শুকতারা পর্ব-৪১

0
1159

#শুকতারা (পর্ব-৪১)
#হালিমা রহমান

সূচির উল্টোদিকে পালিয়ে যাওয়ার ইতিহাস পুরোপুরি না জানলেও কিছুটা আন্দাজ করতে পারলো অন্তু।তাই তার হতভম্ব ভাবটা বেড়ে গেল চক্রবৃদ্ধি হারে। পা বাড়িয়ে ঘরের ভিতর ঢুকতে পারলো না আর।ইচ্ছেটা মরে গেল দুয়ারেই।বস্তুত অনিচ্ছার চেয়ে লজ্জাটাই বেশি বাজলো।যেই মেয়েটা লজ্জায় ডুবে মুখ লুকাতে পালিয়ে গেল, তার সামনে দাঁড়িয়ে সহজভাবে কথা বলা সহজ নয়।
সূচির ঊর্ধ্বশ্বাসে প্রস্থানের সাক্ষী অন্তু ছাড়াও আরেকজন আছে।সে হুমায়রা। ঘরে বসে সেও শুনছিলো সূচিদের ঘরের নৈমিত্তিক ক্যাচাল।কান পাতা লাগে না,ঘরের পাশে ঘর হওয়ায় এমনিই কানে আসে।সূচির উঠতে দেরি হয়েছে বুঝতে পেরে নিজেই উঠেছে আজ রান্না করতে।ঘরে চাল-ডাল যতটুকু আছে তা ফুটিয়েই সকালের নাস্তা সাড়বে।আজ হুমায়রার একটু তাড়া আছে।তাই সকাল সকাল নাস্তা শেষ করাটা জরুরি।তাছাড়া পায়ের ব্যাথাটা কম।বাইরে জেগেছ কুমড়ো ফুলের মতো ঝলমলে রোদ। এই রোদে হুমায়রার জন্য বাজারে যাওয়া অপরিহার্য। হাত-মুখে পানি দিয়ে রান্নাঘরেই যাচ্ছিলো সে।ভাত বসিয়ে গায়ে রোদ মাখতে বাইরে পা দিতেই চোখে পড়লো লুকোচুরি খেলা।খুব বেশি দেখেনি সে।কানে শুনেছে শাশুড়ির কথা,চোখে দেখেছে সূচির কান্ড।কয়েক সেকেন্ড অন্তুর দিকে চেয়ে থেকেই ঘরের দিকে ছুটে গেছে সে।এতটুকুই দেখেছে হুমায়রা।এর বেশি কিছু না।কিন্তু এই দৃশ্যটুকুই রি রি করে বাজলো হৃদয় জুরে।মেয়েটাকে সে যথার্থই ভালোবাসে।তার এই লজ্জাটুকুর ইতিহাস মুহূর্তেই ঘা মারলো অন্তরে।হয়তো নিজের অতীতের কথাই মনে পড়লো। এক সময়ে সেও তো এই একই পথের পথিক ছিল।

তিনটে শপিং ব্যাগ হাতে এখনো একই ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে আছে অন্তু।ঘরে ঢুকবে নাকি বাইরে থেকে সেও পালিয়ে যাবে তাই চিন্তা করছিলো।তার চিন্তা রাজ্যে ভাঙন ধরিয়ে নিচু গলায় ডাকলো হুমায়রা,

” অন্তু, খাড়ায়া আছো ক্যান? ঘরে আসো।”

সময় লাগলো না দ্বিধাবোধ উবে যেতে।লম্বা লম্বা পা ফেলে প্রায় দৌড়ে হুমায়রার রান্নাঘরে পৌঁছে হাফ ছেড়ে বললো, ” বাঁচালে মেজ ভাবি।আমি আর পাঁচ সেকেন্ড পরেই ভাবছিলাম পালিয়ে যাব।”

” ছিঃ! পলাইবা ক্যান? ঘরে আইসা ফ্যানের নিচে বসো।”

” তোমার শরীর কেমন এখন? আফজাল ভাই ফোনে বললো কিন্তু তখন খুব ঝামেলায় ছিলাম।একটুও আসতে পারিনি এদিকে।হাত-পায়ের ব্যাথা কমেছে?”

” হ।আসো ঘরে আসো।”

ঘরে ঢুকে হুমায়রার বিছানায় গা ঢিলা করে বসলো অন্তু। এক গ্লাস ঠান্ডা পানি এগিয়ে দিয়ে হুমায়রা প্রশ্ন করলো, ” এই অসময়ে তুমি? স্কুল নাই আজকে?”

” না,চাকরি ছেড়ে দিয়েছি।”

” ক্যান? ভালো চাকরি পাইছো?”

” হ্যাঁ।এবারে আর হাই স্কুল না, ডিরেক্ট কলেজে।মে মাসের এক তারিখে জয়েন করব।তোমাদের সাথে দেখা হওয়ার সম্ভাবনা খুবই কম।তাই আজকেই ছুটে এলাম। ”

” দেখা হওয়ার সম্ভাবনা ক্যান? ভালো চাকরি পায়া বড়লোকি ভাব নিবা? তাই গরিবগোরে আর দেখতে আসবা না?”

খালি গ্লাস ফিরিয়ে নিতে নিতে কৌতুকপূর্ণ কন্ঠ শোনা গেল হুমায়রার।অন্তু গায়ে মাখলো না খোঁচাটুকু। পাশে ফেলে রাখা একটা শপিং ব্যাগ কোলে তুলে নিয়ে উত্তর দিলো, ” অন্যদের সাথে বড়লোকি ভাব নিতেই পারি।কিন্তু সুন্দরী ভাবির সাথে ভাব নিয়ে দূরে থাকার মতো ভালো মানুষ আমি নই।বিশেষত তোমার সেই ছোট বোন শশীকে তো আমার খুবই ভালো লাগে। ভবিষ্যতে যখন তোমার বোনের জামাই হতে যাচ্ছি তখন তোমার সাথে ভাব কেন নেব ভাবি? তুমি তো আমার ঘরের মানুষ।”

অন্তুর বলার ভঙ্গিতে ফিক করে হেসে ফেললো হুমায়রা। মাথা নেড়ে বললো, ” মানুষ হইলা না।চাকরি কই হইছে?”

” সুদূর ঢাকা।আমি এখান থেকে আজকেই ফুটছি।সন্ধ্যায় লঞ্চ।তারপর সেখানে যেয়ে শান্ত ভাইয়ের কাছে থেকেই চাকরি করব।”

” দাঁড়াও, দাঁড়াও।ঢাকা! শান্ত ভাই কি ঢাকা থাকে? হেয় না সিলেটে থাকে?”

” থাকতো।জানুয়ারির শেষে ভাইয়া চলে এসেছে এখানে।সিলেটের অফিস থেকে এখানে বদলি হয়েছে।আমি মার্চের শুরুর দিকে ঢাকা গিয়েছিলাম।তখনই চাকরি হয়েছে।”

” তুমি চেষ্টা করছিলা ঐখানে চাকরির জন্য?”

” না,আমার তো পরিকল্পনাই ছিল না।বলতে পারো ভাইয়ার সুবাদেই চাকরি হয়েছে। ভাইয়ার বেস্ট ফ্রেন্ড কবির ভাই তার মায়ের নামে একটা স্কুল দিয়েছিলো আরো আগে।এ বছরে মায়ের নামে নতুন করে একটা কলেজ করেছে।শিক্ষকের অভাব এখনো।আমাকে চেনে কবির ভাই।দেখেছে দুই-একবার।বাবা-মা মারা যাওয়ার পরে ভাইয়া-ভাবির সাথে এসেছিল বরিশালে।তাছাড়া,ভাইয়া গল্প করতো আমাকে নিয়ে।এবার ভাইয়ার বাড়িতেই দেখা হয়েছে ওনার সাথে।আমার চাকরি-বাকরির কথা শুনে অফার করেছে।রেজাল্ট ভালো,অভিজ্ঞতাও আছে।তার পছন্দ হয়েছে।আমিও আনন্দময়ী স্কুল থেকে পালাতে চাইছিলাম।বজ্জাত এসিস্ট্যান্ট প্রিন্সিপাল আমার দেরি দেখতেই পারে না।একদিন দেরি হলেই হাজারটা কৈফিয়ত দিতে হয়। ভাইয়াও এবার জেদ করেছে আর একা থাকতে দেবে না।তাদের সাথে থাকতেই হবে। চাকরিও ভালো,স্যালারিও ভালো–তাই আর না করিনি। ভালো চাকরি যখন হাতের কাছে এসে নিজেই ধরা দিচ্ছে তখন তা ঠেলে দেব কেন? তাই আমাকে বরিশাল ছাড়তে হচ্ছে।”

অন্তুর কথা গিলছিলো হুমায়রা।কথা শেষ হতেই বললো, ” তাইলে তো তুমি সহজে এদিকে আসবাই না।”

” মিথ্যা বলব না।বিশেষ দরকার অথবা বড় কোনো ছুটি ছাড়া আসা হবে না।তাছাড়া বরিশালে গেলে যেতেও পারি কিন্তু খুব প্রয়োজন ছাড়া উদয়পুরব আসব না তা নিশ্চিত।আমি মুক্তমনা স্বাধীন মানুষ।এতো অশান্তি আমার ভালো লাগে না।গা রি রি করে।আবার অশান্তি হলো কী নিয়ে? চাচীমার গলা সেই মোড়ের মাথা থেকে শোনা যাচ্ছে।কী নিয়ে ক্ষেপলো আজ? সূচি বিরাট কিছু করে ফেলেছে নাকি?”

” বিরাট কিছু করা লাগে ভাই? এই ঘরে অশান্তি করার লেগা নতুন কোনো ঘটনা লাগে না।তোমগো ভাগ্য ভালো তোমরা কাজী বাড়িতে পোলা হয়া জন্মাইছো।ঘরের বউ হয়া আসলে বুঝতা এই বাড়ির বউগুলির কত কষ্ট।”— চোখ ছলছলিয়ে উঠলো হুমায়রার।কথার শেষে হৃদয় নিংড়ানো দীর্ঘশ্বাসও বেরিয়ে এলো।নিজের কথার রেশ টেনে বললো, ” মাইয়াটা জ্বর কয়দিন ধইরা।কাজী বাড়ির বউ হইছে দেইক্ষাই এই জ্বর নিয়া খাটোন লাগে।তুমি চেহারা দেখলে বুঝবা।ছেড়িটার শরীলে কিচ্ছু নাই।চেহারা দেখলেই বুঝা যায় সে কত অসুস্থ।তোমার চাচীর আর তোমার ভাইয়ের শরীলে মাইনষের রক্ত আছে নাকি তাই জানতে ইচ্ছা করে আমার। আজকে ঘুম থেকা উঠতে সাড়ে আটটা বাজছে। আম্মায় কয় দশটা বলে বাজে। বুঝো অবস্থা।এই নিয়াই শুরু হইছে সকাল থেকা।”

” সূচি কিছু বলেনি?”

” ইশ! এতো সাহস?মুখ ফুইট্টা মাত্র কইতেই শুরু করছিলো।সবাই মিল্লা চাইপ্পা ধরছে তারে।”

এরপর ধীরে-সুস্থে সূচির মুখে শোনা পহেলা বৈশাখের কান্ড খুলে বললো হুমায়রা।নির্বাক শ্রোতার কানে একে একে ঢেলে দিলো সব কথামালা।সব শুনে অন্তুর মনটাও খুব খারাপ হয়ে গেল। সূচিকে তার অকারণেই ভালো লাগে খুব।আঠারো-উনিশ বছরের ছোট একটা মেয়ে যখন গায়ে শাড়ি জড়িয়ে পাকা গৃহিণীদের মতো হাজারটা বাধা পেরিয়ে সংসার করে,তখন মন থেকে খুব করুণ এক স্নেহবোধ জাগে।ঐ হতভাগীর জন্য খুব বড় কিছু একটা করতে মন চায়। মাথা নিচু করে চলা ছোট্ট একটা মানুষের গন্ডির বেড়াটাকে ভেঙে বিশাল পৃথিবীর সাথে জোড়া লাগিয়ে দিতে ইচ্ছা করে।কিন্তু নিভৃত মনের কোনে জাগা ইচ্ছেটাই তো সব নয়।যেখানেই ইচ্ছে জাগবে সেখানেই জাগবে অধিকার,ক্ষমতা,সামর্থের মতো ভারী ভারী শব্দ।এসব যেহেতু নেই তো কী আর করার? হুমায়রার মতো ভারী দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো ভিতর থেকে।চশমাটাকে অকারণেই নাকের উপরে ঠেলে দিয়ে বললো, ” সূচির বাবা-মায়ের চোখে এসব পড়ে না?এতোকিছুর পরেও মেয়েকে শাসন করতে আসে? আশ্চর্য!”

” আশ্চর্যের কী আছে অন্তু? বাংলাদেশটা তো আর বিদেশ হয়া যায় নাই।তোমার ভাই কিছুর থেকা কিছু হইলেই শ্বশুররে ফোন দিয়া কয় তার মেয়েরে দিয়া চলব না।যেন সূচি বাজারের একটা সদাই! সূচির বাপে মেয়ের বাপ। মেয়ের সংসার ভাঙলে তার চলব ক্যান? এইটা বাংলাদেশ। এইখানে চক্ষুলজ্জা আছে,পাঁচজনের নাক গলানি আছে,কটু কথা আছে,হাট-বাজারে লোকের কানাকানি থামানের লেগা মেয়ের সংসার ভাঙার করুণ গল্প শোনানের ঝামেলা আছে,অল্প শিক্ষিত মেয়ের ভবিষ্যতের চিন্তা আছে, তারে দ্বিতীয়বার বিয়ে দেওয়া যাইব কি না তা নিয়া রাত-দিনের ঘুম নষ্ট করা চিন্তা আছে– এতো কিছু সামলানের লেগা কত ধৈর্য লাগে, কত শক্তি লাগে তা কি জানা আছে তোমার? এতো ঝামেলার থেকা মেয়েরে মুখ বুইজ্জা সব সহ্য করতে বলা সহজ। তাছাড়া, এতো ডর-ভয়রে জয় কইরা যদি সূচির বাপের মনে মাইয়ার লেগা আদর-ভালোবাসা না জন্মায় তো তারে আর কী শাস্তি দিবা? সূচির ভাগ্য আবার বেশি ভালো। ভূমি পালায়া যাওয়ার পরেই তার বাপেরে খুব অপমানিত হইতে হইছে। এখন সূচির সাথেও যদি আবার খারাপ কিছু ঘটে তো সে হাটে-বাজারে মুখ দেখাইব কী কইরা?মেয়ের ভালো-মন্দের চাইতে তার লোকলজ্জার ভয় বেশি,মেয়ের সংসার টিকানোর চেষ্টা বেশি।এইখানে কী আর বলার আছে?”

টেন পাশ করা মেজ ভাবিও যে এতো ভারী ভারী কথা বলতে পারে তা জানা ছিল না অন্তুর।হুমায়রার কথার শেষে নিস্পৃহ গলায় বললো, ” যত যাই বলো,বাবা-মায়ের কাছে সন্তানের চেয়ে বেশি আর কিছু আছে? ছেলে-মেয়ের সুখ সবকিছুর ঊর্ধ্বে। আচ্ছা,ফয়সাল কী বলে? চাচীমার সামনে দাঁড়িয়ে কিছু বলবে না তা তো জানা কথা।কিন্তু সূচিকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাচ্ছে না কেন?”

সহসা কঠিন হয়ে উঠলো হুমায়রার চোখ-মুখ।চোখ-মুখ-গলা তিনটাকেই যথাসাধ্য শক্ত করে বললো, ” অন্তু, আমি ভীতু মানুষ অনেক দেখছি।কিন্তু বিশ্বাস করো,তোমার ভাইয়ের মতো অমানুষ আমি আর দুইটা দেখি নাই। একটা জানোয়ার।আমার ইচ্ছা করে সামনে দাঁড়ায়া দুই গালে ঠাস ঠাস কইরা দুইটা থাপ্পড় মারি।হারামজাদায় বউরে নিব ডাক্তারের কাছে? বাবারে বাবা! টাকা কইম্মা যাইব না তাইলে? সে মহাব্যস্ত,বউয়ের দিকে চোখ দেওয়ার সময় কই তার? আমার শ্বশুরে একটা জানোয়ার জন্ম দিয়া গেছে।মাইয়াটার কপালই খারাপ।”— শেষদিকে হুমায়রার কঠিন গলা খুব নরম হয়ে এলো।চোখের কোনটাও ভিজে এলো দেখতে দেখতে।

অন্তুর মতো হাসিখুশি মানুষও মিনিট কয়েক চুপ করে রইলো। কথা ফুটলো না মুখে।ওদিকে হুমায়রা বারবার আঁচলের কোনে চোখ রগড়াচ্ছে। দেবরের সামনে চোখ ভিজে আসায় সেও বিব্রত।বেশ কিছুক্ষণ পর পরিস্থিতি সহজ করতে ঠোঁটের কোনে হাসি টেনে অন্তু বললো, ” পরের দুঃখে বসে বসে চোখের পানি ফেলার অনেক সময় পাবে। এখন এই ছোট ভাইটির পেট ঠান্ডা করো।পেটের ভিতরে কুকুর-বিড়াল সব দৌড়াচ্ছে।তোমার ঘরে কিছু নেই ভাবি? আর কতক্ষণ আমাকে খালি পেটে বসিয়ে রাখবে? ও ঘরে তো মনে হয় না এই বেলায় কোনো খাবার জুটবে।এবার তুমিই দয়া করে কিছু খেতে দাও।”

পরিস্থিতি স্বাভাবিক করার বদলে আরো ঘেটে দিলো অন্তু।হুমায়রা লজ্জায় একটুখানি হয়ে গেল একদম।তার ঘরে সত্যিই আজকে কিছু নেই। চানাচুর,বিস্কুট, আটা,তেল– কিছুই না।ছেলেটা হয়তো গাড়ি থেকে নেমেই এদিকে এসেছে।খুব আফসোস হলো হুমায়রার।ইশ! আজ এক মুঠ আটা থাকলেও দুটো রুটি বানিয়ে দিতো পারতো।

” একটু অপেক্ষা করো।ভাত আর ডাইল ভর্তা হইতে আর অল্প কিছুক্ষণ লাগব।তারপর ভাত খাইতে পারবা।এই বেলা কষ্ট করো ভাই।দুপুরে তোমারে দাওয়াতের খাবার খাওয়ামু।”

” তুমি রাঁধবে?”

” না,আমার সাথে তোমারে নিয়া যামু।আমগো বাড়িতে দাওয়াত আজকে।আমার ভাইয়ের ছেলের আকিকা।রাইতেই ফোন দিয়া বলছে সকাল সকাল
চইলা যাইতে।আমি এই এক ঘন্টার মইধ্যেই বাইরায়া যামু।তুমিও আমার সাথে যাইবা। আজকে তুমি আমার মেহমান।”

কোলের উপরে রাখা শপিং ব্যাগটা নিয়ে উঠে দাঁড়িয়ে গেল অন্তু।সাদা ব্যাগটা হুমায়রার দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বললো, ” নেও এটা তোমার। আজ তাহলে থাক।আমিও এ বাড়িতে আছি আধ ঘন্টার জন্যে।আমার ফ্রেন্ড ইমনের বাড়িতে দাওয়াত আজকে।লঞ্চ ঘাটের কাছে বাড়ি।গত সপ্তাহ থেকে ফোন দিয়ে পাগল করে দিচ্ছে।যাওয়ার আগে ওদের নতুন সংসারে পা দিতেই হবে।বরিশাল থেকে আগে ওদের ওখানেই এসেছি।ব্যাগ পত্র ওর বাড়িতেই।তোমাদের সাথে কিছুক্ষণ সময় কাটিয়েই উঠব।ব্যাগটা রাখছো কেন ভাবি? খুলে দেখো,পছন্দ হয়েছে কি না বলো।”

ব্যাগ থেকে বেরোলো একটা তাঁতের শাড়ি।রঙটা পাকা বাঙ্গির কাছাকাছি রঙ।পুরো শাড়ি জুড়ে ছোট ছোট ফুলের ছাপার কাজ।আঁচলের দিকটা নীলচে-সবুজ রঙা। হুমায়রার সবসময় হালকা রঙ পছন্দ।খুব পছন্দ হলো তার।এরকম উপহার সচরাচর এখন আর পাওয়া হয় না।হাসিতে ঠোঁট ফুলে উঠলো। তবুও ভদ্রতা রক্ষার জন্য বললো, ” কী দরকার আছিলো অন্তু? শুধু শুধু বাজে খরচ।”

” কিছু কিছু জায়গায় খরচ করতে গায়ে বাজে না।পছন্দ হয়েছে?”

” হ,খুব সুন্দর।ঐ দুইটায় কী?”

” চাচীমা আর সূচির জন্যে শাড়ি। শাড়িগুলো দিয়েই বেরিয়ে যাব।তোমাদের সাথে বোধহয় আর…

” অন্তু ভাই”— দরজার বাইরে থেকে ভেসে আসা সূচির কন্ঠে থামতে হলো অন্তুকে।মেয়েটা কখন নিঃশব্দে দরজার কাছে এসে দাঁড়িয়েছে তা কেউ বুঝতেই পারেনি। তার চোখ দুটো ফোলা,কপালের সীমান্ত অবধি আঁচলে ঢাকা,স্বর ভাঙা।মুখটা অস্বাভাবিক রকমের শুকনো।চোয়াল ভেঙে বাজে অবস্থা।সেই শীতের শেষে দেখা সূচির সাথে এই মেয়েটার কোনো মিল নেই।কিছুক্ষণ আগের কোনো কথাই তুললো না অন্তু।মেয়েটাকে সহজ করতে সহাস্যে বললো, ” খুব রোগা হয়ে গেছো।এই বৃষ্টি-বাতাসের মধ্যে ঘরের বাইরে বেরিয়েছো কী করে?ভয় করে না? একটু জোরে হাওয়া ছুটলেই ফুসসস করে উড়ে যাবে তো।”

ঠোঁট বাঁকা করে একটু হাসির ভঙ্গি করলো সূচি।অন্তুর চেহারার দিকে স্থির দৃষ্টি পেতে বললো, ” ঘরে আসুন,আম্মা ডাকছে।”

কন্ঠে কোনো উত্তেজনা নেই।ভাঙা স্বরটাকেই খুব স্বাভাবিক শোনায়।যাক বাঁচা গেল। বুকের উপর থেকে কঠিন এক পাথর নেমে গেল। মেয়েটাকে আবার লজ্জা পেতে দেখলে অন্তু নিজেই লজ্জায় মরে যেত।

” অন্তু তাইলে যাও তুমি।আমি রেডি হয়া তোমার সাথেই তো তাইলে বাইরাইতে পারি।”

” তোমার রেডি হয়ে বের হতে কতক্ষণ লাগবে?”

” এক-দেড় ঘন্টা তো লাগবই।”

মাথা নাড়লো অন্তু।হুমায়রার দিকে চেয়ে বললো,” তাহলে হবে না ভাবি।আমি কিছুক্ষণের মধ্যেই বেরিয়ে যাব।তাছাড়া, তুমি তো যাবে বাজার দিয়ে।আমি যাব পূবের বিল দিয়ে।বিল দিয়ে নদীতে তাড়াতাড়ি যাওয়া যায়। ইমনদের বাড়ি এদিক দিয়েই কাছে।অযথা বাজারে ঘুরব না।”

” আচ্ছা তাইলে।” — তারপর সূচির দিকে চেয়ে বললো, ” সূচি, আজকে আর ভাত আনতে হইব না আমার লেগা।আমি নিজেই রান্না করতাছি।”

” ঘরে আছে কিছু?”

” হ।ডাইল আছে,তা দিয়া ভালোই ভর্তা হইব।”

” আচ্ছা।অন্তু ভাই চলুন।”

দুটো শপিং ব্যাগ হাতে সূচির আগে আগে হেঁটে বেরিয়ে গেল অন্তু।পিছনে সূচিও চললো দূরত্ব রেখে।উঠোনের মাঝে যেয়ে শুধু একবার প্রশ্ন করলো, ” আপনি একটু পরেই চলে যাবেন?থাকবেন না অন্তু ভাই?”

” না।”

কতবড় স্বস্তির নিশ্বাস ফেললো মেয়েটা তা অন্তর্যামী ছাড়া কেউ জানে না।অন্তুর সামনে অপমানিত হতে খুব বিব্রতবোধ কাজ করে সূচির মাঝে। তাই তার চলে যাওয়ার খবর পেয়ে এতোক্ষণে খুব তৃপ্তি নিয়ে স্বস্তির নিশ্বাস ফেললো সে।বাইরের সবাই চলে যাক।কাজী বাড়িতে সূচিই পড়ে থাকুক তার দুর্ভাগ্য নিয়ে।

______________________________

আজকের দিনটা খুব ব্যস্ততায় কাটবে ফয়সালের।খামারে আজ অনেক কাজ।কিছু গাছ লাগাতে হবে,আগাছা পরিষ্কার করতে হবে,কিছু কিছু গাছে সার দিতে হবে।এসবের শেষে আবার আছে মাছ ধরার ধান্দা।খামারের পুকুরে নতুন পোনা ছাড়বে। তাই বড় মাছগুলো ধরবে আজ।তাই সকাল সকাল বেরিয়ে গিয়েছিলো।দুপুরের আগে আগে মাছ ধরবে।বাজারের কিছু মাছ ব্যবসায়ী বায়না দিয়ে গেছে সেদিন।আজ তাদেরকে মাছ বুঝিয়ে দিতে হবে। তাদের সাথেই কথা বলতে গিয়েছিলো সকাল সকাল।ফিরতে ফিরতে নয়টা দশ বেজে গেল।বাজার থেকে কিনে আনা নাস্তার পলিথিন হাতে ঘরে ঢুকতেই রোমেলা বানুর মুখোমুখি হতে হলো।সোফায় বসে পান চিবোচ্ছেন।সামনের টেবিলের উপরে গোটা তিনেক সিরামিকের প্লেট-বাটি। প্লেট খালি, একটা বাটিতে খেজুর গুড়, আরেকটাতে মুড়ি। টেবিলের উপরে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে তিন-চারটে কলার খোসা।ঘরে ঢুকে আগে মাকে সালাম দিলো ফয়সাল।অগোছালো টেবিলের উপরে আঙুল হেলিয়ে নির্দেশ করে বললো, ” ওগুলো কী? গুড়-মুড়ি খেয়েছো আজকে?”

” জ্বি না,তোর বউয়ে এগুলি দিয়া মেহমানদারি করছে।চিন্তা কর একবার।সকাল সকাল মেহমান বিদায় দিছে দুধ-কলা-গুড়-মুড়ি খাওয়ায়া!অলক্ষ্মীর জাত।”

অবাক হলো ফয়সাল।ভ্রু তুলে বললো, ” কে এসেছিলো?”

” অন্তু।”

” অন্তু ভাই! কখন এসেছে?কোথায় সে? ”

” বসে নাই, গেছে গা। আজকে বলে দাওয়াত আছে কোন এক বন্ধুর বাসায়।লঞ্চ ঘাটের কাছেই বাড়ি।সেইখান থেকা আজকে লঞ্চে যাইব।ঢাকায় ভালো চাকরি পাইছে।এখন থেকা শান্তর কাছে থাইকা চাকরি করব।”

” শান্ত ভাই ঢাকায় কী করে?”

” সিলেট থেকা চইলা আসছে ঢাকায়।”

” আমি তো বাজারেই ছিলাম।আমার সাথে তো দেখা হলো না। ”

” পূবের বিল দিয়া গেছে।”

” অন্তু ভাই আমাদের এখানে দু-একদিন থাকতে পারতো।আবার কবে না কবে আসবে,আমার সাথে দেখাই হলো না।”

” কইছে সন্ধ্যায় লঞ্চে যাওয়ার আগে একবার আইসা দেখা কইরা যাইব। তখন দেখা করিছ।তোর হাতে এইটা কী? কী ঐ প্যাকেটে?”

” হোটেলের নাস্তা আম্মা।”

অন্তুর আগমনে রাগের মুখে অনিচ্ছাবশত ছিপি দিয়েছিলেন রোমেলা বানু।মুখটাও বন্ধ হয়েছিলো কিছুক্ষণের জন্য। ছেলের দরদি মন দেখে রাগ বেড়ে দ্বিগুণ হলো।গলা চড়িয়ে বললেন, ” মেমসাহেব হইছে তোমার বউ? হ্যাঁ? সকাল দশটা পর্যন্ত ঘুমায়া এহন রুমে বইসা রইছে।সকালের একটা কাজ করে নাই।এহনও আমার চুলায় আগুন পড়ে নাই।আমার মেহমান বিদায় দিছে বা*-ছাল খাওয়ায়া।এহন তুমি আইছো আবার কুয়ারা দেখাইতে? নাস্তা আনছোছ ক্যান কুত্তার ছাও? তোর বউয়ে রাঁনতে পারে না? তোর বউয়েরে হাত দেয় নাই আল্লায়? বান্দির ঝি কি লুলা?”

ডান পাশের দাঁতগুলোর উপরে পানের ভার ন্যস্ত করে একদমে এতোগুলো কথা বলে ফেললেন রোমেলা বানু।মায়ের সামনে কুকড়ে-মুকড়ে গেল ফয়সাল।ঘাড়টাকে নিচু করে বললো, ” ইয়ে আম্মা, কালকে সূচির খুব জ্বর ছিল।তাই আমিই ডাক দিয়ে যাইনি।ভোরের দিকে ঘুমিয়েছে। আজ নাহয় সকালের নাস্তাটা থাক।দোকানেরটাই খাও।”

কথার শেষেই সোফার কুশনটা উড়ে এলো নাক বরাবর।ব্যাথা না পেলেও ভয় পেয়েছে ফয়সাল।মাথাটাকে আরেকটু নিচু করে ফেললো তাই।

” বউয়ের লগে ঘরে যায়া তুনুতুনু কর।আমার সামনে এতো ঢং করবি না।জানোয়ার জন্ম দিছি আমি।তোর বউয়ের জ্বর সেই বিয়ার পর থেকাই দেখি।এইডা আর নতুন কী?এহন আইছো তুমি ঢং মারাইতে।যা,চোখের সামনে থেকা দূর হ।করগা ঢং,দুইদিন পরে আবার যহন মাথায় উইঠা নাচব তহন আসিছ আমার কাছে।জুতা দিয়া পিটায়া লম্বা বানায়া ফেলুম।বেদ্দপের বংশ বেদ্দপ।”

ঘরে বসে চুপচাপ খাট গোছাচ্ছিলো সূচি। ঘুম থেকে উঠে গোছানো হয়নি।মন দিয়ে শুনতে হয়নি, কানে এসেছে সবই।এখন আর এসব খুব একটা গায়ে লাগে না।নিত্যদিনের কাহিনী গায়ে সয়ে গেছে।অন্তু এই ফয়সাল আসার পাঁচ মিনিট আগেই বেরিয়েছে।তার মুখ দেখেই সূচি বুঝেছে লোকটার খুব ক্ষুধা পেয়েছে।দুর্ভাগ্যবশত আজকেই সকালের নাস্তাটা বানানো হয়নি।শুধু নুডলস দিয়ে পেট ভরাতে ইচ্ছা করলো না।সূচি জানতো মিষ্টি অন্তুর পছন্দ।তাই কিছুটা সঙ্কোচ নিয়েই তার কাছে যেয়ে বললো, ” অন্তু ভাই, আপনি গুড়-মুড়ি খান? গরুর খাঁটি দুধ আছে ঘরে।এনে দেই? খামারের পাকা কলাও আছে।মজা পাবেন খেয়ে।এনে দেব?”

রোমেলা বানুর হয়তো পছন্দ হয়নি এই প্রস্তাব।চোখ-মুখ খিঁচিয়ে কিছু একটা বলতে যাচ্ছিলো,তার আগেই হাত তুলে থামিয়ে দিলো অন্তু।সূচির দিকে ফিরে মুচকি হেসে বললো, ” আনো।দুধটা একটু ভালোভাবে জ্বাল দিয়ে ঘন করো।আর বেশি করে কলা এনো সূচি।”

বহুদিন পরে কেউ হাসিমুখে কথা বললো।নিজের দুঃখ ক্ষনিকের জন্য ভুলে গেল সূচি।একগাল হেসে বললো, ” এখনি আনছি।আপনি আজকে থেকেই যান ভাই।বিকালে সন্দেশ বানাব।সেইবার না খুব মজা করে খেয়েছিলেন?”

আধঘন্টার মতো ছিল অন্তু।বসার ঘরে নিজের চাচীর সাথেই কথা বলেছে। সূচির সাথে খুব একটা কথা হয়নি।যাওয়ার আগে রোমেলা বানু উঠে ওয়াশরুমে গিয়েছিলেন,তখনই সূচিকে ডাকলো সে। একটা শপিং ব্যাগ হাতে তুলে দিয়ে বললো, ” এটা তোমার জন্য।ভার্সিটিতে ভর্তি হয়েছো?”

এদিক-ওদিক মাথা নাড়ে সূচি।

” ফয়সালকে বলেছিলে ভর্তির কথা?”

” না।”

” খুবই ভুল করেছো বোকা মেয়ে। পড়াশোনা কখন কোন কাজে লেগে যায় তা কেউ বলতে পারে না সূচি।এখনো হয়তো ভর্তির ডেট আছে।হয়ে যাও ভর্তি।ফয়সালকে বোঝাও।বুঝিয়ে বললে রাজি হতেও পারে।”

” কেন রাজি হবে অন্তু ভাই? আমি পড়তে গেলে তাদের চলবে কেন? আজকে সকালেই তো দেখলেন সব।একটু দেরি করে ঘুম থেকে উঠাটাও অন্যায়।এরপরেও কেন পড়াশোনার কথা বলে মুখ নষ্ট করব? তাছাড়া আমারও ইচ্ছা নেই। সংসার,পড়াশোনা দুটো একসাথে সামলাতে পারব না।”

বেশ কিছুক্ষণ চুপ করে রইলো দুজনে।ঘর ছাড়ার আগে পিছন থেকে ভেসে এলো অন্তুর নরম কন্ঠ,
” দোয়া করি পৃথিবীর সবচেয়ে ভালো মানুষটা তুমি হও।মানুষের মতো মানুষ হও, নিজের উপর জুলুম করা বন্ধ করো।তোমার মতো ছোট্ট একটা বোকা মানুষের জন্য এরচেয়ে বেশি কিছু চাইব না আর।পরেরবার এরচেয়ে ভালো কোনো পরিস্থিতিতে তোমার সাথে আমার দেখা হবে ইনশাআল্লাহ।”

আহ!বাহুল্য প্রার্থনা।সূচির ভিতরে কে যেন চুপিচুপি ঘোষণা করে দিলো, ” এই লোকটার মতো বড় শুভাকাঙ্ক্ষী তোর নেই বললেই চলে।”

ফয়সাল ঘরে ঢুকে দেখলো সূচি কাজ করছে।বিশেষ কোনো কাজ না।ওয়ারড্রব, খাট,আয়না-টায়না গোছাচ্ছে।খাটের উপরে রাখা একটা শাড়ি।সাদা শাড়িতে টকটকে লাল রঙা বুনোফুলের কাজ।প্রথম দর্শনে একে বৈশাখের শাড়ি বলেই মনে হয়।দেহের এই আবরণটি খুব চেনা। মনে পড়লো,তপুর বোন তনুর জন্মদিনে তার জন্য শাড়ি কেনার সময় ঠিক এই শাড়িটাই সূচির জন্য দেখেছিল।কিন্তু সূচির রঙের সাথে মানাবে না বলে আর কেনা হয়নি।কে আনলো আজ? অন্তু ভাই? ইশ! শাড়িটাই নষ্ট হবে।মেয়েটাকে মানাবেই না।সুন্দর শাড়িটা অযোগ্য ব্যাক্তির গায়ে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে আছে,দৃশ্যটা কল্লনা করতেও ভালো লাগলো না।অন্তু ভাইয়ের আসলে রুচিবোধই নেই।

” তোমার জ্বর কমেছে?”

” হ্যাঁ।”

” সকালের ভাত বসিয়েছো?”

” হ্যাঁ। ”

” তরকারি?”

” না।”

” তাহলে আজ আর রাঁধতে হবে না।বাজারের পরোটা খাও।যেয়ে নাস্তা ঠিক করো প্লেটে।আসছি আমি।”

লক্ষ্মীছাড়া জ্বর আর কিছু করুক বা না করুক,সূচির স্বাদ নেওয়ার শক্তিকে গলা টিপে মেরে রেখে গেছে।জ্বিভটা যেন সিদ্ধ হয়ে আছে। কিছুই ভালো লাগে না মুখে।বমি আসে বারবার।এমনিতেই ইদানীং খাওয়া-দাওয়া কমিয়ে দিয়েছে সূচি,এখন আরও কম খায়।বলা যায় খেতেই পারে না।নিজের হাতে রাঁধা জিনিসগুলোকেও অখাদ্যের কাতারে ফেলতে ইচ্ছা করে।বাজারের রাবারের মতো পরোটা ও মুখের দিকে চেয়ে থাকা ডাল-ভাজির বাজে সংমিশ্রণ দিয়ে পেট ভরানোর কথা মনে আসতেই গড়গড় করে বমি করতে ইচ্ছা হলো।কাল রাতেও খাওয়া হয়নি খুব।পেটে তাই মাত্রাতিরিক্ত ক্ষুধা।অথচ জ্বিভে স্বাদ নেই।কি একটা বিশ্রী অবস্থা।নিজের উপরেই বিরক্ত লাগছে খুব।ওদিক বাইরে থেকে ভেসে আসছে শাশুড়ির উচ্চ কন্ঠ। তার ছেলেদেরকেই বউয়েরা তাবিজ করে, এই বিষধর বউদের সাথে মিলেমিশে থাকার চেয়ে মরন শ্রেয়–এই কথাটাই বারবার ঘোষণা করছেন সতেজে।শাশুড়ির গজগজানি আরো বিরক্ত করে দিলো সূচিকে।সকাল থেকে কাহিনী তো আর কম হলো না।সারা রাত জ্বরসহ নানা ব্যারাম গামছার মতো নিংড়ে রেখে গেছে ওকে।তারপর ঘুম ভাঙার পর থেকেই শুরু।শুনতে শুনতে আর ভালো লাগে না।মাথা ধরে গেছে এখন।সবকিছুর প্রতি বিতৃষ্ণা চলে এলো।শার্ট খুলে হাত-মুখ ধুতে যাচ্ছিলো ফয়সাল,সূচি তাকে ডেকে বললো, ” আম্মাকে আজকের জন্যে একটু থামতে বলুন না।দয়া করে একটু যেয়ে বলুন আজকের জন্য একটু দয়া করতে।আমার মাথা ধরে গেছে।দিন-রাত শারিরীক-মানসিক অশান্তি আমি আর নিতে পারছি না।”

” বুড়ো মানুষেরা ওরকম বলেই।কান না দিলেই হয়।”

” প্লিজ”– সূচির গলায় অদ্ভুত কাতরতা।

” তুমি কি পাগল? সকাল সকাল আমিই একদফা শুনে এসেছি আর তুমি পারবে না? কান দিও না,আম্মা এমনিই চুপ করবে।কিছুক্ষণ তো সহ্য করো।”

” সকাল থেকেই চলছে।সহ্য তো করছিই। এখন পারছি না বলেই আপনাকে বলেছি।আমিও মানুষ।আমারো সহ্যের সীমা আছে।আমি আগে আগেই আপনাকে বলছি আম্মাকে আমার জ্বরের কথা একটু বুঝিয়ে বলুন। পরে আমার মন-মেজাজ আরো খারাপ হয়ে গেলে বাড়াবাড়ি হয়ে যাবে।”

ভ্রু কুঁচকে গেল ফয়সালের। সূচির দিকে চেয়ে বললো, ” কীরকম বাড়াবাড়ি?আবার মুখে মুখে তর্ক করবে? তোমার এতো সাহস? আবার শুরু করছো? কিছুদিন আগের কথা ভুলে গেছো?”

” না ভুলিনি।তর্ক করব না আমি।খুব বেশি খারাপ লাগলে এক কাপড়ে ঘর থেকে বেরিয়ে যাব।যেদিকে দু-চোখ যায় সেদিকেই চলে যাব।হাসছেন কেন? হাসবেন না।আমি সত্যি বলছি কিন্তু। আপনি আগেভাগেই কিছু বলুন নয়তো আমি ঠিক এটাই করব।”

নির্লজ্জের মতো একগাল তাচ্ছিল্যের হাসি হেসে বউয়ের গাল টিপে দিলো ফয়সাল।ওয়াশরুমের দিকে পা বাড়াতে বাড়াতে বললো, ” মোল্লার দৌড় মসজিদ পর্যন্ত । কোথায় আর যাবে? বড়জোর বাবার বাড়ি। আচ্ছা যাও।তার আগে আমাকে নাস্তা দিয়ে যাও আর আমার ফোনটা চার্জে দাও।বন্ধ হয়ে আছে ওটা।”

ওয়াশরুমের দরজা লাগানোর আগে আরেকবার শোনা গেল ফয়সালের কন্ঠ। খুব আমুদে গলায় বললো, ” তারপরে এক কাজ করো।তোমার আব্বাকে ফোন দিয়ে সব খুলে বলো। বলো যে তুমি শাশুড়ির কথায় রাগ করে এক কাপড়ে বাড়িতে যেতে চাচ্ছ।দেখ তিনি কী বলেন।তোমাকে হয়তো সাহায্যও করতে পারে।তোমারই তো বাবা,মেয়ের এতো দুঃখ-কষ্টও কি তার চামড়ায় সইবে?”

ফয়সালের তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য মেশানো খোঁচাটুকু সর্বাঙ্গে বোলতার হুলের মতো ফুটলো।বাবার দিক থেকে কোনো সাহায্য আসবে না তা জানা আছে বলেই লোকটা ইচ্ছা করেই এগুলো বললো। ভিতর থেকে একদলা হতাশা বেরিয়ে এলো তার। ইশ! পাশে দাঁড়ানোর মতো কেউ একজন যদি থাকতো।

_____________________________

ফয়সাল বেরিয়ে যাওয়ার কিছুক্ষণের মাঝেই হুমায়রাও বেরিয়ে গেছে।সূচি তখন পুকুর ঘাটে যাচ্ছিলো এক বালতি কাপড়-চোপড় নিয়ে।আজ বেশ রোদ উঠেছে।ঘরের কিছু চাদর-টাদর ধোয়ার দরকার।এতোদিন বৃষ্টির জন্যই ধুতে পারেনি।সাবানে ভেজানো কাপড়ের বালতি নিয়ে যাওয়ার সময় হুমায়রার ঘরের সামনেই দেখা হলো।বোরকা জড়িয়ে ঘরে তালা মারছে।সূচির চোখে চোখ পড়তেই প্রশ্ন করলো সূচি, ” বাজারে যাও?”

” না, আমাগো বাড়িতে যাই।”

” কেন?”

” ভাইয়ের পোলার আকিকা আজকে।সেই দাওয়াতে যাই।”

” এতোদিন পরে আকিকা?”

” হ।ভাইয়ের হাত খালি ছিল তাই এতোদিন দেয় নাই।এখন দিব।তোমার চোখ-মুখ ওমন শুকনা ক্যান? খাও নাই সকালে?”

” না।দোকানের নাস্তা খেতে ইচ্ছা করছে না।খুব ঝাল ভর্তা দিয়ে গরম গরম ভাত খেতে ইচ্ছা করছে ভাবি।মনে হচ্ছে একটু ভর্তা হলে আমি অনেকগুলো ভাত খেতে পারতাম।”

” দুইটা আলু সিদ্ধ দিয়া ভর্তা বানায়া লও তাইলে।”

ঠোঁট উল্টে ফেললো সূচি।

” ধুর, আবার কে বানায়।এই এক বালতি কাপড় ধোয়ার পর এসব করার সময় থাকবে না,খাওয়ার সময়ও থাকবে না।একবারে দুপুরেই করবনি।”

কথার শেষে চলেই যাচ্ছিলো সূচি।হুমায়রা তাকে থামিয়ে ঘর খুলে ঢুকতে ঢুকতে বললো, ” একটু দাঁড়াও সূচি।”

এক মিনিটের মধ্যেই ফিরে এলো সে।হাতে ছোট্ট একটা স্টিলের বাটি।বাটিতে অল্প একটু ডাল ভর্তা।সূচির হাতে চালান করে দিয়ে বললো, ” আমি খাওয়ার পরে এইটুকু ছিল দেইখা ফ্রিজে রাইখা দিছিলাম।তুমি নাও,গরম ভাত দিয়া খাইলে ওতো ঠান্ডা লাগব না। পেটেরে এইবার কিছু খাইতে দাও সূচি।দুঃখে-কষ্টে থাকলে মানুষ নিজেরে এমন কষ্ট দেয় না।”

” আরে দুঃখে না,সত্যিই কিছু খেতে ভালো লাগে না। তুমি কি থাকবে কিছুদিন তোমাদের বাসায়?”

” আরে না।কালকে ফজরের পরেই চইলা আসুম।মানিকরে থুইয়া যাইতাছি তো।আসি তাইলে এখন।আম্মার চোখ বাঁচায়া আগে খায়া নাও।আমার ঘর থেকা ভর্তা নিয়া ভাত খাইতাছো শুনলে যুদ্ধ লাগায়া দিব।যাও, দোউড়াও।”

হুমায়রার ভবিষ্যত বাণী অক্ষরে অক্ষরে ফললো।ভয়াবহ একটা ঝামেলা হয়ে গেল। তখন ঘড়িতে বাজে সকাল দশটা পঞ্চাশ মিনিট।সূচি গোয়ার্তমিতে সেরা।হুমায়রার কথা শুনে সে প্রথমেই পেট ঠান্ডা করতে ছুটলো না।রান্নাঘরে চুলার পাশে বাটিটা রেখে ভাবলো,কাপড়গুলো ধুতে আর কতক্ষণ লাগবে? এগুলো শেষ করেই বরং খাওয়া যাবে।ভারী কাজের পর ক্ষুধাও বেশি লাগবে।বাইরের কাজ শেষ করে তখন রান্নাঘরে বসেই খাওয়া যাবে।
যেই ভাবা,সেই কাজ। পুকুরে আছড়ে-পাছড়ে কাপড় ধোয়ার পর উঠোনে টাঙানো এমাথা-ওমাথা দড়িতে একে একে ভারী চাদর, বালিশের কভার মেলছিলো।বাড়িতে সে ও রোমেলা বানু ছাড়া আর কেউ নেই।আধভেজা শাড়িটা পায়ের সাথে লেপ্টানো।শাড়ি-টাড়ি সামলে একে একে মেলে দিচ্ছিলো সব।আর দুটো বালিশের কভার বালতিতে আছে।কাজের ফাঁকে একটু জিরোতে কোমড় সোজা করে দাঁড়িয়েছে সবে।এমন সময় দরজার কাছে থপথপ করে হেঁটে এসে থামলেন রোমেলা বানু।হাতে ধরে রাখা স্টিলের ছোট বাটিটা সূচির পায়ের কাছে ছুঁড়ে ফেললেন।দু-তিনটে সিঁড়ি তরতর করে বেয়ে উঠোনের মাঝে এসে দাঁড়িয়ে সূচির চেহারার দিকে ক্রুদ্ধ দৃষ্টি হেনে বললো, ” এই বাটিতে ভর্তা কোনতে আইলো?”

মাটিতে পড়ে আছে সূচির আহার।সকালের খাবারটুকু অকারণে নষ্ট হতে দেখে চট করে রাগ উঠে গেল মাথায়।ক্ষুধার্থ মানুষ নাকি ক্ষুধার চোটে মানুষ খুন করতে পারে।রাতে,সকালে পেট পুরে না খেতে পারা সূচির মনে ঠিক এই চিন্তাটাই এলো।ধা করে প্লাস্টিকের শক্ত বালতিটা শাশুড়ির মাথার দিকে ছুঁড়ে মারতে ইচ্ছা হলো।

” কই পাইছো তুমি এই খাওন? হ্যাঁ, কথা কও না ক্যান এখন? ডাইল সিদ্ধ তো দাও নাই।হুমায়রার থেকা আনছো? এতো সাহস!”

কপালের দু-পাশের রগগুলো ফুলে গেছে আরো আগেই।পায়ের রক্তটা বোধহয় মাথায় উঠেছে।ঘাড় ত্যাড়া করে শাশুড়ির দিকে চেয়ে রইলো কড়া চোখে।ধমকের সুরে বললো, ” ডাল সিদ্ধ দেইনি বলেই ফেলে দিতে হবে? ফেললেন কেন আপনি? সাহস তো কম না।আর কত পদে অত্যাচার করবেন? মানুষ মনে হয় না আমাকে?”
পায়ের কাছে পড়ে থাকা ভর্তাগুলোর দিকে আঙুল দিয়ে নির্দেশ করে বললো, ” ফেলেছেন কেন আমার সকালের খাবার? সবকিছুতে আপনার বাড়াবাড়ি তাই না? এতো খাবার নষ্ট করছেন তো, বুড়ো বয়সে খাবার পাবেন না দেখবেন।রিযিক তো আগেই নষ্ট করছেন।”

” এই কী কইলি তুই? আমারে অভিশাপ দিলি? বান্দির ঝি তোর এতো সাহস?”— বউয়ের দিকে তেড়ে গেলেন রোমেলা বানু।সকাল থেকেই বধূর উপরে অসন্তুষ্ট। এখন আরো বাড়লো।রাগে হতভম্ব হয়ে গেছেন তিনি।

” হ্যাঁ, সাহস।আমার অনেক সাহস।খবরদার আমার সাহস দেখতে চাইবেন না।বাড়িতে আজ কেউ নেই।আপনার ছেলের ফোনটাও ঘরে। তাকেও ডেকে আনতে পারবেন না।তাই সাবধান।ভাববেন না,আমার চেয়ে আপনার শক্তি বেশি।খালি বাড়িতে আমার সাথে তিড়িংতিড়িং করলে খবর আছে।”

আঙুল তুলে তুলে হুমকি দিয়ে দড়ি ধরে দাঁড়িয়ে রইলো সূচি।ভারী কাজের শেষে ক্ষুধাটা মাথাচাড়া দিয়ে উঠছে।রাগ কমাতে চোখ বন্ধ করে ঘন ঘন দম নিচ্ছে সে।কয়েক সেকেন্ড পরে আচমকা, ঠিক আচমকা একটি শক্ত জুতো উড়ে এলো কপালের দিকে।আগে দেখেনি সূচি।বাম ভ্রুর কাছে আঘাত আসতেই চট করে চোখ খুললো সে।বিষয়টা বুঝতে মাত্র দশ সেকেন্ড সময় লাগলো।রোমেলা বানুর ডান পায়ের জুতোটা নেই।তার শাশুড়ি করেছে কাজটা।ছিঃ! ছিঃ! তিনি জুতোটা ছুঁড়ে মেরেছেন সূচির দিকে।

” জারুনির ঘরের জারুনি,তুই আমারে দেছ হুমকি? কু** বা** তোর এতো সাহস কোনতে আইলো? দুই আঙ্গুলের মাইয়া,তুই আইছোছ আমার লগে লড়তে? শয়তানের বাচ্চা,তোর আজকে খবর আছে।ঢুকবিন না তুই আমার ঘরে।চুলের মুঠি ধইরা যদি তোরে তোর বাপের বাড়িতে না পাঠাই তো আমার নাম রোমেলা না।আজকেই ফয়সাইল্লারে কমু তোরে তালাক দিতে।তুই খালি দেখ।এই বাড়িতে সংসার করার ক্ষমতা তোর জন্মের মতো ঘুচায়া দিমু।”

রাগের চোটে একদমে কথাগুলো বলে ঘরের দিকে ছুটলেন রোমেলা বানু।সূচি ক্রুদ্ধ,বিস্মিত,হতভম্ব।রোনেলা বানু তাকে মারলো!এতো সাহস! শাশুড়ির হাতে মার খেয়ে প্রথমে একটা ইচ্ছাই জাগলো মনে।চুলার কাছে ধারালো বটিটা রেখেছে সূচি।রোমেলা বানু পারবেন না লম্বা সূচির সাথে। শাশুড়ির মাথাটা ঘাড় থেকে ফেলতে বটির এক কোপই যথেষ্ট। হ্যাঁ, খুনের ইচ্ছাটাই জাগলো মনে।রাগের মাথায় দু-পা এগিয়েই থেমে গেল। সেকেন্ডের মাঝেই অন্য একটা চিন্তা এলো মনে। খুন করবে কেন সূচি? কাকে মেরে হাত নষ্ট করবে সে? ঐ ঘরে আবার পা রাখতে পারবে সে? পা উঠবে তো?
না,পা উঠলো না আর।ঘরের দিকে কয়েক সেকেন্ড আগুন চোখে চেয়ে রইলো সে।সূচির চোখের আগুন বাস্তবে বেরিয়ে আসলে নিশ্চিত কাজী বাড়ি সেদিন ভস্ম হয়ে যেতো।কিছুক্ষণ পর নিজের মনেই বিড়বিড় করলো সে,

” আমি তোদের বাড়িতে থাকবও না,সংসারও করব না।তোদের মুখে আগুন,তোদের সংসারের কপালে ঝাঁটা।কুলাঙ্গার ছেলেকে আবার বিয়ে করিয়ে নিস।”

বালতিতে সেই দুটো বালিশের কভার এখনো পড়ে আছে।সূচির শাড়িটা এখনো আধভেজা,পায়ের কাছে জড়ানো।পা চালিয়ে হাঁটতে সমস্যা হয়।সেই অবস্থায় বাড়ির সদর দরজা ধরে বেরিয়ে গেল সূচি।অন্তর্যামী ভিন্ন কেউ জানলো না,রাগে অস্থির হয়ে এক পেট ক্ষুধা নিয়ে কাজী বাড়ির ছোট বউ অসুস্থ শরীরে এক কাপড়ে ঘর ছেড়েছে।

চলবে…..

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here