অপেক্ষা সুদূর বর্ষণের পর্ব-১৬

0
3840

অপেক্ষা_সুদূর_বর্ষণের – ১৬

অফিস থেকে ফিরে নিজের ঘরে সুপ্তর খিলখিলিয়ে হাসির আওয়াজ শুনেই দরজাটা একটু ফাঁকা করে ভেতরে তাকাল ইভান। ঈশা পেছনে পিঠ ঠেকিয়ে কোলে বালিশ নিয়ে বই পড়ছে। আর সুপ্ত ইভানের কম্পিউটারে কার্টুন দেখছে। টম এন্ড জেরি। সেটা দেখেই খিলখিল করে হেসে উঠছে। ইভান দরজায় দাড়িয়ে ঈশা কে ভালো করে দেখছে। সমস্ত মনোযোগ তার বইয়ের পাতায়। ঠোঁটে এক চিলতে মিষ্টি হাসি। ইভান এর বইয়ের তাক থেকেই বইটি নিয়েছে সে। কম্পিউটার এর স্ক্রিনটা থেমে যেতেই সুপ্ত ঠোঁট উল্টে ভ্রু কুঁচকে তাকাল। পাশ ফিরে ঈশা কে কিছু বলার আগেই ইভান কে দেখতে পেলো সে। চেচিয়ে উঠে বলল
— মামা।

ঈশা চিৎকার শুনে চমকে তাকাল। ইভান ঈশার দিক থেকে দৃষ্টি ফিরিয়ে সুপ্তর দিকে তাকিয়ে বলল
— সুপ্ত কি করছে?

সুপ্ত ঠোঁট উল্টে বলল
— কার্টুন দেখছিলাম। কিন্তু বন্ধ হয়ে গেছে।

ইভান মুচকি হেসে কম্পিউটারে আবার কার্টুন চালিয়ে দিলো। মহা খুশি সুপ্ত সম্পূর্ণ মনোযোগ সেটাতেই ঢেলে দিয়ে কার্টুন দেখছে। ইভান হাতের ঘড়িটা খুলছে। ঈশা এক পলক সেদিকে তাকিয়ে বলল
— সুপ্ত জেদ করছিলো। এখানে এসেই কার্টুন দেখবে। তাই…

ইভান ঘড়িটা আর ফোনটা বিছানায় ছুড়ে দিয়ে কিছুটা গম্ভীর আওয়াজে বলল
— এই ঘরে আসার জন্য আদৌ কি কোন কৈফিয়ৎ দেয়ার কথা ছিলো? ঘরটা আর ঘরের মানুষটা কে আপন ভেবে নিলেই এতো কথা বলার প্রয়োজন হয়না।

ঈশা পূর্ণ দৃষ্টি মেলে তাকাল। ইভান কোন উত্তরের অপেক্ষা না করেই ওয়ারড্রব থেকে কাপড় বের করে নিয়ে ওয়াশ রুমে চলে গেলো। ইভানের এমন জবাবে ঈশা ঠিক কি বলবে বুঝে উঠতে পারলো না। কারণ সে তো চাইছে ইভানের কাছে আসতে। কিন্তু ইভান নিজেই দূরত্ব বজায় রেখে চলছে। অভিমানটা সম্পূর্ণ গলে না যাওয়া পর্যন্ত ঈশা কে হয়তো অপেক্ষা করতে হবে। সেটার অপেক্ষাই করছে সে। আর সেটার জন্য যে দূরত্ব দুজনের মাঝে তৈরি হয়েছে সেটাও এখন ঈশার দোষ। একটা মানুষের এতো দোষ হলে কিভাবে হয়। ঠোঁট গোল করে শ্বাস ছাড়লো ঈশা। বইটা কোলে খোলা থাকলেও তার দৃষ্টি সামনে স্থির। ইভান ওয়াশ রুম থেকে বেরিয়ে ঈশা কে ওই অবস্থায় দেখে বুঝে গেলো তার বলা কথাটাই ঈশার উপরে প্রভাব ফেলেছে। সেটা নিয়েই গভীর ভাবে ভাবছে। ইভান হতাশ হলো। মেয়েটা এমন কেনো। ভাঙবে তবুও মচকাবে না। অদ্ভুত! হাত মুখ মুছে ঈশার পাশ ঘেঁষে বসে পড়লো ইভান। ঈশা ভাবনায় এতটাই বিভোর যে খেয়াল করলো না। ইভান মাথা চেপে ধরে পেছনে পিঠ ঠেকাতেই ঈশার গায়ে হালকা স্পর্শ অনুভূত হলো। ঈশা কিছুটা চমকে তাকাল পাশে। ইভান চোখ বন্ধ করেই ঈশার ব্যাপারটা বুঝতে পারলো। কিন্তু কিছুই বলল না। ঈশা কয়েক সেকেন্ড তাকিয়ে থেকে বলল
— মাথা ব্যাথা করছে?

ইভান এর মাথা ব্যথা করছিলো না। ক্লান্তিতে শরীর ছেড়ে দিয়েছিল। কিন্তু ঈশার কাছ থেকে সেবা পাওয়ার লোভটা সামলাতে পারল না। তাই মাথা নাড়িয়ে মিথ্যে টা বলেই দিলো। ঈশা বইটা বন্ধ করে ইভানের কপালে হাত রাখলো। দুই আঙ্গুল খুব যত্ন করে কপালে বিচরণ করছে। ইভান আরো ভালো করে শুয়ে পড়লো। কয়েক মিনিটের ব্যবধানে ঘুমিয়ে পড়লো। ঈশা ইভানের ক্লান্ত চেহারার দিকে তাকিয়ে আছে। এবার হাতটা প্রশস্ত করে চোখের উপরে ঢেকে রেখেছে। চোখে আলো লাগছে বলে। রাতের খাবারের সময় হয়ে যাওয়ায় ইভানের মা ছেলেকে ডাকতে এসে ঘরের ভেজানো দরজাটা কিঞ্চিৎ খুলতেই বিছানায় চোখ পড়লো। ইভান আর ঈশা কে দেখেই তিনি আর ভেতরে যাওয়ার সাহস পেলেন না। এই অবস্থায় ভেতরে গেলে অযথাই ছেলে মেয়ে দুটো অপ্রস্তুত হয়ে পড়বে। মুচকি হেসে তিনি দরজাটা নিঃশব্দে বন্ধ করেই বাইরে চলে গেলেন। সুপ্তর খিলখিল হাসি কানে আসতেই ইভান চোখ মেলে তাকাল। ঘুম জড়ানো চোখেই পাশ ফিরে ঈশার দিকে তাকাল। ঈশা ঠোঁট চেপে হাসি আটকে বইয়ের দিকে তাকিয়ে আছে। মনে হচ্ছে কোন মনোমুগ্ধকর মুহূর্ত পড়ছে। ইভান মুচকি হেসে উঠে বসলো। ঈশা পাশ ফিরে ঠোঁট এলিয়ে হেসে বলল
— ঘুম হলো?

ইভান মিষ্টি হেসে বলল
— এতোটা শান্তির ঘুম কতো দিন ঘুমাইনা।

ঈশা দৃষ্টি নামিয়ে নিলো। সুপ্ত চেয়ার থেকে নেমে এসে কোমরে হাত দিয়ে দাড়িয়ে বলল
— খালামণি ক্ষুধা পেয়েছে।

ঈশা বইটা রেখে বিছানা থেকে নেমে সুপ্তর হাত ধরে বলল
— চলো।

সুপ্ত বাইরে বেরিয়ে গেলো। ঈশা বাইরে বেরিয়ে যেতে নিলেই হঠাৎ ওড়নায় টান পড়লো। থমকে দাড়িয়ে গেলো। এমন একটা পরিস্থিতির জন্য কোনভাবেই প্রস্তুত ছিলো না সে। সমস্ত শরীরে শীতল অনুভূতি ছড়িয়ে পড়তেই গলার কাছে ওড়না চেপে ধরে ঘাড় ঘুরিয়ে তাকাল। ইভান ভ্রু কুচকে দুই হাতে ফোনটা চেপে ধরে সেদিকে তাকিয়ে আছে। তার মানে ইভান তার ওড়না টেনে ধরেনি। দৃষ্টি ফেরাতেই দেখলো চেয়ারে আটকে আছে তার ওড়নার মাথা। ঈশা চোখ খিচে বন্ধ করে ফেললো। ইভান বুঝে গেলে বিশ্রী পরিস্থিতিতে পড়তে হতো। ইভান ঈশা কে দাড়িয়ে থাকতে দেখে ভ্রু নাচিয়ে বলল
— কি?

ঈশা মাথা নেড়ে বুঝিয়ে দিলো কিছু না। ইভান পাশে খেয়াল করতেই দেখলো ঈশার ওড়না চেয়ারে আটকে আছে। হাত বাড়িয়ে সেটা খুলে দিলো। ঈশা তপ্ত নিশ্বাস ফেলে চলে যাওয়ার জন্য পা বাড়াতেই আবারও টান পড়লো। ভাবলো হয়তো আবারও চেয়ারে আটকে গেছে। তৎক্ষণাৎ ঘাড় ঘুরিয়ে পেছনে তাকাতেই দেখলো ইভান ওড়নার মাথাটা হাতে পেঁচিয়ে ধরে আছে। ঈশা কিছুটা ভয় পেলো। শুকনো ঢোক গিলতেই ইভান ঠোঁট চেপে হেসে বলল
— আবারও আটকে গেছিলো।

ঈশা লজ্জায় চোখ নামিয়ে নিলো। তার বুঝতে বাকি থাকলো না এটা সম্পূর্ণ ইভানের দুষ্টুমি। ওড়না টান দিয়ে ছাড়িয়ে নিলো। লাজুক হেসে বললো
— সবটাই বুঝতে পেরেছি।

ইভান হাসলো। ফোনে একটা জরুরি কাজ সেরে সেও বাইরে গেলো। ঘর থেকে বের হয়েই বাবার মুখোমুখি হতেই এক রকম অসস্তি ধরে বসলো ইভান কে। সেদিন বাবাকে অমন কড়া কথা শোনানোর পর থেকে নিজের মাঝেই এক রকম খারাপ লাগা কাজ করছিল ইভানের। বাবা সামনে আসলেই দৃষ্টি নামিয়ে নিত। বাবার সেই অপরাধবোধ ইভান কে আরো বেশি অপ্রস্তুত করে দিতো। বাড়িয়ে দিতো খারাপ লাগা। তাই দুজনের এই অসস্তিকর টানা পোড়েন এর কারণে কথা বলা সম্ভব হয়নি। একে অপরের দিকে তাকিয়ে নিরব দৃষ্টি ফেলেই আবার নিজেদের গন্তব্যে চলে গিয়েছে। তার বাবা নত দৃষ্টিতে সামনে দাড়িয়ে হাত দুটো পেছনে রেখেছেন। ইভান কয়েক সেকেন্ড নিচের দিকে তাকিয়ে ভাবলো। তার মনে হলো বাবা তাকে কিছু বলতে চায়। কিন্তু কিভাবে কথা শুরু করবে বুঝে উঠতে পারছে না। হয়তো ভাবছে ইভান যদি এড়িয়ে যায় তাহলে তার জন্য অনেক অপমানের একটা বিষয় হয়ে যাবে। ছেলের কাছে তো আর নিজের সবটুকু আত্মসম্মানবোধ বিসর্জন দিতে পারেন না তিনি। তাই কথা শুরু করতেও পারছেন না। ইভান চোখ টা বন্ধ করে নিজেকে ধাতস্ত করে নিয়ে নরম কণ্ঠে বলল
— কিছু বলবে বাবা?

তার বাবা স্থির দৃষ্টিতে তাকালেন। ইভান বাবার চোখের দিকে তাকিয়ে থাকতে পারলো না। দৃষ্টি ফিরিয়ে নিতেই তার বাবা বলল
— সীমানা এসেছে আমাদের ওর শ্বশুর বাড়িতে নিয়ে যেতে। আসলে ওর বিয়েটা যেভাবে হয়েছিলো তারপর আর কারো যাওয়া হয়নি। গ্রামে বাড়ি হওয়ায় ওনারা আমাদের নিমন্ত্রণ করতে একটু ইতস্তত বোধ করেন। এবার অনেক আশা করে অবশেষে নিমন্ত্রণ করেই ফেলেছেন। সবাই মিলেই যাওয়ার কথা বলেছেন। তুমি তো জানোই তোমার ফুপু তোমাকে কতো ভালোবাসে। তোমার ফুপু আলাদাভাবে তোমার কথা বলেছে আমাকে। আমি কিছু এখনো বলিনি। তোমার সাথে কথা বলে জানতে চেয়েছি। যদি যেতে পারতে তাহলে..

ইভান তার বাবার কথা শেষ করতে দিলো না। তার আগেই বলল
— এখন অফিসে অনেক কাজ। ছুটি হয়তো পাবো না। তোমরা চলে যাও। আমি ছুটির জন্য সবরকম চেষ্টা করবো। যদি পাই তাহলে অবশ্যই যাবো।

ইভান যাবে না সেটা তার বাবা ধরেই নিয়েছিলেন। কিন্তু তারপরেও তার কথা রাখার জন্য চেষ্টা করবে সেটা ভেবেই তার ভালো লাগছে। মনটা খুশি হয়ে গেলো। তিনি আর কথা না বাড়িয়ে চলে গেলেন। ইভান টেবিলে গিয়ে বসলো। ঈশা সুপ্ত কে খায়ে দিচ্ছে। ইভান প্লেটে খাবার নিয়ে খাওয়া শুরু করে দিলো। সীমানা এসে ইভানের পাশের চেয়ারে বসে অভিমানী সুরে বলল
— কি রে। তোর তো সারাদিন কোনো খোঁজ পাওয়া যায়না। অফিস থেকে ফিরেও ঘরেই থাকিস। তুই তো একদম ঘরকুনো হয়ে গেছিস।

ইভান মুচকি হেসে বলল
— আর বলো না। কাজের চাপে নিজের খোজ রাখার সময় পাচ্ছি না। বাসার পরিবেশ আর অফিসের পরিবেশ একদম এক হয়ে গেছে। চরম একঘেয়েমি।

সীমানা একটু ভেবে বলল
— বুঝলাম। কিন্তু বাসার মানুষ গুলো তো আর অফিসে থাকে না। চাইলেও তাদের চেহারা দেখা যায়না। তাই বাসার পরিবেশ বাসার মতই।

ইভান অতি আফসোসের সুরে বলল
— বাসায় থাকলেও সব সময় দেখা সম্ভব হয়না। আগে তাও অনেকবার চেহারা দেখা যেতো। কিন্তু এখন আর তেমন দেখাও যায়না। আজকাল আমার ঘরে তো কেউ যায়না বললেই চলে।

ঈশা কপালে সূক্ষ্ম ভাঁজ ফেলে তাকাল। সীমানা ইভান কে বলল
— তুই যাচ্ছিস তো আমার শ্বশুর বাড়ি?

ইভান প্লেটের শেষ লোকমাটা মুখে পুরে বলল
— এখনো নিশ্চিত করে বলতে পারছি না। ছুটি হয়তো পাবো না। অফিসে এখন খুব কাজের চাপ।

সীমানা কিছুটা উত্তেজিত হয়ে বলল
— এই কথা তো শুনবো না ইভান। সবাই যাচ্ছে। মা স্পষ্ট করে তোর কথা বলেছে।

ইভান পানিটা এক চুমুকে শেষ করে বলল
— এভাবে বলো না আপু। আমার উপরে চাপ হয়ে যায়। আমি চেষ্টা করবো। তবে কথা দিতে পারছি না।

সীমানা আর কথা বাড়ালো না। কিন্তু ঈশার মন খারাপ হয়ে গেলো। সে ভেবেছিল অন্তত ইভান যাবে। সীমানা এবার সুপ্তর দিকে তাকিয়ে বলল
— সুপ্ত তো তার খালামণি ছাড়া কিছুই বুঝে না। ঈশা কে একেবারে বিরক্ত করে মারছে।

ইভান টেবিল ছেড়ে উঠে পড়ল। বেসিনের দিকে যেতে যেতে বলল
— বিরক্ত হওয়ার কি আছে। ভবিষ্যতের জন্য বাস্তব অভিজ্ঞতার সঞ্চয় হচ্ছে। পরে এক সময় কাজে তো লাগবেই। নিজের জীবনেও এই সময়টা আসবে। তখন খুব একটা অসুবিধা হবে না।

ঈশা চোখ বড় বড় করে তাকাল। সীমানা ঈশার চেহারা দেখেই হেসে ফেললো। ইভান ভাবলেশহীন ভাবে ঘরে চলে গেলো।

————
ভ্যাপসা গরমে নাজেহাল অবস্থা। শরীর যেনো নিস্তেজ হয়ে পড়ছে। ঈশা ভার্সিটির সামনে দাড়িয়ে আছে রিক্সার জন্য। অনেক্ষণ ধরে দাড়িয়ে আছে কিন্তু কোন রিক্সার খবর নেই।

— হেই ঈশা। এখানে দাড়িয়ে কি করছিস?

আচমকা কোন পুরুষালি কণ্ঠ শুনে চমকে গেলো ঈশা। পেছন ঘুরে কাব্যকে দেখে সস্তির নিশ্বাস ফেললো। বলল
— তুই?

কাব্য হেসে বলল
— কেনো অন্যকাউকে এক্সপেক্ট করছিস?

ঈশা কৃত্রিম রাগ দেখাতেই কাব্য হেসে ফেলে বলল
— এই রোদে দাড়িয়ে কি করছিস? রিক্সা পাচ্ছিস না? এখানে পাবি না। সামনে একটু হাঁটলেই রিক্সা পাবি। আমি সঙ্গ দিতে পারি।

ঈশা একটু ভাবলো। কাব্য ভুল বলেনি। এখানে আসলেই এই সময় রিক্সা পাওয়া যাবে না। তাই মাথা নাড়িয়ে সম্মতি দিলো। কাব্যের পাশাপাশি ফুটপাথ ধরে হাঁটছে ঈশা। কাব্য ছেলেটা মোটামুটি বাচাল প্রকৃতির। এতটুকু সময়েই কথা বলে ঈশার মাথা ব্যাথা করে দিয়েছে। ঈশা অবশ্য মুখ ফুটে কিছু বলছে না। কাব্যের সব কথা চুপচাপ শুনে যাচ্ছে। কিছুদূর যেতেই একটা রেস্টুরেন্টের সামনে দাঁড়িয়ে গেলো কাব্য। ক্লান্ত কণ্ঠে বললো
— গরমে হাপিয়ে উঠেছি। চল না কোল্ড কফি খাই।

ঈশা আপত্তি জানালেও কাব্যের অনুরোধের কাছে টিকতে পারলো না। বাধ্য হয়ে রেস্টুরেন্টে ঢুকে পড়ল। এক কোনায় একটা টেবিলে বসতেই ঈশার ফোন বেজে উঠলো। ইভান এর নাম্বার দেখে প্রথমে কিছুটা অবাক হলেও মনে মনে খুশি হলো। ফোনটা ধরতেই ওপাশ থেকে ভেসে এলো ইভানের আদুরে কণ্ঠ
— ক্লাস শেষ হয়নি?

ঈশা মুচকি হেসে বলল
— হয়েছে।

— এখন কোথায়?

ঈশা বলতে গিয়েও থেমে গেলো। এই মুহূর্তে সে কাব্যের সাথে রেস্টুরেন্টে আছে সেটা জানলে ইভান খুব রাগ করবে। আপাতত না বলাই ভালো। পরে বুঝিয়ে বলবে। তাই বিষয়টা চেপে গিয়ে বলল
— ভার্সিটির সামনে। রিক্সার জন্য অপেক্ষা করছি।

ইভান কয়েক সেকেন্ড চুপ করে থেকে বলল
— ঠিক আছে। রাখছি।

ঈশা সস্তির নিশ্বাস ফেললো। কোল্ড কফি শেষ করেই বাইরে বেরোলো। কাব্য রাস্তায় দাড়িয়ে এপাশ ওপাশ খুঁজতে লাগলো রিক্সা। ঈশা কাব্যের পাশেই দাড়িয়ে আছে। কিন্তু সামনে রাস্তায় চোখ পড়তেই অনাকাঙ্ক্ষিত মানুষটাকে দেখেই তার ভেতরটা ভয়ে কেপে উঠলো। ইভান তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে তার দিকে। ঈশা সেই দৃষ্টির অর্থ ধরতে পেরেই কাপছে। এভাবে মিথ্যেটা ধরা পড়ে যাবে সেটা তার ধারণায় ছিলনা। আর ইভান তো তাকে বলেও নি যে সে বাইরে তাও আবার তার ভার্সিটির কাছাকাছি আছে। সে তো ভেবেছিলো আজ ছুটির দিনে ইভান এখন বাসায়। তাই মিথ্যা বলে দিয়েছে। ভেবেছিলো ইভান জানতেই পারবে না। কিন্তু এখানে তো পুরো ঘটনা উল্টা ঘটে গেলো। এখন সে কিভাবে নিজেকে বাঁচাবে। ইভান এগিয়ে এসে ঈশার সামনে দাঁড়িয়ে দাতে দাঁত চেপে বলল
— এই তোর রিক্সার জন্য অপেক্ষা তাই না?

ঈশা আরেকদফা কেপে উঠলো। এমন কণ্ঠস্বর সে আগেও শুনেছে। আর এরপর কি হতে পারে সেটার ধারণাও আছে। ইভান শক্ত করে ঈশার হাত চেপে ধরলো। টেনে নিয়ে একটা রিক্সা থামিয়ে সেটাতে উঠে বসলো। রিক্সা বাড়ির দিকে চলছে। ঈশা ঘন নিশ্বাস ফেলছে। ভয়ে তার গলা শুকিয়ে কাঠ। ইভান স্থির দৃষ্টিতে সামনে তাকিয়ে আছে। কেউ কোন কথা বলছে না। অল্প সময়ের ব্যবধানে রিক্সা বাসায় এসে থেমে গেলো। ভেতরে ঢুকেই ঈশা দাড়িয়ে গেলো। ইভান তাকে পাশ কাটিয়ে সিড়ি বেয়ে ওঠার মুহূর্তে ঈশা হাত টেনে ধরলো। ইভান রক্তিম দৃষ্টি নিয়ে তার দিকে তাকাল। ঈশার ভয়টা আরো গাঢ় হলেও সেটাকে পাত্তা না দিয়ে কান্না জড়িত কণ্ঠে বলল
— আমি তোমাকে….

মুহূর্তেই গালে থাপ্পড় দিয়ে বসলো ইভান। নিজের রাগটা সংবরণ করার চেষ্টা করেও ব্যর্থ হলো সে। কিছুটা চেচিয়ে বলল
— তুই যদি ভাবিস তোর কোন পদক্ষেপের উপরে আমার নজর নেই তাহলে ভুল করবি। আমি তোর সবকিছুই জানি। এতো কিছুর পরেও আমাকে মিথ্যা বলার সাহস কিভাবে পাস তুই? এটা সত্যিই এবার বাড়াবাড়ি হয়ে গেলো।

কথা শেষ করেই ইভান আর দাড়ালো না। ঈশার সামনে দাঁড়িয়ে থাকলে তার রাগটা আরো বেড়ে যাবে। আর সেটাকে নিয়ন্ত্রন করা অসম্ভব হয়ে পড়বে। ঈশা নিঃশব্দে দাড়িয়ে কাদঁছে। ইভান দ্রুত সিড়ি বেয়ে উঠে ভেতরে চলে গেলো। একবার ফিরেও তাকালো না ঈশার দিকে।
———–
সেই যে দুপুরে ঘরে ঢুকেছে সারাদিন আর বের হয়নি ইভান। কেউ তাকে বিরক্ত করেনি। এখন সে ঘরের ভেতরে থাকলে সবাই ধরে নেয় কাজে ব্যস্ত। তাই আর বিরক্ত করে না। রাত প্রায় ৮ টা বাজে। এতক্ষণে নিজেকে পুরোপুরি সামলে নিয়ে বাইরে বের হলো ইভান। বাইরের পরিস্থিতি বোঝার চেষ্টা করলো। সবাই নিজের কাজে ব্যাস্ত। সুপ্ত কে দেখা যাচ্ছে না কোথাও। এমন কি তার আওয়াজ ও কানে আসছে না। ইভান এগিয়ে এসে ঈশার দরজার সামনে দাড়াতেই ভেতরে সুপ্তর আওয়াজ শুনতে পেলো। দরজাটা খুলে সেখানেই হেলানী দিয়ে দাড়িয়ে গেলো। পুরো মেঝেতে ছোটদের গল্পের বই ছড়িয়ে আছে। আর মেঝের একপাশে সুপ্ত গালে হাত দিয়ে বসে আছে। আর ঈশা তার সামনে বসে গল্প পরে শোনাচ্ছে। ঈশা গল্পটা শেষ করে পাশের পানির বোতল খুলে গলায় ঢেলে দিতেই সামনে থাইতে চোখ পড়ল। ইভান কে দাড়িয়ে থাকতে দেখেই তার অস্থিরতা বেড়ে গেলো। অভিমানটা গাঢ় হতেই চোখ টলমল করে উঠলো। নিজের ব্যথাতুর অনুভূতিটা লুকিয়ে ফেলতেই চোখ নামিয়ে নিলো। ইভান ভেতরে ঢুকে দরজাটা বন্ধ করে দিলো। একদম ঈশার সামনে গিয়ে বসে পড়লো। গভীর দৃষ্টিতে তাকাল অভিমানী প্রেয়সীর ব্যাথাতুর চেহারায়। ঈশা আরো অস্থির হয়ে উঠলো। নিজেকে সামলানো কঠিন হয়ে পড়েছে। চোখ পানিতে ঝাপসা হয়ে আসলো। পানি গড়িয়ে পড়তে দিলো না কিন্তু অনবরত নাক টানছে। ইভান এর বুঝতে অসুবিধা হলো না যে ঈশা তার কাছ থেকেই চোখের পানি লুকাতে চেষ্টা করছে। সেই সময় ইরা রুমে আসলো। ইভান কে দেখেই বলল
— ভাইয়া তুমি এখানে। আর আমি তোমার রুমে খুঁজে আসলাম।

ইভান গম্ভীর আওয়াজে বলল
— কেনো?

ইরা হতাশ কণ্ঠে বললো
— আমার ল্যাপটপটা কাজ করছে না। তোমাকে সেটা দেখাবো বলেই খুঁজছিলাম।

ইভান আশ্বস্ত করে বলল
— ঠিক আছে। আমার রুমে রেখে আয় আমি দেখবো।

ইরা মাথা নাড়িয়ে বের হতে যাবে তখনই ইভান ডাকলো। ইরা পেছন ঘুরে তাকাতেই চোখের ইশারায় সুপ্ত কে সাথে নিয়ে যেতে বলল। ইরা কি বুঝে মুচকি হেসে সুপ্ত কে কোলে নিয়ে বাইরে চলে গেলো। ঈশা স্ট্যাচুর মতো এক জায়গাতেই বসে নাক টেনেই যাচ্ছে। ইভান কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে যেই গালে থাপ্পড় মেরেছে সেই গালে হাত দিয়ে গেলেই অভিমানী ঈশা সরিয়ে দিলো। উঠে যেতে চাইলে ইভান তাকে টেনে নেয়। ঈশা একদম ইভানের বুকের উপরে এসে পড়ে। এতটা কাছে আসায় অন্য সময় হলে হয়তো ঈশা অসস্তিতে অস্থির হয়ে উঠতো। কিন্তু এখন তার মাঝে রাগটা বেশি প্রাধান্য পাচ্ছে। হাত পা চালিয়ে নিজেকে ছাড়ানোর চেষ্টা করছে সে। ইভান এক হাতের মুঠোয় ঈশার হাত দুটো নিয়ে আরেক হাতে শক্ত করে কোমর চেপে ধরলো। এতে ঈশা আরো কিছুটা কাছাকাছি চলে এলো। রাগের তীব্রতা বৃদ্ধি পেতেই জোরে নিশ্বাস ফেললো সে। ইভান তাকে ছেড়ে দিয়ে দুই হাতে আলতো করে গাল চেপে ধরে কপালে কপাল ঠেকিয়ে আদুরে কণ্ঠে বললো
— সরি জান।

অভিমানী প্রেমিকার অনুভূতিতে যেনো হাওয়া লাগলো। সেই হাওয়ার দাপটে চোখের পানি গড়িয়ে পড়ল গাল বেয়ে চিবুকে। ইভান একই অবস্থায় বলল
— আর কিভাবে সরি বলা সম্ভব আমার জানা নেই। মাফ করা কি একেবারেই অসম্ভব?

ইভান এর আকুতি ভরা কণ্ঠ শুনে ঈশা কিছুটা নরম হলো। কিন্তু পুরোপুরি অভিমান থেকে বেরিয়ে আসতে পারলো না। তাই ফুপিয়ে কেঁদে উঠলো। ইভান একটু সরে এসে চোখের পানি মুছে দিয়ে বলল
— আমি এতদিন তোর প্রতিটা ভুলের জন্য শাস্তি দিয়েছি। তোকে কষ্ট দিতেও ভাবিনি। কিন্তু আমার ভাবা উচিৎ ছিলো। নিজের অনিচ্ছায় হলেও তোর জীবনের এই ভুলগুলোর দায় ভার আমার। আমি তোকে সুযোগ দিয়েছি। কখনো ঠিক ভুল বুঝিয়ে দেইনি। উল্টা তোর উপরে দায় ভার চাপিয়ে দিয়ে খারাপ ব্যবহার করেছি। কখনো ভাবিনি তুই ইচ্ছা করে কিছু করিস নি। তুই মিথ্যা বললে আমার খুব রাগ হয়। কিন্তু এটা কখনো ভাবিনি যে আমার ভয়েই তুই সত্যিটা চেপে যাস। তোর মিথ্যা বলার সুযোগ টা আমিই তোকে করে দেই বারবার। সব ভুলের জন্য তোর সমপরিমাণ দায়ী আমি। নিজের ভুলগুলো আমার ভাবা উচিৎ ছিলো। তোর সাথে এমন ব্যবহার না করে আমি সহজ হয়ে গেলেই হয়তো তুই সবটা বলতে পারিস। আর আমারও তোকে সামলাতে সহজ হয়।

ইভান থেমে যেতেই ঈশা ছলছল চোখে তাকাল। এমন কথা শুনে ভেতরের অনুভূতিটা প্রশ্রয় পেতেই বুকে ঝাঁপিয়ে পড়লো। কান্নায় ভেংগে পড়লো সে। ইভান শক্ত করে জড়িয়ে ধরে বলল
— আর কখনো এমন হবে না। তোকে কখনো মিথ্যা বলার সুযোগ দেবো না।

ঈশা কিছু সময় কেঁদে নিজেকে হালকা করে নিলো। এখন আর রাগ অভিমান তেমন নেই। কিন্তু ইভানের বুকেই মাথা রেখে চোখ বন্ধ করে আছে। হৃদপিন্ডের আওয়াজটা মা’দ’কের নে’শা’র মতো কাজ করছে। ইভান ঈশার চুলের ভাঁজে হাত বুলিয়ে দিয়ে বলল
— আমি তোকে নিতেই গিয়েছিলাম। কিন্তু তুই মিথ্যা কথা বলাতে খুব রাগ হয়েছিলো। মিথ্যা বলার দরকার ছিলো না। কাব্যর সাথে আছিস সেটা বললেই হতো।

ঈশা মাথা তুলে তাকাল। অবাক হয়ে বলল
— কাব্যকে তুমি কিভাবে চেনো?

ইভান মুচকি হেসে গালে হাত রেখে বলল
— তোর সম্পর্কে কোন কিছুই আমার অজানা নেই। কোথায় যায় কি করে সবকিছুর খোঁজ রাখতে হবে তো। একটাই বউ আমার। হারিয়ে গেলে কোথায় পাবো।

ঈশা হেসে ফেললো। ইভান মুচকি হেসে যে গালে থাপ্পড় মেরেছে সেখানে আলতো করে ঠোঁট দুটো চেপে ধরলো। ক্ষণিক সময়ের জন্য ঈশা স্তব্ধ হয়ে গেলো। শরীরে শীতল শিহরণ বয়ে যেতেই হালকা কেপে উঠলো। লজ্জায় চোখ বন্ধ করে ফেললো সে। ইভান দুই আঙ্গুলে আলতো করে গালে ছুয়ে দিয়ে বলল
— এতদিন শুধু ভালোবাসা ছিলো। আর এখন ভালোবাসা অধিকার দুটোই আছে। এই অধিকারটুকু আমার প্রাপ্য। আর আশা করছি এর জন্য আলাদাভাবে অনুমতির কোন প্রয়োজন নেই।

চলবে…

(সবাইকে ঈদ মোবারক। ঈদ উপলক্ষে আপনাদের জন্য একটা সারপ্রাইজ পর্ব। পর্বটা অনেক বড় করে লিখেছি। আশা করছি আপনাদের ভালো লাগবে।)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here