#প্রেম_তুমি
ফাবিহা নওশীন
পর্ব-২৭
দর্শন অপরাধীর ন্যায় ওর দিকে চেয়ে আছে। ওর দৃষ্টি শান্ত, স্থির আর অনুতপ্ত। ভেতরটা দুমড়ে মুচড়ে যাচ্ছে। অর্ষাকে কতটা ক্ষত-বিক্ষত করেছে সেটা অনুভব করতে খুব একটা অসুবিধা হচ্ছে না।
“আমি স্বীকার করছি আমার পৃথিবীর একাংশ আমার স্বপ্ন কিন্তু এর মানে এই না যে তোমাকে সেই পৃথিবীর কোন জায়গা দেইনি। তুমি আমাকে পুরো পৃথিবী দিয়েছো বটে কিন্তু আমি একাংশ দেইনি এটা সত্য নয়। একদম সত্য নয়।”
অর্ষা আলতো হাসল। সে হাসিতে তাচ্ছিল্য, অবিশ্বাস, ব্যথা, আর অভিমান।
“তাই? যদি তাই হত তাহলে এমনটা তুমি কখনোই করতে না। আমি তোমার জন্য কি না করেছি। তুমি আমার জন্য কি করেছো?”
“দেখো আমি বুঝতে পারিনি যে আলিশা তোমাকে এভাবে হেনস্তা করবে। আমি বুঝিনি যে আমি ওর পাতা ফাঁদে পা দিয়ে ফেলেছি।”
“আমি বলেছিলাম, বলিনি তোমাকে? কিন্তু তুমি আমার কথার কোন দাম দেওনি। কুকুর বেড়ালকে মানুষ যেভাবে তাচ্ছিল্য করে ঠিক তেমন ভাবেই করেছো। আমার সাথে যা নয় তাই ব্যবহার করেছো। করোনি?”
অর্ষা রাগে ফেটে যাচ্ছে। কথা বলতে পারছে না আর।
“হ্যা করেছি। কিন্তু আমি সত্যিই বুঝতে পারিনি আলিশা….”
দর্শনের কথা শেষ না হতেই অর্ষা আবারও হাসল। এই হাসির মানে দর্শন বুঝতে পারল না। অর্ষা এভাবে কেন হাসল? অর্ষার দিকে জিজ্ঞাসুক দৃষ্টিতে তাকাল। দর্শনের দৃষ্টি দেখে অর্ষা প্রশ্ন করল,
“কেন হাসছি? হাসছি তোমার কথা শুনে। ট্রাস্ট মি হাসি পাচ্ছে। তুমি এখনো বুঝতেই পারোনি আমার দগ্ধতার কারণ কী? তোমার ভুল কী? কন্টিনিউয়াসলি আলিশাকে দোষ দিয়ে যাচ্ছো। নিজের দোষটা দেখছো না। অপমান তো এই প্রথম হইনি। এর আগে অনেকবার তোমার জন্য অপমানিত হয়েছি। তুমি নিজেও আমাকে অনেকবার অপমান করেছো। করোনি? সব হজম করে নিয়েছি। কিছুই মনে করিনি। মুহুর্তেই ভুলে গেছি। বাট লাস্ট টাইম যা করেছো আই কান্ট ফরগেট। আমি অসভ্য হতে পারি, আমার ম্যানার নেই কিন্তু আত্মসম্মান আছে আর সেটাও লাস্ট টাইম তোমার জন্য বিসর্জন দিয়েছি। আর তুমি সেখানেও শুধুমাত্র নিজের কথা ভেবেছো। নিজের পড়াশোনা, নিজের ক্যারিয়ার। এর বাইরে তোমার চোখে কিছুই পড়ে না। কখনো পড়বে না সেটাও বুঝতে পেরেছি। আমার জন্য তোমার পড়াশোনায় ক্ষতি হচ্ছে, আমার জন্য তোমার পরীক্ষা খারাপ হচ্ছে, আমি তোমার লাইফে আসার পর থেকে তোমার লাইফ ডেস্ট্রয় হয়ে যাচ্ছে। আমাকে আর চাও না সেটা মুখে বলে দিলেই তো পারো। এত নাটকের কী দরকার? আমি হব না আর তোমার পথের বাঁধা।”
দর্শন অর্ষার হাত ধরল। অর্ষা ছটফট করলে দর্শন আরো শক্ত করে ধরল ওর হাত।
“আমি কখনো তোমাকে কোন কিছুর জন্য দায়ী করেছি? তবে কেন মনগড়া কথা বলছো? হ্যা, আমার পরীক্ষা খারাপ হচ্ছে। আমি আগের মতো মনোযোগী নই। এটা আমার দোষ, আমার অবহেলার পরিনতি, এর জন্য কেউ দায়ী না একমাত্র আমি ছাড়া।”
“হ্যা, তারপরেও আলিশার ফাঁদে পা দিয়ে দিলে? তারপরেও মনে হলো আমার জন্য তোমার ক্ষতি হবে। আমার জন্য তুমি বহিষ্কার হবে।”
দর্শন আর সত্যতা চেপে রাখতে পারছে না। ওর হাত ছেড়ে ঘুরে দাঁড়াল। হাতের মুঠোয় সামনের দিকের চুলগুলো পুড়ে নিজেকে শান্ত করল। তারপর অর্ষার দিকে ঘুরল। ঘুরে ডান হাতে ডান ভ্রু চুলকে নিজেকে ধাতস্থ করে বলল,
“আমি আমার জন্য কিছু করিনি। আমি যা করেছি সব তোমার জন্য করেছিলাম। আমাকে কলেজ থেকে বহিষ্কার করা হবে এটা মিথ্যে ছিল। আমি জাস্ট তোমাকে রাজি করানোর জন্য মিথ্যা বলেছি। আলিশা তো তোমাকে……
” তুমি আমাকে মিথ্যা বলেছে? তুমি আমাকে মিথ্যা বলেছে?”
প্রথম বার আস্তে বললেও পরে চিৎকার করে বলল।
দর্শন মাথা নুইয়ে ধীরস্থির গলায় বলল,
“হ্যা।”
অর্ষা রাগে ফেঁটে যাচ্ছে। রাগ শুধু দর্শনের প্রতি না, নিজের প্রতিও হচ্ছে। প্রচন্ড রাগ হচ্ছে। দু’হাতে নিজের চুল নিজেই খামচে ধরে চিৎকার করল।
“তুমি আমাকে মিথ্যা বলে এসব করতে বাধ্য করেছো। অনেক কনফিডেন্স ছিল তোমার। তুমি জানতে অর্ষা একদম নাদান একটা মেয়ে। যা বলব তাই করবে। বোকা কি-না। তার উপর এত্ত এত্ত ইমোশনাল। সহজেই ওকে দিয়ে যেকোন কাজ করানো যাবে। এরই ফায়দা তুলেছো? রাইট? অফকোর্স! কি বোকা আমি? সবটা দিয়ে পাগলের মতো ভালোবাসলে তাকে সত্যিকার অর্থে পাগল ভাবা হয়? আর পাগল দিয়ে তো সব করানো যায়। তাই না?”
দর্শন ওকে শান্ত করার চেষ্টা করছে।
“অর্ষা তুমি আমাকে আবারও ভুল ভাবছো। তুমি যেমন ভাবছো তেমন নয়। আই রিয়েলি লাভ ইউ এণ্ড রেস্পেক্ট ইউ।”
“রেস্পেক্ট? লাভ? এগুলো তোমার মুখে মানায় না। যেখানে বিশ্বাস নেই সেখানে ভালোবাসা নেই। যেখানে ভরসা নেই সেখানে রেস্পেক্ট নেই। ইউ আর এ লায়ার। আই হেইট ইউ। আই হেইট ইউ দর্শন। ইউ ব্রোক মি টু পিচস। ইউ ইউল নেভার কাম বিফোর মি, প্লিজ।”
অর্ষার চোখ বেয়ে উষ্ণ জলের ফোঁটা পড়ছে। মুখ চেপে ধরে কান্না থামানোর চেষ্টা করছে। দর্শন স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। অনুভূতিগুলো শূন্যে ভাসমান।
অর্ষার নিজেকে পাগল মনে হচ্ছে। ও এলোমেলো ভাবে হাঁটছে। কি চেয়েছিল এই রিলেশন থেকে? লোয়েল থাকা, একে অপরকে বিশ্বাস করা, ভরসা করা, কখনো না ঠকানো। মনের যত্ন করা আর পাগলের মতো ভালোবাসা। যে ভালোবাসা সব কিছুর ঊর্ধ্বে। কিন্তু এই ভালোবাসা ওকে শুধু নিচু করেছে। অপমানিত করেছে। ভালোবাসার মানুষ সব সময় ওকে ছোট করেছে, তুচ্ছ করেছে। এমনটা তো চায়নি। তবে কেন এমন হলো? আর পারছে না দম বন্ধ হয়ে আসছে। অস্থির লাগছে। গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেছে। বুকের ভেতরটা কেমন করছে। অসহ্য যন্ত্রণা।
—————–
রাত বারোটা। এই গভীর রাতে প্রেমিক-প্রেমিকা প্রেম বার্তায় মেতে থাকে। বাড়তে থাকে অনুভূতির ছড়াছড়ি। দর্শন বইয়ের উপর মাথা রেখে শুয়ে আছে। বইয়ের পাতা ওর চোখের পানিতে ভিজে একাকার। এক পাতা আরেকটা পাতার সাথে লেপ্টে আছে। দর্শন সেদিকে নির্বিকার। কিছুক্ষণ আগে ওর মা এসে মাথায় হাত বুলিয়ে বলে গেছে, ভালো রেজাল্ট করা চাই। সামনে তোমার জন্য সুন্দর ভবিষ্যৎ অপেক্ষা করছে। আমাদের এতদিনের পরিশ্রম। তোমার প্রতি ভরসা সবটার মান রাখবে আশা করি। সামনে সুন্দর একটা দিন তোমার জন্য অপেক্ষা করছে। আর সেই দিনের জন্য তোমাকে পরিশ্রম করতে হবে আরো এবং আরো। মন দিয়ে পড়। কোন সমস্যা হলে নির্বিঘ্নে জানাবে। আমরা সর্বত্র দিয়ে সমাধান করার চেষ্টা করব। তোমার বাবা-মা দু’জনেই ডক্টর ইউ নো।
বাবা-মায়ের এত এত এক্সপেকটেশন আর নিজের পার্সোনাল লাইফের এত এত প্রব্লেম সব মিলিয়ে হতাশায় নিমজ্জিত দর্শন। না পড়াশোনার অবস্থা ভালো আর না ওর লাভ কন্ডিশন ভালো। অর্ষা ওকে ভুল বুঝে আছে। যতদিন পর্যন্ত না ওকে মাফ করবে ততদিন ওর শান্তি নেই। পড়াশোনার অবস্থাও শোচনীয়। কিভাবে কোনটা শুরু করবে বুঝতে পারছে না। সন্ধ্যা থেকে জাস্ট বই খুলে বসে নিজের হতাশাগ্রস্থ জীবনের হিসাবনিকাশ করেছে। পড়া হয়নি কিছু। হবেই বা কি করে। এতকিছু জমে গেছে যে কোনটা রেখে কোনটা সলভ করবে বুঝতে পারছে না। মাথা কামড়াচ্ছে। মনে হচ্ছে মাথার ভেতর অনেকগুলো পোকা জড়ো হয়ে কুটকুট করে কামড়ে মাথাটা খেয়ে ফেলছে। ভীষণ যন্ত্রণা হচ্ছে।
বারবার কল করছে অর্ষাকে। কিন্তু নাম্বার বন্ধ আসছে। ফেসবুক, হোয়াটসঅ্যাপ কোথাও নেই। যদি একটু কথা বলতে পারত। যদি বলতে পারত নিজের শোচনীয় অবস্থার কথা। একটু যদি শেয়ার করতে পারত তবে মনটা শান্ত হত।
চলবে_______