অপেক্ষা সুদূর বর্ষণের পর্ব-১৯

0
4999

অপেক্ষা_সুদূর_বর্ষণের – ১৯

মাথার উপরে সাইসাই করে ফ্যান চললেও ঈশা ঘেমে গেছে। ঠোঁটের ওপরে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমে আছে। চোখটা বন্ধ। ইভান এর উষ্ণ নিশ্বাস আছড়ে পড়ছে ঈশার ঠোঁটে। ইভান আলতো করে নাকে নাক ঘষে সরে গেলো। কিন্তু ছেড়ে দিলো না। ঈশা যেনো প্রাণ ফিরে পেলো। এতক্ষণ ভয়ে দম বন্ধ হয়ে যাওয়ার উপক্রম। ভীষন অসস্তিতে শরীর কাটা দিয়ে উঠছে। ইভান ঈশার এলোমেলো চুলগুলো কানের পেছনে গুঁজে দিয়ে আঙ্গুল ছুঁয়ে ঠোটের উপরের ঘাম মুছে দিলো। এমন স্পর্শে ঈশা কেপে উঠলো। ঈশা জোরে একটা শ্বাস টেনে কাপা কাপা গলায় বলল
— কেউ চলে আসবে। ছেড়ে দাও।

ইভান মৃদু আওয়াজে বলল
— সেটা জেদ করার আগে ভাবা উচিৎ ছিলো। আমি খুব কম সময়ই জেদ করি। তবে আমি জেদ করলে সেটা তোর জন্য শাস্তি হয়ে যায়। আমার কিছু করার নেই।

ঈশা চোখ বন্ধ করে বলল
— আর করবো না। প্রমিস! আমাকে ছেড়ে দাও।

তখনই ইভানের উত্তর এলো না। কিছুটা সময় পর ভীষন নরম কণ্ঠে বলল
— আমি কখনো তোর বিশ্বাস ভেংগে ফেলেনি। তবুও আমাকে বিশ্বাস করতে এতো অসুবিধা।

ঈশা চোখ মেলে তাকাল। ইভান এর কথাটা ধরতে পারলো না। বিশ্বাস অবিশ্বাসের প্রশ্ন আসছে কেনো। ইভান ঠিক কি বোঝাতে চায়? ঈশার কোন উত্তর না পেয়ে ইভান তাকে ছেড়ে দিলো। ঈশা উঠে দাঁড়ালো। ইভান পাশ থেকে ফোনটা নিয়ে সম্পূর্ণ মনোযোগ সেটায় নিবদ্ধ করলো। ঈশা কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে নরম কণ্ঠে বলল
— বিশ্বাস অবিশ্বাসের কথা আসছে কেনো? তোমার সাথে কি আমার সেরকম সম্পর্ক?

ইভান তাকাল। একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল
— সম্পর্কটা কোথায় ঈশা?

থেমে গেলো। ঈশার কোন উত্তর না পেয়ে আবারও বলল
— শুধু মাত্র একটা কাগজ কোন সম্পর্কের ভিত্তি হতে পারে না। সেটার উপরে নির্ভর করেই যে কোনো সম্পর্ক তৈরি করতে হবে সেটা কিন্তু নয়। ৫ বছর ধরে তোর সাথে আমার একটা সম্পর্ক থাকার পরেও আমি জানতাম না। তাই নিজেকে সংযত রেখেছিলাম। কিন্তু জানার পর যে নিজেকে সংযত রাখার প্রয়োজন নেই সেটাও নয়। আমি হয়তো আমার মাত্রাটা সত্যিই অতিক্রম ফেলেছি। একটু বাড়াবাড়ি করে ফেলেছি।

ইভান থেমে গেলো। ঈশা তাকিয়ে থাকলো কিছুক্ষণ। তারপর বলল
— কি বলছো তুমি?

ইভান হাসলো। বলল
— ওই কাগজে তোর আর আমার সাইন না থাকলে আমি এতো কিছু হয়তো ভাবতাম না। সম্পর্কটা আগের মতই থেকে যেতো। তবে একটু হয়তো পরিবর্তন হতো। আমি আগে খুব বেশি রিয়্যাক্ট করতাম। এখন বুঝি আমার ভুলগুলো। নিজেকে শুধরানোর চেষ্টা করি। আমি নিজের প্রতি স্যাটিসফাইড। অনেকটা চেঞ্জ করতে পেরেছি নিজেকে।

ঈশা কিছু বলার আগেই ইলহাম এসে ঘরে ঢুকল। বিছানায় বসে কলার উচু করে বলল
— যা গরম।

ইভান ঈশা কেউ কোন কথা বলল না। ইভান ফোনের দিকে তাকিয়ে আছে আর ঈশা তার দিকে। ইলহাম বিষয়টা খেয়াল করেই বলল
— এনিথিং রং? কোন সিরিয়াস কিছু?

ইভান এর প্রতিক্রিয়ার পরিবর্তন হলো না। ঈশা মাথা নেড়ে মুচকি হেসে মলিন কণ্ঠে বললো
— সিরিয়াস কিছু না।

বলেই ঘর থেকে বেরিয়ে গেলো। ইভান দীর্ঘশ্বাস ফেললো। তার প্রতি ঈশার এই আচরণ বিরূপ। ঈশার এমন আচরণটাই ইভান মেনে নিতে পারে না। মেয়েটা কি বুঝেও বোঝে না। ইভান কখনো নিজের সীমা অতিক্রম করে নি। তবুও ঈশা তাকে বিন্দু মাত্র ভরসা করে না। অথচ তাকেই চোখ বন্ধ করে ভরসা করা উচিৎ ছিলো।

———-
বৃষ্টি ভেজা ঝরঝরে হাওয়ায় কেটে গেলো একটা নির্ঘুম রাত। ইভান এর মন ভালো নেই। তার মন ভালো না থাকলে সাধারণত মেজাজও খারাপ থাকে। আর কারো সাথে খুব একটা কথাও বলেনা। এই অভ্যাসটা বাড়িতে সবার অবগত। ঝিরিঝিরি বৃষ্টি পড়ছে অনবরত। সকাল থেকে তাই সবাই বাড়িতেই এদিক সেদিক ঘুরে বেড়াচ্ছে। বাইরে যাওয়ার কোন উপায় নেই। ইভান নিজের ঘর থেকে বেরিয়ে এসে বারান্দায় দাড়িয়ে উদাসীন দৃষ্টিতে আকাশের দিকে তাকাল। আকাশে আলোর ঝলকানি। মাঝে মাঝে মৃদু আওয়াজ হচ্ছে। রাতে খুব একটা ভালো ঘুম হয়নি। তার এই একটা সমস্যা। মন ভালো না থাকলে কিছুই ঠিক মত হয়না। ক্লান্ত নিশ্বাস ফেলতেই পেছন থেকে অতি কাঙ্ক্ষিত আওয়াজটা কানে এলো।
— কখন উঠলে?

ইভান পেছনে তাকাল না। কারণ এই মানুষটার উপরেই তার দুনিয়ার অভিমান। কথা বলতে গেলেও মন খারাপটা রাগে পরিণত হয়ে যাবে। আর অযথা খারাপ ব্যবহার করবে। এই মুহূর্তে সেরকম কিছু করতে চাইছে না। ঈশা আবারও জিজ্ঞেস করলো
— কথা বলছো না যে?

এতক্ষণ নিজেকে আটকে রাখলেও এখন আর সম্ভব হলো না। ইভান পেছনে ঘুরে তাকাল। গম্ভীর আওয়াজে বলল
— এখন কি আমাকে সব কৈফিয়ৎ দিতে হবে। আমি এতো কৈফিয়ৎ দিতে প্রস্তুত নয়।

আচমকা এমন কথার জন্য ঈশা প্রস্তুত ছিলো না। হতাশ কণ্ঠে বললো
— এমন রাগ করে কথা বলছো কেনো? কি এমন হলো যে ঘুম থেকে উঠেই রেগে গেলে?

ইভান তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকাল। ঈশার উপরে রাগটা এবার চরম পর্যায়ে পৌঁছে গেলো। মেয়েটা রাগ অভিমান কিছুই বোঝে না। কঠিন গলায় বলল
— আমার স্বভাব টাই এমন। রাগ করার কোন কারণ লাগে না। আমি এখন তোর সাথে কথা বলতে চাচ্ছি না। ভালো লাগছে না। আমার সামনে থেকে চলে যা।

সকাল বেলায় ইভানের এমন আচরণ ঈশার উৎফুল্ল মনটাকে খারাপ করে দিতে যথেষ্ট হয়ে দাঁড়ালো। চেহারায় সেই বিষন্নতা ভেসে উঠতেই ইভান বুঝে গেলো। ঈশা কে এভাবে মন খারাপ করতে দেখে এবার নিজের উপরে রাগ উঠে গেলো। এই জন্যই ঈশার সাথে কথা বলতে চায়নি। না বললে কি খুব ক্ষতি হতো? শুধু শুধু মেয়েটাকে কষ্ট দিলো। ইভান ঘুরতেই মিলির সাথে ধাক্কা খেতে গিয়েও নিজেকে সামলে নিলো। রাগ উঠলেও সেটাকে দমিয়ে রাখার সর্বোচ্চ চেষ্টা করলো। কারণ ঈশার উপরে রাগ দেখাতে পারলেও একটা অপরিচিত মেয়ের উপরে রাগ দেখানোর ব্যাপারটা অশোভনীয়। বিরক্তিকর দৃষ্টিতে তাকাতেই মিলি চায়ের কাপ টা এগিয়ে দিয়ে বলল
— আপনার চা।

ইভান ঘনঘন নিশ্বাস ফেলে নিজেকে শান্ত করে নিয়ে চায়ের কাপটা হাতে নিয়ে নরম কণ্ঠে বললো
— ধন্যবাদ।

মিলি আবারও ইভানের দিকে মুগ্ধ দৃষ্টিতে তাকাল। এই মানুষটার গলার আওয়াজ শুনলেই তার ভেতরে অদ্ভুত অনুভূতি মাথা চাড়া দিয়ে ওঠে। মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে থাকতে ইচ্ছা জাগে। ভেতরে শুরু হয় অস্থিরতা। বারবার কথা শুনতে ইচ্ছা হয়। এমন ভাবে তাকিয়ে থাকতে দেখে ইভানের মেজাজ আরো খারাপ হয়ে গেলো। কিন্তু কিছুই বলল না। মিলি কয়েক মুহূর্ত তাকিয়ে থেকে অস্থির কণ্ঠে বললো
— আপনার কি শরীর খারাপ?

ইভান তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকাল। সেই দৃষ্টি দেখেই মিলি কিছুটা ঘাবড়ে গিয়ে মিনমিনে সরে বলল
— আসলে আপনাকে কেমন যেনো দেখাচ্ছে। তাই জিজ্ঞেস করলাম। আপনি ঠিক আছেন তো?

ঈশা পাশে দাড়িয়ে তাদের কথা শুনছিল। মিলির কথা শুনে ভালো করে তাকাল ইভানের দিকে। চোখ গুলো লাল হয়ে আছে। চেহারাটাও কেমন শুকনো লাগছে। ইভান বিরক্ত হয়ে বললো
— কিছু হয়নি। আমি ঠিক আছি।

বলেই চায়ের কাপ নিয়ে ঘরে চলে গেলো। ঈশা সেখানে দাড়িয়ে ভাবলো তাহলে কি ইভান অসুস্থ? কিন্তু সেটা ঈশার চোখে ধরা পড়লো না কেনো? ঈশার ভাবনার মাঝেই মিলি এসে দাড়ালো। বলল
— কোনো জানি মনে হচ্ছে উনি ঠিক নেই।

ঈশা ঘাড় ঘুরিয়ে মিলির দিকে তাকাল। এই মেয়েটাকে এই মুহূর্তে তার অসহ্য লাগছে। মেয়েটার কথা যেনো একদম মাথায় ধরছে। সেখান থেকে এক পাশে চলে গেলো। একা দাড়িয়ে ভাবছে সে। নিজের আচরনে নিজেই চমকে উঠলো। মিলি মেয়েটা যথেষ্ট ভালো। তার সাথে এই কয়দিনে বেশ ভালো সম্পর্ক তৈরি হয়েছে। কিন্তু এখন কেনো মেয়েটাকে সহ্য করতে পারছে না। ইভান এর প্রতি তার এমন আচরনের কারণে মেয়েটাকে ঈশার প্রতিদ্বন্দ্বী মনে হচ্ছে। হিংসায় ভেতরটা জ্বলে যাচ্ছে। এমন মনে হওয়ার যুক্তি যুক্ত কোন কারণ নেই। ঈশা অস্থির হয়ে উঠলো। মিলির ইভানের সাথে এভাবে কথা বলাটা তার ভালো লাগছে না। ইভান কেমন আছে সেটা ঈশার বোঝা উচিত ছিলো। কিন্তু এই মেয়েটা বুঝে গেলো। এটা তার জন্য কোনভাবেই মানা সম্ভব নয়। মিলিকে ভালোভাবে বুঝিয়ে দেবে সে যে ইভানের প্রতি তার এই সচেতনতা ঈশা কোনভাবেই ভালো দেখছে না। তার অসহ্য লাগছে।

চলবে….

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here