#শুকতারা (পর্ব-৯)
#হালিমা রহমান
উদয়পুরের কাজী বাড়ি বিশাল। অন্য শরিক ঘর করতে পারেনি এখানে।এ মাথা-ও মাথা উঠোনের তিন ধারে বসবাসের জন্য তিনটি মাত্র ঘর।গোয়ালঘর,রান্নাঘর,খড়ের গাদা,হিজল, জামরুল,আম,কাঁঠাল,দেবদারু, আমড়া গাছগুলো বাড়ির অলংকারের মতোন জ্বলজ্বল করে। বিস্তৃত উঠোনে মুরগিগুলোর অবাধ বিচরণ,টিনের সাথে আঁটকে রাখা হুমায়রার সাধের টিয়া পাখিটা খাঁচা ভেঙে উড়াল দিতে চায় দূর আকাশে,রোমেলা খাতুনের এক ডজন হাঁস উত্তরের বিশাল পুকুরে চষে বেড়ায়, ঝড়ের দিনে হুমায়রার ঘরের কোনের তালগাছটা মাথা নামিয়ে মাটি ছুঁতে চায়,প্রতি হেমন্তে ধান মেলে ঘেটে দেওয়া অথবা শীতের শুরুতেই ঘরের সামনে লালশাক,পালং শাকের চারা লাগানো — সবকিছু মনে হয় যেন তুলির আঁচড়ে সযত্নে এঁকে দিয়েছে কোনো শিল্পী। গ্রামের বাড়ি বললে যে স্নিগ্ধ এক প্রতিচ্ছবি ফুটে উঠে মনের কোনে,কাজী বাড়ি ঠিক তারই প্রতিনিধি।
ফয়সালের দাদা,কাজী এনায়েতউল্লাহর বাস ছিল ভিন্ন গ্রামে। মেঘনার কোল ঘেষা যে গ্রামটি বহু বছর আগে নদী গর্ভে বিলীন হয়েছিল,সেখানেই বাস করতেন তিনি। ঘর-সংসার,ব্যবসা-বাণিজ্য মিলিয়ে তার জমজমাট অবস্থা। অবস্থা বেশি দিন রইলো না।এক রাতের নদী ভাঙনে সব শেষ।আটচালা ঘর,ঢেঁকিঘর, গোয়ালঘর সব ভেসে গেল মেঘনায়।ভাগ্যক্রমে পরিবারের সদস্যদের প্রাণ বেঁচেছিল শুধু। ধ্বংসাত্মক মেঘনার কোলে দাঁড়িয়ে হাউমাউ করে কাঁদতে কাঁদতে নিষ্প্রাণ নদীকে অভিশাপ দিয়ে উদয়পুরের পথ ধরলেন কাজী এনায়েতউল্লাহ। উদয়পুর তার শ্বশুরবাড়ি।কপর্দকহীন এনায়েতউল্লাহ উপায়ন্তর না পেয়ে ঘর জামাই ছিলেন বছর কয়েক। ব্যবসা বাণিজ্যের জন্য পুঁজি দরকার, এনায়েতউল্লাহর ওসব ছিল না তখন।বাপ-দাদার সম্পদ হারিয়ে মন-মানসিকতাও ভালো ছিল না খুব একটা।তবে অর্থ-সম্পদ না থাকলেও বুদ্ধি ছিল অনেক। মাথা ভরা বুদ্ধির সাথে সাথে কর্মঠও ছিলেন। কাজী এনায়েতউল্লাহ টুকটাক পড়ালেখা জানতেন।বাংলা,ইংরেজির সাথে কোরআন শরীফের দুই পারা পর্যন্ত মুখস্ত ছিল।বক্তৃতাতেও পটু ছিলেন খুব।যেকোনো জিনিস মানুষকে বুঝিয়ে বলতে পারতেন সহজে।দু-একটা হাদিসও পারতেন গড়গড় করে বলতে।জ্ঞানকে পুঁজি করেই মাদ্রাসা খুলে ফেললেন।অনেকটা আগের দিনের পাঠশালার মতো।গাছতলায় গুরু পড়ান,শিষ্যরা শিখে।কেউ পড়ে কায়দা,কেউ আমপারা, কেউ আবার কোরআন শরীফ।উদয়পুরের মানুষের অবস্থা তখন ভালো।গোলা ভরা ধান,গোয়াল ভরা গরু,উঠোন ভরা মুরগি।অভাব দূর হওয়ায় দান-খয়রাত,ধর্ম চর্চায় মন দিলো গ্রামবাসী। ততোদিনে এনায়েতউল্লাহর নাম-ডাক ছড়িয়ে গেছে চারদিকে।গ্রামবাসী নিজ উদ্যোগে টিনের ঘর করে দিলো,পুকুর কেটে দিলো, ছাত্রদের পড়ার জন্য বিনামূল্যে বই-পুস্তক কিনে দিলো মাদ্রাসায়।এ অঞ্চলের একমাত্র মাদ্রাসায় ছেলেরা দল বেঁধে আসতে শুরু করলো।মাঝে মাঝে প্রবীণরাও ভীড় করে সকাল-সন্ধ্যা কোরআন শিখতো।সারা বছর তো ধান-পাটের পিছনেই খাটতে হয়।একটু ধর্মচর্চা না করলে পরকালে দাঁড়াবে কী করে?
ছাত্রদের বেতনে,গ্রামবাসীদের অনুদানে এনায়েতউল্লাহর দিন ফিরলো। বাড়ি করলেন,চাষের জমি কিনলেন,জমি বর্গা দিলেন,আয় বাড়লো।এনায়েতউল্লাহর দুই ছেলে।বড় বেলায়েত, ছোট আকরাম।এনায়েতউল্লাহ পড়ালেখা করিয়েছেন দুজনকেই।ইচ্ছা ছিল তার পরে ছেলেরাই হাল ধরবে সাধের মাদ্রাসার। তিল তিল করে গড়ে তোলা মাদ্রাসাটা বড় সাধের জিনিস।বিধি বাম! ছেলে দুটো মানুষ হলো না।বড়টা মারধরের দৌলতে পড়াশোনা করেছে,কিন্তু ছোটটা প্রাইমারি স্কুলের গন্ডি পেরিয়ে, হাই-স্কুলের মুখও দেখলো না।এনায়েতউল্লাহর দুঃখের শেষ নেই।মনের দুঃখে এক দুপুরে আকরামকে ইচ্ছামতো পিটিয়ে সাইকেল-ঘড়ি মেরামতের দোকানে কাজে লাগিয়ে দিলেন।পড়াশোনা শেষ হতে বেলায়াতও অকাজ করলো।হাই স্কুলের অঙ্কের শিক্ষক সুলতান স্যারের মেয়েকে বিয়ে করে ফেললো।তাদের নাকি দীর্ঘদিন ধরেই প্রেমের সম্পর্ক। ইশ!তারপরে সে কি কান্ড। উঠোনের বিশাল কাঁটাল গাছের সাথে বেলায়াতকে বেঁধে, চোর মারার লাঠি দিয়ে আধ-ঘন্টা মনের সাধ মিটিয়ে পিটিয়েছেন কাজী এনায়েতউল্লাহ। নতুন বউকে ঘরে তুলেননি,ছেলেকেও ঘরে তুলেননি।উঠোন ভরা লোকের সামনে ছেলেকে পিটিয়ে এক কাপড়ে বের করে দিলেন।মনের দুঃখে এনায়েতউল্লাহও ঘরে খিল দিলেন।নিভৃতে স্ত্রী আমিরাকে ডেকে বিস্তর আফসোস করলেন।
” আমিরা, পোলা দুইটারে মানুষ করতে পারলাম না। আমি যদি জানতাম, ওরা এমন হইব তাইলে জন্মের সময় মুখে লবন দিয়া মাইরা ফেলতাম। মরলেও আমার কলিজাডা পঁচব না। আমি মরলে তুমি কী করবা ওগোরে নিয়া?”
কাজী এনায়েতউল্লাহ বাঁচলেন না বেশিদিন।এক সপ্তাহের মাঝেই পটল তুললেন।শখের মাদ্রাসাটা ভেঙে গেল।বাগানের বিশাল আম গাছের নিচে বাবাকে কবর দিয়ে, আকরাম কেঁদে-কুদে মাকে নিয়েই নতুন করে শুরু করলো সব। বেলায়াত এসেছিল বাপের কবর দেখতে,আমিরা বেগম ঘরে ঢুকতেই দিলেন না ছেলেকে।সে কি রাগ তার! লাঠি নিয়ে তেড়ে গেছেন ছেলে,ছেলে বউয়ের দিকে। বেলায়াত টিকতে পারেনি।কি আর করা? দূর থেকে বাবার কবরের দিকে চেয়ে দু-ফোঁটা চোখের জল ফেলে আবার বউয়ের হাত ধরে বরিশালের দিকে পা বাড়িয়েছেন।বছর ঘুরতেই আকরাম বিয়ে করে নিলেন রোমেলা বানুকে। রোমেলা বানু যখন এ বাড়িতে পা রেখেছেন,তখন তার বয়স মাত্র বারো বছর।বারো বছরের বোকা- সোকা মেয়েটা আমিরা বেগমের সর্বক্ষণের শিষ্য হলেন।স্বামী মরার পর আমিরা বেগম খুব খিটখিটে হয়ে উঠেছিলেন।এই কাদা মাটির মতো ছোট মেয়েটাকেই আগুনে পুড়িয়ে, বাতাসে শুকিয়ে, কখনো আদর-যত্ন দিয়ে একটু একটু করে বড় করলেন।সবসময় সহ্য করতে পারতেন না রোমেলা বানু। মাটির ঘরে খিল দিয়ে হাপুস নয়নে স্বামীর বুকে মাথা রেখে কাঁদতেন। স্বামী আকরাম মাথায় হাত বুলিয়ে দিতেন।সান্ত্বনার সুরে বলতেনঃ” কাইন্দো না রুমি,আল্লায় তোমারে ভালো রাখব। মা আগের মানুষ,তাই এমন করে।তুমি কিন্তু পোলার বউগো লগে এমন কইরো না।ওরা আদরের জিনিস।ঘরের বাত্তিরে যত্নে রাখতে হয়।তুমিও যত্নেই রাইখো।”
ছোট্ট রোমেলা মাথা নাড়তেন।স্বামীর বুকেই মাথা রেখে বলতেনঃ” আল্লায় আমারে পোলা দিলে তাড়াতাড়ি বিয়া দিমু ওগোরে। ঘরে আলো আনুম।বউগো লগে কেমন ব্যবহার করতে হয় তা দেখায়া দিমু আম্মারে।ততোদিন আল্লাহ আমারেও বাঁচায়া রাখুক,আম্মারেও বাঁচায়া রাখুক।”
এরপর কেটে গেছে বহু বছর।আমিরা বেগম মরলেন।মাকে শেষবার দেখতে বরিশাল থেকে ছুটে এলো বেলায়াত। উঠোনে শুয়ে গড়াগড়ি দিয়ে কাঁদল,মায়ের লাশ জড়িয়ে ধরে কাঁদলো,ভাইকে জড়িয়ে কাঁদতে কাঁদতে অজ্ঞান হলো। মায়ের মৃত্যু যেন এলোমেলো করে দিল তাকে।স্ত্রী-পুত্রের হাত ধরে একেবারে নিজ গ্রামেই খুঁটি গাড়লেন। তার এক কথা, যতদিন বাঁচবে ততোদিন বাপ-মায়ের কবর দেখবে প্রতি সকালে।বেলায়াতের দুই ছেলে।কাজী শান্ত, কাজী অন্তু।আকরামের সংসারও ততোদিনে ভারী হয়েছে।ভাইয়ের মতো তারও দুই ছেলে।কাজী আফজাল,কাজী ফয়সাল। শান্ত বংশের বড় ছেলে।তারপর আফজাল,তারপর অন্তু,সবার ছোট ফয়সাল।গ্রামের মানুষ বলতো এ বংশের মেয়ে ভাগ্য নেই। তাই যুগ পেরিয়ে গেলেও মেয়ের মুখ দেখেনি এরা।এনায়েতউল্লাহর দুই ছেলে,তার দুই ছেলেরও দুটো করে ছেলে। একটি মেয়ের জন্য অন্তুর মা খালি আফসোস করত।একটি মিষ্টি মেয়ের মুখ দেখার ইচ্ছা ছিল বহু দিনের। শেষ অবধি অপূর্ণই রয়ে গেল ইচ্ছাটা।
কাজী বেলায়াতের ইচ্ছা পূরণ হলো না।পেশায় তিনি স্বর্নকার। বরিশালে গয়নার দোকান ছিল।ছেলেদের পড়াশোনা সব বরিশালে।মায়ের মৃত্যুর পর আবেগের বশে নিজ গ্রামে থাকার প্রতিজ্ঞা করেছিলেন।রক্ষা হলো না তা।এতোদিনের ব্যবসা ছেড়ে একেবারে চলে আসা সম্ভব না।বাড়ি-ঘর ভাগ হলো,জায়গা-জমি ভাগ হলো। পশ্চিমে কাজী আকরামের ঘর,পূর্বে কাজী বেলায়াতের নতুন তোলা টিনের ঘর।এক রুম,বাইরে রান্নাঘর আর টিনের বাথরুম মিলিয়ে বেলায়াতের সাধের ঘর। মা মারা যাওয়ার চল্লিশ দিন পরেই ঘর-দুয়ারে তালা দিয়ে,বাবা-মায়ের কবরের দিকে ঘোলা চোখে চেয়ে, চোখের জল ফেলতে ফেলতে আবারো বরিশালে পাড়ি জমালেন কাজী বেলায়াত।জীবনের অলি-গলিতে হতাশারা ভীড় করেছে।তার জীবনটাই গেল চোখের জল ফেলতে ফেলতে।
___________
স্যার উইলিয়াম শেকসপিয়ার তার বিখ্যাত নাটক ” এজ ইউ লাইক ইট”– এ খুব সুন্দর একটা কথা বলেছেন। ” পৃথিবীটা রঙ্গমঞ্চ,আমরা সবাই অভিনেতা।”
কথাটা কত বড় সত্যি তা মানুষকে না দেখলে বোঝা যায় না।আমরা প্রত্যেকে অভিনেতা। রোমেলা বানুও কম যান না।এককালে তিনি ছিলেন শিষ্য, অপরিণত এবং শোষিত। শ্বাশুড়ি সব শিখিয়েছেন বটে কিন্তু শিখানোর পদ্ধতি ছিল রুঢ়,কঠিন।শ্বাশুড়ির আদর-যত্নের ভার তার ঝুলিতে কম।সেকালের অপরিনত, অল্পবয়সী মেয়েটাই একালে সংসারের মাথা। শোষিত থেকে শাষক হয়েছেন।শ্বাশুড়ির কাছ থেকে সংসার শিখেছেন।রোমেলা বানুর হাল-চাল বদলে গেছে। এখন আর ঘরের বউকে আলো মনে হয় না,নিজের প্রতিদ্বন্দ্বী মনে হয়। সংসারের বাতাসে প্রতিযোগিতার গন্ধ পান।তার শিখানোর পদ্ধতিও রুঢ়,কঠিন।দৃষ্টিভঙ্গি সেই আদিকালের আমিরা বেগমের মতোন।মেজাজ খিটখিটে। তিন সেই আগের রোমেলা বানু নয়,যে স্বামীর বুকে মাথা রেখে ছেলে-ছেলের বউয়ের স্বপ্ন দেখতেন।সুন্দর কথা বলতেন।তিনি এখন ঘরের কর্ত্রী, তিনিই অভিভাবক।বয়সের সাথে সাথে হাড়ে হাড়ে ঘুণে ধরেছে, আগের মন-মানসিকতায়ও ঘুণে ধরেছে।বউ রোমেলা ও শ্বাশুড়ি রোমেলায় আকাশ-পাতাল তফাৎ।মানুষটা একই আছে, শুধু বদলেছে অভিনয়ের পালা।আগে বউ, এখন শ্বাশুড়ি। দুটো সত্তায় দিগন্তসম পার্থক্য। পৃথিবীর চাইতে বড় রঙ্গমঞ্চ আর কোথায় আছে? মানুষের চাইতে বড় অভিনেতা আর কোথায় আছে?
এক নাগাড়ে মায়ের শীর্ণ পা দুটো টিপে যাচ্ছে ফয়সাল।পাতলা কাঁথার নিচে মায়ের পা দুটো সাদা শাড়িতে জড়ানো।উঠোন থেকে হুমায়রার গলার স্বর শোনা যাচ্ছে।হুমায়রা লাল শাকের চারা বুনেছে ঘরের সামনে।রোমেলা বানুর লাল রঙা মুরগীটা সব নষ্ট করে দিচ্ছে।হুমায়রা হুস হুস করে তাড়াচ্ছে মুরগীকে।তবুও হতচ্ছাড়া মুরগী অকাজ করেই যাচ্ছে।হুমায়রা বাইরে থেকে ফয়সালকে ডাকছে মুরগী নেওয়ার জন্য।বিরক্তিতে বিড়বিড় করছে মেয়েটা।কত সাধের লাল শাকের চারা!
হুমায়রার বিড়বিড়ানি ফয়সালের কানে ঢুকলেও মাথায় ঢুকলো না।সে মনে মনে প্রস্তুতি নিচ্ছে।মাকে সে বাঘের মতো ভয় পায়।যেকোনো কথা বলার আগে তাই বহু প্রস্তুতি নেয়,মহড়া দেয় মনে মনে।আগে কথা বলার আগে ঘরের দরজা আঁটকে স্ক্রিপ্ট লিখে নিতো। এখন আর স্ক্রিপ্ট লেখা লাগে না।বয়স হয়েছে তাই মনে মনে কথা সাজাতে পারে।মায়ের পা দুটো আলতো করে টিপে দিলো ফয়সাল। এ হলো অনুরোধের আগের খেদমত ।রোমেলা বানু চোখ মেলে একবার ছেলেকে দেখলেন।ছেলের নাড়ী-নক্ষত্র সব চিনেন তিনি। ফয়সাল কখন ডান পা ফেলবে আর কখন বাম পা ফেলবে তাও এক লহমায় বলে দিতে পারেন।মনে মনে হাসেন রোমেলা বানু।যুগ হিসেবে ছেলেটা বড় সহজ-সরল।
” ফয়সাল, কিছু কবি বাপ?”
ফয়সাল একটু চমকে গেল।মা জেগে আছে? ফয়সাল বুঝতেই পারলো না।মনে মনে ঢোক গিলে ফয়সাল।কথাগুলো সাজিয়ে নেয় একের পর এক।
” আম্মা,ওই সূচিদের সাথে আর কথা বলছিলা তুমি?”
” হ।আগামী সোমবার আংটি পরাইতে যাইবা।”
” কি!” __ তীক্ষ্ণ আর্তনাদের মতোন শোনায় ফয়সালের কন্ঠস্বর।অবিশ্বাস্য। মা এতো কিছু ঠিক করে ফেললো? কই ফয়সাল তো কিছুই জানতে পারলো না।
” তোমার কিছু কওনের আছে?”
” আম্মা,সব অনেক তাড়াতাড়ি করছ না তুমি? লাখ কথা ছাড়া বিয়ে হয় না।সেখানে এক দেখায়,এক কথায় সব ঠিক করে ফেলাটা কি ঠিক? তুমিই বলো?”
” হুট কইরা করতাছি,তা তোমারে কে কইলো? সূচিরে আমি অনেক আগ থেকাই চিনি।মাইয়ার স্বভাব -চরিত্র অনেক ভালো।শান্ত-শিষ্ট।রত্নাগো বাসায় আরো কয়েকবার দেখছি।রত্নার চাইতে ভালো।রত্নার ছুকছুকানি স্বভাব।মোবাইলে কারো লগে মনে হয় কথা কয়। সারাদিন মোবাইল টিপে।আল্লাহ মাবুদ জানে কী করে মোবাইলে।”
” আম্মা,তবুও তুমি অভিজ্ঞ মানুষ।আরেকটু বিচার-বিবেচনা করো।”
” অভিজ্ঞ দেইখাই তো তোর বিয়ার সিদ্ধান্ত নিছি।নাহয় এতো তাড়াতাড়ি সাহস করতাম না।এই চুলগুলি বাতাসে পাকে নাই।আমি মানুষ চিনি।সূচির আগে-পিছে ঝামেলা নাই।পরিবার ভালো।আমি মরলে তুমি একটা গার্জেন পাইবা।মমিন ভাইয়ের জায়গা-জমিও আছে। ভূমির ঝায়-ঝামেলা নাই।ওই পরিবারে তুমি আদর পাইবা।”
মায়ের ইঙ্গিত বুঝতে অসুবিধা হয় না ফয়সালের। তবুও, মনটা খচখচ করে।এতো সুবিধায় কী লাভ,যদি ঘরের গিন্নীটাই চোখ শোভা না হয়? ফয়সালের এক পাল বন্ধু-বান্ধব।যদি বন্ধুদের বউয়ের চাইতে সুন্দর একটা বউই কপালে না জুটে, তবে বিয়ে করে লাভ কী? ফয়সাল তাই সাহস করে কথাটা বকেই ফেললো।একটু শক্ত গলায় বললোঃ” আম্মা,সূচিকে আমার পছন্দ না।আরেকটু যদি সুন্দর হতো,তবে…
ফয়সালকে ডান হাত তুলে থামিয়ে দেন রোমেলা বানু। উদাস গলায় বললোঃ” তোমার দাদার একটা চোর মারার লাঠি আছিলো।তোমার বাপের কাছে শুনছিলাম আব্বার মতের বাইরে বিয়া করছিলো বইলা অন্তুর বাপরে কাঁঠাল গাছের লগে বাইন্ধা পিটাইছিলো।ওই লাঠিটা আমি যত্নে রাখছি।শ্বশুররে দেখি নাই,শ্বশুরের স্মৃতি হিসাবে লাঠিটা আমার খাটের তলায় আছে।আমার হাড়-গোড় পঁইচা যায় নাই।তোমার হাড্ডি ভাঙ্গার শক্তি আমার আছে।মেট্রিকেও মাইর খাইছিলা মনে আছে? এবার যদি মারতেই হয় তাইলে পঞ্চায়েতের সালিশ ডাইকা শত শত মাইনষের সামনে তোমারে মারমু।কসম কাটলাম না খালি।খবরদার, আমার কথার অবাধ্য হইবানা ফয়সাল।এক পোলারে আলাদা করছি।আরেক পোলারে ত্যাজ্য করতে আমার গলা কাঁপব না। আজকে সাবধান করলাম,ভবিষ্যতে যেন আর না লাগে।আর পা টিপা লাগব না।চোখের সামনে থেকা যাও এখন।”
গলা শুকিয়ে গেল ফয়সালের। মারার কথা ফাঁকা বুলি নয়।শরীরে লাঠির ঘা বসিয়ে দেওয়ার সাধ্য মায়ের আছে।এই বয়সে মার খাওয়ার দৃশ্য কল্পনা করতেই গায়ে কাটা দেয় ফয়সালের।মায়ের পা দুটো থেকে হাত সরিয়ে উঠে দাঁড়ায়।পা দুটো ভারী লাগছে। মনের ভার হুট করে পায়ে চলে গেল নাকি?
” অন্তুর নম্বরটা আমার ফোনে সেভ কইরা দিও তো।ওরেও দাওয়াত দিমু।পরে নাহয় আবার প্যাঁচ ধরব।এতো দামড়া পোলা এহনো বিয়া করে না।বলদ একটা।আর শান্তর নম্বরটাও দিও।দেখি,সিলেট থেকা আসে নাকি।”
” খামারে কাজ আছে আম্মা।বিকালে দেবনি।আসছি।”
চোখের জল লুকিয়ে দ্রুত পায়ে ঘর থেকে বেরিয়ে পড়লো ফয়সাল।উঠোনে দাঁড়িয়ে থাকা হুমায়রার নজর থেকে নিজের দুর্বলতা লুকানোর জন্য প্রায় ছুটে বেরিয়ে গেল বাড়ি থেকে।ছেলেটা একদম ছিঁচকাঁদুনে। এতো কাঁদতে হয়?
______________
” ও আম্মা, আজকে কচুর মুখি আর তেঁতুল দিয়ে টক রান্না করো না।খুব খেতে ইচ্ছে করছে। ”
মিথ্যা বললো সূচি।কচুর মূখির টক খুব বেশি একটা পছন্দ না সূচির।মা রাঁধলে আধা চামচ অথবা এক চামচ নেয়।এই তরকারীতে ভাত মাখলে অনেক পিচ্ছিল হয়ে যায় ভাত।পিচ্ছিল ভাত মুখে নিতেই বিরক্ত লাগে।তবে ভূমির ভীষণ পছন্দ। এক চামচ তরকারী দিয়ে গোটা এক প্লেট ভাত খেতে পারে।ভূমির বাসায় যাওয়ার ইচ্ছা আছে আজকে।তাই তরকারীর কথা বললো সূচি।মায়ের কোনো হোলদোল না করে আবারো আহ্লাদী সাজে সূচি।মায়ের গায়ে হেলান দিয়ে আদুরে গলায় অনুরোধ করে।
” আম্মা, রান্না করো না।মনে হচ্ছে তরকারী রাঁধলে আমি অনেকগুলো ভাত খেতে পারব।”
” কচুর মুখি কই পামু আমি? ঘরে নাই।”— জ্বলন্ত আগুনে আরেকটা কাঠ গুজে দেন সাহিদা বেগম।মাগুর মাছটায় আরেকটু ঝোল দরকার।বোতল থেকে একটুখানি পানি ঢেলে দিলেন মাছের উপরে।
একটু ইতস্তত করে সূচি।আমতা আমতা করে বলেঃ” জয়া ভাবীর কাছে আছে।আমি যেয়ে নিয়ে আসি।বেশি না সাত-আটটা আনব।”
সূচি ভেবেছিল বকা শুনতে হবে।মায়ের চাওয়ার অভ্যাস নেই।ঘরে না থাকলে না খেয়ে থাকবে,তবুও কারো কাছে কিছু চাইবে না।সূচিকে অবাক করে দিয়ে সাহিদা বেগম কিছুই বললেন না।শুধু একবার মুখের দিকে চেয়ে নরম গলায় বললেনঃ” অনেক মন চাইতাছে?”
” হুম।”
” আচ্ছা, আন। আসার সময় আমার ঘরে বয়াম থেকা পাঁচ-ছয় বিচি তেঁতুল আনিছ।”
খুশিতে বাক-বাকুম সূচি।খুশিমনে পা বাড়ায় জয়ার ঘরে।চম্পা ভাবির থেকে জলপাইয়ের আচার আনতে হবে।ভূমি আপা খুব ভালোবাসে জলপাইয়ের আচার।লুকিয়ে যেয়ে বড় আপাকে বিয়ের খবরটা দিতে হবে।বাবা তো আপাকে বলবে না।লজ্জা -শরমের মাথা খেয়ে নিজেই বলতে হবে।
” আল্লাহ,এইবার যেন বাবার হাতে ধরা না পড়ি।একটু দেখো,প্লিজ।”—হাঁটতে হাঁটতে মনে মনে প্রার্থনা করে সূচি। বাবাকে মেয়েটা অনেক ভয় পায়।
চলবে…..