#শুকতারা (পর্ব-২২)
#হালিমা রহমান
রাতের তীব্র উষ্ণতা সকাল পর্যন্ত টিকলো না।ভোজভাজির মতো চলে গেল।বেলা গড়ালে যেমন কুয়াশা কাটে, তেমনি সূর্যকিরণ ধরনী ছুঁতে না ছুঁতেই সূচির জ্বর পালালো।রীতিমতো লেজ গুটিয়ে পালালো।তীব্র জ্বরের ছিঁটেফোঁটাও নেই। ঘাম দিয়ে জ্বর ছেড়েছে।পুরো শরীর ভিজে জবজবে হয়ে আছে। কালচে খয়েরী রঙা শাড়িটা ঘামে ভিজে কিছুটা লেপ্টে আছে সূচির শরীরে,আঁচলের কিছু অংশ ফয়সালের গলার কাছে। এলোমেলোভাবে শুয়ে থাকা ফয়সালের পাশ ঘেঁষে সাবধানে উঠে গেল সূচি।ডান হাতের উল্টো পিঠে গলার নিচের চকচকে ঘামটুকু মুছে ফেললো।গরম লাগছিলো বলে শরীর থেকে কম্বল ফেলে দিয়েছিলো।অনাদরে ফেলে দেওয়া কম্বলটা ফয়সালের পায়ের কাছে পড়া।অলস হাতে কম্বল তুলে সূচি সযত্নে জড়িয়ে দিলো ফয়সালের গায়ে। ঈষৎ মেলে রাখা ঠোঁট দুটোতে হাত বুলিয়ে দুটোকে জোড়া লাগিয়ে দিলো।বালিশের একপাশে প্রিয়তমের ভারী মাথাটা কাৎ হয়ে পড়ে আছে।সূচি দুর্বল হাত দুটো দিয়ে আদুরে ভঙ্গিতে তা বালিশে তুলে দিলো। ফ্যাকাশে ঠোঁট দুটো মেলে অল্প-বিস্তর হেসে ফয়সালের বটগাছের মতো ঝাঁকড়া চুলে হাত বুলিয়ে দিলো।এই চুলগুলো সূচির ভারী পছন্দ।একমাথা কালো কোঁকড়া চুল।একটা আরেকটার সাথে প্যাঁচিয়ে থাকে সবসময়।চিরুনী চালিয়ে লাভ হয় না।কিছুতেই এই চুলগুলো সোজা হয় না।সূচি হাঁটুতে মুখ গুজে চুপচাপ চেয়ে রইলো একমনে।কালো কোঁকড়াচুল, চাইনিজদের মতো ছোট ছোট দুটো চোখ,খাঁড়া নাক,দুটো ঠোঁট, আপেলের মতো গর্ত হয়ে যাওয়া একটা পরিষ্কার থুতনী,শক্ত-পোক্ত,লম্বা-চওড়া একটা ছিপছিপে শরীর– এর মাঝেই সূচি মরেছে। চিরতরে ডুবে গেছে বিষের সাগরে।সে অনেক কাল আগের কথা।সূচির কৈশোরের প্রথম প্রহরের লজ্জাজনক অধ্যায়ের উপাখ্যান। তপ্ত সূর্যে তেঁতে উঠা এক ত্যক্ত দুপুরের কথা।সেই বারো-তেরো বছর বয়সের কোনো এক অলক্ষুণে দুপুরে, ঘামে ভেজা ফয়সালকে দেখেই প্রথম মরেছিল সূচি।আহা রূপ! ফয়সালের সৌন্দর্যেই প্রথম মরেছে সূচি,এ একবারে ডাহা সত্যি কথা।সূচির চোখে ফয়সাল রূপবান।বাড়াবাড়ি রকমের সৌন্দর্যের ভীড় ছেলেটার সারা শরীরে।ফয়সালকে এর আগেও বহুবার দেখেছে সূচি।কিন্তু সেদিনের দেখায় আর আগের দেখায় ছিল আকাশ-পাতাল তফাৎ। আগে দেখতো বড় বোনের সহপাঠী হিসেবে।সেদিন দেখলো প্রেমিক হিসেবে।ভালো লাগার প্রথম সোপানেই সূচির মনে হলো,সে প্রেমে পড়েছে।অপ্রকাশিত, একপাক্ষিক প্রেম।সূচি নিশ্চিত ইঁচড়েপাকা। বয়সের আগে পেকেছে বলে তার অনুভূতিরা এতো বুড়ো,এতো বয়স্ক।বছরের পর বছর গড়িয়েছে,দিনের পিঠে দিন গেছে,সূচি আরো পাগল হয়েছে।একপাক্ষিক প্রেমগুলো বোধহয় এমনই হয়। স্বীকৃতি পাওয়ার আগ থেকেই এরা ডাল-পালা মেলে দেয়।অনুমতি নেয় না,অনুযোগের সু্যোগ দেয় না,প্রাপ্তির আশা থাকে না।এর উল্টো পিঠে অনিশ্চয়তা মাখা ভয় আর ভয়।সূচির সাথেও এমন হয়েছে।স্কুল,কলেজে যাওয়ার পথে রাস্তা-ঘাটে লুকিয়ে-চুরিয়ে দেখতে দেখতে বুঝতেই পারলো না, অনুভূতিগুলো কবে বুড়ো বটগাছের মতো বহুদূর অবধি শিকড় গেড়েছে। অন্তরের অন্তস্থল পর্যন্ত হাতড়ে হাতড়ে সূচি অবাক হয়।শত তাচ্ছিল্যের পরেও এখানে তারই আধিপত্য। সূচি ভারতবর্ষ,ফয়সাল ইংরেজ।কামান,গোলা-বারুদ নিয়ে গেড়ে বসেছে।তাই তো হাজারবার চোখ রাঙানোর পরেও সূচি তার চোখেই মরে।সূচি নিশ্চিত বেহায়া।আত্মসম্মানবোধের ছিটেফোঁটাও নেই।তাই তো বিষের সাগরে হাত-পা-ঘাড় ভেঙে ডুবতে চায়।
বন্ধ জানলা গলে ভোরের আলো আসছে।সুচের মতো সরু আলোতে ফয়সালকে আবছা আবছা দেখা যায়। পরিষ্কার ভোরের স্নিগ্ধ আলোতে সূচি প্রাণভরে দেখলো প্রিয়তমকে।রাতে ভালো ঘুম হওয়ায় সকালের দিকে সূচির মনটা ভালো আজ।হৃদয়ের সবটুকু প্রেম, ভালোবাসা ঢেলে দিয়ে সূচি ফয়সালের এলোমেলো চুলগুলোতে হাত বুলিয়ে দিলো।এলোমেলো প্যাঁচানো চুলগুলোকে আদর করলো বারেবারে। এরপর আরেকটা কাজ করলো সূচি।দুঃসাহসিক একটা কাজ। যেই কাজটা সূচি ভূমির বাড়িতে করতো।নিরিবিলি ঘরে ফোনের স্ক্রিনে ঠোঁট ঠেকিয়ে হৃদয়ের আনুগত্য প্রকাশ করতো।আজ ঠিক সেটাই করলো। এক আকাশ আবেগের বাড়াবাড়িতে টুক করে একটা চুমু এঁকে দিলো ফয়সালের শুকনো কপালে। ফর্সা, লম্বা কপালটাতে হৃদয়ের সবটুকু আনুগত্য ঢেলে দিয়ে আরেকটা চুমু দিলো।দুঃসাহসী সূচির মুখে হাসি ফুটলো বহুদিন পর।হতভাগী সূচির বহু বছরের লালিত সাধ পূরণ হলো আজ।
কাল রাতের জ্বরে খুব ভুগেছে সূচি। ঠান্ডায় কান-মাথা-গলা সব ব্যাথা।নাক বন্ধ,জ্বরের তীব্রতায় বারবার কেঁপে উঠতে উঠতে সূচির প্রাণ যায়। ফয়সাল আর যাই হোক অমানবিক নয়।সূচির জ্বর টের পেতেই উঠে একটা নাপা খাইয়ে দিলো।ঔষধ খাওয়ার ঘন্টাখানেক পরেই জ্বর ছেড়েছে সূচির।মাথা ধরাটাও কমেছে।শেষ রাতের দিকে আরামে ঘুমাতে পেরেছে।দেরিতে ঘুমিয়েছে বলেই আজ একটি দেরিতে ঘুম ভেঙেছে সূচির।
ফজরের নামাজের ওয়াক্ত শেষ বলে সূচি তাড়াহুড়ো করে উঠলো না বিছানা থেকে। শাড়ি সামলে, বালিশ ঠিক করে,মশারি গুজে খুব ধীরে নামলো বিছানা থেকে। এলোমেলো চুলগুলো হাত খোঁপা করতে করতে জানলা খুলে দিলো।মুহূর্তেই এক দমকা বাতাসে মাখামাখি আলো ছুঁয়ে দিলো সূচিকে।সূচি প্রাণভরে শ্বাস নিলো। ফয়সালের কাল রাতের একটুখানি যত্ন সূচির চোখে ফুলে-ফেঁপে উঠছে।ফয়সালের কাজে নিছক দায়বদ্ধতা ছাড়া আর কিছু ছিল কি না কে জানে।কিন্তু সূচি এটিই ভুলতে বসেছে। তার মনে হচ্ছে,ফয়সাল এই কয়েকদিনে একটু হলেও দূর্বল হয়েছে।আর কিছুদিন যাক।ছেলেটা নিশ্চিত সূচিকে চোখে হারাবে।এতোদিন মোনাজাতে সূচি কেবল ফয়সালকে চেয়েছে।আজ প্রার্থনা কবুল হওয়ার পর মনে হচ্ছে এতোদিন ঠিকঠাকভাবে চাওয়া হয়নি।পছন্দের মানুষটাকে পাওয়াই কি সব? তাকে পেলেই হয় না, তার মনোযোগও লাগে। তার ভালোবাসা, দুর্বলতা, যত্ন সব লাগে।তাই আজ সূচির প্রার্থনা বদলে গেল।চাওয়া-পাওয়ার ছকটাও নতুন করে কষতে হল।তাই জানলার শিকে মাথা ঠেকিয়ে সূচি অন্যরকম এক দোয়া করলো।ভোরের নতুন আলোয় নতুন এক আর্জি জানালো দয়াময়ের দরবারে।প্রথমবারের মতো প্রাণভরে প্রার্থনা করলোঃ” হে খোদা,তাকে আমার প্রতি দুর্বল করে দাও। আমি যেমন তাকে চাই,সে জানে তার চেয়েও বেশি আমায় চায়।আমার চাইতে দশগুণ বেশি পাগল যেন সে হয়।প্লিজ খোদা,আমি আর কিছু চাই না।”
____________________________
সূচি যখন হাত-মুখ ধুয়ে রান্নাঘরে পা রেখেছে,তখন ঠিক আটটা বাজে।দেরি হয়েছে বলেই সূচি ভেবেছিল আজ আর রুটি বানাবে না।তাড়াতাড়ি করে এক পট চালের ভাত বসিয়ে দেবে।রাতের ডাল আছে।এর সাথে দুটো ডিম ভেজেই সকালটা চালিয়ে দেবে।জ্বর কমলেও ম্যাজম্যাজে ভাবটা কমেনি।কেমন অলস অলস লাগছে নিজেকে।তাছাড়া, আজ কাজ আছে।এই ঘরে থাকতে সূচির গা ঘিনঘিন করে। বাথরুম থেকে শুরু করে বেডরুম,সব নোংরা।একগাদা ধুলাবালি সবজায়গায়।এমনকি রান্নাঘরেও।নিত্য ব্যবহার্য পাতিলগুলো ছাড়া সব পাতিল ময়লায় কালো হয়ে আছে।মশলার কৌটা,চালের ড্রাম,ডালের কৌটা,সবজি রাখার ঝুড়ি– সবকিছুই ময়লায় কালচে হয়ে আছে। কাল রাতেই সূচি বুঝে গেছে,এ বাড়িতে আড়ম্বরের বালাই নেই।অনাড়ম্বরভাবে সূচিকেই হাল ধরতে হবে।দুই কাঁধে হাজারটা দায়িত্ব নিতে হবে।সুতরাং অযথা দেরি করে লাভ কী? আজ থেকে একটু একটু করে কাজ করা ভালো।এদিক-ওদিক তাকাতে পারে না সূচি।রান্নাঘরে বসে এক লোকমা ভাত মুখে দিতেও শরীর শিরশির করে।মনে হয় যেন, এক লোকমায় এক বস্তা বালি পড়েছে দাঁতের নিচে।
মেপে এক পট চাল পাতিলে ঢালতেই সূচির ডাক পড়লো। রোমেলা বানু ডাকছেন।সূচির ইচ্ছা ছিল ভাত বসিয়ে রান্নার কাজে হাত দেবে।কিন্তু মাঝ পথে শ্বাশুড়ির ডাক পড়তেই অগত্যা সেদিকেই পা বাড়াতে হলো।
দরজার সামনে দাঁড়িয়ে নিচু গলায় অনুমতি চাইলো সূচি।
” আম্মা,আসব?”
” হ,আসো।”– রোমেলা বানুর মুখ থমথমে। কঠিন মুখে রাগের ছাপ।পানদানীতে মত্ত ডান হাতের আঙুল দুটোতেও অসাধারণ তীব্রতা।সূচির অকারণেই ভয় হলো খুব।এই মানুষটাকে সূচি ভয়াবহভাবে ভয় পায়।
” কয়টায় উঠছো ঘুম থেকা?”
” মাত্রই আম্মা।”— শাড়ির আড়ালে লুকিয়ে থাকা হাঁটু দুটো কাঁপছে সূচির। থরথর করে কাঁপছে ভয়ে,দুঃশ্চিন্তায়।
” এইটা তোমার বাপের বাড়ি না।যা মন চায় তাই করতে পারবা না।বেলা ফুটছে আরো আগে।ফজরের নামাজ পড়ছো?”
” না,আম্মা।আজকে ছুটে গেছে।”
” নামাজটাও পড়ো নাই!”— অবাকের রেশে দু-আঙুলে ধরে রাখা পানটাও মুখে পুরলেন না রোমেলা বানু।
সূচি কাঁপা গলায় কৈফিয়ত দেওয়ার চেষ্টা করলো।মাথা নিচু করে বললোঃ” আসলে আম্মা,কাল রাতে খুব জ্বর এসেছিল,ঘুমাতে দেরি হয়েছে।সকালে তাই উঠতে দেরি হয়ে গেল।”
রোমেলা বানু কঠিন গলায় বললেনঃ” তোমার এইসব অজুহাতগুলি বাদ দাও।এইসব অজুহাত এইখানে চলব না।মানুষ চড়ায়া ভাত খাইছি আমি।আজকে শিখায়া দিতাছি কেমনে কী করবা।আর যেন শিখাইতে না হয়।ঐ চেয়ারে বসো।”
কলের পুতুলের মতো বসলো সূচি।একমনে ফ্লোরের দিকে চেয়ে রইলো।
” ফজরের আগে উঠার চেষ্টা করবা।ফজরের পরে ঘুম থেকা উঠবা না। বউ মানুষগো ওতো বিলাসিতা করোন লাগে না।ভোরে আগে হাতে-মুখে পানি দিয়া উঠান ঝাড়ু দিবা।বেলা ফুটার আগে যেন বাসি ঘর আর বাসি উঠান ঝাড়ু দেওয়া হয়।ফয়সালরে কইছি খামার করে থেকা দুইটা গরু আনতে।আমি পারতাম না দেইখা এতোদিন গরু বাড়িতে রাখি নাই।গেরামের বাড়িতে গরু,হাঁস-মুরগী না পাললে আঁতকুড়ার মতোন লাগে।উঠান ঝাড়ু দিয়া গরুরে খাওয়াইবা।হাঁস ছাড়বা,মুরগীরে খাওন দিয়া মুরগী ছাড়বা।আমি ঠান্ডা পানিতে ওযু করতে পারি না।আমি ঘুম থেকা উঠার আগে পানি গরম করবা।নামাজ পইরা সকালের লেগা হালকা নাস্তা বানাইবা।হালকা নাস্তা।একটু সেমাই নাহয় নুডুলস।অথবা একটু তেলের পিঠা ভাজবা।সকালের নাস্তা যেন সাড়ে ছয়টা সাতটার মইধ্যে হয়। এরপর সকালের খাওন। আমগো কিছু জমি নিজরা চাষ করে আর কিছু বর্গা দেওয়া।জমিতে বদলারা কাজ করে।হেগো সকালের খাওন আমগো বাসা থেকা দেয়।হেগো লেগা পান্তা ভাত আর দুই-তিন পদের ভর্তা।তাগো ভাত আলাদা রানবা,আমগো ভাত আলাদা রানবা।ভাজি-টাজি করবা সকালের লেগা।আন্দাজ কইরা করবা।যেন বেশি না হয়।বাসি-টাসি আমরা খাই না।তুমি কি শুনতাছো?”
” জ্বি আম্মা।”
” সকালের খাবার রান্দার পরে জামা-কাপড় ধুইবা।আমরা সকালে গোসল করি।আমার জামা-কাপড়,ফয়সালের জামা-কাপড় সাবান দিয়া সকালের মইধ্যেই ধুইয়া ফেলবা। তারপর দুপুরের রান্দা রানবা।ওইডা আমিই তোমারে বইলা দিমুনি কী রানতে হইব।দুপুরের খাওনের পর থালা-বাটি জমায়া রাখবা না। লগে লগে ধুইয়া ফেলবা। বিকালে আবার উঠান ঝাড়ু দিবা।তারপর বিকালের নাস্তা তৈরি করবা।হাঁস-মুরগী ঘরে ঢুকাইবা,গরুরে খাওয়াইবা,গাছে পানি দিবা।সন্ধ্যার সময় আবার রাইতেরটা রানবা।আমরা কিন্তু তিন বেলাই গরম গরম খাই।রান্দা শেষ কইরা আবার লগে লগে হাঁড়ি-পাতিল ধুইয়া ফেলবা। এরপর রাইতে ঘর-দোর ঝাড়ু দিয়া,রুমে রুমে মশারি টাঙায়া তারপর ঘুমাইতে যাইবা।বুঝছো?”
সূচি অস্ফুটে উত্তর দেয়ঃ” জ্বি,আম্মা।বুঝতে পেরেছি।”
” আজকের মতো এতো দেরি আর কখনো করবা না। ফয়সালের লগে তাল মিলায়া সাত-সকালে ঘুমায়া থাকলে চলব না।রাজ্য চালাইলেও মহিলাগোরে হাড়ি ঠেলতে হয়।শুধু জামাই ধইরা বইসা থাকলে চলব না।”
শ্বাশুড়ির শেষ কথা সূচির কান ঝাঁ ঝাঁ করে উঠলো লজ্জায় কান দিয়ে ধুয়া ছুটে গেল।মাথা নিচু করে মিনমিন করে বললোঃ” আর ভুল হবে না আম্মা।”
” ভুল না হইলেই ভালো।তোমার মায় কী শিখাইছে তা জানি না।কিন্তু এইখানে আমি যেমনে শিখামু তেমনেই চলবা।”
” জ্বি আচ্ছা আম্মা।”
রোমেলা বানু সন্তুষ্ট হলেন।পানটাকে মুখে পুরে প্রসন্ন গলায় বললেনঃ” এহন কী রানতাছো?”
” এক পট ভাত বসিয়ে দেব। ভেবেছি ডিম ভাজব আর রাতের ডাল আছে..
” তুমি রাইতের বাসি ডাইল খাওয়াইবা! কী শিখাইলাম এতোক্ষণ? তোমার কানে কিছু ঢুকে নাই?”– শেষদিকে অত্যন্ত কঠিন শোনালো রোমেলা বানুর কন্ঠ। ধমকে জড়োসড়ো হয়ে একটুখানি হয়ে গেল সূচি।এপাশ-ওপাশ মাথা দুলিয়ে নিচু গলায় বললোঃ” আমি নতুন করে শিম-আলুর ভাজি,আর বেগুন ভর্তা করে নিচ্ছি আম্মা।”
” আজকে যা করছো তা সহ্য করলাম।ভবিষ্যতে আর যেন না হয়। আমরা সকালে রুটি খাই।আমার ডায়বেটিস আছে।তুমি জান না?”
সূচি জানতো না।তাই মাথা নেড়ে নিজের অপারগতা প্রকাশ করলো।
” আমি সকাল আর রাইতে রুটি খাই। তাই আমার লেগা রুটি বানাইবা।পোড়া যেন না হয়। আজকে আর বদলাগো লেগা খাওন রান্দা লাগব না।যায়া সকালেরটা রান্দো।তাড়াতাড়ি করবা।এক ঘন্টার মইধ্যে যেন হয়।”
” জ্বি,আম্মা।”
মাথা নিচু করে বেরিয়ে যাচ্ছিলো সূচি।দরজা পেরোনোর আগে ফের পিছু ডাকলেন রোমেলা বানু।বালিশে হেলান দিয়ে আয়েসী ভঙ্গিতে বললেনঃ” তাড়াতাড়ি রান্দা শেষ কইরা আসো তো।আমার কোমড়টা ব্যাথা করতাছে কালকে রাইত থেকা।একটু টিপ্পা দাও।পারবা না?”
সূচি সম্মতি জানিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। রোমেলা বানুর ঠিক করে দেওয়া রুটিন মাথায় ঘুরছে এখনো।এখনি মাথা ঘুরছে সূচির।বাবার বাড়িতে নিজের কাজ ছাড়া বাড়তি একটা কাজও করেনি সূচি।বাবা-মায়ের কাজ তো বহু দূরের কথা।বিবাহিত জীবনের শুরুর দিকে এতো দায়িত্ব,পুরোনো গৃহিনীদের মতো একগাদা কাজের ফর্দ সূচিকে হতবিহ্বল করে দিলো।শ্বাশুড়ির কথায় স্পষ্ট বুঝতে পারছে, সামনের দিকে দম ফেলার সময় খুঁজে পাওয়া মুশকিল হবে।আনাড়ি সূচি তখন চলবে কী করে? মানিয়ে নেবে কী করে? ভাবনা সাগরে ডুবে গেল সূচি।চিন্তার স্রোতে থই পায় না মেয়েটা।রোমেলা বানুর থেকে কাজ শিখতে হবে,এ যেন আরেক দুশ্চিন্তা। মানুষটা খালি ধমক দেয়।
সূচি তার সামনে গেলে ভয়েই মরে যায়।সেখানে কাজ শিখবে কী করে?
মাঝের ঘরে পা দিতেই ফয়সালের সাথে দেখা।মাত্র ঘুম থেকে উঠেছে বোধহয়।শুকনো মুখ,চোখের কাছে পিঁচুটি লেগে আছে।মুখোমুখি দেখা হওয়ায় সূচিকে আগাগোড়া পরীক্ষা করলো ফয়সাল।দুই-তিনবার গভীর পর্যবেক্ষণের পর গলায় একরাশ বিরক্তি নিয়ে বললোঃ” ঘুম থেকে উঠে ভালোই তো টইটই করছো।রাতে বিরক্ত করলে কেন এতো? তোমার যন্ত্রণায় বাড়ি-ঘর ছেড়ে পালাতে হবে দেখছি।”
এতো বড় খোঁচামারা কথার কোনো উত্তর দিলো না সূচি। ভাবুক চোখে চেয়ে রইলো কেবল।বেশ কিছুক্ষণ পরেও উত্তর না পেয়ে খুব অবাক হলো ফয়সাল।মুখে মুখে উত্তর দেওয়া সূচির স্বভাব।এই কয়েকদিনেই সূচির এই অভ্যাসের সাথে পরিচয় হয়েছে ফয়সালের।আজ তাই ব্যতিক্রম ঘটনা ঘটায় খুব অবাক হলো সে।মেয়েটার আবার জ্বর এলো না তো? হাতের তালুতে সূচির কপাল ছুঁয়ে বললোঃ” কী ব্যাপার? জ্বর এসেছে আবার?”
সূচি জবাব দিলো না।প্রিয়তমের স্পর্শে অন্তরের প্রশান্তি ব্যক্ত করল না।কেবল ভাবুকের মতো প্রশ্ন করলোঃ” আপনাদের এতো অসহযোগীতার মাঝে আমি টিকব কী করে,বলুন তো?”
চলবে….