#শুকতারা (পর্ব-৪২)
#হালিমা রহমান
ভূমির শরীরটা ইদানীং আর চলেই না।ভারী শরীরের ভার হাড়ে হাড়ে অব্যক্ত এক তিক্ত-মধুর যন্ত্রণার সৃষ্টি করে।সহ্য করা যায় না অথচ অম্লান বদনে তাই সহ্য করতে হচ্ছে দিন-রাত।সময়টা এপ্রিলের শেষ শেষ।তাই এরকম হওয়াটাই স্বাভাবিক।ভূমির সর্দি-কাশি কমলোই না আর। কাশির দমকে এখনো সে বেঁকে যায়।চব্বিশটা ঘন্টা সে স্বপ্নে বিভোর থাকে।ক্যালেন্ডারের পাতায় চেয়ে থাকে অহর্নিশ।হাতে গুনে আর কয়েকটা দিন মাত্র।তারপরে বয়ে বেড়ানো এই দুষ্টু বদমায়েশটা বাইরে আসবে।মাকে চূড়ান্ত যন্ত্রণা দেওয়ার পরে পৃথিবীতে এসে সে ভ্যা ভ্যা করে কাঁদবে।কাদামাটির তালের মতো ছোট্ট একটা শরীর বড় হবে ধীরে ধীরে।বুলি ফুটবে,হাঁটতে শিখবে,মুখের আদল হবে তাদের মতো,সূচির মতো পড়া চোর হবে আর ভূমি কাঁধে ধরে ধরে পড়াবে।কতকিছু যে ভাবে ভূমি!প্রত্যেকটা মায়ের জন্যেই এই ভাবনা কতই না মধুর! ভূমির দিন এভাবেই কাটছে।
কিন্তু আজকের চিত্রটা ভিন্ন।সকাল থেকেই কেমন যেন অস্থির অস্থির লাগছে ভূমির।পেটের টনটনে ব্যাথা,গলা ব্যাথা,কাশি, হাত-পা,হাঁটুর ব্যাথা ছাড়াও অন্য এক রকমের অস্থিরতা কাজ করছে মনে।এ অস্থিরতা শারিরীক যন্ত্রণা থেকে সৃষ্টি নয়,মনের দিক থেকে তৈরি। বারবার মনে হচ্ছে আজ খুব খারাপ কিছু একটা হবে।রাতে তার ঘুম হয় না।এ সেই শুরু থেকেই।নিদ্রাহীনতাই এখন অভ্যাস।কাল রাতেও হয়নি। সকাল থেকে মনটা অজানা এক কারণেই আঁকুপাঁকু করছে,গলা শুকিয়ে আসছে বারবার।সকাল থেকে এক লিটার পানি শেষ করেছে সে।সকালে নাস্তা খাওয়ার পরে এদিক-ওদিক হেঁটে মন ভালো করার চেষ্টা করেছে,ইশতিয়াকের গায়ের দিকে চেপে বসে মন শান্ত করার চেষ্টা করেছে।কিন্তু কোথায় কী? কিছুক্ষণ পরপরই মনে এক অজানা ভয় হাতছানি দিচ্ছে।বুকের উপর চেপে বসে আছে নিতান্ত অমূলক,অজানা,অচেনা কিছু একটা।ভূমি তাকে কিছুতেই সংজ্ঞায়িত করতে পারছে না।
আজ মোটেও একা থাকতে ভালো লাগছে না তার।ইশতিয়াক বেরিয়ে যাওয়ার সময় প্রতিদিন সে রাস্তা পর্যন্ত এগিয়ে দেয়।আজকেও দিলো।স্বামীকে বিদায় দেওয়ার আগ মুহূর্তে মুখ বাড়িয়ে বললো,
” শোনো ইশতি,আজ কাজ কম থাকলে দুপুরের দিকে ছুটি নিয়ে আসতে পারবে?”
ইশতিয়াক ব্যস্ত হয়ে পড়লো।ফের বাড়িতে ফিরে উদ্বিগ্ন গলায় প্রশ্ন করলো, ” কেন? শরীর খারাপ লাগছে তোমার? হাসপাতালে যাবে? আমাকে আগে বললে না কেন?”
” না,তেমন কিছুই না।আমার মনটা আজ ভালো নেই।কেমন যেন অস্থির লাগছে।”
শারিরীক কোনো সমস্যা নেই শুনে মনে মনে স্বস্তি পায় ইশতিয়াক।নিত্যদিনের মতো বউকে সাবধানে থাকার উপদেশ দিয়ে যাওয়ার আগে কথা দেয় আজ লাঞ্চ আওয়ারেই অর্ধেক বেলার ছুটি নিয়ে চলে আসবে।
চব্বিশ এপ্রিল,বেলা এগারোটা পনেরো।ফোনের ওয়ালপেপারে তারিখ ও সময়টা দেখে বিছানা ছাড়লো ভূমি।ইশতিয়াককে বিদায় দিয়ে সে একটু ঘুমিয়ে পড়েছিলো।প্রত্যেকদিনই ঘুমায়।রাতে ঘুমাতে পারে না বলে সকালে নাস্তা খাওয়ার পরে টানা দুই-তিন ঘন্টা ঘুমায়। ঘুম থেকে উঠে অলস হাতে বিছানার চাদর টানটান করে রাখলো ভূমি।বালিশটাও গুছিয়ে রাখলো জায়গামতো।বাইরে আজ রোদ উঠেছে খুব।মাথার কাছের জানালাটা দিয়ে রোদের তাপ এসে গলায় খরা নামিয়ে দিয়ে গেছে।এক গ্লাস পানির অর্ধেকটা গলায় ঢেলে বাকি অর্ধেক জানালা দিয়ে মরিচ গাছের গোড়ার দিকে ছুঁড়ে মারার উদ্যোগ নিতেই দৃশ্যটি চোখে পড়লো তার। পরনের গাঢ় ধূসর রঙা শাড়িটার হাঁটু অবধি রাজ্যের কাদা তুলে ধীর পায়ে বাড়িতে ঢুকছে সূচি!
ট্র্যাজেডি নাটকের শেষে বিরহে কাতর নায়িকা যেমন ধীর পায়ে মঞ্চ ছাড়ে, ঠিক তেমন করেই সূচিও বাড়িতে ঢুকছে।পায়ের ছন্দে একটুও প্রাণ নেই।মুখখানি খুব শুকনো, মনে হয় কে যেন তার জীবনীশক্তি চুষে নিয়ে গেছে। চোখের নিচের কালি,রোগা শরীরের ভার টেনে চলার দৃশ্য ভূমিকেও পাথর করে দিলো যেন।সহসা জানালার পাশ থেকে নড়তে পারলো না সে।কোনো ধরনের প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করতে পারলো না। মনে জেগেছে কেবল একটি চিন্তা, ” আশ্চর্য, এ সেই সূচি!”
সূচি দেখেনি ভূমিকে।দরজার কাছে এসে ক্লান্ত পথিকের ন্যায় গলাটাকে বহু কষ্টে চাঙ্গা করে জোর গলায় ডেকে বললো, ” বড় আপা,বড় আপা।আমি এসেছি,দরজাটা খোলো।”
___________________________________
দুইদিন আগেও বড় আপার বিরুদ্ধে পাহাড়সম এক অভিমান ছিল সূচির মনে।ভূমি কেন এতো কাছাকাছি থেকেও কোনোদিন ওর খোঁজ নিলো না, এই ছিল তার অভিযোগ। আর সবার মতো ভূমিও তাকে ভালোবাসে না,পহেলা বৈশাখের ঝামেলার পর থেকে এই ছিল তার স্থির বিশ্বাস।পণ করেছিলো আর কোনোদিন ভূমিকে দেখতে আসবে না।অথচ আজ রাগে-ক্ষোভে চরম ক্ষুধার্ত অবস্থায় সে যখন আধভেজা শাড়িতে বাড়ি ছাড়লো তখন ভুল করেও বাবার বাড়িতে আশ্রয় নেওয়ার কথা তার মাথায় এলো না।সবার আগেই মনে এলো বড় আপার কথা,সূচির সবচেয়ে বড় স্বস্তির জায়গা এটাই।এদিকে মানূষ এমনিই কম থাকে, রাস্তায় খুব বেশি লোকজন ছিল না বললেই চলে।দু-একটি ফেরিওয়ালা রাস্তায় চিৎকার করে ভ্যান টেনে নিয়ে যাওয়ার সময় আলগোছে নজর বুলিয়েছে ওর দিকে।জুতোর ছিঁটায় কাদা উঠেছে শাড়িতে,অগোছালো চুল, অগোছালো শাড়ি।তাকে দেখতে রাস্তার ধারের ভিখারির মতোই দেখাচ্ছিলো।তবে একটুখানি পার্থক্য হয়তো আছে।রাস্তার ভিখারিদের চোখে-মুখে নমনীয়তা থাকে,থাকে ভিক্ষা পাওয়ার করুণ আকাঙ্ক্ষা।আর সূচির মুখ-চোখে ছিল অস্বাভাবিক কাঠিন্য।শীর্ণ মুখের সাথে সে কাঠিন্য মিলেমিশে তাকে করেছে অন্য স্তরের এক মানুষ।সে যেন হেঁটে বেড়ানো এক লোহার পরিব্রাজক।
নিজেকে ধাতস্থ করে উড়ে যেয়ে দরজা খুলতে ভূমির সময় লেগেছে ঠিক এক মিনিট। দরজা খুলার পরে বোনের মুখের দিকে চেয়ে কথা জাগেনি তার মুখে।ঘরে ঢুকে খাটের উপরে বসে সূচিই প্রথমে কথা বললো।ভালো-মন্দ কোনো যোগ-জিজ্ঞাসা নেই,অসুস্থ বোনের শরীরের দিকে নজর দেওয়ার বালাই নেই।খাটে বসে বড় বোনের মুখের দিকে স্থির দৃষ্টি পেতে সবার আগে সূচিই যা বললো তা হলো,
” খুব বিপদে পড়েই তোমার কাছে এসেছি বড় আপা।আমাকে একটা হাজার টাকা ধার দিতে হবে।আর কষ্ট করে একটু বলতে হবে, উদয়পুরে থানাটা কোথায়।তুমি চেনো? আমার খুব দরকার।”
এ সেই চেনা চপলা সূচি নয়।আদরের বোনের স্বরটাও আজ খুব অপরিচিত ঠেকে কানে।ভাঙা স্বরে রুক্ষ আওয়াজ। ভূমি অবাকের উপরে মহাঅবাক।কিছুক্ষণ হা করে চেয়ে থেকে বললো,
” থানা দিয়ে তোর কী হবে?আর এই অবস্থা কেন তোর? কী হয়েছে বল তো? সব ঠিক আছে?”
” এখন অবধি আমি বাদে ওরা সবাই ঠিক আছে। কিন্তু একটু পর থেকে আর ঠিক থাকবে না।ওদের রাতের ঘুম আমি হারাম করে ছাড়ব।”
সূচির গলায় তীব্র উত্তেজনা,অস্বাভাবিক রুক্ষতা।সব কথা ভূমির মাথার উপর দিয়ে গেল।তবে কিছু না বুঝলেও এটুকু বুঝলো, সূচিকে এখন শক্ত হাতে সামলাতে হবে।এতোটা উত্তেজনা সুস্থ মানুষের জন্যেও ঠিক না।বোনের দু-কাঁধে ভরসা মাখা হাত রেখে নরম গলায় বললো, ” কী হয়েছে তোর? এমন করছিস কেন, সোনা? তুই ভালো আছিস?”
আহ! কতদিন পরে কেউ এমন সহানুভূতির সুরে ওর ভালো-মন্দ জিজ্ঞাসা করলো! বালির মতো ঝুরঝুর করে ভেঙে পড়লো সূচি।বসে থেকে বোনের কোমড় জড়িয়ে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলো।মাথা নেড়ে বললো, ” আমি ভালো নেই আপা,একটুও ভালো নেই।ওরা সবাই মিলে আমাকে মেরে ফেলেছে।সেই শুরু থেকে আব্বা-আম্মাসহ সবাই আমাকে উপর থেকে শুধু চেপেই যাচ্ছে। আজ আমি অসুস্থ শরীরে না খেয়ে ঘর ছেড়েছি।আর কোনোদিন ওই বাড়িতে পা ফেলব না।আমি তোমাকে শুরু থেকে সব বলব।জানো কী করেছে ওরা? ওরা,ওরা…
আর বলতে পারে না সূচি।ক্ষুধা-তৃষ্ণায় দিশেহারা হয়ে বোনের কোমড় জড়িয়ে তার পেটে মুখ গুজে রেখেছে। লুকানো মুখটা থেকে কেবল ফোঁপানির শব্দ আসে।আদরের বোনের কষ্ট ছুঁয়ে গেল ভূমিকে।সে হয়তো কিছু কিছু বুঝতে পেরেছে। পায়ের তলা থেকে মাটি সরে গেলেও ভূমি ভেঙে পড়লো না।বোনের মাথায় হাত বুলিয়ে বললো, ” সব শুনব।তার আগে তুই গোসল করবি,ভাত খাবি তারপর রেস্ট নিতে নিতে সব বলবি। এতো তাড়াহুড়োর কিছু নেই।”
” না,না এতো দেরি করলে চলবে না।ওরা কিছু টের পাওয়ার আগেই আমাকে থানায় যেয়ে জিডি করতে হবে।সময় নেই বড় আপা।”
” অনেক সময় আছে।ওঠ তুই আগে।”
জোর করে সূচির মুখটা দু-হাতের আঁজলায় তুলে নিয়ে, তার কপালে পড়ে থাকা চুলগুলো গুছিয়ে দিয়ে বললো, ” আমি আছি তো,কোনো ভয় নেই।যা তুই গোসলে যা। আমার আগের এক সেট জামা নামিয়ে দিচ্ছি। গোসল করে নে, তারপর ভাত খা।গা থেকে সাবানের গন্ধ আসছে।ঘাম-কাদায় এক অবস্থা হয়ে আছে তোর। ছিঃ! এ নাকি আমার সূচি।এই তুই এমন নোংরা হয়েছিস কেন বলতো? আগের মতোই নোংরা এখনো।যা, যা, ওঠ।আবার কাঁদছে।ইশ! কী ছিড়ি করেছিস মুখের।দেখি চোখ মুছে ওঠ।”
জোর করে কলতলায় ঠেলে পাঠিয়ে চটপট সকালের খাবারগুলো গরম করতে গেল ভূমি।আজ সকালে তাড়াতাড়ি উঠে দুপুরেরটাসহ একসাথে রেঁধেছে। এক প্লেট ঠান্ডা ভাতের সাথে বেশ খানিকটা পাটশাক ভাজা ও এক চামচ কুমড়োর তরকারি নিয়ে নিলো।রান্নাঘর ছাড়ার আগে ফ্রিজ থেকে মাংসের একটা পলিথিন নামিয়ে মাংসটুকু পানিতে ভিজিয়ে রাখলো।এতোদিন পর বোন এসেছে ভূমি কি আর এমনি এমনি তাকে ছেড়ে দেবে?
ভালোভাবে গা ডলে ডলে গোসল সেড়ে, বহুদিন পরে পেট পুরে খেয়ে সূচি যখন উঠলো, তখন তার অর্ধেক ক্লান্তিই পালিয়ে গেছে।সাথে নিয়ে গেছে অর্ধেক রাগ-তেজ-ক্ষোভকে।শরীরে ভর করেছে একরাশ অবসন্নতা।শরীরটা বাসি ফুলের মতো নেতিয়ে পড়ছে।কাল রাতেও ঘুম হয়নি।এখন একটু না শুতে পারলে সূচি হয়তো বাঁচবেই না।
” সূচিইইই,এখানে আয়।”
বোনের ডাকে মাঝের ঘরে গেল সূচি।ছোট্ট একটা চৌকিতে ভারী তোশক পাতা।ভূমি তার উপর নতুন চাদর বিছিয়ে ঝেরে-ঝুরে শোয়ার উপযোগী করছিলো।দুটো বালিশ জায়গামতো গুছিয়ে খাটের উপর নিজে উঠে বললো, ” আয় শুবি আয়।”
” প্লেট না ধুইয়েই চলে এসেছি।”
” থাক, পরে ধোয়া যাবে।”
সূচির পাশের বালিশটাতে নিজেও মাথা পেতে শুয়ে পড়লো ভূমি।বোনের ভেজা চুলে হাত বুলিয়ে বললো, ” এবার বল কী কী হয়েছে। সব বলবি।তোর দোষ থাকলেও বলবি,ওদের দোষ থাকলেও বলবি।আপার কাছে কিচ্ছু লুকাবি না।”
” আচ্ছা।”
সূচি সবার আগে বললো রোমেলা বানুর কথা যাকে সে এই মুহূর্তে সবচেয়ে বেশি ঘৃণা করে।একদম বিয়ের আগ থেকে শুরু করলো।সূচিকে বউ করে নেওয়ার জন্য তার আগ্রহ,ডিসেম্বরের শেষদিনে হঠাৎ বিয়ের প্রস্তাব,বিয়ে,তারপর থেকে তার কর্তৃত্ব,গলাবাজি,কটু কথা,সবকিছু নিয়ে বাড়াবাড়ি,ওদের বাড়ি থেকে যৌতুক নেওয়া,সবশেষে একটু আগের তার সেই আক্রমণ।ভ্রুর কাছে শাশুড়ির জুতো উড়ে আসার গল্পটা বলার সময় ঘৃণায় চোখ-মুখ কুঁচকে এলো সূচির।সে নিজের ঘৃণা নিয়ে এতোটাই ব্যস্ত ছিলো যে ওধারে ভূমির সাদা হয়ে যাওয়া মুখটা চোখেই পড়লো না।আজকের ঘটনাটা বলার শেষে থামলো সূচি।বেশ কিছুক্ষণ থেমেই রইলো।
” তারপরে? ”
” বলছি আপা।”
এরপর সূচি বললো তার আব্বা-আম্মার কথা।শুরু করার আগে ভূমিকে জড়িয়ে ধরে বললো, ” আব্বা-আম্মাকে তো তুমি চেনো।জানো তারা কী করেছে?”
” কী করেছে?”
” এবার বাড়ি যেয়ে আমি আম্মার সাথে সব বলেছিলাম।আম্মা বলেছে সব মেনে নিতে।একটা বাচ্চা-কাচ্চা হয়ে গেলে নাকি সব ঠিক হয়ে যাবে।”
চোখ বেরিয়ে আসার উপক্রম হলো ভূমির।অবাক হয়ে বললো, ” কী বললি? আম্মা এই কথা বললো? পাগল নাকি? তুই কি খুব বড় হয়ে গেছিস সূচি? কতটুকু বয়স তোর? একটা বাচ্চা আসার আগে কত যন্ত্রণা হয় জানিস? আম্মা আর কী বললো?”
” শেষবার ভালোভাবে কথা হয়েছে পহেলা বৈশাখের রাতে।সেদিন বলেছে, আম্মা নিজেই আমাকে সহ্য করতে পারে না,মানুষের মা কীভাবে সহ্য করবে? আগে তাকে জ্বালাতাম,এখন আমি আমার শাশুড়িকে জ্বালাই।আমার জন্মই হয়েছে জ্বালানোর জন্য।আমি মরলে তারা বাঁচে।”
ধক করে জ্বলে উঠলো ভূমির দু-চোখ।চিবিয়ে চিবিয়ে বললো, ” এই বললো!আচ্ছা,আম্মার কথা বাদ দে। আব্বার কথা বল।আব্বা কী বললো?”
” বলেছে কোনো কারণে যদি আমি শ্বশুরবাড়ি ছাড়ি তো আব্বা আমাকে মোটেও বাড়িতে জায়গা দেবে না।আমাকে কেটে মেঘনায় ভাসাবে।”
একে একে পহেলা বৈশাখের সব ঝামেলার কথা বললো সূচি।ফার্নিচার দেওয়ার কথা,ঝামেলার রাতে ফোনে দেওয়া হুমকি-ধমকির কথা–সব। কথার শেষে বললো, ” মাথার উপরের একটুখানি ছাদের জন্য হলেও আমাকে সব মেনে নিতে হবে বড় আপা। কাজী বাড়িতে যতদিন থাকব ততোদিন বাবার বাড়িতেও আমার কদর থাকবে।কাজী বাড়িতে আশ্রয় না পেলে বাবার বাড়িতেও আশ্রয় মিলবে না।এমনি ভাগ্য আমার।”
চোখের কার্নিশ বেয়ে দরদর করে জল নামলো সূচির।ভূমি সযত্নে দু-আঙুলে মুছে দিলো তা।বোনের চুলে আদুরে ভঙ্গিতে বিলি কেটে বললো, ” আচ্ছা,ফয়সাল কী বলে? তোর প্রতি ওর মনোভাব কেমন?”
” সে রাগ,গোস্বা,পছন্দ,অপছন্দের বাইরে আপা।তার নিজস্বতা বলতে কিছু নেই।সবসময় আম্মা যা বলে তাই।নিজের ব্যাপারে একটা সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতাও তার নেই।আমার চেয়ে আম্মাকে সে বেশি ডরায়।তারও একই কথা, আমাকে সবকিছু মেনে নিতে হবে।আমার যেকোনো কথাকে সবসময় উল্টো বুঝে।আমি যদি আম্মার উপরে অতিষ্ঠ হয়ে ওকে কিছু বলি,ও তখন সেটাকে অভিযোগ মনে করে।ধর,আম্মা আমাকে অকারণে খুব বকলো।সে বাড়ি ফেরার পরে আমি তাকে বললাম আম্মাকে একটু বুঝিয়ে বলতে যাতে আম্মা আমাকে এভাবে না বকে।ও আমার কথার উল্টোটা করে।আমাকেই উল্টো ধমক দিয়ে বলে আমি নাকি আম্মার নামে অভিযোগ করছি।আমি নাকি ওকে নিয়ে আলাদা থাকতে চাই।বোঝো আপা? আবার কিছু থেকে কিছু হলেই আমাকে বলে ঘর থেকে বেরিয়ে যেতে।ভালো না লাগলে নাকি আমি বেরিয়ে যাব। অবশ্য সে আমাকে পছন্দ করে না আপা।তাই আমাকে সমর্থন করতেও তার গায়ে বাজে।বিয়ের পর থেকে ভাত-কাপড় ছাড়া একটু মানসিক শান্তিও আমি পাইনি।”
” অপছন্দ করে কী করে বুঝলি?অপছন্দ হলে বিয়ে করলো কেন?”
” আম্মার কথায় বিয়ে করেছে।তার খুব সুন্দরী বউয়ের শখ ছিল হয়তো। সেদিন ঝামেলার মধ্যে বলেই ফেললো, আম্মার জন্যেই আমি কাজী বাড়িতে আমি বউ হয়ে যেতে পেরেছি।নাহয় সে আমার দিকে ফিরেও চাইতো না।আমার মতো একশটা সূচিকে সে মাড়িয়ে যেতে পারবে।তাহলেই বোঝো আমি কত অপছন্দনীয় তার কাছে। অবশ্য বিয়ের শুরু থেকেই আমার বোঝা উচিত ছিল।বিয়ের রাত থেকেই তো শুরু করেছিলো।”
” কী করেছে?”
” দুচ্ছাই।প্রথম রাতে সবাই কত গল্প করে।আর ও ঘরে ঢুকে বিছানায় পড়েই বললো, আমি যেন বিরক্ত না করি।তার কাঁথা-কম্বলও যেন গায়ে না জড়াই।সে এসব শেয়ার করতে পারবে না।তারপর থেকে খুব চোটপাট করতো আপা,কথায় কথায় ধমক দিতো।আমিই গাধা ছিলাম, তখন তার মন বুঝতে পারিনি।ভেবেছিলাম সে হয়তো বিয়ের ধাক্কায় ক্লান্ত তাই এরকম করছে।”
” তারপর সব ঠিক হলো কী করে?”
” একসাথে থাকতে থাকতে।”
বোনের দিকে চেয়ে ঠোঁট বাঁকা করে মুচকি হাসলো সূচি।চোখের কোন থেকে আবারও গড়িয়ে পড়লো কয়েক ফোঁটা পানি।
” শত হলেও সে মানুষ আপা।আমি ছাড়া তার গতি নেই।আমাকে সহ্য হবে না কেন? তাদের মা-ছেলের দুজনেরই আমাকে চাই। তাদের কাছে আমার শরীরের মূল্য অনেক। যেই খাটা আমি ঐ সংসারে খাটি, সেই খাটুনি অন্য কেউ করলেও তো মাসে বেতন দিতে হবে।সেখানে আমাকে দেয় কেবল ভাত-কাপড়।লাভ তো ওদেরই।আমার মাঝে মাঝে মনে হয়, ফয়সালের কাছে আমি একদলা মাংসপিন্ড ছাড়া আর কিছু নই। আমাদের সংসারটা টিকে আছে শুধু কবুলের জোরে আর ঐ একটা জিনিসের লোভেই। ভালোবাসা,শ্রদ্ধা,সম্মানের ছিটেফোঁটাও নেই আমাদের মাঝে।ওর সঙ্গটাও আমার গায়ে বিষের মতো লাগে।অথচ সত্যি কথা কী জানো আপা? এককালে ওকেই আমি সবচেয়ে বেশি ভালোবাসতাম।আমার প্রথম কৈশোরের প্রেম,সোজা বিষয় না।এতো বেশি ভালোবাসতাম যে তুমি চিন্তাও করতে পারবে না।কত দোয়া যে করেছি! বিয়ের আগে-পরে কত মানত করেছি! আমি ওকে যতটা ভালোবাসতাম,ততোটা তুমিও হয়তো ইশতি ভাইকে বাসতে পারোনি।”
ভূমির ডান চোখ থেকে এক ফোঁটা পানি গড়িয়ে পড়লো সূচির কপালে।ধরা গলায় বললো, ” জানি আমি।বিয়ের আগে শেষ যেইবার এসেছিলি সেইবার ফয়সালকে নিয়ে দুটো কথা বলেছিলাম বলে খুব চোটপাট করেছিলি। তখনই বুঝেছি।”
ভূমির কথাটা যেন কানেই ঢুকলো না।নিজের কথার রেশ টেনে বললো, ” ভাবতাম ওর কিছু হলে আমি হাসতে হাসতে প্রাণটাও দিতে পারি।অথচ, এখন কী ভাবি জানো? এখন ভাবি, নিজের ভালো থাকার জন্যে আমি ওর প্রাণটা নিতে পারি।এখন আর একটুও ভালোবাসি না আপা। মোটেও ভালোবাসি না।ওর সাথে বিয়ে না হলে আমি জানতামই না, এতো প্রেমও মরে যেতে পারে।সুখ-শান্তি,শ্রদ্ধা,সম্মান যেখানে থাকে না,ভালোবাসা সেখানে জানালা দিয়ে পালায়।আমারটাও পালিয়েছে।এতোদিন সংসার করেছি স্রেফ কবুলের জোরে। এখন সেই জোরও কাটলো,আমি আর ঐ সংসারে ফিরে যাব না। ঐ ঘরের দুটো মানুষকেই আমি ঘৃণা করি। শাশুড়িকে তো আমার খুন করতে ইচ্ছা করে। সবাই বলে,বুড়ো মানুষেরা সংসারে বটগাছের মতো।তারা মাথার উপরে ছায়া দেয়।কিন্তু ছায়া দেওয়ার বদলে এই বটগাছটাই যখন মাথার উপরে হেলে পড়তে চায়,তখন কী করার থাকে আপা? তুমিই বলো?”
উত্তর দিতে পারে না ভূমি।বোনের দিকে চেয়ে ধীরে ধীরে মাথা নেড়ে বলে, ” তুই অনেক বড় হয়ে গেছিস সূচি।এতো বড় কী করে হয়ে গেলিরে? এই তো সেদিন আমি তোকে দু-হাতের মাঝে নিয়ে উঠোনে ঘুরে ঘুরে চাঁদ দেখাতাম।আর আজ তোকে চিনতেই পারছি না।”
” আমি এখন তোমার চেয়ে বুড়ো আপা। পরিস্থিতি মানুষকে বাঁচাতেও পারে,মারতেও পারে।আচ্ছা আপা,তুমি এতো কাছে থেকেও আমাকে দেখতে যাওনি কেন?”
” আমি নির্বাসিত তাই।তাছাড়া,আমার স্থির বিশ্বাস ছিল তুই সেখানে ভালো নেই।”
চমকে উঠলো সূচি।বোনের ভারী, গোলগাল মুখটার দিকে চেয়ে প্রশ্ন করলো, ” কেন? বড় ভাবি ছাড়া আর কেউ তো বিশ্বাস করে না এই কথা।এমনকি আমাকে যে জন্ম দিয়েছে সেও না।তুমি আমাকে না দেখে,কিছু না শুনে কী করে জানলে?”
” তুই জানিস আমি অসুস্থ।আবার আমার বাড়ির এতো কাছাকাছি এতোগুলো মাস আছিস।অথচ একটা দিনও তুই আমাকে দেখতে এলি না।তোর অবস্থা বোঝার জন্য এই একটা কারণই যথেষ্ট।”
” আমি এবার মুক্তি চাই আপা।আর না।আমি কোনো ইন্ডিয়ান সিরিয়ালের নায়িকা না যে গায়ে হাত তোলার পরেও মাটি কামড়ে সেখানে পড়ে থাকব।ওদের বাড়ির দিকে ফিরে থু থুও ফেলব না আর। তুমি আমার সাথে থানায় চলো।আমি মামলা করব, তুমি সাক্ষী হবে।”
বোনের ঘন চুলের ফাঁকে আঙুল গলিয়ে হৃদয়ের সবটুকু স্নেহ ঢেলে দিয়ে ভূমি বললো, ” মিথ্যা সাক্ষ্য দিতে বলছিস কেন আমাকে?”
বিস্ফোরিত চোখে চেয়ে রইলো সূচি।চরম বিস্ময় নিয়ে বললো, ” তুমি আমার কথা বিশ্বাস করলে না বড় আপা?”
” কে বললো করিনি? করেছি।কিন্তু এসব তো আমি চোখে দেখিনি সূচি।মামলা-মোকদ্দমায় কানে শোনা কথার কোনো মূল্য নেই।সব মূল্য চোখে দেখার। আমি তাই দেখিনি। তাই বললাম মিথ্যা সাক্ষ্য।তাছাড়া, একটা সংসার ভাঙা এতোই সহজ? তুই এতো শখ করে বিয়ে করেছিস মাত্র চার মাস সংসার করার জন্যে?”
ভূমির গা ঘেঁষে শুয়ে ছিল সূচি।এবার আর পারলো না। চরম উত্তেজনায় উঠে বসলো।মুখোমুখি বসে মিইয়ে যাওয়া গলায় প্রশ্ন করলো, ” তার মানে তুমিও বলছো আমাকে সহ্য করতে? মুখ বুজে পড়ে থাকতে? আমি অন্তত তোমার কাছে এটা আশা করিনি বড় আপা।”
সূচির উত্তেজনা ছুঁতে পারলো না ভূমিকে।সে শান্ত গলায় বললো, ” আমি কখন বললাম এসব? তুই কি ভাবছিস, আমিই তোকে ওবাড়িতে যেতে দেব? একটা বিহিত না হওয়া অবধি কোনোদিন না। শোন সূচি,থানায় যেয়ে তুই এখন কী বলে মামলা করবি? তোর শাশুড়ি তোকে মেরেছে সেই প্রমাণ আছে তোর কাছে? গায়ে চিহ্ন আছে? সাক্ষীও তো নেই।তোর শাশুড়ি যদি অস্বীকার করে তখন কী করবি?থানা প্রমাণে বিশ্বাসী,তোর মুখের কথা বিশ্বাস করবে না।আরেকটা কথা ভেবে দেখ,তোর ছাড়াছাড়ি হয়ে গেলে আব্বা কিন্তু ফিরেও দেখবে না।তখন তুই কী করবি? একটা ভালো সার্টিফিকেটও তোর নেই যে সাধারণ মানের কোনো একটা চাকরি-বাকরি করে স্বাবলম্বী হবি।”
” আমি দরকার পড়লে ভিক্ষা করে খাব।”
” ছিঃ! ওসব কেমন কথা?আমাকে ভুল বুঝিস না। আমি শুধু তোর অবস্থাটা তোকে দেখাচ্ছি।তোকে ভিক্ষা করতে হবে না।আমি এখনো বেঁচে আছি। আমি বেঁচে থাকতে তোর খাওয়া-পরার অভাব হবে না। তুই আমার কাছে থাকবি। আমার কাছ থেকে তোকে নিয়ে যাওয়ার আগে কাজী বাড়ির মানুষদেরকে চূড়ান্ত জবাবদিহি করতে হবে। তোর সাথে করা প্রত্যেকটি আচরণের কারণ দেখাতে হবে। তোর মুখোমুখি হওয়ার আগে ওদেরকে আমার মুখোমুখি হতে হবে।আমার বোনের সাথে পশুর মতো আচরণ করেছে,ওরা এমনি এমনিই পার পেয়ে যাবে? দরকার পড়লে চেয়ারম্যান-মেম্বার ডেকে তাদের কাছে নালিশ করব। তুই সংসার থেকে বেরিয়ে আসবি কেন বলদ? ওদের ঘাড় ধরে মানুষ করে তারপর সংসার করবি। সংসার ভাঙা এতোই সহজ? আজ তুই বেরিয়ে এলে কাল আরেকটা মেয়কে বিয়ে করবে।ও ছেলে,আমাদের দেশে একটা ছেলে চৌদ্দটা বিয়ে করলেও কেউ কিছু বলে না। কিন্তু দেখবি বাকি জীবন কাটানোর জন্যে সহজে তুই কোনো সঙ্গী পাবি না।তোকে দেখলে পাঁচজনে পাঁচটা কটু কথা বলবে।তুই এসব কেন সহ্য করবি?এসব সহ্য করার শক্তি তোর আছে? আর বলছিস মামলা করবি।কিন্তু মামলা করার মতো যথেষ্ট প্রমাণ তোর কাছে আছে? নেই।তাছাড়া,থানা-টানায় হচ্ছে টাকার খেলা।যার কাছে টাকা থাকে তাকে ওসব আজকাল খুব একটা কাবু করতে পারে না।সুতরাং ওখানেও তুই খুব একটা সুবিধা করতে পারবি না।”
” তাহলে কী করব এখন?”
” যতদিন না ওরা তোকে খুঁজতে আসছে ততোদিন তুই আমার কাছে থাকবি।তারপর ওরা আসুক,আমরা তিন-চারজন মানুষ নিয়ে বসব বিচার করতে।তোর কথা তুই জানাবি,অভিযোগ জানাবি,ওদেরটা ওরা জানাবে।তারপর দেখ সেখানকার বিহিত কেমন হয়।জীবন তোর, সিদ্ধান্ত তোর।এরপর তুই সিদ্ধান্ত নিবি তুই কী করবি।কিন্তু ঝোঁকের বশে কোনো সিদ্ধান্ত নয়।বুঝেছিস?”
সূচি মাথা নাড়ে।কাতর গলায় বললো, ” কিন্তু ওরা তো আমাকে খুঁজতে আসবে না।”
” কে বলল আসবে না? তুই তো বললি, তোকে ছাড়া ওদের চলবে না।আমিও জানি চলবে না।ওরা নিশ্চয়ই আসবে।আশা করছি আজ বিকালেই একটা হেস্তনেস্ত হবে।এই ঘটনার জের এতো তাড়াতাড়ি কিছুতেই মিটবে না।ঝামেলা একটা তো হবেই।”
বোনের গায়ের সাথে মিশে আবার শুয়ে পড়লো সূচি।দু-হাতে ভূমির গলা জড়িয়ে ধরে বললো, ” তুমি আমার পাশে থাকবে তো বড় আপা?”
” অবশ্যই।তুই কি আমার কম আদরের সূচি?”
বহুক্ষণ পরে উল্লাসে একটু কেঁপে উঠলো সূচি।হুট করেই ডর-ভয় সব কেটে যাচ্ছে।আর কোনো ভয় নেই।তার পাশে তার বড় আপা আছে।আর ভয় কীসের? এই বিশাল পৃথিবীতে সূচিও আর একা নয়।বাবার ঘর ছাড়াও স্বস্তিতে পা ফেলার আরেকটি জায়গা তার আছে।এ কি কম আনন্দের কথা? ”
চুলের মাঝে চষে বেড়াচ্ছে ভূমির আঙুলগুলো।ঘুমে চোখ বুজে আসছে সূচির।বড় আপাকে জড়িয়ে ধরে শান্তিতে চোখ বুজলো ও। বহুদিন পরে আজ ও শান্তিতে ঘুমাবে।আজ বিশ্ব শান্তি দিবস।
চলবে…