অপেক্ষা_সুদূর_বর্ষণের-২
তারপর কেটে গেলো আরও দুইটা নির্ঘুম রাত। অবস্থার কোন পরিবর্তন হয়নি। আরও বেশী খারাপ হচ্ছে দিনদিন। গত দুইদিন ধরেই পুরো হাসপাতালের স্টাফসহ বাড়ির লোকজন অক্লান্ত ভাবে ঈশার বাবাকে একই কথা বোঝাতে চেষ্টা করছে। কিন্তু কোন লাভ হচ্ছে না। তিনি কারো কথা শুনতে রাজি না। ইভান আসলেই তিনি অপারেশন করাবেন তার আগে নয়। ডাক্তার আজ স্পষ্ট করে বলে দিয়েছেন ২৪ ঘণ্টার মধ্যে যদি অপারেশন শুরু না করা হয় তাহলে আর হয়তো কিছুই করার থাকবে না। গুমোট অন্ধকারের মাঝেও চোখের পাতা বন্ধ করতেই মাথাটা টনটন করে উঠলো। ঈশা কপালে ভাঁজ ফেলে এক হাতে মাথা চেপে ধরল। ব্যথাটা এবার বুঝি তীব্র রুপ নেবে। সে শয্যাশায়ী হয়ে যাবে। আর হয়তো বাবাকে দেখতে হাসপাতালে যেতে পারবে না। মাইগ্রেনের ব্যাথা বেড়ে গেলে ঈশা কিছুতেই আর বিছানা ছাড়তে পারে না। কয়েকদিন ব্যথাটা তাকে ভুগিয়েই ছাড়ে। পেটের ভেতর থেকে সব বেরিয়ে আসার উপক্রম হতেই অন্ধকারেই আন্দাজ করে ওয়াশ রুমে গেলো। মুখ ভরে বমি করে চোখে মুখে পানি দিয়ে সেখান থেকে বের হয়ে আসতেই দেখল ঘরের আলো জ্বালানো। ইরা দাঁড়িয়ে আছে। ঈশা কে এমন বিদ্ধস্ত অবস্থায় দেখে বলল
–কি হয়েছে আপু? তোমার কি শরীর খারাপ লাগছে?
ঈশা আচলে মুখ মুছে বিছানায় উঠে বসতে বসতে বলল
–মাথাটা একটু ব্যাথা করছে।
ইরা তার দিকে তাকিয়ে থাকলো কিছুক্ষন। কিছু একটা বলতে চাইল। ঈশা বুঝতে পারলেও এখন শোনার মতো অবস্থা নেই তার। বিছানায় আবারো গা এলিয়ে দিয়ে চোখ বন্ধ করে ক্লান্ত গলায় বলল
–আমি একটু রেস্ট নেবো। তুই এখন যা। পরে কথা হবে।
ইরা গেলো না। লাইট অফ করলো না। ঈশা ক্লান্ত চোখ মেলে তাকাল। বলল
–লাইট অফ করে দিয়ে যা।
ইরা মিনমিনে কণ্ঠে বলল
–তোমাকে হাসপাতালে যেতে হবে।
ঈশা মাথাটা একটু তুলে তার দিকে তাকাল। বুকের ভেতরে কেমন ছ্যাত করে উঠলো। বাবার কিছু হয়নি তো? ভীত কণ্ঠে বলল
–কেন?
–বাবা তোমার সাথে কথা বলতে চায় আপু। এখনই যেতে বলেছে। অপারেশন থিয়েটারে যাওয়ার আগে তোমার সাথে কথা বলে তারপর যাবে বলেছে।
ঈশা সস্তি পেলো। তপ্ত শ্বাস ছেড়ে বলল
–বাবা রাজি হয়েছে?
ইরা তখন ঘর থেকে বের হয়ে যাচ্ছিল। ঈশার কথা শুনে থেমে গেলো। তার দিকে না তাকিয়েই বলল
–হুম। ভাইয়া এসেছে।
ঈশা থমকাল। অনুভুতিশুন্য হয়ে গেলো যেন কয়েক সেকেন্ডের জন্য। বিষণ্ণ চোখ দুটো চকচক করে উঠলো। কেমন যেন এক প্রশান্তি অনুভুত হল। ঠোঁটের কোণে সূক্ষ্ম হাসি দেখা দিলো। বিস্ময়কর কণ্ঠে বলল
–ইভান…
নামটা উচ্চারন করতেই ইরা ঘুরে তাকাল। থমথমে চেহারা। কৌতূহলী দৃষ্টি। খানিকবাদেই সব পরিবর্তন হয়ে গাড় অভিমান জমে গেলো। কঠিন গলায় বলল
–রেডি হয়ে নাও। ইলহাম ভাইয়া আসছে আমাদেরকে নিয়ে যেতে।
বের হয়ে গেলো ঘর থেকে। ঈশা কোন কথা বলল না। এতদিন বাদে মানুষটার দেখা পাবে। মাথায় সেটাই বারবার ঘুরতে লাগলো। আর কিছু ভাবার সুযোগ অবচেতন মন তাকে দিলো না।
————
বুকের মাঝে দুরুদুরু কাপন নিয়ে হেটে চলেছে কেবিনের দিকে। দরজায় দাঁড়াতেই চোখ আটকে গেলো সামনের মানুষটার উপরে। বিচ্ছিন্ন অনুভুতির চাপে হাত পা কাঁপছে অল্প বিস্তর। ইভান একটা টুলে বসে আছে। আর ঈশার বাবা তার এক হাত ধরে হেসে হেসে কথা বলছে। ঈশা চোখ ভরে ইভান কে দেখে নিয়ে বাবার দিকে তাকাল। এতদিনে আজ তাকে অদ্ভুত রকমের খুশী মনে হচ্ছে। তার হাস্যজ্জল চেহারা বলে দিচ্ছে তিনি মন থেকে হাসছেন। ঈশার চোখে পানি টলমল করে উঠলো। কথা বলার এক পর্যায়ে ঈশার বাবা দরজার দিকে তাকালেন। বললেন
–ঈশা তুই দাঁড়িয়ে আছিস কেন?
ইভান দ্রুত ঘুরে তাকাল। চোখে চোখে তাকিয়ে কেটে গেলো কয়েক মুহূর্ত। ইভানের হার্ট বিট বেড়ে গেলো কয়েকগুন। তৃষ্ণার্ত চোখ জোড়া যেন সতেজ হয়ে উঠলো। অল্প সময়ের ব্যাবধানে আবার সামনে দৃষ্টি ফেরাল। স্বচ্ছ টাইলসে দৃষ্টি স্থির করতেই ঈশার বাবা আরেক হাত বাড়িয়ে বললেন
–আমার কাছে আয় মা।
ঈশা ধির পায়ে এগিয়ে আসলো। ইভানের পাশে দাঁড়িয়ে হাত বাড়িয়ে বাবার হাত ধরে ফেললো। ঈশার বাবা মুচকি হেসে বললেন
–তোদের সাথে কথা বলতেই অপেক্ষা করছিলাম।
ঈশা নিচের দিকে তাকাল। তার বাবার ইভানের হাতের উপরে ঈশার হাত রেখে বললেন
–আমার আর কতটুকু সময় আছে কে জানে? আমি ইভানের সাথে দেখা করে তবেই অপারেশন করতে যাবো। এখন আর কোন চিন্তা থাকবে না। আমি মরে গেলেও ইভান সব সামলে নেবে।
ইভান কাঁপা কাঁপা গলায় বলল
–তুমি একদম ভেব না ছোট বাবা। সব ঠিক হয়ে যাবে।
ঈশার বাবা দুর্বল হেসে বললেন
–জানি রে। সেজন্যই তো তোর অপেক্ষা করছিলাম। কি যে শান্তি লাগছে। আমি অর্ধেক সুস্থ হয়ে গেছি।
ইভান হাসল। সেই হাসিতে অবিশ্রান্ত মুগ্ধতা। ঈশার হাত কাঁপছে। তবুও সে আলতো করে ইভানের আঁকড়ে ধরল। কিন্তু ইভান তার হাত একদম সোজা রেখেছে। বরাবরের মতো ঈশার হাত আঁকড়ে ধরল না। ঈশা এক পলক ইভানের দিকে তাকাল। তার দৃষ্টি নিচের দিকে। চেহারায় অসস্তি ভাবটা কেউ না বুঝলেও ঈশা বুঝতে পারলো। হাতের দিকে উদাসীন দৃষ্টিতে তাকাল। রাস্তা পার হওয়ার সময় ইভান শক্ত করে ঈশার হাত চেপে ধরত। সেই আঁকড়ে ধরার মাঝেই এক অন্যরকম অধিকারবধ থাকতো। নীরব কিছু অনুভূতি যার অর্থ ‘আমি আছি তো’। মুখে না বললেও ঈশার বুঝতে কষ্ট হতো না। কিন্তু আজ ইভানের স্পর্শে সেরকম কিছুই নাই। কেমন যেন অনুভুতিশুন্য। ইভান হাত সরিয়ে নিয়ে ঈশার বাবার হাত ধরে বলল
–তোমার কিছু হবে না। তুমি এখনই অনেক সুস্থ। আর অপারেশন করলে একদম সুস্থ হয়ে যাবে।
ঈশার বাবা হেসে উঠলেন। ইভান উঠে দাঁড়িয়ে বলল
–তুমি একটু রেস্ট নাও। আমি ডক্টরের সাথে কথা বলে আসি।
সেখানে আর দাঁড়ালো না। ঈশা অবাক হল ইভানের আচরনে। এতোটা সময়ের ব্যবধানে ইভান একবারও ঈশার দিকে তাকায় নি। এমন কি ইভানের কথার মাঝেও তেমন গুরুত্ব পেলো না। এমন কখনই ছিল না সে। এতোটা পরিবর্তন হয়ে গেলো এই ৫ বছরে? ঈশার বাবা শুয়ে পড়তেই ঈশা বলল
–আমি আসছি বাবা।
কেবিন থেকে বাইরে বের হয়ে এসেই দেখতে পেলো ইভান ডাক্তারের সাথে কথা বলছে। তাদের কথোপকথন কানে না গেলেও দেখে মনে হচ্ছে ডাক্তার তার পরিচিত। ঈশা দরজার কাছেই দাঁড়িয়ে গেলো। দেয়ালে হেলানি দিয়েই ইভান কে দেখছে। দুজন কথা বলতে বলতে সেদিকেই এগিয়ে গেলো। ঈশা তাদেরকে দেখে ঠিক হয়ে দাঁড়িয়ে গেলো। তার সামনে এসেই ইভান থেমে গেলো। ঈশা সরে দাঁড়ালো সেখান থেকে। এক পলক দেখেই চোখ ফিরিয়ে ডাক্তারকে উদ্দেশ্য করে বলল
–এখনই কি ছোট বাবাকে ওটি তে নিবি?
ডাক্তার মৃদু স্বরে ‘হুম’ বলল। দুজনেই আবার ভেতরে চলে গেলো। তাদের পেছনে ঈশাও ভেতরে ঢুকল। তাদের ঠিক পেছন পেছন নার্স একটা ট্রে এনে ভেতরে ঢুকলেন। ডাক্তার নার্স কে কিছু আনুসঙ্গিক বিষয় বুঝিয়ে দিলেন। ঈশা পেছনে দাঁড়িয়ে এদিক সেদিক চোখ ফিরিয়ে দেখছিল। হুট করেই টেবিলের উপরে একটা চকচকে কিছুর উপর চোখ আটকে যায়। কৌতূহল বশত সেদিকে এগিয়ে গিয়েই হাতে তুলে নিলো। হাসপাতালে ব্যবহৃত ছোট ব্লেড গুলো সাধারণত খুব ধারাল আর চকচকে হয়। ঈশা সেটা নিয়ে নেড়েচেড়ে দেখছিল। ইভান ঘাড় ঘুরিয়ে তাকাতেই ঈশার উপরে চোখ পড়ে। ব্লেডটা এভাবে নাড়াচাড়া করা দেখেই ভ্রু কুচকে ফেলে। এতোটাই ধারাল যে কোন সময় হাত কেটে যেতে পারে। ইভান এগিয়ে গিয়ে ঈশার হাতের কব্জি চেপে ধরল। এতোটা জোরে চেপে ধরেছে যে ঈশার হাত ব্যথায় অসাড় হয়ে আসছে। আঙ্গুল গুলো আপনা আপনি আলগা হয়ে আসতেই ইভান ব্লেডটা নিয়ে ট্রে তে ছুড়ে ফেলে। হাত ছেড়ে দেয়। ঈশা হাতের দিকে তাকায়। ইভানের আঙ্গুলের ছাপ ফর্সা হাতে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। লাল হয়ে গেছে পুরো জায়গাটা। এখনো টনটন করে ব্যাথা করছে। ঈশা এক পলক ইভানের দিকে তাকায়। ইভান তার দিকে তাকিয়ে ছিল। সাথে সাথেই চোখ ফিরিয়ে নেয়। ঈশার চোখে পানি চলে আসে। হাত চেপে ধরে সেদিকে তাকিয়ে অনবরত পলক ঝাপটে চোখের পানি আটকাবার চেষ্টা করে। ইভানের স্পর্শে আজ কোন ভালোবাসার ছোঁয়া নেই। আছে শুধু হিংস্রতা আর অভিমান। ইভান পুরো বিষয়টা খেয়াল করতেই বুকের মাঝে চিনচিন করে ওঠে। আবারো রাগের মাথায় ঈশাকে কষ্ট দিয়ে বসলো। ব্যথাতুর দৃষ্টিতে ঈশার হাতের দিকে তাকায়। এমনটা না করলেও পারতো। ঈশা ঠিকই বলে তার ভালোবাসা ঈশার জন্য শুধুই কষ্টের। অত্যাচারের। কিন্তু ইভান এমনটা চায় না। সে ঈশাকে ভালো থাকতে দেখতে চায়। আর ভালো থাকতে দেখতে চাওয়া মানেই নিজেকে ঈশার কাছ থেকে দূরে রাখা। তাই সে ঠিক করেই ফেলেছে। নিজেকে ঈশার কাছ থেকে দুরেই রাখবে। এতোটা দূরে যে সে চাইলেও কোনভাবে আর ঈশাকে কষ্ট দিতে পারবে না। দূর থেকেই ঈশাকে ভালো রাখার চেষ্টা করবে। ভালবাসবে। তবুও কাছে এসে কষ্ট দিয়ে সেটা সহ্য করতে পারবে না।
চলবে…
(এই পর্বে গল্পটা শেষ করে দেয়ার কথা থাকলেও সেটা সম্ভব হল না। কারণ শেষ করলে তাড়াহুড়ো হয়ে যেতো আর মাধুর্য নষ্ট হয়ে যেতো। কিছু বিষয় এখনো পাঠকদের কাছে অস্পষ্ট। তাই আরও কয়েক পর্ব বেড়ে যাবে। )