শুকতারা পর্ব-৩৭

0
960

#শুকতারা (পর্ব-৩৭)
#হালিমা রহমান

বসার ঘর ধুলোতে মাখামাখি। এখানে ময়লা,সেখানে ময়লা। উঠোন থেকে বালি উড়ে এসে এই শুরুর ঘরেই আশ্রয় নিয়েছে।ঝরা পাতাও চোখে পড়ে কয়েকটা।এখানে ঝাঁটা পড়েছে সেই ছয়দিন আগে। শুধু এই রুমটাই না,সারা ঘরের অবস্থা একই রকম।উঠোনের অবস্থা আরো শোচনীয়।কাঁঠাল গাছের তলা থেকে শুরু করে সেই পুকুর পাড়,গোয়ালঘর,অন্তুদের অব্যবহৃত ঘরের কোনাকুনি– কিছুই পরিষ্কার নেই।অনাদরে,অবহেলায় রাজ্যের ময়লা জমেছে কাজী বাড়িতে। যেহেতু ঘরের বউরা নেই তাই পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার বালাই নেই।এই সমার্থক শব্দ দুটো ঘরের বউদের জন্য,কর্ত্রীর জন্য নয়।রোমেলা বানু তো এই বাড়ির কর্ত্রী,বউ না।
অতিরিক্ত অবসর মানুষকে মাত্রাতিরিক্ত অলস করে তোলে। রোমেলা বানু এই কয়েকদিন হাঁড়ি-চামচ নেড়েই দিন কাটিয়েছেন।ঘর-দোর ঝাঁট-ফাট দেওয়া বাহুল্য ছাড়া আর কিছু নয়।এসব তার কোনোকালেই পছন্দ না।পরিষ্কার ঘর-দুয়ার দেখতে ভালো লাগে কিন্তু পরিষ্কার করতে ভালো লাগে না। তাছাড়া বহুদিনের অনভ্যাস।হুমায়রা আসার পর থেকে এসব পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার দিকে খুব একটা নজর দেওয়ার দরকার পড়ে না।এইবারও এমন নোংরা থাকতো না সবকিছু।সূচি বাড়ি যাওয়ার পরের দিনই হুমায়রাও বাড়িতে গেছে বিশেষ প্রয়োজনে।তাই এবারের অবস্থা বেশি খারাপ।

সখীর ঘরের চারদিকে বিতৃষ্ণার দৃষ্টি ফিরানোর পর, পাশের বাড়ির টুটুলের মা নজর দিলো চায়ের কাপের দিকে।এক চুমুক চা গিলে তীব্র ভর্ৎসনার দৃষ্টি হেনে বললেন, ” ইছছ,এমন নোংরা ক্যান সবকিছু? এই ঘরে থাকোছ ক্যামনে তুই? ভাত খাইতে পারোছ এই পরিবেশে ? আমি হইলে না খায়াই মইরা যাইতাম। যতসব সৃষ্টিছাড়া নোংরামি।”

টুটুলের মায়ের আর যত দোষ থাকুক,অস্পষ্টতার দোষ তার নেই।তিনি চিরকালের ঠোঁটকাটা।কথা বলার সময় যা মুখে আসে তাই বলে।রাখ-ঢাক,চেপেচুপে কথা বলার অভ্যাস তার নেই। রোমেলা বানুর মতো কাঠখোট্টা মানুষও অপ্রস্তুত হলেন।মনে মনে কুঁকড়ে গেলেন খানিকটা।ঠনঠনে বুড়ো মানুষদের মতো জায়গা বুঝে অসুখের কথা পাড়লেন।লজ্জিতস্বরে আমতা আমতা করে বললেন, ” ঐ আমার কোমড়ের ব্যাথাটা বেশি ইদানিং। তাই নুইয়া নুইয়া ঝাড়ু দিতে পারি না।বউরা নাই।তাই আসলে..

” তাই ঘরের অবস্থাও এমন থাকে! ছোটটায় নাহয় বাপের বাড়ি গেছে বড়টায় কই?”

” বাপের বাড়ি।ওর চাচতো চাইয়ের পোলা হইছে। আঁতকুড়া মানুষ,ঝুট-ঝামেলা নাই তাই ভাবির লগে হাসপাতালে আছিলো।”

” তুই যাইতে দিলি? ঝুট-ঝামেলা না থাকুক,ঘর-সংসার তো আছে।”

মুহূর্তেই তেঁতো হয়ে এলো রোমেলা বানুর গলা।চরম বিরক্তি প্রকাশ করে বললেন, ” আলাদা থাকে এখন।আমারে কিছু জিগায়? যাওয়ার আগে দিয়া বইলা গেছে নাহয় আমি জানতামও না।”

” হাহ! বউগো এতো কইলজা ক্যামনে হয়? তোরে দেখলে আমার অবাকই লাগে।তোর বাড়িতে থাইক্কা তোর সামনেই এতো উড়ার সাহস পায়! আমার বউ হইলে দেখতি।পা দিয়া টিপ্পা কলিজা বাইর কইরা ফেলতাম।”

খুব সহজেই কথা শেষ করার সাথে সাথে এক কাপ ঠান্ডা চা শেষ করে ফেললো টুটুলের মা।নিজের কথার রেশ টেনেই ভীষণ অহংকারীর মতো দু’হাত নেড়ে বললো, ” আমার ঘরের দিকে দেখ। সব জায়গায় ঠিকঠাক।বউ সবার সেবা করতাছে,আমারে মানতাছে,সাত চড়েও রা কাড়ে না,টুটুলে আমার কথার বাইরে পা রাখে না,মাইয়া-মাইয়ার জামাই নিয়া আমার সুখের সংসার।সংসার হইব এমন।তোগোরে দেখলে আমার খারাপ লাগে বইন। পোলা বিয়া করানের লগে লগে যেন তোরা পোলা বেইচ্চা দিছোছ।আরে আমরা বাঁইচ্চা থাকতে পরের বাড়ির মাইয়াগো আবার কীসের এতো খবরদারি?”

” তোর টুটুলের মতো সোনার টুকরা কি আর আছে এই গেরামে? এহনকার দিনে কয়টা পোলা টুটুলের মতো হয়? আমার ঘরের দিকেই দেখ বইন,দুইটা কুত্তার ছাও জন্ম দিছি।আফজালের কথা বাদই দে, হুমায়রা শয়তানটা তাবিজ করছে আমার পোলারে। নাইলে আমার পোলাটা কত ভদ্র আছিলো,দেখোছ নাই তোরা? বউ আনতে না আনতে সেই পোলা বদলায়া গেল।”— রোমেলা বানু সাক্ষী মানলেন সইকে। তার গলায় উদাসীনতা। টুটুলের মায়ের অহংকারী কথাবার্তা শুনলে মনের মাঝে চিনচিনে একটা ব্যাথা জাগে।যতই বান্ধবী হোক,মানুষ তো।ঈর্ষা-হিংসার ঊর্ধ্বে যেতে পারেন না।টুটুলের মায়ের সুশৃঙ্খল সংসারের কথাগুলো তার শ্রবনশক্তিকে দু-পায়ে মাড়িয়ে কানের ভিতর ঢুকে।মনের মাঝে তীব্র আফসোস জাগে।ইশ! দুটো ছেলেই যদি তার কথা মতো চলতো।বউগুলো যদি টুটুলের বউয়ের মতো সবকিছুতেই মুখ বুজে থাকতো!

কিছুক্ষণ চুপ মেরে থাকার পরে বটতলার ভন্ড খোরশেদ কবিরাজের কথা তুললেন রোমেলা বানু।

” আমি বটতলার কবিরাজেরে বাড়িতে আনছিলাম।”

” কবে?”

” আফজাল আলাদা হওয়ার পরে।হুমায়রা তখন অসুস্থ আছিলো,বউরে নিয়া ডাক্তারের কাছে গেছিলো আফজাল।এই সুযোগে কবিরাজেরে আনছিলাম।”

” পরে?”

” কবিরাজে অনেক গর্ত-টর্ত কইরা দুই-তিনটা তাবিজ বাইর করলো।আমার আগের থেকাই সন্দেহ আছিলো,পরে নিশ্চিত হইলাম।কবিরাজে কইছে,জাদুখুন্নী আমার পোলারে কঠিন তাবিজ করছে। এর লেগাই পোলা আমার কথা শুনে না।”

এই শতাব্দীতে বসেও নিভৃত পল্লীজননীর বুজরুকিতে বিশ্বাস দেখলে অন্তরে ক্লেশবোধ হয়।শিক্ষা,সংস্কার,সংস্কৃতি,প্রগতি থেকে এরা এখনো যোজন যোজন দূরে।
টুটুলের মায়ের মনে খুব আগ্রহ জাগলো।ভ্রু কুঁচকে প্রশ্ন করলো,” তারপর? তুই তাবিজ কাটানের ব্যবস্থা করোছ নাই?”

” করছি। দুই হাজার টাকা দিয়া তিনটা তাবিজ নিছি।কবিরাজে কইছে এগুলি দুই হাতে আর কোমড়ে বাঁনতে হইব।আমি তাই করছি।এই দেখ”– দু-হাতের ব্লাউজের কাছে পুরোনো তাবিজ দুটো হাত উঁচিয়ে দেখালেন তিনি।পুরোনো তাবিজ,সময়ের সাথে সাথে সোনালী রঙ পাল্টে কালচে হয়ে গেছে।কথায় আছে বিশ্বাসে মেলায় বস্তু।এর ভিতরে কি আছে তা আল্লাহ মালুম।শুধুমাত্র বিশ্বাসের উপরেই ভিত্তি করে এতো বছরেও এগুলো কাছ ছাড়া করতে পারেননি রোমেলা বানু।

” রোমেলা,কাম হইছে এগুলিতে? পোলায় কি ঠিক হইছে?”

” এখনো না।যদি হয় ভবিষ্যতে, তাই খুলি নাই।”

সখীর কথায় বিরাট এক হাই তুললো টুটুলের মা।মাছি তাড়ানোর মতো করে বললো, ” হুদাই কবিরাজরে এতোগুলি টাকা দিছোছ।মাইরের উপরে ওষুধ আছে? পোলায় যখন ঘরে না থাকতো তখন দিতি হারামজাদীর চুলে ধইরা দুইটা কিল,দেখতি তাবিজ করা ছুইট্টা যাইতো।মাইরেরে ভূতেও ডরায়।আর এইটা তো তোর ঘরের বউ।তোর হাতে জোর নাই দেইক্ষাই এতো সাহস পায়। বড়টার কথা বাদ দে,ছোটটার কী খবর? এইটাও তিড়িংতিড়িং করে?”

সূচির কথা মনে উঠতেই চোখ-মুখ খিঁচে দুটো অশ্রাব্য গালি দিয়ে বসলেন রোমেলা বানু।দাঁত খিঁচিয়ে বললেন, ” এই জানোয়ার আরো অসভ্য।বড়ডায় তো মুখের উপরে কিছু কইতো না,এইটায় এখনি মুখের উপরেই কথা কইতে চায়। বাপের বাড়িতে দুইদিন থাকার অনুমতি দিছিলাম।আজকে ছয়দিন।কুত্তার ছাওয়ের আসার কোনো নাম-গন্ধ নাই।বাইচ্ছা-বুইচ্ছা একটা আখাডা মাইয়া আনছি আমি পোলার লেগা।”

” ঠিকই আছে।কপালের নিচের চোখ দুইটা কি নাই তোর? কী দেইক্ষা আনছোছ এই ছেড়িরে? চেহারাও তো ওতো ভালো না। ফর্সা একটা পোলার লেগা আনছে একটা কালীরে। বংশও তো ওতো ভালো না।বাপের বাড়ির অবস্থাও আহামরি ভালো না।চাষ কইরা খায়। সত্যি কইরা ক তো, কী দেইক্ষা আনছিলি?”

সূচির বাবার অবর্তমানে তার সব জায়গা-জমি সূচির ভাগেই এসেছে।এই লোভেই সূচিকে ঘরে তুলেছেন,এই কথা মুখ ফুটে বলতে পারলেন না রোমেলা বানু।গোপন কথাটা বান্ধবীর সামনে ফাঁস করতে ইচ্ছা হলো না।তাই কথা ঘুরিয়ে অনুতপ্তের সুরে বললেন, ” ভুল হইছেরে খুব।তখনই আরো ভাইব্বা-চিন্তা কাজ করা উচিত ছিল।আমার পোলা শুরুতেই রাজি আছিলো না।আমিই জোর করছি।”

” এখন ফয়সালের কী খবর?”

” এইটা এখনো হাতে আছে।আমার কথা ছাড়া মুতেও না।এই যে কইছি শ্বশুরবাড়িতে যাইতে না,যায় নাই।ফয়সালে একটু অন্যরকম।”— কথার শেষে গৌরবের ভঙ্গিতে হাসলেন রোমেলা বানু।ছেলেটা ভারী ভীতু। মতামত অপছন্দ হলেও এখনো তার মুখের উপর কথা বলে না।

” মাশাল্লাহ তাইলে তো ভালোই।”

” হ তবুও ভয় করে।শ্বশুরবাড়িতে যাইতে দেই নাই।বড়টার মতো যদি তাবিজ করে,যদি পানি পড়া-টড়া খাওয়ায়া দেয়! জাত ছোটলোক তো,বউগো বাড়ির মানুষগোরেও বিশ্বাস হয় না।”

টুটুলের মা খুব বিজ্ঞের মতো বললো, ” শোন, বউরে শুধু কথায় চলব না।এগুলি হইছে বান্দরের জাত।লাই দিলেই মাথায় উঠব।একটুর থেকা একটু কিছু করলেই খপ কইরা চুলের মুঠি ধরবি।আধুনিক দিন,একটু কঠোর না হইলে চলব না। আর বিয়ার অনেকদিন তো হইছেই,বেয়াই বাড়ি থেকা কিছু দেয় নাই এখনো? গয়নাগাটি অথবা টুমটাম? কবে দিব?”

বাইরে পায়ের শব্দ শোনা যাচ্ছে।আসরের পরে ফয়সাল আসে একবার।সেই এসেছে হয়তো।ছেলের অস্ত্বিত্বের খবর পেয়ে গলা দ্বিগুণ চড়িয়ে দিলেন রোমেলা বানু। ছেলের মনে শ্বশুরবাড়ি সম্পর্কে অশ্রদ্ধা জাগাতেই চেঁচিয়ে বললেন, ” জাত ছোটলোক না? এগুলি বুঝে নাকি? অসামাজিকের বংশ অসামাজিক। নাইলে তুই চিন্তা কর, বিয়া হইছে সেই ডিসেম্বরে। এখনো মুঠ থেকা একটু কিছু গলে নাই।আরে ভাই মানুষ তো আর পাঁচটা মানুষ দেইক্ষাও শিখে।জীবনে দেখে নাই কাউরে মাইয়ার শ্বশুরবাড়িতে একটু উপহার দিতে? আমার মুখ ফুইট্টা জিগাইতে মন চায় মাঝে মাঝে।কিন্তু পারি না।ওগো চোখের চামড়া নাই কিন্তু আমার তো আছে।ক্যামনে সরাসরি জিগাই? তবুও সেদিন সূচির বাপরে কইলাম…… আরে ঐখানে কে দাঁড়ায়া? কে?? তুমি! তুমি কখন আসলা বউ? তোমারে কে আনছে? ফয়সাল গেছিলো?”

ঘরের বউয়ের পিন্ডি চটকাতে এতোই ব্যস্ত ছিলেন যে সূচি কখন ঘরের দুয়ারে এসে দাঁড়িয়েছে তা বুঝতেই পারেননি রোমেলা বানু।সহসা দরজার কাছে সূচিকে কাঠ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে অবাক হয়ে গেলেন।মেয়েটার মুখ থমথমে,চোখ দুটো টকটকে রক্তজবা। টুটুলের মা গভীর বিস্ময়ে দেখলেন সেই অন্তর্ভেদী কঠিন দৃষ্টি।কোনো মানুষের চোখ পাথরের মতো এমন কঠিন হতে পারে তা এই প্রথম দেখলেন।সূচির এই দৃষ্টির সাথে খুব পরিচিত রোমেলা বানু।বউয়ের চোখদুটো একটু বড় বড় বলেই রাগ-ক্ষোভ আগে চোখে ফুটে উঠে।সূচির রাগকে তিনি একটু একটু ভয় করেন। যখনই এতো রেগে যায় তখনই গলা চড়িয়ে মুখে মুখে কথা বলতে আসে।মনে মনে প্রমাদ গুনলেন তিনি।বাইরের মানুষের সামনে এখন যদি মুখ নাড়া শুরু করে মেয়েটা! মান-ইজ্জত আর কিছু থাকবে না।

সূচি কিন্তু কিছু বললো না। মাত্র কয়েক সেকেন্ডে নিজেকে সামলে নিলো।শাশুড়িকে চোখ দুটো দিয়ে আগাগোড়া মেপে নিলো একবার।তারপর গলা।বাড়িয়ে বাইরে তাকালো।মমিন শেখ দাঁড়িয়ে আছে দরজায়।এখনো আগের মতোই,হতভম্ব মুখ,অসার দুটো পায়ের ভর মাটি শুষে নিয়েছে।রোমেলা বানুর কথা যে তিনি নিজ কানে সব শুনেছেন তা বলার অপেক্ষা রাখে না। এতোকিছু শোনার পরেও পা দুটো আর দরজা ভেদ করে ভিতরে গেল না।মেয়ের কাপড়ের ব্যাগটা ধরে বাইরে দাঁড়িয়ে রইলেন দরজার বাইরে।কাজী বাড়ির বুড়ো কাঁঠাল গাছের মতোই তিনি অসার।
সূচি দু-পা এগিয়ে বাবার কাছে এলো।নিতান্ত অবহেলায় বাবার হাত থেকে নিজের ব্যাগটা টেনে নিয়ে সহজ গলায় বললো,” ভালো থেকো আব্বা।তোমার জামাই ঘরে নেই।তুমি কি আসবে ভিতরে? এক কাপ চা খাবে এই বেলায়?”

নিমন্ত্রণ নয়,বাবাকে একপ্রকারে তাড়িয়েই দিলো সূচি।এভাবে বললে যে বাবা ঘরে ঢুকবে না তা বেশ জানা তার।মমিন শেখ তাড়াতাড়ি হাত নেড়ে বললেন,” না,না।অনেক গরম। এখন আর যামু না।জামাইরে বলিছ আমার কথা আর বিয়াইনরে সালাম জানাইছ।”

” আচ্ছা।”

অচল পা দুটোকে সচল করে প্রায় পালিয়েই যাচ্ছিলেন মমিন শেখ। কিছু একটা ভেবে আবার মেয়ের কাছে ফিরে এসে বললেন, ” মা,শ্বশুরবাড়িতে এমন কথা শুনতেই হয়।আমারই দোষ। সামাজিকতার কথাটা মাথায় রাখা উচিত ছিল।আমার লেগাই তোরে এতো কথা শুনতে হইতাছে।তুই জামাইয়ের সাথে এইসব কথা তুইল্লা রাগারাগি করিছ না মা।আমারে কিছুদিন সময় দে আমিই সব ঠিক কইরা দিমু।”

” না আব্বা।তোমার জামাইকে আমি কিছু বলব না।কাউকে কিছু বলব না বলেই তোমাকে ঘরে ডাকতে পারলাম না।এতো অসম্মানের মাঝে আমি তোমাকে এক গ্লাস পানিও খেতে দেব না।তোমার আর কিছুই করতে হবে না।আমাকে আর কখনো দেখতে এসো না তোমরা।”

আর দাঁড়ালেন না মমিন শেখ।লজ্জায়,অপমানে,দুঃখে দরজার বাইরে থেকেই পালিয়ে গেলেন।ঘরেও ঢুকলেন না।
দরজায় মাথা ঠেকিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেললো সূচি।নিজের জন্মদাতাকে সে খুব চিনে। তাই তো দাঁড়িয়ে থেকে মুখের উপরে বাবার অসম্মান দেখলো।মুখ নেড়ে একটা প্রতিবাদও করতে পারেনি।বাবা বুঝবে না কিছুই, তার প্রতিবাদকে বেয়াদবির তকমা দিয়ে হয়তো এখানেই বিচার করতে বসবেন।এতোকিছু শোনার পরেও যে মেয়েকে একটা কথাও বলতে নিষেধ করে,তার কাছ থেকে সময়মতো কতটুকু সমর্থন পাওয়া যাবে তা বেশ জানা আছে।

____________________________________

ঘর-দোর গুছিয়ে,সব সাফ-সুতরো করে,গতকাল দুপুরের বাসি গন্ধযুক্ত টক হয়ে যাওয়া ডাল-তরকারি ফেলে, গজগজ করতে করতে আছড়ে-পাছড়ে থালাবাটি ধুয়ে, রাতের খাবার রেঁধে,অবেলায় গোসল সেড়ে সূচি যখন ঘরে পা রাখলো,তখন একবারে রাত সাড়ে নয়টা বাজে। দীর্ঘ ছয়দিনের অনভ্যাসের পর আজ একসাথে এতো কাজ করার পর শরীরটা ছেড়ে দিয়েছে একদম।চুল থেকে ভেজা গামছা খুলে সজোরে ছুঁড়ে দিলো দূরের চেয়ারে।সেই বাড়ি ছাড়ার দিনে গোসলের পর শাড়ি ধুয়ে দড়িতে শুকাতে দিয়েছিলো।আজ এখন অবধি সেটা সেখানেই আছে। শুধু নিজেদের ঘর না,রান্নাঘর ও শাশুড়ির ঘরটা ছাড়া পুরো বাড়িতে যেটা যেভাবে রেখে গিয়েছিলো সেটা সেভাবেই পেয়েছে আজ।মেজাজ তো বিকাল থেকেই খারাপ ছিল।নোংরা বাড়ির অবস্থা দেখে রাগে-ক্ষোভে হাত কামড়াতে ইচ্ছা করেছে সূচির। এই বাড়িতেই এতোদিন বাসি খাওয়া চলতো না,তিনবেলা উঠোন-ঘর ঝাঁট না দিলে বংশের চৌদ্দপুরুষ ধরে টান মারতো রোমেলা বানু,কোনো কাজ ফেলে রাখার জো ছিল না।আজ এতোদিন পরে মুখোশ খসে পড়লো।মাত্র ছয়দিনেই বাড়িটার যা অবস্থা হয়েছে,এর থেকে যেকোনো পাবলিক টয়লেটের চেহারা আরো ভালো হয়।

” আমার ক্ষেত্রেই শুধু পরিষ্কারগিরি।আমি না থাকলে দেখা যায় কে কত পরিষ্কার।যত্তসব,জ্বালিয়ে মারার ধান্দা।খালি আমি বলেই সংসার করছি এখনো।অন্য মেয়েরা হলে তিনবার ঝাড়ু মেরে পালাতো।”– গজগজ করতে করতে ক্লান্ত শরীরের ভারটুকু বিছানায় ছেড়ে দিলো। এখন থেকে নয়,সেই বিকাল থেকেই গজগজ করছে।বাড়ির চেহারা দেখে এটাকে পরিষ্কার না করে আর পারলো না।এসে অবধি শাশুড়ির সাথে দু-একটা কথা ছাড়া বেশি কথা বলেনি।কাজ করতে করতে রাগ গিলেছে।অকারণেই এটা-ওটা আছড়ে ফেলেছে।ধুমধাম,ঝনঝন শব্দ করে বাসন-কোসন ধুয়ে রান্না করেছে।নির্জীব থালা-বাটি,মগ-বালতির উপরেই রাগ মিটিয়েছে সূচি।কাউকে কিচ্ছু বলেনি।
এক পেট ক্ষুধা নিয়েই শুয়ে পড়লো সূচি।কতদিন পরে নিজের বিছানায় পিঠ ঠেকালো! কিন্তু বাড়ি ফেরার আনন্দে খুশি হতে পেরেছে কই? রাগ মেশানো তীব্র একটা যন্ত্রণা এফোঁড়-ওফোঁর করে দিচ্ছে। কাল রাতের পর থেকে ফয়সালের সাথে কথা হয়নি।সে এখনো বাড়িও ফিরেনি।এতো দেরি করে না,আজ করছে।সূচি জানে শুধুমাত্র জবাবদিহিতার ভয়েই পালিয়ে বেড়াচ্ছে এখনো।কাল রাতে ফোন রাখার পরে অন্ধকার ঘরে খুব কাঁদলো সূচি।রাগ,দুঃখ,হতাশা– সব গলে গলে পড়েছে চোখের পানির সাথে। একটা ভীতু লোক যার কাঁধে চেপে বসে তার কাঁদা ছাড় আর কী করার থাকে? ফয়সাল তো ইমোশনে টোকা দিয়েই খালাস। কিন্তু যার অনুভূতির সাথে খেললো তার অবস্থা স্বয়ং আল্লাহ জানে।সূচি না পেরেছে এসব অযাচিত উপদ্রবের কথা কাউকে বলতে আর না পেরেছে নিজের ভাগ্যকে দোষ দিতে।একচোট কাঁদার পর নিজেই কল্পনা করলো।ফয়সালকে ছাড়া বাড়ি ফিরলে কে কী বলবে? নিশ্চয়ই সবাই কপাল কুঁচকে বলবে, ” এ আবার কী? এক গ্রামেই বাড়ি হয়েও এমন ছাড়া ছাড়া ভাব-ভঙ্গি কেন?”
তারপর নিশ্চয়ই একে একে সবাই প্রশ্ন করবে।সূচিকে ধরে ধরে ভাবিরা উদ্বিগ্ন গলায় বলবে, ” কী রে সূচি,ঝামেলা কইরা আসছোছ বাড়ি থেকা? জামাই নিতেও আসলো না,নিয়াও গেল না।কী হইছে? খুইল্লা বল তো।”

অনাকাঙ্ক্ষিত প্রশ্নবানে জর্জরিত হয়ে সূচি কী বলবে তখন? শুয়ে শুয়ে উত্তর খুঁজলো। কিন্তু হাতের কাছে মুখ রক্ষার মতো ভালো কোনো অজুহাত খুঁজে পেল না।বেশ অনেক্ষণ কাঁদার পরে মনে মনে কঠিন এক সিদ্ধান্ত নিলো।ফয়সালের ভীরুতার মাশুল ও কেন দেবে? এতো দায় কীসের? ফয়সাল সাহস করে যেদিন নিতে আসবে সেদিনই যাবে।যেই ভাবা সেই কাজ।মনের মধ্যে নতুন জোর খুঁজে পায় সূচি।চূড়ান্ত অবাধ্যতার জন্য নিজেকে প্রস্তুত করে মনে মনে।

না,অবাধ্য আর হতে হলো না।সূচিকে আসলে কিছুই করতে হলো না।ফয়সাল বোকা নয়। সে ভীতু কিন্তু চালাক।সুযোগ বুঝে জায়গামতো কাজ করে।সকাল হতেই চট করে শ্বশুরের ফোনে কল করল।বিনয়ে গদগদ হয়ে অনুরোধ করলো, ” আব্বা,সূচিকে আপনি নিয়ে আসবেন? আমার আসলে ডায়রিয়া হয়েছে খুব।তাই আমি যেতে পারছি না।তাছাড়া, সূচিকে ছাড়া আম্মারও খুব কষ্ট হচ্ছে।বুড়ো মানুষ, বুঝতেই পারছেন।একা একা পারছে না।তাই যদি কষ্ট করে আপনিই ইয়ে মানে সূচিকে একটু…….

আর বলতে হলো না।মেয়ের জামাইয়ের বিনয়ী গলায় একদম গলে পড়লেন মমিন শেখ।সকাল হতেই তাড়া দিলেন মেয়েকে।জামাই তার ডায়রিয়ায় কষ্ট করছে।মেয়েকে কি আর আঁটকে রাখলে চলে?
সবাই শুনলো ফয়সালের অসুস্থতার কথা।অবশ্যই বিশ্বাস করলো সবাই।অনাকাঙ্ক্ষিত প্রশ্নবাণ থেকে মুক্তি পেল সূচি।ভাবিরা একে একে ওকে ডেকে উপদেশ দিলো।এখনকার ডায়রিয়া খুব খারাপ জিনিস।বেছে-বুছে খাওয়াতে হবে জামাইকে,পেট ঠান্ডা করার জন্যে রোগীর পথ্য খাওয়াতে হবে ঠিকভাবে।
সাহিদা বেগম মেয়েকে কাছে ডেকে সব বুঝিয়ে দিলেন।হাত নেড়ে নেড়ে বললেন, ” সময় মতো স্যালাইন বানায়া দিবি।ডাব খাওয়াবি।ঝাল তরকারি দিবি না। কাঁচা কলার তরকারি দিবি,পানি ফুটায়া দিবি… আরো কতকিছু। সবাই ব্যস্ত হলো শুধু ব্যস্ততা দেখালো না সূচি।ফয়সালের অসুখের কথার বিন্দু-বিসর্গও বিশ্বাস হলো না তার।কাউকে নিজের অবিশ্বাসের কথাও বললো না।কে বিশ্বাস করবে? চুপচাপ শুনলো সবার কথা।বিশ্রি এক অবসন্নতা ছড়িয়ে পড়লো সারা শরীর জুড়ে।ছিঃ! ছিঃ! নিজের ভীরুতা লুকাতে একজন মানুষ কতজনের অনুভূতি নিয়ে খেলতে পারে!

এলোমেলো কথাগুলো চিন্তা করতে করতে চোখ প্রায় লেগেই এসেছিলো ওর।আধো ঘুম,আধো জাগরণে ঘুম-অঘুমের মাঝে একরকম অসারের মতোই পড়ে ছিল।সহসা এক পশলা উষ্ণ বাতাস ছুঁয়ে দিলো খুব কাছ থেকে।তন্দ্রার ঘোরেই শিউরে উঠলো সূচি।এ যেন জাহান্নামের আগুন ছোঁয়া বাতাস।আগুনের মতোই উষ্ণ, শরীরে অস্বস্তি ধরায়।চট করে ঘুম ঘুম ভাব কেটে গেল।চোখ মেলতেই গোচরে এলো অন্ধকারে ডুবে থাকা চেনা ঘর।ধরফর করে উঠে বসতেই মাথা ঠুকে গেল মাথাভর্তি কোঁকড়া চুলের একটা শক্ত মাথার সাথে।খুব কাছেই বসে ছিল ফয়সাল।যতটা কাছে বসলে সারাদিনের ঘামের গন্ধ সূচির নাকে যেয়ে হোঁচট খেয়েছে,ঠিক ততোটা কাছে।

” আপনি কখন এসেছেন? অনেক রাত হয়েছে? কয়টা বাজে?”

এতোগুলো প্রশ্নের একটা জবাবও দিলো না সে।কেবল গায়ের সাথে মিশে চুপচাপ বসে রইলো।অন্ধকারে হাতড়ে হাতড়ে হাত দুটো সূচির পিঠ ভাসানো চুলে ডুবিয়ে বললো, ” আমি অনেক মিস করেছিলাম তোমাকে।কসম, আর কখনো যেতে দেব না।”

ভালো লাগলো না সূচির।ভুম ভাঙার পর এতো আহ্লাদ অযথা উপদ্রবের মতো মনে হলো।মূহুর্তেই মনে পড়ে গেল আজ সারাদিনের কথা।স্বামীর ভীরুতার কথা,প্রতারণার কথা,বিকালের শাশুড়ির সেই গলা উঁচিয়ে বলা কথাগুলো। তবে ভালো না লাগলেও চোটপাট করলো না সূচি।আগের মতো অভিযোগ করলো না।সেও অন্ধকারে চুপচাপ শক্ত হাতের বাঁধনে পড়ে রইলো।
বেশ কিছুক্ষণের নিস্তব্ধতার পর শ্রান্ত গলায় বললো, ” আপনার নাকি ডায়রিয়া হয়েছে?”

” হুম খুব।”

” তাহলে এতোক্ষণ খামারে ছিলেন কী করে? খামারে কি ওয়াশরুম আছে? নেই তো।হাগা-মুতার কাজটা কি তাহলে পুকুরে নেমেই করেছেন? ফাইজলামি করার জায়গা পান না? কালকে কাঁচকলা আনবেন।আপনাকে শুধু হলুদ দিয়ে তিনবেলা কাঁচকলা রেঁধে খাওয়াব।আপনার পেটের সব ময়লা যদি আমি বের না করেছি তো আমার নাম সূচি না।”

চলবে…

( রিচেক করিনি।টাইপিং মিস্টেক অনেক আছে হয়তো)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here