প্রেম তুমি পর্ব-৫

0
1397

#প্রেম_তুমি
ফাবিহা নওশীন
পর্ব-৫

দর্শন প্রচন্ড শকড রুশানের কথা শুনে। শুধু শকডই না রীতিমতো মাথা ঘুরছে। কান ভনভন করছে। সিনেমার মতো একই লাইন বারবার বাজছে। দর্শন কান চেতে ধরল দুই হাতে। কান স্তব্ধ হয়ে রয়েছে। আঙুল দিয়ে কানে খোঁচা দিয়ে বলল,
“আমি ভুল শুনছি?”

রুশান ফ্যাকাসে মুখ করে বলল,
“দোস্ত তুই বয়রা হয়ে গেছিস? অর্ষা, আমি অর্ষার কথা বলছি। তুই শুনতে পাচ্ছিস? হ্যালো ওয়ান টু চেক… ”

দর্শন রক্তচক্ষু নিয়ে ওর দিকে তাকাল। রাগে গা কাঁপছে। দাঁতে দাঁত চেপে বলল,
“তুই জানিস না অর্ষা আমাকে ভালোবাসে?”

“তাতে কী? তুই তো আর বাসিস না। ওইদিন না বললি অন্য খাঁচায় বন্ধি হয়ে গেলে তুই বেঁচে যাস? আমি তোকে বাঁচিয়ে দিচ্ছি। বন্ধু হয়ে বন্ধুর উপকার করছি। সমস্যা নেই একদিন ট্রিট দিয়ে দিস। তাছাড়া অর্পা আমার সাথে যা করেছে তার শোধ নেব না? ওকে দেখিয়ে দেখিয়ে
অর্ষার সাথে প্রেম করব। খুব জ্বালাব।”

অর্পা জ্বলবে কি-না জানা নেই তবে দর্শন জ্বলে পুড়ে ছারখার হয়ে যাচ্ছে। বোম ফাঁটবে ফাঁটবে অবস্থা। সব চেয়ে বেশি জ্বালা করছে রুশানের নেকা হাসি দেখে।
“একটা লাথি মেরে তোর পেট ফাঁটিয়ে নাড়িভুঁড়ি বের করে ফেলব। আরেকবার যদি অর্ষার নাম মুখে নিয়েছিস তো ঠোঁট কেটে ফালা ফালা করব। একটা গেছে আরেকটা ধরার জন্য অস্থির হয়ে গেছে।”
দর্শন রাগে গজগজ করতে করতে চলে গেল। যেতে যেতেও বিড়বিড় করছে। রুশান ক্যাবলার মতো দাঁড়িয়ে আছে। দর্শন এ-সব কি বলে গেল মাথায় ঢুকছে না।


অর্ষা লাইব্রেরীতে বসে আছে। কিন্তু আজ সারাদিনও দর্শন লাইব্রেরীতে আসেনি। অর্ষা ঘুম ঘুম ভাব নিয়ে এলোমেলো হয়ে বসে আসছে। ক্ষনে ক্ষনে নিয়ম করে হাই তুলছে। বিরক্তি আর নিরাশা নিয়ে এদিক সেদিক দেখছে। কত স্টুডেন্ট আসছে, যাচ্ছে, কেউ দাঁত কেলিয়ে হাসছে, কেউ বই খুঁজছে, কেউ বিরক্ত লুক নিয়ে লাইব্রেরী জুড়ে হাঁটছে, কেউ ফিসফিস করে গল্প করছে, কেউ কথার ফাঁকে চুপিচুপি হাসছে। অর্ষা এ-সব দেখতে দেখতে বোর হয়ে যাচ্ছে। অবশেষে নিদ্রা আসছে৷ তখনই লাইব্রেরী গেট দিয়ে দর্শন ঢুকল। অর্ষা নড়ে-চড়ে বসে, চুলগুলো ঠিক করে বই খুলে এক্সট্রা ভাব নিয়ে বসল। এমন জায়গায় বসেছে যাতে লাইব্রেরীতে ঢুকেই অর্ষার দিকে প্রথম চোখ যায় অর্ষা অর্ষার চোখ বইয়ের দিকে এমন চাব যেন পড়াশোনায় গভীর মগ্ন। অর্ষা আড়চোখে দর্শনের দিকে তাকাল। কিন্তু হায়! দর্শন লাইব্রেরীতে ঢোকার পথেই একটা ছেলে ওকে আগলে নিয়ে কথা বলতে লাগল। অর্ষার এত ভাব নিয়ে বসে থাকার কোন লাভ হলো না। দর্শন ছেলেটার সাথে কথা বলছে তো বলছেই। ওদের কথা থামছে না। অর্ষা ভাবছে এই বুঝি শেষ হবে কিন্তু বারবার অর্ষা ভুল প্রমাণিত হচ্ছে। ওদের কথা শেষ হচ্ছে না। ওদের দেখে মনে হচ্ছে ওদের গল্প জমে গেছে। দর্শন তো রীতিমতো হেসে হেসে দাঁত কেলিয়ে হাসছে। অর্ষার শরীর জ্বলে যাচ্ছে। ঠোঁট ফুলিয়ে বসে রইল। কাঁদতে ইচ্ছে করছে। কখন ওদের কথা শেষ হবে আর কখন দর্শনের দৃষ্টি ওর দিকে পড়বে। অর্ষার রাগ হচ্ছে ভীষণ। অর্ষা রাগে গাল ফুলিয়ে ব্যাগ নিয়ে উঠে গেল। দর্শনের পাশ দিয়ে হেঁটে গেল ওর দৃষ্টি আকর্ষণ করার জন্য। কিন্তু দর্শন গল্পে মশগুল। অর্ষা কিছু দূর গিয়ে পেছনে তাকাল। দর্শনকে দেখে ওর আরো রাগ হচ্ছে। ইচ্ছে করছে মার্ডা*র করে দিতে। ওর দিকে না তাকানোর দায়ে হ*ত্যা।
দর্শন মাথা ঘুরাচ্ছে। অর্ষা জানে না দর্শন পেছনে তাকাবে কি-না, যদি তাকায়? আর যদি অর্ষাকে দেখে ফেলে? কী লজ্জা! কী লজ্জা! এত লজ্জা কই রাখবে? তাই দ্রুত মাথা ঘুরিয়ে সামনের দিকে হাঁটতে লাগল। প্রিয়াকে কল করছে কিন্তু ও রিসিভ করছে না। আজ কলেজেও আসেনি। অর্ষা আবারও প্রিয়াকে কল করছে। কিন্তু রিসিভ হচ্ছে না। ক্লাসের সামনে গিয়ে ওকে দেখতে পেল। প্রিয়াকে দেখে ওকে ডাক দিল।
প্রিয়া ওর ডাক শুনে থেমে গেল। অর্ষা ওর সামনে গিয়ে বলল,
“তুই বেঁচে আছিস? আমি তো ভেবেছি মরে গেছিস।”
প্রিয়ার সামনে যেতেই প্রিয়া বলল,
“আম্মুর সাথে শপিংয়ে গিয়েছিলাম। তাই শুধু লাস্ট ক্লাস পাচ্ছি৷”
অর্ষা রাগে গজগজ করতে করতে বলল,
“মোবাইল কী গিলে খেয়েছিস? না দান করে এসেছিস? না-কি শপিংয়ের বিল দিতে পারিসনি তাই মোবাইল রেখে দিয়েছে? কোনটা? চটপট এন্সার মি।”
প্রিয়া ভ্রু কুঁচকে বলল,
“আরো কিছু অপশন দে তারপর তোর কোশ্চেনের এন্সার দিচ্ছি।”
“ড্রামা বাদ দে, তোর মোবাইল কই?”
“আরে, তাড়াহুড়ায় বাড়িতে ফেলে আসছি। জানিসই তো আম্মু শপিং করতে গেলে কত তাড়া দেয়।”
“আমি না জানি তুই তো জানিস। কেন গিয়েছিলি?”
প্রিয়া বুঝতে পারছে কোন কারণে অর্ষা চটে আছে। তাই ঠান্ডা মাথায় বলল,
“যাওয়া দরকার ছিল, ইয়ার। তোর কী হয়েছে তাই বল। মাথা গরম কেন?”
অর্ষা ওর প্রশ্নে গলে গেল। যেন এতক্ষণ এই প্রশ্নের অপেক্ষায় ছিল।
“পুরো কলেজের দৃষ্টি আমার দিকে থাকলেও তার দৃষ্টি অন্যদিকে। আমাকে তার চোখেই পড়ে না। আমি এতবড় জলজ্যান্ত একটা মানুষ, গোল গোল চমশায় কী আমাকে দেখা যায় না? চশমায় কী পাওয়ার নেই?”
প্রিয়া ভোলাভালা মুখ করে বলল,
“আমি গিয়ে জিজ্ঞেস করে আসব?”
অর্ষা নেকা কান্না করে বলল,
“তুই আমার সাথে মজা নিচ্ছিস? তোর সাথে আড়ি আমার।”
প্রিয়াও নেকামি করে বলল,
“আহারে! থাক বাবুটা কাঁদে না।”
অর্ষা ওর পিঠে একটা থাপ্পড় মেরে বলল,
“চোখের সামনে থেকে দূর হ।”
এটা বলে নিজেই চলে যাচ্ছে। প্রিয়া দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে হাসছে।

অর্ষা শেষ ক্লাস না করে গাছের নিচে বসে আছে। ভালো লাগছে না কিছুই। বসে বসে আইসক্রিম খাচ্ছে। মোবাইল অফ করে রেখেছে যাতে প্রিয়া কল দিতে না পারে। পরক্ষণেই মনে পড়ল প্রিয়া তো মোবাইল আনেনি। হুদাই রাগ করে মোবাইল অফ রেখেছে। মোবাইল অন করে একটা সেল্ফি তুলে ফেসবুকে আপলোড দিল। তখনই হোয়াটসঅ্যাপ থেকে নোটিফিকেশন আসল। কেউ একজন মেসেজ করেছে। অপরিচিত নাম্বার। “কেমন আছো তুমি?”। অর্ষা কয়েকবার মেসেজটি দেখে নাম্বার দেখল। তারপর আইসক্রিমে মনোযোগ দিল। এক কামড় দিয়ে ডান হাতের বুড়ো আঙুল দিয়ে ব্লক দিয়ে দিল। তারপর আবারও আইসক্রিম খেতে খেতে ফেসবুক স্ক্রল করছে। তখন রুশান এলো। ওর পাশে বসে পড়ে বলল,
” কী করো তুমি?”
অর্ষা মুখে জবাব না দিয়ে মোবাইল দেখিয়ে আবারও স্ক্রল করছে। রুশানকে একদম পাত্তাই দিচ্ছে না। রুশান ওকে ভালো করে পর্যবেক্ষণ করে বলল,
“এই তোমার ফেবু আইডিটা দেও তো।”
অর্ষা ভ্রু কুঁচকে এক পলক ওকে দেখল। তারপর বলল,
“অন্বেষা হাসান লিখে সার্চ দিন। আমার পিক দেওয়া আছে পেয়ে যাবেন।”
রুশান ওর নাম লিখে সার্চ করল। একই সাথে কতগুলো মেয়ের আইডি আসল। তাই অর্ষাকে দেখিয়ে বলল,
“কোনটা তুমি?”
অর্ষা আবারও এক পলক দেখে বলল,
“তিন নাম্বারটা।”
দর্শন, অর্ষা আর রুশানকে এক সাথে দেখে হতভম্ব। ওর পিলে চমকে উঠে। হঠাৎ করে কপাল দিয়ে চিকন ঘাম ছুটতে লাগল। রুশান কী সত্যিই অর্ষাকে পটিয়ে ফেলেছে? ওরা এক সাথে কেন? এসব প্রশ্ন নিয়ে অর্ষা আর রুশানের দিকে দ্রুত এগিয়ে গেল।
গিয়েই হন্তদন্ত হয়ে রুশানের দিকে প্রশ্ন ছুড়ে দিল,
“তুই এখানে কেন? এখানে কী করিস?”
তারপর আড়চোখে অর্ষার দিকে তাকাল। অর্ষা চোখ উল্টালো তারপর আবারও ফেসবুক স্ক্রল করতে লাগল। মনে মনে বিরবির করে বলছে,
“তার বন্ধু থাকায় আমাকে চোখে পড়ছে। দূর থেকেও চোখে পড়ছে। আর আমি একা সামনে থাকলেও চোখে পড়ে না। বদ ছেলে একটা। একবার বয়ফ্রেন্ড বানাতে পারলে হারে হারে শিক্ষা দিয়ে দেব।”
রুশান হাসি হাসি মুখ করে বলল,
“এই তো অর্ষার সাথে একটু গল্প করছি।”
অর্ষা অবাক হয়ে ভাবছে ওর সাথে গল্প কখন করল।
দর্শন বলে উঠে,
“অনেক গল্প হয়েছে৷ এখন উঠ আর ক্লাসে আয়। পড়াশোনা বাদ দিয়ে এত গল্প কীসের? ওর না-হয় গল্প করে চলে যাবে তোর তো চলবে না। তুই তো যেন তেন স্টুডেন্ট না।”
কথাগুলো ঠেস মেরে অর্ষাকে বলল সেটা অর্ষা আর রুশান দুজনেই বুঝতে পারল। অর্ষা নাক ফুলিয়ে নিচের দিকে চেয়ে আছে। অন্য কেউ হলে এই কথার উত্তরে একশো কথা শুনিয়ে দিত কিন্তু দর্শনের প্রতি ওর দুর্বলতা ওকে বলতে দিচ্ছে না। রুশান ওর দিকে চোখমুখ কুঁচকে তাকাল। দর্শন ধমক দিয়ে বলল,
“এখনো বসে আছিস কেন? প্যান্টে কী আঠা লাগানো? উঠতে পারছিস না?”
রুশান দ্রুত বসা থেকে উঠে গেল তারপর বলল,
“হ্যা, অনেক বিদ্যাসাগর হয়ে গেছো।”
অর্ষা মনে মনে বলছে,
“শুধু তাই না? বিদ্যার সাগরে ডুবে যাচ্ছে। ভাব কত!”

রুশান যেতে যেতে দর্শনকে অর্ষার ফেসবুক আইডি দেখাল।
“দোস্ত, দেখ ডিপিতে কত সুন্দর একটা পিক দেওয়া। জিন্স-টপ্সে ওকে সেই লাগছে।”

দর্শন বিস্ময় নিয়ে বলল,
“ওর আইডিও পেয়ে গেছিস?”

“মাত্রই নিয়ে এলাম৷ তারপর রাতভর জমিয়ে আড্ডা গল্প করব। এভাবে একদিন পটিয়ে ফেলব।”

দর্শন অর্ষার পিকটা দেখছিল। রুশানের কথা শুনে আবারও মেজাজ বিগড়ে গেল। ওর হাত থেকে মোবাইলটা নিয়ে অর্ষাকে ব্লক লিষ্টে রেখে দিল। রুশান চোখ বড়বড় করে চেয়ে রইল। কিছু বলতে গেলে দর্শন ওকে ধমক দিয়ে চুপ করিয়ে দিল।

ছুটির পর অর্পাকে দেখে দর্শন জিজ্ঞেস করল,
“তুই কি সত্যিই রুশানের সাথে ব্রেকাপ করেছিস?”

অর্পা রুশানের দিকে চেয়ে মুখ ভেংচি দিয়ে আবারও মুখ বাকিয়ে বলল,
“এই ঢেরসের সাথে যে এক বছর ছিলাম এটাই ওর ভাগ্য। আমার মতো মেয়ে এই জীবনেও পাবে না।”
রুশান দর্শনের দিকে চেয়ে বলল,”দেখেছিস কী ব্যবহার?”
দর্শনের ওর ব্যবহার দেখার দরকার নেই। ঘটনা যে সত্য এটা জেনেই ওর মাথা ঝিমঝিম করছে।
তাই দাঁতে দাঁত চেপে রাগে ফুসতে ফুসতে বলল,
“ও যে তোর পাতানো ছোট বোন অর্ষার সাথে লাইন মারছে সেটা কি তুই জানিস?”
অর্পা চোখ বড়বড় করে বলল,
“কী? অর্ষা!!”
“হ্যা, অর্ষা।”
অর্পা চোখ লাল করে রুশানের দিকে তাকাল। রুশান ভয়ে চুপসে গেল।

চলবে……..

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here