#শুকতারা (পর্ব-২১)
#হালিমা রহমান
আজ বোধহয় বৃষ্টি হবে। পৃথিবীর ঢাকনায় ঘন মেঘের প্রাচুর্য। সহস্রাধিক কালো মেঘ মিলেমিশে সূর্যকে আড়াল করে রেখেছে।সূর্যের দেখা নেই সকাল থেকে।শীতের বৃষ্টি আরাম দেয় না। মাঘের হাড় কাঁপানো দস্যু শীতের পারদটাকে আরো কয়েক ডিগ্রি বাড়িয়ে দেয় কেবল।চারদিকে মলিন আলো। সকালের উজ্জ্বল আলোর বদলে বেলাশেষের ম্লান আলোয় ছেঁয়ে গেছে প্রকৃতি। শকুনের মতো হিংস্র বাতাস ঠোক্কর দেয় রাস্তা-ঘাটে।রাস্তার সব ধুলাবালি উড়িয়ে এনে চোখ-মুখ ঢেকে দেয়।রাধাদের সরিষা ক্ষেতে হলুদ ফুলের ছড়াছড়ি। তীব্র বাতাস হলুদ সাগরে ঢেউ তোলে। ফুলগুলো আদুরে ভঙ্গিতে মাথা নাড়ে। বাতাসে মাথা নেড়ে নেড়ে খেলে। দ্রুতপায়ে হেঁটে যাওয়ার সময় রত্না একপলক দেখে ফুলগুলোকে। হলুদ হলুদ ফুলগুলো বেশ পছন্দ তার। এদিকে রাধাদের ক্ষেতেই এতো ফুল হয়েছে এবার। বাতাসে শত শত ফুল নড়েচড়ে উঠে। আহ্লাদী নতুন বউয়ের মতো একজন আরেকজনের উপর হেলে পড়তে চায়।বেশ লাগে দেখতে।মনে হয় যেন মানুষের পৃথিবীতে স্বর্গের একফালি দৃশ্য বুনেছে কেউ।
সূচিদের দুয়ারে পা রেখে বড় এক দম নিলো রত্না।সূচির বৌভাতে যাওয়ার কথা ছিল। কিন্তু ডায়রিয়া একদম কাবু করে ফেলেছিলো মেয়েটাকে।এই কয়েকদিন বিছানা থেকে উঠতে পারেনি।কাল থেকে অবস্থা একটু ভালো। তবুও এই আবহাওয়ায় ঘর থেকে বেরোতো না রত্না।আজ সূচির বিদায় দিন।তাই কষ্ট করে দেখা করতেই এবাড়িতে আসা।কাঁচা রাস্তার সব ধুলাবালি জায়গা করে নিয়েছে রত্নার চোখে। ওড়নার আঁচলে হাত পেঁচিয়ে চোখ ঘসে। গায়ের চাদর ঠিক করে ঘরে ঢুকে।
বসার ঘরে কেউ নেই।মাঝের ঘরেও কেউ নেই। রত্না অগত্যা সূচির ঘরের দরজায় যায়।পুরোনো টিনের দরজা ভেজানো।দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে সূচিকে ডাকে রত্না।
” সূচি,সূচি ”
” কে?”
ভিতর থেকে ফয়সালের কন্ঠ ভেসে আসে।রত্না লজ্জা পায়।ফয়সাল এসময়ে ঘরে থাকবে বুঝতে পারেনি।দরজা খুলে বাইরে বেরিয়ে আসে ফয়সাল।দরজার বাইরে দাঁড়ানো রত্নাকে দেখে ঠোঁট মেলে হাসে।
” ভালো আছো রত্না?”
” জ্বি,দুলাভাই।আপনে ভালো আছেন?”
” এই তো আলহামদুলিল্লাহ। কাকা-কাকির কী খবর? আমাদের বাসায় যায় না কেন?”
” ওই যে আমার শরীরটা খারাপ ছিল, তাই যায় নাই এতোদিন।”
ফয়সালের চেহারায় ফুটে উঠলো উদ্বেগ। উদ্বিগ্ন গলায় প্রশ্ন করেঃ” কী হয়েছিল?”
ডায়রিয়ার কথা বলতে লজ্জা হয় রত্নার। নরম গলায় বলেঃ” তেমন কিছু না দুলাভাই।সামান্য জ্বর-ঠান্ডা।”
” ভালো হয়েছে এখন?”
” হ্যাঁ। সূচি কই দুলাভাই?”
খোশগল্পের মাঝে সূচির খবর বিরিয়ানীর ভিতর লুকিয়ে থাকা এলাচির মতো লাগলো ফয়সালের কাছে। মুখটা ফাটা বেলুনের মতো চুপসে গেল।
” সূচি কি ঘরে?”
” না।উঠোনে কী যেন করছে।”
” উঠানে নাই তো।আমি আসলাম দেখি নাই।”
” তাহলে আর বলতে পারছি না।অনেকক্ষণ ধরেই দেখছি না।সকালের নাস্তার পর আর দেখিনি।”
অবাক না হয়ে পারে না রত্না।বৈধতা পাওয়ার পরেও ফয়সালকে ছেড়ে এদিক-ওদিক ঘুরছে সূচি!এতো উদাসীনতা! অবিশ্বাস্য। বান্ধবীর গোপন প্রণয়ের কথা আল্লাহ ছাড়া শুধু রত্না জানে। আর কেউ জানে না।আগে ফয়সালকে নিয়ে প্রায় দুজনের মাঝে কথা হতো।সূচি তখন রত্নার গায়ে ভর দিয়ে বলতোঃ” দোয়া কর যেন বিয়েটা হয়।বিয়ের পর দেখিস,ফয়সাল ভাইকে আমি শাড়ির আঁচলে বেঁধে রাখব। একদম আলমারির নতুন চাবির মতো।আমার দু-চোখের বাইরে কোথাও যেতে দেব না।”
রত্না এদিক-ওদিক চোখ বুলায়।ঘরে আর কারো অস্তিত্ব খুঁজে পায় না।
” কাকিও কি ঘরে নাই দুলাভাই?”
” আমি বলতে পারি না।সকালের নাস্তার পর ঘুমিয়ে ছিলাম।ঘর থেকে বের হইনি।”
” ওহ,আচ্ছা।তাইলে আমি খুঁইজা দেখি।”
দরজার দিকে এগিয়ে যাওয়ার পথে একটা কথা মনে হলো রত্নার। ঠোঁটের কোনে হাসি ফুটিয়ে আবারো ফিরে এলো সূচির দরজায়।ফিঁচেল হেসে বললোঃ” আপনের বউ একটা নমুনা দুলাভাই।”
” যেমন”— কিঞ্চিৎ অবাক হলো ফয়সাল।
” আল্লাহ, আপনেরে কিছু কয় নাই সূচি? সূচি যে আপনেরে কত পছন্দ করতো! আমি ওর মতো এতো পাগল একটাও দেখি নাই।”
বিস্ময়ের রেশ কাটলো না ফয়সালে।তরতর করে বেড়ে গেল। কপাল কুঁচকে বললোঃ” আমি বুঝলাম না রত্না।”
রত্না হাসে। মধুর হাসি হেসে বলেঃ” আপনেগো বিয়া ঠিক হওয়ার পরেই আমি কইতে চাইছিলাম। সূচি কইতে দেয় নাই।আজকে বলি।আপনে কিন্তু সূচিরে কইবেন না।ঠিকাছে?”
ফয়সাল মাথা নাড়ে।ব্রেকিং নিউজটা শুনতে হবে।
” সূচি আপনেরে অনেক আগ থেকা পছন্দ করে।অনেক পছন্দ করে। যাতে আপনের সাথেই বিয়ে হয় তাই কত দোয়া করতো! আপনেরে দেখলেই ওর পেট মোচড় দিতো।”
খিলখিল করে হাসলো রত্না।হাসির রেশ টেনেই বললোঃ” আমগো মাঝে আপনেরে নিয়াই বেশি কথা হইতো,দুলাভাই। সূচি অনেক পাগল।খালি কইতো, দোয়া কর যাতে আমাদের বিয়েটা হয়।আপনে নাকি তার বাল্য প্রেম। সূচি যেন কেমনে কয়।ওর মুখে শুনতে বেশি ভাল্লাগে। জানেন কী হইছে?”
ফয়সাল বোকার মতো মাথা নাড়ে।জানান দেয় সে জানে না।
” বিয়ার জন্য সূচি মানত করছিলো।কচকচা এক হাজার টাকা ফালাইছে মসজিদের দানবাক্সে।ওয় তো কোথাও যাইতে পারে নাই।বিয়ার দিন চুপে-চাপে আমার হাতে টাকা দিয়া গেছে।আমি মসজিদের দানবাক্সে ফালাইছি। আবার আপনেরা যখন প্রথম দেখতে আসছিলেন,তখনো পাঁচশ টাকা ফালাইছে।আরো অনেক মানত করছে।নফল নামাজ,সূরা ইয়াসীন,সূরা আর রাহমান,আরো অনেক।”
এক শ্বাসে কথা বলো আবারো হাসলো রত্না।লাজুক হেসে বললোঃ” আমি পেটে কথা চাইপ্পা রাখতে পারি না।আপনে কিন্তু আবার সূচিরে বইলা দিয়েন না।কইলে ধরব আমারে। ওয় কইতে চায় না আপনেরে,লজ্জা পায়।”
এতোদিনে চেপে রাখা কথাগুলো ফয়সালের সামনে উগড়ে দিয়ে ভালো লাগলো রত্নার। বাঁচা গেল।মানুষ কথা চেপে রাখে কী করে? রত্না একটুও পারে না। একগাদা কথা বলে হাসিমুখে দরজার দিকে এগিয়ে গেল রত্না।পিছনে ফেলে গেল বিস্মিত ফয়সালকে।বউয়ের গোপন প্রণয়ের কথা শুনে সত্যিই অবাক হয়েছে সে। একপাক্ষিক প্রেমের কথা এতোদিন নাটক-সিনেমায় দেখেছে সে।আজ নিজের কানে শুনলো কোনো এক একপাক্ষিক প্রেমের গল্প।সুন্দরী রত্নার গোপন কথা কানের কাছে মৃদু সুরে গুনগুন করছে। সূচির গোপন প্রেমের ফিসফিসানি কানের কাছে গুঞ্জন তুলছে এখনো। সূচি তাকেই ভালোবাসতো! সত্যি নাকি? প্রার্থনায় শুধু তাকেই চেয়েছে? অদ্ভুত।এতো ভালোবেসেও এতো চোটপাট কী করে করে? কষ্ট হয় না?
মনির ঘরের পিছনে বসে আছে সূচি।আশেপাশে ভাবি মহল গোল করে বসা। কেউ শাক বাছে,কেউ মাছ কাটে,কেউ চাদর মুড়িয়ে বসে আছে। সূচির কাছেই পিঁড়ি পেতে বসে ডাব কাটছে রনি।ধারালো দা দিয়ে একের পর এক আঘাত করছে সবুজ ডাবে।লিলি ঘাঁটের পয়লা সিঁড়িতে বসে হাঁড়ি-পাতিল খেলছে। বালির ভাত রান্না করা শেষ।চুলায় আছে কচুরিপানার মাংস।আগুন বিহীন চুলায় মনোযোগ দিয়ে মিথ্যা-মিথ্যি রান্না করছে।রত্না সূচির পাশে এসে বসলো। সত্যিকারের আবেগের বাড়াবাড়িতে পাশ থেকে জড়িয়ে ধরলো সূচিকে। উৎফুল্ল গলায় প্রশ্ন করেঃ” কেমন আছোছ বইন?”
সূচি হাসে।পাশ থেকে নিজেও জড়িয়ে ধরে রত্নাকে।আলতো হেসে বলেঃ” এই তো ভালো আছি।তোর পেটের অসুখ ভালো হয়েছে?”
” হ। তোর ঠান্ডা লাগলো ক্যামনে? শরীরটাও তো গরম গরম।”
নিজের কপালের উপর থেকে রত্নার হাত সড়িয়ে দিলো সূচি।কপালে উপর থেকে চুল সরিয়ে বললোঃ” না, জ্বর না। এমনিতেই একটু গরম শরীরটা।”
মনি পাশ থেকে মাথা নাড়ে।পাঙ্গাস মাছের মাথাটা বটিতে ফেলে বলেঃ” নারে সূচি।তোর চোখ দুইটাও লাল।জ্বর না থাকলেও আসব মনে হয়।একটা নাপা খায়া ফালাইছ।”
” আচ্ছা খাবনি।”
রত্না নিচু গলায় বান্ধবীর সাথে গল্প করে। দুই বান্ধবী একসাথে বসলেই এরা কথার পসরা সাজিয়ে বসে। রত্না আগ্রহ নিয়ে সূচির গোপন কথা জিজ্ঞেস করে।সূচি কিছুই বললো না।মুচকি হেসে এড়িয়ে গেল কথা। রত্না থেমে থাকে না।আগ্রহ নিয়ে রাতুলের কথা বলে। রাতুলের দেশে আসার দিন এগিয়ে আসছে।দেশে এলেই রত্নার বাড়িতে আসবে বিয়ের কথা নিয়ে।রত্না নিচু গলায় রাতুলের গল্প করে।রত্না শুধু দিন গুনছে।ক্যালেন্ডারের পাতায় কেটে রাখছে একের পর এক তারিখ।মেয়েটার চোখে-মুখে অন্যরকম আনন্দ।আনন্দে চকচক করছে রত্নার সুন্দর মুখ।সূচি চোখ ভরে দেখে। নিজের প্রতিচ্ছবি দেখতে পায় রত্নার মাঝে।সূচিও তো আগে এমন করতো।ফয়সালের কথা বলার সময় ঠিক এমন করেই আনন্দে ভরে যেতো সূচির মুখ। কত ভালোবাসতো ফতসালকে! এখনো ভালোবাসে।কেবল আগের মতো আতিশয্যটা নেই এখন।চুপচাপ প্রিয়তমের কথা ভাবতে ভালো লাগে।কিন্তু মুখ নেড়ে তার সাথে কথা বলতে ভালো লাগে না। ফয়সাল শুধু বাজে ব্যবহার করে।কথায় কথায় ধমক দেয়।শক্ত শক্ত কথা বলে।সূচির রাগ উঠে যায়।পরে সূচিও রাগ করে।গলা শক্ত করে কথা বলে।পরে কী হয়? নিজেই আবার কষ্ট পায়।কষ্টের কথা মুখ ফুটে কাউকে বলতে পারে না।কষ্ট বেড়ে দ্বিগুণ হয়। ওরা দুজন ঘাত-প্রতিঘাতের খেলায় মেতেছে।আজ সকালেও একচোট হলো। তীক্ষ্ণ কথার বাণে জর্জরিত করে ফেললো একে-অন্যকে।বিয়ের দিন থেকেই তো বাজে ব্যবহার করে ফয়সাল।স্বামীর হুটহাট মেজাজ এখনো ঠিক বুঝে উঠতে পারে না সূচি।আজ সকালে তোয়ালে নিয়ে কথা কাটাকাটি হয়েছে দুজনের মাঝে।সূচি ভুল করে ফয়সালের তোয়ালে ব্যাগে নেয়নি। ফয়সাল সকালে গোসল করে।গোসলের সময় সূচি নিজের তোয়ালেটা দিলো।ফয়সাল চোখ-মুখ কালো করে নিষেধ করে দিলো।তার তোয়ালে লাগবে না।সূচিকে বকা-ঝকা করলো ভুলের জন্য। কপাল কুঁচকে বললোঃ” একটা ব্যাগও গোছাতে পারো না? তুমি আসলে কোনো কাজেরই না।মাথামোটা মেয়ে।”
” আমার তোয়ালেটাই নিন।”
ফয়সাল অকারণেই রেগে যায়।সূচির কথার বিপরীতেও রেগে গেল।হিসহিসিয়ে বললোঃ” মুখে মুখে কথা বলবা না। তোমার জ্বিভ এতো চলে কেন?”
” আমি কী করলাম আবার?”
” আবারো কথা বলো বেয়াদব।”
রীতিমতো গালাগালি।সূচির রাগ হলো।তোয়ালেটা বিছানার উপরে সজোরে আছড়ে ফেলে বললোঃ” আপনি আর এভাবে আমার সাথে কথা বলবেন না।যদি এরকম ব্যবহার করতেই হয় তবে আর কথা বলারই দরকার নেই।আপনার হুটহাট রাগের ভার নেওয়ার শক্তি নেই আমার।অসহ্য।”
ফয়সালের মনের খবর জানে না সূচি।তবে নিজের কথা জানে।এই কয়েকদিনেই হাঁপিয়ে গেছে সে।মনে স্বাস্থ্য বলতেও একটা শব্দ আছে।নিজের মাঝে সুস্থ মনের ছিঁটেফোঁটাও খুঁজে পায় না।সবটা রক্তাক্ত,অবহেলায় জর্জরিত। অভিমান করতেও ভালো লাগে না।ক্লান্ত লাগে।যেখানে অভিমানের মূল্য নেই সেখানে অভিমান ধরে রাখাই এক মূর্তিমান বিড়ম্বনা।সূচির আর ভালো লাগে না।কাঁদতেও ভালো লাগে না।চোখের জলকে বিরক্ত লাগে।বিশ্রি অবসন্নতায় ছেঁয়ে গেছে সূচির সবটুকু। বিয়ের দিন থেকে এক সেকেন্ডের জন্যেও শান্তির খোঁজ পায়নি মেয়েটা। এই কয়েকটা দিনে সূচি যা সহ্য করেছে তার একফোঁটাও যদি কেউ আঁচ করতে পারতো,তবে হয়তো ভয় পেতো।পৃথিবীর সবার অবহেলা সহ্য করার শক্তি সূচির আছে।কিন্তু প্রিয়তমের অবহেলা বয়ে বেড়ানোর ক্ষমতা সূচির নেই।এ এক নামহীন বিষ।এই কয়েকদিনেই সূচিকে অর্ধেক খেয়ে ফেলেছে।
________________________________
আরো একবার বিদায়ের ঘন্টা বাজলো। ট্র্যাজেডি গল্পের মতো আরেকবার সবাইকে কাঁদিয়ে কাজি বাড়ির পথ ধরলো সূচি। দু-দিন চলে গেছে চোখের পলকে।এবার বাড়ি ফিরতে হবে। অটোর শক্ত সিটে
মাথা ঠেকিয়ে চুপচাপ বসে রইলো সূচি।অটো চলছে ধীর গতিতে। সূচির শরীরটা ভালো লাগছে না।ঠান্ডায় মাথার সাথে সাথে কানদুটোও ব্যাথা করছে।সত্যিই মনে হয় জ্বর আসবে।শরীরটা কেমন ম্যাজম্যাজ করছে।চোখ খুলে রাখতে কষ্ট হয় সূচির।আসার আগে মা কাঁদেছে,বাবা চোখ মুছেছে পাঞ্জাবির হাতায়।ভাবিরাও কাঁদলো।রনি,লিলিও বাদ যায়নি।খেঁজুর গাছ পর্যন্ত এগিয়ে দিয়েছে সবাই।রনি ফ্যাচফ্যাচ করে কাঁদতে কাঁদতে বললোঃ” আমি তোমারে একটু জড়ায়া ধরি সূচি আপা?”
আর ভাবতে ভালো লাগে না সূচির।ও বাড়ির মানুষগুলোর কথা ভাবতে ক্লেশবোধ হয়।বিয়ে না হলে হয়তো সূচি জানতেই পারতো না সবাই ওকে কতটা ভালোবাসে।পায়ের কাছে ঠকঠক করে কাঁপছে তিনটি বাক্স। বাদামী রঙা বাক্স ভর্তি হরেক রকম পিঠা। মেয়ের সাথে পিঠা-পুলি দিয়ে দেওয়া এখানকার ঐতিহ্য। সূচি দরজার দিকে পা ঠেলে রাখে।খাবারের সাথে পা লাগায় না।
আজকের আবহাওয়া ভালো না। সকালে শুধু বাতাস ছিল।এখন বাতাসের সাথে গুড়িগুড়ি বৃষ্টি পড়ছে।একেকটা বৃষ্টির ফোঁটা কাঁটার মতো।শরীরে এসে পড়লেই খচ করে জ্বলে ওঠে।চলছে নেতিয়ে যাওয়া বিকাল।অপরাহ্নের ময়লা আলো অশরীরির মতো ভর করেছে গাছের মাথায়।চারপাশ ধোঁয়ার মতো ঘোলাটে।বাতাসের তেজ কমেনি বরং বেড়েছে। রাস্তা-ঘাট জনশূন্য। মাঠে মাঠে গরু-ছাগলেরও দেখা পাওয়া যায় না। গাছ-গাছালির ফাঁক-ফোঁকড়ে পাখিদের অস্তিত্ব নেই।আসন্ন ঝড়ের ভয়ে সবাই লুকিয়েছে নিজ নিজ আস্তানায়।উঁচু-নিচু ভেজা মাটিতে সাবধানে চলছে অটো।একটুখানি রাস্তা। আশেপাশে সুপারি গাছ,কাঁটাঝোপ। সূচি একদৃষ্টিতে বাইরে চেয়ে থাকে।পাশেই বসে আছে ফয়সাল।শক্ত সিটে পিঠ ঠেকিয়ে স্থিরভাবে বসে আছে।দুজনের মাঝে চোখে পড়ার মতো দূরত্ব। সকাল থেকে প্রয়োজনীয় কথা ছাড়া খুব বেশি একটা কথা বলেনি সূচি।ফয়সালের নজর থেকে এক প্রকারে পালিয়েই ছিল।বেলায় বেলায় অশান্তি ভালো লাগে না।
কাঁধ থেকে পিছলে পড়া চাদরটাকে আরো ভালোভাবে জড়িয়ে নিলো সূচি। একটু দূরের অশ্বত্থ গাছের মাথা দেখা যাচ্ছে। বাতাসের তোড়ে থরথর করে কাঁপছে গাছের পাতা।ভূমির বাড়ির কাছাকাছি চলে এসেছে অটো।বেড়ার ফুটো টিন দেখা যাচ্ছে।বকের মতো গলা বাড়িয়ে বাড়িটা দেখলো সূচি। সাহস করে ফয়সালকে বললোঃ” আপার বাড়ির সামনে অটোটা একটু থামাবেন?”
” বাইরে বৃষ্টি পড়ছে।”
” পাঁচ মিনিটের জন্য একটু রাখুন।আমি একটু দেখা করেই চলে আসব,প্লিজ।আমি অনেকদিন আপার সাথে দেখা করিনি।”—- সূচির কন্ঠে অনুনয়।এমন কন্ঠ বিয়ের পর থেকে শোনেনি ফয়সাল।শুনতে বেশ লাগলো।তবে বিচলিত হলো না সে।বাইরের দিকে চোখ রেখে গম্ভীর গলায় বললোঃ” তুমি কি পাগল? এখন যাওয়া যাবে না।”
চলন্ত অটো বাড়িটাকে পিছনে ফেলে এগিয়ে গেল সামনে। হেলেদুলে চলতে শুরু করলো রাস্তা পাশ ঘেঁষে। সূচি আর অনুরোধ করলো না।নির্জীবের মতো হেলান দিয়ে বসে রইলো কেবল।
____________________________
সন্ধ্যা থেকেই জ্বর জ্বর লাগছে সূচির।প্রথমে পাত্তা দেয়নি।কিন্তু শরীর ভেঙে পড়তেই আর অবহেলা করতে পারলো না। মাথা ভারী হয়ে আছে।চোখের পাতা দুটো খুলে রাখা দায়।নাক বন্ধ হয়ে আছে।ঠান্ডা লাগলে এই এক সমস্যা।সূচির নাক বন্ধ হয়ে যায়।মুখ দিয়ে দম নিতে হয় তখন।
মাগরিবের দশ মিনিট আগে বাড়ি ফিরেছে ওরা।বাতাসের সাথে সাথে তখন বেড়েছে বৃষ্টির তেজ।অটো থেকে নেমে ঘরে আসতে আসতে বেশ খানিকটা ভিজে গিয়েছিলো সূচি। তারপর থেকে বেশি ঠান্ডা লাগছে।অসময়ের চার-পাঁচ ফোঁটা বৃষ্টি মাথায় পড়েছে বলেই হয়তো মাথাটা বেশি ভারী।এশার আযানের সাথে সাথেই আজ নামাজ পড়ে ফেললো সূচি।ইচ্ছা ছিল নামাযের পরপরই ঘুমিয়ে যাবে।ভীষণ ক্লান্ত লাগছে শরীর।খেতেও ইচ্ছা করছে না।বাইরে ঝুম বৃষ্টি।বসে থাকতে কষ্ট হচ্ছিলো। পিঠ ভেঙে আসছিলো। তবুও নামাযের জন্যে ঠায় বসেছিল।কোনোমতে নামায শেষ করে বিছানার কাছে গেছে,এমন সময়েই সূচির ডাক পড়লো।রোমেলা বানু ডাকছেন।কপাল অবধি আঁচল টেনে দিয়ে সূচি শ্বাশুড়ির ঘরে যেয়ে দাঁড়ালো।দুয়ারে দাঁড়িয়ে ক্ষীণ গলায় বললোঃ” আসব আম্মা?”
” হ, আসো।”
ঘরে ঢুকলো সূচি। কষ্ট করে দাঁড়িয়ে রইলো খাটের কাছে।এই মানুষটাকে অকারণেই ভয় করে।কেমন কাটখোট্টা সেপাইয়ের মতো একটা মুখ।
তর্জনী আঙুলের সবটুকু চুন জ্বিভে ঠেসে দিলো রোমেলা বানু।পানের নির্যাসটা গলায় নিয়ে প্রশ্ন করলোঃ” তোমারে সন্ধ্যা থেকা দেখলাম না যে?”
” ঘরেই বসেছিলাম আম্মা।”— মিনমিন করে উত্তর দেয় সূচি।
” ফয়সাল কই?”
” বোধহয় খামারে গেছে।”
” এই বৃষ্টিতে! তুমি এখন কী করবা?”
” একটু ঘুমাতে চেয়েছিলাম আম্মা”— সূচির গলায় ইতস্ততবোধ।
রোমেলা বানুর কপাল কুঁচকে গেল।দু-পাটি দাঁতের মাঝে পানের ছোবা রেখে আগাগোড়া নিরীক্ষণ করলেন সূচিকে।ফ্যাসফ্যাসে গলায় বললেনঃ” এহন ঘুমাইবা ক্যান?”
সূচি জ্বিভ দিয়ে ঠোঁট ভিজায়।উত্তর দেওয়ার সাহস সঞ্চয় করে বলেঃ” আমার মাথাটা একটু ধরেছে আম্মা।”
” একটু মাথা ধরলেই শোওন লাগে না।মাইয়া মাইনষে হাজারটা অসুখ কোমড়ে বাইন্ধা সংসার করে। সন্ধ্যার লগে শোয়া অলক্ষ্মীর লক্ষণ।বুঝছো?”
উপর-নিচে মাথা দুলায় সূচি।মাটির দিকে চেয়ে থাকে।
” শোনো বউ,আমগো ঘরে কেউ নাই।আমি,তুমি,ফয়সাল–আমরা এই কয়জনই।ঘরের হাল কিন্তু তোমারই ধরতে হইব।মুখ ঘুরায়া থাকলে চলব না। তুমি নতুন বউ তাই বইলা হাত গুটায়া থাকবা না।বউয়েরা নতুন থাকে তিনদিন।বিয়ার দিন,তার পরেরদিন,তার পরেরদিন।তোমার এইসব চুইক্কা গেছে।এখন থেকা আমগো সংসারের লগে মিশ্যা যাইতে হইব।ঠিক আছে?”
” জ্বি আম্মা।”
সূচির মিনমিনে কন্ঠে সন্তুষ্ট হলেন রোমেলা বানু।ঘরের বউদের তেজ থাকা ভালো না।এরা হবে মাটি।এদেরকে পিটিয়ে পিটিয়ে,আগুনে পুড়িয়ে শক্ত করতে হয়।জানলায় শিক গলিয়ে উঠোনে পানের পিক ফেললেন রোমেলা বানু।প্রসন্ন গলায় প্রশ্ন করলেনঃ” বউ,রুটি বানাইতো পারো?”
রুটি জিনিসটা ঠিক হয় না সূচির।আটাকে বেলুন দিয়ে জোর খাটিয়ে বেলে ঠিকই কিন্তু তা চাঁদের মতো গোল হয় না। কখনো জুতোর মতো,কখনো মানচিত্রের মতো আবার কখনো কোনো আকারহীন অচেনা এক বস্তু হয়। সূচি ইতস্তত করে বললোঃ” আম্মা,পারি কিন্তু পুরোপুরি হয় না।”
” একটু তো পারো।”
“জ্বি।”
” তাইলে আমার লেগা কয়টা রুটি বানাও।রুটি যেন না পোড়ে। আমি রাইতে রুটি খাই।মনে রাইখ।”
” আচ্ছা,আম্মা।”
” আর সাথে বেগুন আর আলুরে ভাজি কইরো।হালকা তেলে ভাজবা।”
” ঠিকাছে।”
এলোমেলো পায়ে ঘর ছাড়লো সূচি।দু-চোখে সবকিছু ঘোলা দেখছে।পা কাঁপে সূচির।শক্তি পাচ্ছে না।শরীরটা সত্যি খারাপ লাগছে।রান্নাঘরে যাওয়ার পথেই মাঝের ঘরের আলমারিটা সামনে পড়লো।সূচি আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজের প্রতিবিম্ব দেখে।রক্তজবার মতো টকটকে দুটো চোখ।জ্বর এলেই সূচির চোখ লাল হয়ে যায়। আলমারির সাথে ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়ে কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিলো সূচি।ঠান্ডা লাগলে নিঃশ্বাস নিতে কষ্ট হয়।নাক বন্ধ থাকে বলে শ্বাস আঁটকে যায়।সূচি জোর করে শ্বাস নেয়।নাকের বদলে মুখ ব্যবহার করে।বাঁশপাতার মতো সরু ঠোঁটদুটো কিঞ্চিৎ ফাঁক করে রাখে। ফাঁপড়ের মতো ওঠানামা করে বুক।ক্লান্ত চোখে দূরের রান্নাঘরের দিকে তাকায়।সত্যি খুব ক্লান্ত লাগছে সূচির।
রান্নাবান্না, খাওয়া-দাওয়া ও শ্বাশুড়ির বিছানা করে দেওয়ার পর নিজের বিছানায় আসতে রাত দশটা বেজে গেল।বাইরের তীব্র বাতাসের সাথে সাথে ঝরছে মেঘের জল। হুমায়রার ঘরের টিনে বৃষ্টিরা আছড়ে পড়ছে।ঝুমঝুম শব্দ ভেসে আসছে।দূরে কোথাও বোধহয় বাজ পড়লো।ক্ষীণ শব্দ শোনা যাচ্ছে এখান থেকেই।
কারেন্ট নেই।বাতাস বাড়ার সাথে সাথেই কারেন্ট চলে গেছে। সেও দু-ঘন্টা আগের ঘটনা।মহামান্য বিদ্যুৎ আবার আসবে কবে তা জানা নেই।একটু বৃষ্টি-বাতাস হলেই কারেন্টের শুক্রবার শুরু হয়।আসতেই চায় না।
টেবিলের উপর মোমবাতি জ্বলছে।আগুনের তাপে গলে পড়ছে মোম। মিনিটের মাঝেই আবার জমে যাচ্ছে।ঘরের দরজা-জানলা বন্ধ।বাতাস আসছে না ঘরে।মোমের স্থির বহ্নি শিখায় একহাত জায়গা পরিষ্কার দেখা যায়।বাকিটুকুতে জমাট বাঁধা অন্ধকার।মশারির ভিতর শুয়ে আছে ফয়সাল।চোখ বুজে পাথরের মূর্তির মতো শুয়ে আছে বিছানায়।সন্ধ্যা থেকেই চোখে ঘোলা দেখছে সূচি।এই অন্ধকারে সবকিছু আরো ধোয়াশা লাগছে।মাথা তুলে ফয়সালকে এক নজর দেখলো।স্পষ্ট দেখা যায় না।কেবল আলিঝালি ফয়সালের একটা অবয়ব দেখা যায়।সূচি মোম নিভিয়ে হাতড়ে হাতড়ে বিছানায় এলো।মশারি তুলে আস্তে করে ঢুকে গেল ভিতরে।আজ আর ঝামেলা করতে হলো না।ফয়সাল একপাশে চেপে শুয়েছে।এদিকে অনেকখানি জায়গা।সূচির জন্য বরাদ্দ অর্ধেক কম্বল।আপাদমস্তক কম্বল মুড়িয়ে শুয়ে পড়লো সূচি।
দুটো কম্বল,একটা পাতলা কাঁথা, গায়ে সুতির শাড়ি।তবুও কাঁপুনি থামলো না সূচির।কচি কিশলয়ের মতো তিরতির করে অনবরত কাঁপছে মেয়েটা।থরথর, থরথর।মস্তিষ্কে বইছে উষ্ণ রক্তস্রোত।ভারী কম্বলের নিচে শরীর গুজেও আরাম পাওয়া যায় না।সূচির কাঁপুনি থামে না।আরেকটু উষ্ণতার জন্যে আগুন গরম শরীরটাকেই ঠেলে দিলো ফয়সালের দিকে।পিঠে মাথা রেখে পড়ে রইলো একভাবে।সূচি ঘুমায়নি আবার পুরোপুরি জেগেও নেই।ঘুমন্ত ও জাগ্রতের মাঝে এক প্রকারে পড়ে আছে।
ফয়সাল হয়তো জেগেই ছিল।সূচির ভারী মাথা পিঠে পড়তেই নড়েচড়ে উঠলো।সূচির দস্যু চুলগুলো গলার কাছে সুড়সুড়ি দিচ্ছে। ফয়সাল বিরক্ত হয়।কপাল কুঁচকে বলেঃ” ওদিকে চেপে শোও।”
” আমার খুব ঠান্ডা লাগছে।”
” ঢং করবে না সূচি।”
সূচি কাঁপতে কাঁপতে আরেকটু চেপে শোয়।ফয়সালের কানের কাছে মুখ তুলে ফিসফিসিয়ে বলেঃ” আপনি আমাকে ভালোবাসেন না কেন?”
সূচির কন্ঠে এক আকাশ আকুলতা। মস্তিষ্কে বহমান উষ্ণ রক্তস্রোতের অবদানে এলোমেলো বকে সূচি। ভেঙে পড়া হতাশ মানুষের মতো পুনরায় প্রশ্ন করেঃ” আমি আপনার কী ক্ষতি করেছি?আপনি সবসময় এমন করেন কেন?
চলবে…