারছে।কখন বাবু আসবে বলে বলেয়!বাচ্চারা ফারিহাকে একের পর এক প্রশ্ন করছে আর ফারিহার রাগি চোখে আয়ানের দিকে তাকাচ্ছে।আর এদিকে আয়ান তো খুব মজা পাচ্ছে হাসতে হাসতে পারছেনা শুয়ে পড়ে।রিমঝিম ফারিহার কাছে বসে জিজ্ঞেস করলো,
“ও পিপি বাবু কবে আসবে?”
ফারিহা একটু হেসে বললো, “আসবে মামনি।আরো কিছুদিন পর”
“তাড়াতাড়ি বাবুকে নিয়ে এসো। আমরা বাবুর সাথে খেলবো”
“রিমঝিম মামনি বাবু যখন আসবে তখন তো ছোট থাকবে। তখন খেলতে পারবেনা একটু বড় হলে তারপর তোমাদের সাথে খেলবে।ঠিক আছে?”
বাচ্চারা সবাই বলতে লাগল, “ঠিক আছে, ঠিক আছে বাবুকে তাড়াতাড়ি নিয়ে আসবে কিন্তু”
বাচ্চাদের কথা শুনে ফারিহা হাসছে আর আয়ান ফারিহার হাসিমাখা মুখ দেখছে।ফারিহা আরো অনেকক্ষণ বাচ্চাদের সাথে সময় কাটায়। তারপর বাচ্চাদের সাথে দুপুরের খাবার খেয়ে সবার থেকে বিদায় নিয়ে বের হয়।আয়ান বাচ্চাদেরকে আদর করে ফারিহার সাথে চলে আসে।আয়ান ফারিহাকে জোর করে ওর গাড়িতে তোলে।মিস্টার আজাদ কিছু বলতে চেয়েও বলতে পারলো না কারণ মিস্টার আজাদ জানে আয়ানকে বললেও শুনবে না।মিস্টার আজাদ নিজের গাড়ি দিয়ে অফিসে দেখে যায় আর আয়ান ফারিহাকে বাসায় পৌঁছে দিবে।
ফারিহা গাড়িতে বসে জানালা দিয়ে বাইরের দিকে তাকিয়ে আছে।আয়ান ড্রাইভ করছে আর কিছুক্ষণ পরপর ফারিহার দিকে তাকাচ্ছে।ফারিহাকে আজকে খুব মিষ্টি লাগছে।পরনে একটা লাল গোল জামা।আয়ানের ইচ্ছে করছে সারাক্ষণ ফারিহাকে জড়িয়ে ধরে বসে থাকতে।আয়ান নিজের ভাবনায় নিজেই ঠোঁট কামড়ে হেসে উঠলো।আর ফারিহা তো গাড়ি থেকে বাইরের দিকে তাকিয়ে বিভিন্ন দোকানের উপরের নাম পড়ছে, ও জানেও না কেউ একজন গভীর দৃষ্টিতে ওকে দেখছে।
চলবে….