#শুকতারা (পর্ব-২০)
#হালিমা রহমান
সকাল থেকে সূচির মনটা ভালো। প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করতে পেরে মহারানীর ভাব ধরে সারা ঘরে হাঁটছে।সূচির ঘুম ভেঙেছে বেলা করে। সাতটা-আটটা হবে বোধহয়। চোখ খুলে অভাবনীয় এক দৃশ্য দেখলো।একদম অভাবনীয়।আধো আলো,আধো অন্ধকার ভীড় করেছিলো সূচির ছোট্ট ঘরে।পশ্চিমের জানলা গলে সরু এক ফালি সোনালী আলো সগর্বে মশারির উপরে জায়গা করে নিয়েছে।সেই আলোতেই এক মনোমুগ্ধকর ছবি চোখে পড়লো। সকাল সকাল এতোটা আশা করেনি মেয়েটা। মুহূর্তেই ঘুমের অলসতা কেটে একরাশ লজ্জা ভীড় করলো সারা শরীরে, সূচির সুন্দর তেলতেলে চেহারায়।তার প্রাণপ্রিয় মানুষটি তখন ঘুমে ব্যস্ত।ফয়সালের শক্ত হাতের বাঁধন খুলে আস্তে আস্তে ঘর ছেড়েছে সূচি। ভাগ্য ভালো লোকটা ঘুমিয়ে ছিল।ফয়সাল জেগে থাকলে হয়তো সূচি আজ লজ্জায় মরেই যেত।
ব্রাশ করে,চোখে-মুখে পানি দিয়ে রান্নাঘরে গেল সূচি। সাহিদা বেগম পিঠা বানাচ্ছেন নতুন জামাইয়ের জন্য। নকশী পিঠা, দুধ চিতই।সূচি মায়ের পাশে যেয়ে পিঁড়ি পেতে বসলো।দুধ চিতইয়ের পাতিলে ডান হাতের আঙুল ছুঁইয়ে মুখে আঙুল দিলো।কড়া মিষ্টি।
” মিষ্টি হইছে সূচি?”
” অনেক মিষ্টি।”
” জামাই মিষ্টি খায়? আরেকটু মিষ্টি দিমু?”
ফয়সাল কতটুকু মিষ্টি খায় তা জানা নেই।আন্দাজে ঢিল মারলো সূচি।
” আর লাগবে না আম্মা। উনি এতো মিষ্টি খায় না।”
আরেকবার আঙুল ছুঁইয়ে দিলো সূচি।
” আহ,তুই এমনে খাছ ক্যান? বাটিতে নিয়া খা।”
” কী হয় এভাবে খেলে?”
” খাছরামি বন্ধ কইরা বাটিতে নিয়া খা।”
” হাহ!”
মিটসেফ থেকে বাটি, চামচ নিয়ে আবারো মায়ের পাশে বসে সূচি।পাতিল থেকে সাবধানে একটা পিঠা তুলে নিলো। পিঠা মুখে দিয়ে মুহূর্তের জন্য উদাসীন হয় সূচি।দুধ চিতই বড় আপার খুবই পছন্দ।বড় আপা সবসময় অতিরিক্ত মিষ্টি খেতে ভালোবাসে। এই পিঠাটা বড় আপা পেলে লোভনীয় ভঙ্গিতে খেতো। মিনিটের মাঝে চেটেপুটে পুরো বাটি খালি করে ফেলতো। সহসা চোখ ভরে আসে সূচির। কে জানে এই শীতে পিঠা খেতে পেরেছে কিনা! বড় আপার তো কেউ নেই।পৃথিবীতে এক ইশতিয়াক আর সূচি ছাড়া সত্যিই কেউ নেই।
পিঠাটা আর গলা দিয়ে নামলো না সূচি। আধ-খাওয়া পিঠার বাটি ঠেলে পাশে রেখে দিলো। কড়া মিষ্টি মুখে নিমের রসের মতো তেতো লাগছে।
” কিরে খাইলি না? মজা হয় নাই?”— সাহিদা বেগমের কন্ঠে উদ্বেগ।
সূচি উপর-নিচে মাথা দুলায়। নরম গলায় বলেঃ” মজা হয়েছে আম্মা।তোমার পিঠা আবার খারাপ হয়?”
” তাইলে খাইলি না যে?”
” ভালো লাগছে না।খালি পেটে পিঠা খেলে পেট ব্যাথা করবে।”
” আচ্ছা,তাইলে ভাত খায়া খাইছ।”
সূচি চুপচাপ বসে বসে চুলার আগুন দেখে।মাটির শক্ত-পোক্ত দেহের মাঝে গনগনে আগুন।আগুনের তাপ এসে গায়ে ধাক্কা খায়।এই শীতে তা বড়ই আরামদায়ক। আগুনের তাপে মায়ের মুখে জায়গায় জায়গায় লাল হয়ে আছে।সূচির ভালো লাগে। চুলার কাছে থাকলে মাকে একটু বেশিই সুন্দর লাগে।গোলগাল ফর্সা মুখে লাল আভা বেশ মানায়।সূচি আরেকটু এগিয়ে বসে। সাহিদা বেগমের পাশ থেকে চ্যালাকাঠ নিয়ে আগুনে ঠেলে দেয়।হাঁটুতে মুখ গুজে চুপচাপ আগুন দেখে।নিরিবিলি বসে বসে কাল রাতের কথা মনে করে।
কাল রাতে চম্পা ভাবির কথাগুলো মাথায় গেঁথে ছিলো একদম।তাই তো এতোটা দুঃসাহস দেখানোর সুযোগ পেয়েছে সূচি। ঠাস ঠাস করে কথার জবাব দিয়ে শুয়ে পড়েছিলো ঠিকই। কিন্তু কম্বলের নিচে শুয়েও ভিতর-বাহির কাঁপছিলো সূচির। ফয়সালের প্রতি সে বড়ই দুর্বল। প্রথমদিন থেকে বাড়াবাড়ি না করলে সূচি হয়তো কখনো চোখ তুলেও তাকাতো না। কিন্তু এখানে পরিস্থিতি ভিন্ন। প্রাণাধিককে শীতের কষ্ট দিয়ে নিজের মনে বিশ্রি রকমের এক খারাপ লাগা কাজ করেছে। সবকিছু ভুলে-টুলে ফয়সালকে কম্বলের নিচে টেনে নিতে ইচ্ছা করেছে। ফয়সালের বালিশে মাথা দিয়ে,প্রাণাধিকের গলা জড়িয়ে বলতে চেয়েছেঃ” আপনি আর চোখ রাঙাবেন না। শক্ত কথাও বলবেন না।গলাকে এতো শক্ত করে কথা বলেন কীভাবে? গলা ব্যাথা করে না?”
প্রশ্নটা আর করা হয়নি।মন গহীনের বিশাল প্রশ্নটা চেপে রেখেই কম্বলের নিচে ঠকঠক করে কেঁপেছে সূচি। মনে ভয় ছিল।ফয়সাল কাল যথেষ্ট রেগে ছিল।যদি রেগেমেগে চড় মেরে বসতো? সূচি তখন কী করতো? অথবা, সত্যিই যদি বাবা-মায়ের কাছে বিচার দিতো ফয়সাল! ছিঃ, কী বিশ্রি কান্ডটাই না ঘটতো।
মনে অশান্তি থাকায় সহজে ঘুম এলো না।সূচি জেগেই ছিল।তাছাড়া, পাশের মানুষটা এ পাশ -ও পাশ করেছে শুধু। পাতলা কাঁথায় শীত মানে না এটা জানা কথা। ফয়সাল জেগে ছিল,সূচিও জেগে ছিল। ফয়সাল শীতে কেঁপেছে, সূচি শুয়ে শুয়ে নিস্তব্ধ রাতে ঘড়ির শব্দ শুনেছে মনোযোগ দিয়ে। এরকম করতে করতে মাঝরাতের দিকে চোখ লেগে এলো সূচির। ঘুমেরা সবে ভর করছিলো চোখের পাতায়।এমন সময় দুটো ঠান্ডা হাতের স্পর্শে সূচির চোখ খুলে গেল।উষ্ণতার খোঁজে ফয়সাল তখন হাত-পা চারটে গুজে দিয়েছে সূচির কম্বলে। মানুষের শরীরে উষ্ণতা সবচেয়ে বেশি। সূচির শাড়ির ভাঁজে ফয়সাল আতিপাতি করে আরাম খোঁজে।মুহূর্তেই স্বর্ণলতার মতো জড়িয়ে গেল ফয়সাল।মাথা এলিয়ে দিলো সূচির বালিশে।সূচি কাঠ হয়ে শুয়ে ছিল।ঘুমের মানুষ এতো পরিকল্পিতভাবে হাত-পা গরম করার উপায় খুঁজতে পারে না।ফয়সাল নিশ্চিত জেগেই ছিল।সূচিকে ঘুমন্ত ভেবেই হয়তো কম্বলের ভিতর ঢুকেছে। সূচি চুপচাপ পড়ে রইলো ফয়সালের বলিষ্ঠ হাতের বন্ধনে। সূচির হৃদয়ের রঙটা ঠিক রংধনুর রঙ ছিল তখন।উজ্জল আকাশে চিররঙিন এক রংধনু। হৃৎসাগরে একের পর এক স্রোত আছড়ে পড়ে হতবিহ্বল করে দিয়েছিলো সূচিকে।এতোবড় সৌভাগ্যে থরথর করে কাঁপলো সূচি। কাঁপতে কাঁপতে হাজার দশেক ছবি আঁকলো মনের মাঝে।সুন্দর এক ঘরকন্যার ছবি।সূচি দুই হাতে সামলাচ্ছে সব। কাজী বাড়ির নির্দিষ্ট ঐ ঘরটাতে সূচির ব্যস্ত পদচারণা।সব ব্যস্ততা এই বলিষ্ঠ পুরুষকে ঘিরেই। কাজ শেষের অবসরে, অলস দুপুরে অথবা ব্যস্ত রাতে, কে সূচির শয্যা আলো করে রাখবে? কে সঙ্গ দেবে? ভরসা মাখা হাতদুটো কাঁধে জড়িয়ে দেবে কে? সবকিছুতেই এই মানুষটার অধিকার। কাজী ফয়সাল– নামটা সূচির কল্পনায় জ্বলজ্বল করে। ফয়সালের ভারী নিঃশ্বাসের শব্দ কান পেতে শুনে।মনোযোগ ছাত্রীর মতো হৃৎস্পন্দন অনুভব করে।অন্ধকার রাতে ফয়সালের কোঁকড়া চুলগুলোকে আদর করে ধীরে ধীরে।এই চুলগুলোর উপর লোভ সূচির অনেক দিনের।একটু রাগ দেখালেই যদি সৌভাগ্যরা যেচে ধরা দেয় তবে সূচি আজীবন রাগ দেখাবে।মনোমালিন্য থেকে যদি ভালো কিছু হয় তবে প্রতিবেলায় মনোমালিন্য হোক।সূচি কিছু মনে করবে না।
স্বপ্ন দেখতে দেখতেই রাত কাটলো।ওই একপাশে ফিরেই ঘুমিয়ে ছিল সূচি।সকালে উঠেই রাতের ছবিটাকে চোখে দেখলো।রাতে শুধু অনুভব করেছিল,সকালে তা সত্যি হয়ে চোখে ধরা দিলো।সৌভাগ্যের বাস্তব রূপ বড়ই সুন্দর।সূচি লজ্জায় লাল হয়।ভয়াবহভাবে পেট মোচড় দেয়। ফয়সালকে দেখলে এখনো পেটে ভূমিকম্প হয় সূচির।অসুখটা আর ভালো হলো না।
” সূচি ”
” জ্বি আম্মা।”
” তোর শ্বাশুড়ি ক্যামন? তোর লগে ক্যামন করে?”
” আমার কাছে তো ভালোই লাগলো আম্মা।তবে খুব চুপচাপ। কথা-বার্তা কম বলেন।”
” আর তোর জা হুমায়রা? ”
” আমার অনেক ভালো লেগেছে ভাবিকে।অনেক মিশুক।আমি এই দুইদিন ভাবির সাথেই ছিলাম।”
স্বস্তি পেলেন সাহিদা বেগম।পরিবারের অন্যান্য মানুষগুলো ভালো হলে পথ চলতে সুবিধা।ফয়সালের ব্যাপারেও প্রশ্ন করতে ইচ্ছা হয়।তবে করলেম না।নিজের জ্বিভকে সংযত করলেন।মেয়ের সাথে বন্ধুত্বের সম্পর্ক নেই।তাছাড়া,সূচির পেট থেকে কথা বের করার জন্য চম্পাদেরকে কাজে লাগিয়েছেন। ওদের থেকেই শোনা যাবে পরে।
” সূচি,সূচি।”
ও-ঘর থেকে ফয়সালের কন্ঠ শোনা যাচ্ছে।ঘুম জড়ানো কন্ঠের আহ্বান।সূচি ব্যস্ত পায়ে উঠে দাঁড়ায়।শাড়ি সামলে নিজের ঘরের দিকে পা বাড়ায়।পিছন থেকে কানে আসে সাহিদা বেগমের কন্ঠ,
” জামাইরে হাত মুখ ধুইয়া পিঠা খাইতে ক, সূচি।”
_________________________
ঘুম থেকে উঠে খাটের কোনে বসে আছে ফয়সাল।চোখের উপর ভাসছে কাল রাতের চিত্র।যত মনে পড়ছে ততই রাগ বেড়ে যাচ্ছে।সূচি কালকে চোটপাট করেছে! কত সাহস মেয়েটার! নিজের আচরণকে মনে করেও লজ্জা পায় মনে মনে।কাল রাতে কাপুরুষের মতো আচরণ হয়েছে।সূচির বেয়াদবির উপরে দুটো চড় মারতে পারলো না! এইটুকু একটা মেয়ের কানের নিচে ঠাটিয়ে দুটো চড় মারলেই চলতো। আজীবনের জন্য সোজা হয়ে যেতো।তা না করে চুপচাপ মেনে নিলো সব।ফয়সাল নিজের চেহারা আর আয়নায় দেখতে পারবে কি না সন্দেহ।
” আমাকে ডাকছিলেন?”
সূচির ঠোঁটের কোনে লজ্জার হাসি। তবে বউয়ের লজ্জা চিনলো না ফয়সাল।মনে করলো সূচি উপহাস করছে।ফয়সালকে জব্দ করতে পেরে মুখ টিপে হাসছে।আপাদমস্তক জ্বলে উঠলো ফয়সাল।হিসহিসিয়ে প্রশ্ন করলোঃ” আমার ব্রাশ কই?”
” লাগেজেই আছে।দাঁড়ান দিচ্ছি।”
” পরে দিও।তার আগে বলো,কালকে এমন করেছো কেন?”
” আপনিও তো করেছিলেন।”
” আমি আর তুমি কি সমান?”— হুট করেই সূচির দিকে তেড়ে এলো ফয়সাল। চোখ পাকিয়ে চেয়ে রইলো।
এতোক্ষণের কল্পনা করা সুখ ছবি হুমড়ি খেয়ে পডলো সূচির।চোখের উপরের রঙিন পর্দাটা চিড়ে ফালা ফালা করে ফেললো ফয়সাল নিজেই। মাতালের পিঠে চাবুকের ঘা পড়লে যেমন তার হুশ হয়,তেমনি সূচিরও হুশ হলো।মনে হলো বিশ্রি দুটো গালি দিয়ে ফয়সাল ওকে আক্রমণ করলো।সূচি সতর্ক হয়ে গেল মুহুর্তেই।কপাল কুঁচকে গেল।কাল রাতের চিরচেনা রাগটা ফিরে এলো।কঠিন গলায় প্রশ্ন করলোঃ” আমি আর আপনি এক নই?”
” না।কখনোই না।আমি যা করব তা তুমি করবে কেন? আমার সমস্যা হয় বলেই তো তোমায় বলেছিলাম।”
” আমারও তো সমস্যা হয় তাই আপনাকে বলেছিলাম।তাছাড়া আমার সাথে ভালোভাবে কথা বলতেও আপনার সমস্যা? আপনি সবসময় এরকম করে কথা বলেন কেন?”
সূচির কন্ঠের দৃঢ়তা,দৃষ্টির প্রখরতা অবাক করে দেয় ফয়সালকে। মেয়েটা কি আদো তার শাসন মানবে? নাকি নিজেই উল্টো শাসন করবে?
” কী হলো কথা বলছেন না কেন?”
” আমি তোমার সাহস দেখে অবাক হয়ে যাই সূচি।এটা তোমার বাড়ি। তাই এমন করছো? এতোদিন শুনেছি নিজের আঙিনায় এলে বিড়াল বাঘ হ্য়।আজ নিজের চোখে দেখলাম। হিসাব রেখ সবকিছুর।আজ বাদে কাল কিন্তু ও বাড়িতে যাবে।মনে রেখো কথাটা।”
সূচি অবাক হয়ে চেয়ে রইলো।ফয়সাল হুমকি দিচ্ছে! সাহস তো কম নয়। বিস্ময় রাগে রূপ নিলে সূচির। দু-পা এগিয়ে যেয়ে ফয়সালের গা ঘেষে দাঁড়ালো।মুখোমুখি দাঁড়িয়ে আঙুল নাচিয়ে প্রশ্ন করলোঃ” কাল রাতে আপনার শিক্ষা হয়নি?এরপরেও আমাকে ঘাটাবেন? এতো সমস্যা থাকলে বিয়ে করেছেন কেন? আমি জোর করেছিলাম আপনাকে?”
সুন্দর প্রশ্ন।ফয়সাল উত্তর দিতে পারে না।তবে উত্তর দিতে পারলেই বোধহয় ভাল হতো।ঘটনার গোড়াতেই এসপার-ওসপার হয়ে যেতো।ফয়সাল ও সূচি দুজনেই বেঁচে যেত।
চলবে…..