অপেক্ষা_সুদূর_বর্ষণের – শেষ পর্ব
ভোরের প্রথম আলোটা ঈশার মুখে এসে পড়তেই সে চোখ বন্ধ করে ফেললো। আর বন্ধ চোখেই ভেসে উঠলো স্পষ্ট প্রতিচ্ছবি। ইভান এর হাসি মাখা মুখটা। ঈশা চোখ খুললো। সরাসরি সূর্যের দিকে তাকাল। সূর্য লাল আভা ছড়িয়ে যাচ্ছে পৃথিবীর বুকে। ধীরে ধীরে আলোটা উজ্জ্বল হতেই ঈশা চোখ সরিয়ে নিলো। আর সেদিকে তাকিয়ে থাকা সম্ভব নয়। বারান্দা থেকে ঘরে এলো। চোখটা জ্বালা করছে ভীষন। নির্ঘুম একটা রাত এভাবে বারান্দায় দাড়িয়ে কাটিয়ে দেয়ার জন্য মাথায় সূক্ষ্ম যন্ত্রণা হচ্ছে। ধীরে ধীরে এক সময় সেই যন্ত্রণা যে বেড়ে যাবে সেটাও সে জানে। তবুও সেদিকে ভ্রুক্ষেপ নেই তার। বুকটা ভারী হয়ে আছে। ভেতরে অসহনীয় একটা যন্ত্রণা হচ্ছে। গতকাল ইভান ওই বাড়ি থেকে ঈশা কে মোটামুটি জোর করে এনেছে এই বাড়িতে। ঈশার কোন জেদ কাজ করেনি ইভানের সামনে। কারণ ইভান এবার কঠিন সিদ্ধান্ত নিয়েছে। সে কোনমতেই ঈশা কে আর তার ইচ্ছা মতো চলতে দেবে না। সেদিন যখন ঈশা জানতে পেরেছিল যে ডিভোর্সের ব্যাপারটা সম্পূর্ণ ইভান আর তার বাবার নাটক। তখন তার খুব অভিমান হয়। যখন সে ইভানকে নিজের সবটা ভাবতে শুরু করেছে তখনি তারা তার সাথে এমন একটা নাটক করলো। ঈশার মনে হয়েছিল ইভান তাকে ইচ্ছা করে কষ্ট দিয়েছে। তাই নিজের অভিমানকে প্রাধান্য দিয়ে সবাইকে ছেড়ে চলে গিয়েছিল একা থাকতে। গত ৬ মাস যাবত ইভান অনেক চেষ্টা করেছে তাকে মানাতে। ফিরিয়ে আনতে নিজের বাড়িতে। কিন্তু লাভ হয়নি। ঈশা কোনভাবেই তার কথা শোনেনি। এমন কি তার সাথে দেখাও করতে চায়নি। কিন্তু ইভানের এবার ধৈর্যের বাঁধ ভেংগে গেছে। মোটামুটি বাধ্য হয়েই ঈশা কে এনেছে এই বাড়িতে। ওয়াশ রুমে গিয়ে মুখে পানি দিয়ে বেরিয়ে এলো। হাত মুখ মুছে বিছানায় পা তুলে বসলো। আচমকাই দরজা খোলার শব্দ হতেই সেদিকে ঘুরে তাকাল। ইভান ঠোঁট এলিয়ে হেসে দরজাটা বন্ধ করে দিলো। ঈশা অগ্নি দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে আছে। ইভান কাছে এসে গালে হাত ছুঁয়ে দিতে গেলেই ঈশা সরিয়ে দেয়। ইভান বাকা হেসে ঈশার দিকে এক পা করে এগিয়ে যেতে যেতে বলে
— জান! তোর এই চাহুনি দেখলেই আমি কেমন এলোমেলো হয়ে যাই। তোর ওই জ্বলন্ত চোখের অগ্নি কুন্ডে স্বইচ্ছায় ঝাঁপিয়ে আত্মাহুতি দেয়ার প্রয়াশ জাগে। আজ আমি এই ইচ্ছাটা পূরণ করতে চাই। অনেক দূরত্ব মেনে নিয়েছি। আর না।
ঈশা কিছুটা ভয় পেলেও সেটা প্রকাশ করলো না। নিজেকে সামলে রেখেই তাচ্ছিল্য হাসলো। বলল
— ভালই অভিনয় করতে পারো। ভাবছি সেদিনের নাটকটা ভালো ছিলো নাকি আজকের টা।
ইভান শব্দ করে হেসে উঠলো। এক পা এক পা করে ঈশার দিকে এগিয়ে আসতে লাগলো। ঈশা ভয়ে পেছাতে পেছাতে এক সময় বিছানায় বসে পড়ে। ইভান অনেকটা ঝুঁকে দুই পাশে হাত রেখে ফু দিয়ে সামনে পড়ে থাকা চুলগুলো উড়িয়ে দিয়ে বলল
— তোর এই আগ্নেয়গিরির জ্বালাময়ী উত্তাপে সবাইকে ভস্ম করার চেষ্টা করলেও ওই আগ্নেয়গিরিতে আমাকে তুই কোনদিনও জ্বালাতে পারবি না। কারণ এই আগ্নেয়গিরির উত্তাপ আমার কাছে বেশ সহনীয় এবং আরামদায়ক। আর আমি নিজেই এই আগ্নেয়গিরিতে ঝাঁপ দিয়েছি। আমাকে আর ফেরানো সম্ভব নয়। তাই চেষ্টাও করিস না। বিপদে পড়বি।
ঈশা দুই হাতে ইভান কে ধাক্কা দেয়ার চেষ্টা করলো। কিন্তু সরাতে পারলো না। ইভান নিঃশব্দে হেসে বললো
— এতদিন আমি তোকে তোর মতো ছেড়ে দিয়েছি বলেই তুই সেভাবে চলতে পেরেছিস। কিন্তু আজ থেকে আর পারবি না।
কথা শেষ করে কিছুটা সরে গিয়ে বিছানায় বসলো। পেছনে শরীর এলিয়ে দিয়ে চোখটা মৃদু বন্ধ করলো। ঈশা রাগে ফুঁসছে। সে বিছানা থেকে নেমে সোজা চলে যাওয়ার জন্য পা বাড়াতেই হাতে টান পড়লো। কিছু বুঝে ওঠার আগেই আছড়ে পড়লো ইভানের বুকে। ইভান এক হাতে ঈশার কোমর চেপে ধরে আরেক হাতে চুলগুলো কানে গুঁজে দিয়ে ঠান্ডা স্বরে বলল
— তোর উচিৎ এবার আমাকে ভয় পাওয়া। কারণ এবার তুই সত্যিই দেখবি আমি কতটা ভয়ঙ্কর হতে পারি জান। তোকে পাওয়ার জন্য আমি কতটা নিষ্ঠুর আর নির্লজ্জ হতে পারি। অনেক সুযোগ দিয়েছি। অনেক ছাড় পেয়েছিস। আর না। এবার সম্পর্কটা পাকাপোক্ত করে পুরো অধিকার ছিনিয়ে নেবো। প্রয়োজনে জোর করবো। ভালো করে শুনে রাখ। সাক্ষী রেখে পুরো নিয়ম মেনে তারপর তোকে বিয়ে করবো। তোর উপরে সম্পূর্ণ অধিকার এখন থেকে শুধু আমার থাকবে। আর তুই আমাকে বাধা দিতে পারবি না। এটা যত দ্রুত তুই মেনে নিতে পারবি তোর জন্য ততই ভালো।
ইভান এর কথা শুনে ঈশার চোখ বেয়ে পানি গড়িয়ে পড়লো। ঈশার চোখে পানি দেখে ইভানের বুকের ভেতর এলোমেলো হয়ে গেলো। এই মেয়েটা জানে ইভান তার চোখের পানি সহ্য করতে পারে না। তাই হয়তো ইচ্ছা করেই তার দুর্বলতার সুযোগ নেয়। কিন্তু ইভান এবার আর দুর্বল হবে না। তাই খুব যত্ন করে ঈশার চোখের পানি মুছে দিয়ে বলল
— আমি আমার অধিকার জোর করে আদায় করে নিতে চাই না। তবে তুই যদি আমাকে বাধ্য করিস তাহলে খুব খারাপ হবে। কারণ এরপর আমার মধ্যে অপরাধবোধ আর তোর মধ্যে ভয় কাজ করবে। যা আমাদের দুজনের সম্পর্কের জন্য খুব খারাপ। আশা করি বোঝাতে পেরেছি। তুই হয়তো নিজেও জানিস না তুই আমার জন্য কি। তোকে আমি কখনো হারাতে পারবো না। কোনো কিছুর বিনিময়ে নয়।
শেষের কথাটা ভীষন আবেগময় শোনালো। ঈশা ভেতরে যেনো একটা ধাক্কা খেল। ইভান এর এমন কম্পমান কণ্ঠস্বর ঈশার ভেতরে জমানো অনুভূতিগুলো নাড়িয়ে দিলো। সে নিজের জেদ রাগ এসব কে প্রাধান্য দিয়েছে সব সময়। এই মানুষটার কথা ভাবেনি। সেদিন যখন ঈশার বাবা ডিভোর্স এর কথা বলেছিল আর ইভান সম্মতি দিয়েছিল তখন ঈশার দম বন্ধ হয়ে আসার উপক্রম হয়েছিল। অসহায় মনে হয়েছিল নিজেকে। কলিজা ছিঁড়ে যাওয়ার মতো তীব্র যন্ত্রণায় ছটপট করে উঠেছিল সে। কিন্তু ইভান তার দিকে ফিরেও তাকায় নি। জানতেও চায়নি ঈশা কি চায়। অভিমান করে থাকলেও সে ইভানের কষ্টটা সেদিন উপলব্ধি করতে পেরেছিল। নিজের ভুলের কারণে এতদিন ধরে এই মানুষটাকে সে কষ্ট দিয়েছে। সব কষ্ট মেনে নিয়েছে। কোনদিনও অভিযোগ করেনি। কিভাবে পারে ইভান? ঈশা ফুপিয়ে কেঁদে উঠলো। চোখ বেয়ে টপটপ করে পানি পড়ছে। ইভান এতক্ষণে নিজের মধ্যে ফিরলো। তার মাথায় আসলো সে রাগের মাথায় আবারও ঈশা কে কষ্ট দিয়েছে। তাই ছেড়ে দিয়ে বারান্দায় চলে গেলো। চোখ বন্ধ করে নিজের রাগ সংবরণ করার চেষ্টা করলো। কিন্তু লাভ হলো না। ঘর থেকে ঈশার ফুপিয়ে কান্নার আওয়াজ আসছে। ইভান এর মনে হচ্ছে কেউ যেনো তার বুকের উপরে ছুরি চালিয়ে যাচ্ছে অনবরত। বেশ কিছুক্ষণ নিজের মন মস্তিষ্কের সাথে যুদ্ধ করে ঘরে এলো আবার। ঈশা দুই পায়ের মাঝে মুখ গুজে কাদঁছে। ইভান হতাশ নিশ্বাস ফেলে অসহায়ের মতো বলল
— কাদিস না। আমি তোকে কোনদিন জোর করবো না। তোর যতদিন ইচ্ছা সময় নে। আমার আপত্তি নেই। শুধু কাদিস না। আমি এটাই সহ্য করতে পারি না। হয়তো আমাদের এই সম্পর্কের তিক্ততার শেষ কোনদিন হবে না। আমি নিজে ভালো থাকার জন্য তোকে কোনদিন কষ্ট দিতে পারবো না জান। তুই ভালো থাকিস। এটাই আমার জন্য যথেষ্ট। প্লিজ কাদিস না। তোকে খুব ভালোবাসি জান। নিজের থেকেও বেশী।
ইভান এর কথার কোন প্রভাব পড়লো না ঈশার উপরে। সে নিজের মতো কেঁদেই যাচ্ছে। ইভান সহ্য করতে না পেরে শেষ পর্যন্ত ঘর থেকে বাইরে যাওয়ার জন্য দরজা খুললো। কিন্তু অপ্রত্যাশিত ভাবে মুখোমুখি হলো ঈশার খালার। তার ঠিক পেছনেই দাড়িয়ে আছে এক মাত্র খালাতো ভাই অভ্র। ঈশার খালা ইভানকে এভাবে দেখে তার পেছন দিয়ে ভেতরে উকিঝুকি দিলো। ঈশা সেই একই অবস্থায় আছে। ঈশার খালা তার স্বভাব বশত চিৎকার করে উঠে বলল
— তুমি ঈশার ঘরে কি করছিলে? আর দরজাই বা বন্ধ করে রেখেছিলে কেনো?
ঈশা মাথা তুলে তাকাল। তার চিৎকার শুনে সবাই দৌড়ে এলো। ঈশার মা এসে বোনকে বলল
— কি হয়েছে আপা? তুমি চিৎকার করছো কেনো?
— ইভান আর ঈশা দরজা লাগিয়ে এক ঘরে ছিলো। তুই কি কিছুই দেখিস না? অবিবাহিত প্রাপ্ত বয়স্ক মেয়ে তোর বাড়িতে আছে। চোখ কান তো খোলা রাখতে হবে নাকি?
কথাটা বলেই তিনি আবারও ইভানের দিকে তাকালেন। কিছুটা তাচ্ছিল্য করে বললেন
— আর তোরই বা কি দোষ দেবো। তোদের যা পরিবার! আগুন আর ঘি একসাথে রাখলে তো অঘটন ঘটবেই। আমার তো আগেই সন্দেহ হয়েছিলো। তোরাই কোন গুরুত্ব দিসনা তাই কিছু বলিনি।
ইভান এর মেজাজ এমনিতেই ভালো নেই। তার উপর এমন কথা শুনে সেটা আরো খারাপ হয়ে গেলো। সে এই মুহূর্তে কোন সিন ক্রিয়েট করতে চায়না তাই চুপ করে থাকলো। কিন্তু ঈশার খালা একের পর এক কথা বলেই যাচ্ছিলেন। এক পর্যায়ে তিনি ঈশার চরিত্র নিয়ে কিছু কুরুচিপূর্ণ ইঙ্গিত করলেন যা ইভানের ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে দিলো। দাতে দাত চেপে বলল
— অনেক বলেছেন। ঈশা কে নিয়ে আর কোন বাজে কথা আমি শুনতে চাই না।
ঈশার খালা এমন ধমকে থেমে গেলেও অভ্র এগিয়ে এলো। সন্দিহান কণ্ঠে বললো
— এই সকাল বেলা তুই ঈশার ঘরে কি করছিস ইভান? কথাটার উত্তর দিলি না যে?
ইভান কিছু একটা বলতে গিয়েও থেমে গেলো। সবার দিকে একবার করে তাকাল। সবাই কেমন অস্বস্তির মধ্যে আছে। কারণ তাদের বিয়েটা একেবারেই অন্য রকম ভাবে হয়েছে। কেউ জানে না সেটা। কিন্তু পেছন থেকে শোনা গেলো ঈশার তীক্ষ্ণ কণ্ঠ।
— আমার বর আমার ঘরে কি করছে তার জবাব কি এখন সবাইকে দিতে হবে? নাকি আমার ঘরে আসতে তাকে সবার কাছে পারমিশন নিতে হবে? আমরা কি করবো সেটা সম্পূর্ণ আমাদের ব্যাক্তিগত ব্যাপার। এর জন্য কারো কাছে জবাব দিহী করার কোন প্রয়োজন আমি মনে করি না।
ঈশার কথা শুনে তার খালার মুখ হা হয়ে গেলো। অভ্র অবাক চোখে তাকিয়ে আছে ঈশার দিকে। সব থেকে বেশী অবাক হলো ইভান। কারণ ঈশা যে এমন কথা বলবে সেটা তার ধারণাতেই ছিলো না। বাকি সবাই যে যার মতো চলে গেলো। কারণ এরপর আর কোনো কথা নেই। ঈশার খালা কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে তিনিও চলে গেলেন। থেকে গেলো শুধু অভ্র। সে নিজের বিস্ময় এখনো কাটিয়ে উঠতে পারছে না। অবাক কণ্ঠে বললো
— তোমার বর ইভান? কি বলছো ঈশা?
ঈশা এগিয়ে এসে ইভানের পাশে দাঁড়ালো। মুচকি হেসে বললো
— যা শুনেছেন তাই বলেছি অভ্র ভাইয়া।
— কবে হলো?
অভ্রর অবাক করা প্রশ্নের জবাবে ঈশা আবারও মৃদু হাসলো। বলল
— প্রায় ৬ বছর হয়ে যাচ্ছে আমাদের বিয়ে রেজিস্ট্রি হয়েছে।
অভ্র যেনো কথাটা বিশ্বাস করতে পারলো না। কিছুটা উত্তেজিত হয়ে বলল
— আমি বিশ্বাস করি না।
ঈশা কঠিন গলায় বলল
— কে বিশ্বাস করলো আর কে করলো না সেটাতে আমাদের কোন যায় আসেনা। আর জনে জনে এভাবে আমাদের বিয়ের কথাটা প্রমাণ দেয়া প্রায় অসম্ভব। তাই আপনি যদি বিশ্বাস করতে না পারেন তাহলে আমাদের কিছু যায় আসেনা। আমার মনে হয় আপনার উত্তর পেয়ে গেছেন। তাই এখন বিরক্ত না করলে খুশি হবো।
অভ্র সেখানে আর দাড়ালো না। চলে গেলো সেখান থেকে। ঈশা সেদিক থেকে দৃষ্টি ফিরিয়ে ইভানের দিকে তাকাল। ইভান কিছুক্ষণ ঈশার দিকে তাকিয়ে থেকে চলে গেলো। ঈশা বুঝতে পারলো ইভানের এই মুহূর্তে মেজাজ খারাপ। তাই তেমন কিছুই বলল না। সেও আর দেরি না করেই ইভানের বাবার ঘরে চলে গেলো। ঘরে ঢুকেই কোন ভঙ্গিমা ছাড়াই বলল
— বড়ো বাবা আমি একটা গুরুত্তপূর্ণ কথা বলতে এসেছি।
ইভান এর বাবা কিছুটা কৌতূহলী হয়ে জিজ্ঞেস করলেন
— কি বলবি মা?
— তোমার ছেলে আর আমার মাঝে সম্পর্কটা অনেক জটিল হয়ে পড়েছে। আমি আর জটিলতা চাইনা। সবকিছু ঠিক করে সুখে শান্তিতে সংসার করতে চাই। আর আমার মনে হয় তোমরাও তাই চাও।
————
দূর আকাশে আজ মিটিমিটি তারা জ্বলছে না। একটা শীতল হাওয়া শরীর ছুঁয়ে যাচ্ছে। কোথাও হয়তো বর্ষণ হচ্ছে। ইভান রেলিংয়ের কাছ ঘেঁষে দাঁড়িয়ে আছে। দৃষ্টি মেঘাচ্ছন্ন রাতের আকাশের দিকে স্থির থাকলেও মস্তিষ্ক অন্য কোন ভাবনায় বিভোর। পাশেই কারো উপস্থিতি বুঝতে পেরে তাকাল। ঈশা কে দেখে কিছু সময় তাকিয়ে থাকলো। সেও আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে। ইভান দৃষ্টি ফিরিয়ে আগের জায়গায় স্থির করে নরম কণ্ঠে বলল
— ঘুমাস নি?
ঈশা ঝটপট উত্তর দিলো
— ঘুমালে কি এখানে থাকতাম? এখানে যখন আছি তখন ঘুমাইনি।
ইভান উত্তর দিলো না। খানিকবাদে ঈশা জিজ্ঞেস করলো
— মন খারাপ তোমার?
ইভান একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল
— নাহ্!
ঈশা ইভানের সামনে এসে দাড়ালো। আলতো করে বুকের উপরে হাত রেখে বলল
— তুমি তো মিথ্যা বলতে না। কিভাবে শিখলে?
ইভান ব্যাথাতুর দৃষ্টিতে ঈশার দিকে তাকিয়ে বলল
— এসব কেনো করছিস ঈশা? এসবের কি মানে? আমি তো বলেই দিয়েছি তোকে কোনদিন জোর করবো না। তুই চেয়েছিস আমাকে বিয়ে করতে। আমি সেটাও মেনে নিয়েছি। বিয়ে করেছি ঠিকই সাথে এটাও বলেছি তোর যতো সময় প্রয়োজন নিতে পারিস। আমি কোনদিন তোর অনিচ্ছায় নিজের অধিকার দেখাবো না। তাহলে এখন কি চাস?
— তোমাকে।
ইভান ঈশার চোখের দিকে দৃষ্টি স্থির করলো। কিন্তু উত্তর দিলো না। ইভান কে চুপ করে থাকতে দেখে ঈশার মন খারাপ হয়ে গেলো। চোখে পানি টলমল করে উঠলো। সে চোখের পানি লুকাতে নিচের দিকে তাকিয়ে কাপা কাপা গলায় বলল
— আমি.. আমি তোমাকে অনেক কষ্ট দেই। তুমি কিভাবে সহ্য করো? কিভাবে মেনে নাও? আমার সব অন্যায় তুমি মেনে নাও। তবুও কেনো ভালোবাসো? বড়ো বাবা ভুল বলে। তুমি আমাকে ঠিকই ভালো রাখতে পারবে কিন্তু আমি তোমার যোগ্য নই। আমি তোমাকে ভালো রাখতে পারবো না।
ইভান স্থির হয়ে গেলো। কোন কথা উচ্চারণ করার মতো অবস্থায় নাই সে। ঈশা তাকে বারবার এমন একটা পরিস্থিতিতে ফেলে দেয় যেখানে দাড়িয়ে তার নিজেকে সব থেকে অসহায় মনে হয়। নিজেকে গুছিয়ে নিয়ে মেয়েটার কাছে গেলেই সব কেমন এলোমেলো হয়ে যায়। আর তার কাছ থেকে নিজেকে দূরে রাখার সিদ্ধান্ত নিলেই মেয়েটা কেমন বিদ্ধস্ত এলোমেলো হয়ে যায়। সে আসলে নিজেই জানে না তার কি চাই। ইভান অনেক চেষ্টা করেছে তাকে তার মনের কথা বুঝতে দিতে। কিন্তু কোনভাবেই সম্ভব হয়নি। কথা গুলো বলতে বলতেই কেঁদে ফেললো ঈশা। হাতের উলটো পিঠ দিয়ে চোখ মুছতে লাগলো। ইভান হতাশ নিশ্বাস ফেলে ঈশা কে বুকে টেনে নিলো। শক্ত করে জড়িয়ে ধরে বলল
— আমার জীবনে সৃষ্টিকর্তার দেয়া সবথেকে বেস্ট গিফট তুই। তুই থাকলেই আমি ভালো থাকবো। আমার ভালো থাকার জন্য খুব বেশি কিছু প্রয়োজন নেই জান। তোর ভালো থাকাই আমার ভালো থাকার কারণ। আর কখনো কাদবি না। আমার ভালো থাকার জন্য এটা তোকে মানতেই হবে।
ঈশা মুখ তুলে বলল
— আমি অনেক এলোমেলো। অগোছালো। কোন কিছুই ঠিক নেই। আমি পারিনা। না চাইতেও সব কেমন যেনো হয়ে যায়। আমি নিজেকেই বুঝতে পারিনা।
ইভান কথা বলার ধরন দেখেই হেসে ফেললো। বলল
— আমি গুছিয়ে নেবো। পুরোটা আমার দায়িত্ব। নিজেকে বোঝার দরকার নেই তো। আমি আছি তো।
ইভানের শেষের কথাটাই যথেষ্ট হয়ে গেলো ঈশার জন্য। ভেতরটা শীতল অনুভূতিতে ছেয়ে গেল। ইভান দুই হাতে ঈশার গাল আলতো করে ধরে কপালে গভীর চুমু খেল। ইভান এর আদরে ঈশা যেনো প্রশ্রয় পেলো। ভেতরের সমস্ত আবেগ ঠিকরে বেরিয়ে আসতে চাইছে। ফুপিয়ে কেঁদে উঠলো। ইভান কপালে কপাল ঠেকিয়ে আবেগী কণ্ঠে বললো
— ইউ ওয়ার আ প্রিন্সেস বাট নাও ইউ আর দা কুইন অফ মাই কিংডম! স্টপ ক্রাইং জান।
ঠোঁট দুটোতে আলতো করে নিজের ঠোট ছুয়ে বলল
— এই এলোমেলো অগোছালো ঈশা কেই আমার ভালো লাগে। এভাবেই আমি তাকে সবকিছুর থেকেও বেশী ভালোবাসি। নিজের জীবনের থেকেও বেশী।
নিজের কথা শেষ করে ঈশা কে কোলে তুলে নিলো। তারপর সিড়ি বেয়ে নামতে লাগলো। ঈশা নিজেকে ছাড়াতে চেষ্টা করে বলল
— কোথায় নিয়ে যাচ্ছো আমাকে?
ইভান উত্তর দিলো না। সোজা নিজের ঘরে এনে দরজা বন্ধ করে দিলো পা দিয়ে। ঈশা কে বিছানায় বসিয়ে দিয়ে তার দিকে কিছুটা ঝুঁকে বলল
— নিজের সবটুকু ভালোবাসা আজ উজাড় করে দেবো তোর নামে। তোর জীবনের সব থেকে সুখের মুহূর্ত উপহার দেবো। আজকের পর থেকে আর কোন আফসোস থাকবে না তোর জীবনে। আজ প্রেম বর্ষণ হবে। সমাপ্তি ঘটবে এই অপেক্ষা_সুদূর_বর্ষণের।
সমাপ্ত
( কিছুটা তাড়াহুড়ো করে শেষ করা। ব্যস্ততায় ক্লান্ত হয়ে পড়েছি। এই অবস্থায় গল্প লেখা অসম্ভব হয়ে পড়ছে। তার উপরে রাইটিং ব্লক। এতদিন যারা গল্পটার সাথে ছিলেন সবাইকে জানাচ্ছি আন্তরিক ধন্যবাদ। এখনই নতুন গল্প শুরু করার মতো সময় এবং অবস্থা কোনটাই নেই। একটা দীর্ঘ বিরতির প্রয়োজন নিজেকে গুছিয়ে নিতে। গুছিয়ে নিয়েই আবার ফিরবো পুরো উদ্যমে।)