- #যেদিন_তুমি_এসেছিলে
#পর্ব_১৬+১৭
#মুন্নি_আক্তার_প্রিয়া
________________
কেয়া বাড়ি ফেরার পর থেকে গম্ভীর হয়ে আছে। কারও সাথে কোনো কথা বলছে না। আহনাফের সাথে কেয়ার বিয়ে ঠিক হয়েছে খবরটা শুনে অর্ষা খুবই খুশি হয়েছে। কিন্তু কেয়ার অভিপ্রায় কিছুই বুঝে উঠতে পারছে না সে। এমতাবস্থায় কিছু যে জিজ্ঞেস করবে সেটাও তার সাহসে কুলাচ্ছে না।
সকাল আনুমানিক দশটা বাজে। রুহুল আমিন অর্ষাকে শো-রুমে যেতে বারণ করেছে কিছুদিন। এজন্য সে নিজে গিয়ে বোনের ছুটির জন্য কথা বলেছেন। বিয়ের বাড়ি। কাজের তো শেষ নেই। এই সময়ে বাড়িতে অর্ষার প্রয়োজনটা অত্যাধিক। আহনাফের ছুটিও কম। এরপর আবার দেশে ফিরতে অনেক দেরি হবে। তাই বিয়েটা এখনই সেরে ফেলতে চাচ্ছে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব। রুহুল আমিন একটু গাঁইগুঁই অবশ্য করছিল প্রথমে, পরে জহির চৌধুরী তাকে আশ্বস্ত করে বলেছেন, টাকার জন্য সে সাহায্য করবে। এই প্রস্তাব রুহুলের কাছে অনেকটা চাঁদ হাতে পাওয়ার মতোই। তাই তাড়াহুড়ায় বিয়েতে তার কোনো আপত্তি নেই।
অর্ষা তিয়াসকে কোলে নিয়ে কেয়ার কাছে যায়। কেয়া একটু আগে ঘুম থেকে উঠেছে কিন্তু এখনো বিছানা ছাড়েনি।
অর্ষা জিজ্ঞেস করল,’উঠো না কেন?’
‘উঠব।’
‘সেই কখন তোমার ঘুম ভেঙেছে! এখনো তুমি শুয়েই আছো। তোমার কি মন খারাপ?’
‘না, তো। মন খারাপ হবে কেন?’
‘না, এমনি বললাম।’
কেয়া অর্ষার হাত ধরে বিছানায় বসায়। অর্ষা হেসে বলে,’আহনাফ ভাইয়ার সাথে তোমাকে দারুণ মানাবে।’
‘তাই?’
‘অবশ্যই।’
‘আচ্ছা উনাকে তোর কেমন লাগে?’
‘কেমন লাগবে? উনি মানুষটা ভালো। জানো, আমার চার বান্ধবীই কিন্তু তার প্রতি চরম লেভেলের ক্রাশ খেয়েছিল।’
কেয়া হেসে বলে,’তাই নাকি? তুই ক্রাশ খাসনি?’
‘ধুর যা! তুমি খুব ভালো করেই জানো আমি কেমন। স্কুল লাইফে শুধু তুষারকেই আমার ভালো লেগেছিল। আর সেই ভালোলাগাও তো ভাইয়ার মাইর খেয়ে পালিয়ে গেল। কিন্তু তুমি হঠাৎ এসব প্রশ্ন করছ কেন? উনাকে কি তোমার পছন্দ হয়নি? তুমি এই বিয়েতে রাজি নও?’
কেয়া অর্ষার গাল টেনে দিয়ে বলল,’আমি রাজি।’
অর্ষার মনের ওপর থেকে যেন ভারী পাহাড় সরে গেল। এতক্ষণ কেয়ার গম্ভীর মুখ দেখে মনে কিন্তু কিন্তু একটা ভাব ছিল। এখন আর সেটা নেই। সে মনেপ্রাণে চায় কেয়া সুখী হোক। আর সে আহনাফকে যতটুকু চেনে বা জানে, নিঃসন্দেহে কেয়া তার সাথে ভালো থাকবে। আহিলের ভাই বলে বিশ্বাসটা যেন একটু বেশিই!
.
একদিন কেটে গেছে বিয়ের বন্দোবস্ত করতে করতেই। ভারী, জাঁকজমক অনুষ্ঠান আহনাফের অপছন্দ। তাই সে জাঁকজমকহীনভাবে বিয়ে করতে চেয়েছিল। কিন্তু বাড়ির বড়ো ছেলের বিয়ে বলে কথা। আমেনা বেগম অনুষ্ঠান ছাড়া ছেলেকে বিয়েই করাবেন না। জহির চৌধুরীরও এক মত। তাদের এক কথা হয়তো আয়োজন তেমন করবে না, তবে অনুষ্ঠান করবেই করবে। এটা নিয়ে বাড়িতে একচোট কথা কাটাকাটি হয়েছে; যার রেশ এখনো পর্যন্ত রয়েছে।
ইতিমধ্যে দূর-দূরান্ত থেকে অনেক আত্মীয়-স্বজন চলে এসেছে। বাকিরা আজ রাতের মধ্যেই চলে আসবে। যেহেতু বিয়েটা অতি তাড়াহুড়া এবং কালকেই হবে তাই দেরি করার উপায় নেই। হয়তো আরো কিছুদিন সময় নেওয়া যেত; তবে ফুপু, মামা, খালা এরা ছাড়াও বাকি কাছের আত্মীয়রা যখনই আহনাফের বিয়ের খবর শুনেছে তখনই পইপই করে বলে দিয়েছে বিয়ের পর নতুন বউকে নিয়ে যেন অবশ্যই তাদের বাড়িতে আসে। এদের আবার ছেলে-মেয়েদের শ্বশুরবাড়িও রয়েছে। সকলের বাসায় আলাদা আলাদা বেড়াতে গেলেও মিনিমাম সাতটা দিন এক্সট্রাভাবে হাতে রাখতে হবে। আর এরা এতটাই কাছের আত্মীয় যে কারও দাওয়াত মুখের ওপর ফিরিয়ে দেওয়ার উপায় নেই। অগত্যা বিয়ের ডেটও একদম কাছাকাছি ফেলেছে।
বড়ো খালামনি, ছোটো খালামনি এরা এসেছে একটু আগেই। আর আসতে না আসতেই আমেনা বেগমের বিলাপ শুরু হয়ে গেছে।
আহনাফের জেদের কথা বোনদের শুনিয়ে বলেন,’আমার আদরের ছেলে বাবু জানিসই তো! ওর বিয়েতে নাকি অনুষ্ঠান করতে পারব না। তোরাই বল এটা কোনো কথা? আমরা তো বাবা-মা। আমাদেরও তো শখ-আহ্লাদ আছে। ছোটো ছেলে একটা আছে। ও কবে বিয়েশাদী করে তার কোনো ঠিক-ঠিকানা নেই। ততদিন বাঁচি নাকি মরি সেটা কে জানে বল?’
আহনাফ পাশেই সোফায় বসে ছিল। মূলত ড্রয়িংরুমে এসেছিল শপিং-এ যাবে বলে। কিন্তু মা তো কিচ্ছা-কাহিনি শুরু করে দিয়েছে।
খালামনিরা আহনাফের ওপর খুবই অসন্তুষ্ট হলেন। অসন্তোষ হয়ে বললেন,’এগুলো আবার কী কথা বাবা? তোর বাপের কি টাকার আকাল পড়ছে?’
আহনাফ নিরুত্তর। সে জানে, তার বারণে কিছু যায় আসবে না। অন্তত বিয়ের আয়োজনের ব্যাপারে না। বাবা যে কমিউনিটি সেন্টারও ভাড়া করে ফেলেছেন এবং বেশ জাঁকজমকপূর্ণ আয়োজন করেছেন সে কথা ইতিমধ্যে তার কানে চলে এসেছে।
আহিল বোধ হয় আহনাফের ভাবমূর্তি বুঝতে পারল। তাই সে মায়ের উদ্দেশ্যে বলল,’মা, সময় তো চলে যাচ্ছে। কখন শপিং করতে যাবে আর কখন ফিরবে। তোমাদের মেয়েদের তো শপিং করতেও কম সময় লাগে না।’
কথা সত্য। মেয়েদের শপিং করার প্রসঙ্গ মানেই ধৈর্যের ব্যাপার। তারমধ্যে বিয়ের শপিং বলে কথা! তিনি গল্পের আসর ছেড়ে উঠে গেলেন। বোনদের বললেন বিশ্রাম নিতে। এই বাড়ি থেকে আমেনা বেগম, আহনাফ আর আহিল যাচ্ছে শপিং-এ। জহির চৌধুরী বিয়ের আয়োজন ঘটিত বিষয় নিয়ে ব্যস্ত তাই শপিং করতে যাওয়ার সময় নেই তার। যাওয়ার সময় ওরা কেয়া আর অর্ষাকে নিয়ে যায়।
শপিংমলে গিয়ে অর্ষা হা করে তাকিয়ে থাকে। চারদিকে এত ঝলমলে আলো। বিয়ের ভারী লেহেঙ্গা, শাড়িগুলো চিকচিক করছে।
অর্ষা অস্ফুটস্বরে বলে,’কী সুন্দর!’
আমেনা বেগম কেয়াকে জিজ্ঞেস করলেন,’বিয়েতে কী পরবে? লেহেঙ্গা নাকি শাড়ি?’
কেয়া সলজ্জিত হেসে বলল,’আপনাদের ইচ্ছে।’
‘ওমা! মেয়ে বলে কী! বিয়ে তুমি করবে। তোমার ইচ্ছে বলো।’
পাশ থেকে আহিল বলে,’নিয়ে নাও আপু। থুক্কু ভাবি! এই সুযোগ কিন্তু বারবার আসে না মেয়েদের।’
কেয়া তবুও বলল,’আপনাদের যা ভালো লাগে।’
আমেনা বেগম অর্ষাকে বললেন,’বলো তো অর্ষা মা, কেয়ার জন্য কী নেওয়া যায়?’
অর্ষা খুটিয়ে খুটিয়ে সব পোশাক দেখছিল। আচমকা প্রশ্নের বাণ তার দিকে আসায় সে একটু অপ্রস্তুত হয়ে পড়ে। অপ্রস্তুতভাবে হেসেই বলল,’আপনার ইচ্ছা।’
তিনি এবার হেসে ফেলেন। ছেলেদের দিকে তাকিয়ে বলেন,’দুজনে একইরকম। আহনাফ, তুই বল কী নেব?’
আহনাফও বলল,’ইচ্ছে। তবে লেহেঙ্গায় মনে হয় বেশি ভালো লাগবে।’
‘হ্যাঁ, ভাইয়া। আমিও এটাই বলি।’ আহনাফের সাথে সহমত পোষণ করল আহিল।
আমেনা বেগম বললেন,’তাহলে লেহেঙ্গাই নেব।’
এরপর তিনি আহনাফ এবং আহিলকে নিয়ে অনেকগুলো লেহেঙ্গা থেকে একটা লেহেঙ্গা পছন্দ করে ক্রয় করলেন। লেহেঙ্গা দেখে অর্ষা কেয়াকে ফিসফিস করে বলে,’আপু লেহেঙ্গাটা দেখেই বোঝা যাচ্ছে অনেক ভারী! সামলাবে কীভাবে বলো তো?’
কেয়াও ফিসফিস করে বলল,’এখন চুপ কর।’
আমেনা বেগম এখন শাড়ি দেখছেন। তিনি কেয়া আর অর্ষাকে বললেন,’শাড়ি নিজেরা পছন্দ করে নাও।’
কেয়া শাড়ি নেড়েচেড়ে দেখতে লাগল। অর্ষা চুপ করে বসে ছিল। তিনি বললেন,’তোমাকেও বলেছি পছন্দ করতে।’
অর্ষা হেসে বলল,’আমার লাগবে না।’
‘লাগবে নাকি লাগবে না সেটা আমি দেখব। তুমি পছন্দ করো।’
‘ঐ সবুজ শাড়িটা দেখি তো!’ একইসাথে দুই ভাই সেলসম্যানকে সবুজ শাড়িটার কথা বলে মুখ চাওয়া-চাওয়ি করল।
আহিল হেসে বলল,’আচ্ছা তুমিই দেখো।’
আহনাফ বলল,’না, থাক। তুই দেখ।’
‘তোমার বিয়ে। আজ তোমার জন্য সব ছাড়।’
‘এত ছাড় দেওয়া লাগবে না। তুই দেখ।’
‘আরে না ভাইয়া। আমি অর্ষার জন্য দেখতে চেয়েছিলাম। তুমি দেখো।’
আমেনা বেগম বললেন,’সমস্যা নাই। এক রকম শাড়ি দুইটা নেব।’
সেলসম্যান দুঃখী দুঃখী কণ্ঠে জানাল,’স্যরি ম্যাম। এই শাড়ি একটাই।’
আহনাফ আহিলের কাঁধ চাপড়ে বলল,’শাড়িটা অর্ষাই নেবে।’
অর্ষা সাথে সাথে মাথা নাড়িয়ে বলল,’না, না। শাড়িটা কেয়া আপু নেবে।’
এবার কেয়া বলল,’শাড়িটা তুই-ই নিবি।’
ছোটোখাটো ঝগড়া, কথা কাটাকাটি কেয়া ও অর্ষা এবং আহনাফ ও আহিলের মাঝে হয়ে গেল। আমেনা বেগম অসহায় দৃষ্টিতে ওদের মিষ্টি ঝগড়া দেখছেন। শেষমেশ আহনাফ ওর ভাইয়ের ওপর রাগ হয়ে সেলসম্যানকে বলল,’ভাইয়া শাড়িটা দিন তো।’
সেলসম্যান শাড়িটা আহনাফের হাতে দিলো। আহনাফ শাড়ি নিয়ে অর্ষার কোলের ওপর রেখে বলল,’শাড়িটা আমি তোমায় বিয়েতে উপহার দিলাম। খবরদার! কোনো বাহানা করবে না।’
কেয়াও অর্ষার হাত চেপে ধরল যেন আর কিছু না বলে। আসলে আহনাফ এমনভাবে বলল যে অর্ষাও আর মুখের ওপর বারণ করতে পারল না। শপিং করতে করতে প্রায় অনেক রাত হয়ে যায়। এত শপিং নিয়ে রেস্টুরেন্টে বসে খাওয়া সম্ভব নয় বলে সব গাড়িতে রাখে। আহিল আর আহনাফ গিয়ে সকলের জন্য খাবার নিয়ে আসে এবং গাড়িতে বসেই খায়।
গাড়িতে ওঠার সময় আহিল অর্ষাকে বলল,’ওড়না সরা। গাড়ির চাকায় লাগবে তো।’ বলে সে নিজেই ওড়নাটা সরিয়ে দিলো।
অর্ষা তখন আহিলের শার্ট ধরে টেনে কাছে আনে। ফিসফিস করে বলে,’কেন তুই আমার জন্য শাড়িটা পছন্দ করতে গেলি?’
আহিলও ফিসফিস করে বলল,’আমি কি জানতাম নাকি ভাইয়াও শাড়িটা পছন্দ করবে? এনিওয়ে শাড়িটা কিন্তু আসলেই সুন্দর। তোকে অনেক মানাবে। আমাকে তো ধমক দিলি। ভাইয়াকে থ্যাংকস দিস বুঝলি।’
এরপর আহিল হেসে সামনে গিয়ে বসে। অর্ষাদের বাড়িতে পৌঁছে দিয়ে শপিং এর ব্যাগ সব বাড়ির ভেতর দিয়ে যায় আহনাফ এবং আহিল। আর সত্যি সত্যই আহনাফ চলে যাওয়ার সময় অর্ষা পিছু ডেকে বলল,’থ্যাঙ্কিউ শাড়িটা গিফ্ট করার জন্য।’
আহনাফ মুচকি হেসে বলল,’মোস্ট ওয়েলকাম।’
এত এত শপিং এবং নিজের জন্যও এত দামী শাড়ি, গয়না দেখে কুসুম ভীষণ খুশি হয়। তার জন্যও যে এতকিছু কেনাকাটা করা হবে এটা সে স্বপ্নেও ভাবেনি।
.
.
আজকের সকাল অন্যরকম সুন্দর। চারদিকে শুধু আনন্দের সমাহার। ভোর থেকেই অর্ষা বাকি সবার সাথে কাজে লেগে পড়েছে। সকালে গায়ে হলুদ এবং রাতে বিয়ে। হলুদের জন্য আলাদা করে কোনো অনুষ্ঠান করবে না বলে নিয়ম রক্ষার জন্য সকালে হলুদ মাখানো হবে। নিয়ম রক্ষাটা আসলে শুধু কেয়াদের বাড়িতেই হয়। আহনাফের বাড়িতে ওর কাজিনমহল, ভাই, বন্ধুবান্ধব মিলে বাড়ির ছাদেই গায়ে হলুদের জন্য বিশাল আয়োজন করেছে। সঙ্গে নাচ-গান তো আছেই।
সকাল দশটা নাগাদ অর্ষার বাসায় আসে গ্যাঞ্জাম পার্টির সকলে। অর্ষাকে তাড়া দিয়ে বলে,’চল।’
অর্ষা ভ্রুঁ কুঞ্চন করে জানতে চায়,’কোথায়?’
উত্তরে লামিয়া বলল,’আহিলদের বাসায়। আহনাফ ভাইয়ার তো বেশ জাঁকজমকভাবেই গায়ে হলুদ হচ্ছে। কেয়া আপুর তো হলুদ মাখানো শেষ। আমরা এখন ঐ বাড়িতেই যাব।’
‘পাগল নাকি তোরা? আমি কেন যাব? তোরা যা।’
দিদার বলল,’ঢং! তুই কেন যাবি মানে কী? আফরিন আপুর বিয়েতে কেন গেছিলি? আহিলের বোন বলেই তো? তাহলে এখন আহনাফ ভাইয়ার হলুদে কেন যাবি না? নিজের বেয়াইনের সাথে বিয়ে হচ্ছে বলে এত অনিয়ম?’
অর্ষা অসহায়কণ্ঠে বলল,’তোরা বুঝতে পারছিস না। বাড়িতে অনেক কাজ পড়ে আছে।’
‘এখন কাজ করার জন্য অনেক মানুষজনও আছে। তুই চল তো!’
রুহুল সেসময়ে পাশ দিয়েই যাচ্ছিল। আশিক ও’কে ডেকে বলল,’ঐ ভাইয়া শুনো।’
রুহুল ব্যস্তভাবে এগিয়ে এসে বলে,’কী হয়েছে? তাড়াতাড়ি বল। কত কাজ পড়ে আছে আমার জানিস।’
জুঁই বলল,’আমরা আহিলের বাসায় যাব ভাইয়ার হলুদে। অর্ষাকেও নিয়ে যাব।’
রুহুল এক কথাতেই রাজি হয়ে বলল,’আচ্ছা নিয়ে যা। কিন্তু তাড়াতাড়ি আসিস। বিকেলে কিন্তু কেয়াকে পার্লার থেকে সাজাতে আসবে। আমাদের সবাইকে আবার কমিউনিটি সেন্টারে যেতে হবে।’
রেশমি বলল,’তুমি কোনো চিন্তা কোরো না ভাইয়া। আমরা তাড়াতাড়ি চলে আসব।’
রুহুল হেসে বলল,’ঠিক আছে।’
ভাইয়া পারমিশন দিয়ে দিয়েছে এখন আর গ্যাঞ্জাম পার্টিকে পায় কে। ওরা অর্ষাকে বগলদাবা করে ঐ বাড়িতে নিয়ে যায়। গায়ে হলুদেও যে এত মানুষ হতে পারে সেটা ধারণার বাইরে ছিল ওদের। এখানের অর্ধেক মানুষজন তো আহিলদের আত্মীয়-স্বজনই। আহিলই এসে ওদেরকে ছাদে নিয়ে যায়। সুযোগ পেয়ে আহনাফের কাজিন ও বন্ধুরা ওদেরকে হলুদ মাখিয়ে ভূত বানিয়ে দেয় আর বলে,’বেয়াই-বেয়াইনদের সাথে হলুদ হলুদ না খেললে কি হয়?’
আশিকের অবস্থা নাজেহাল। সে চোখ মেলেই তাকাতে পারছে না। এক চোখ দিয়ে পিটপিট করে তাকানোর চেষ্টা করে বলে,’সুখে থাকতে কিলাইছিল ভূতে, এজন্যই আসছিলাম হলুদ দিতে।’
জুঁই চোখমুখ শক্ত করে বলে,’ম’রতে গেলেও তোর কবিতা বলা বন্ধ হবে না।’
বাড়ি ফেরার সময়ে আহিলকে আর খুঁজে পাওয়া গেল না। বেশি দেরি করা যাবে না বলে, আহনাফ আর আমেনা বেগমকে বলেই ওরা বাড়িতে চলে যায়। অর্ষা বাড়িতে ফিরতে ফিরতে পার্লারের মেয়েরা সাজাতে চলে এসেছে। এরা বেশ নামিদামি পার্লারের লোক। অবশ্য হবেই না বা কেন? জহির চৌধুর বড়ো ছেলের বিয়ে বলে কথা! তিনিই তো ওদের হায়ার করেছেন।
মেয়েরা সব লাইন ধরে মেহেদী দিচ্ছিল। পার্লার থেকে সর্বমোট ৬ জন মেয়ে এসেছে। এরা কাজে যে কতটা দক্ষ ও পটু সেটা ঝটপট মেহেদী দেওয়া দেখেই বোঝা যাচ্ছে। এবং ডিজাইনও যে নিঃসন্দেহে অনেক বেশি সুন্দর সেই বিষয়েও কোনো সন্দেহ নেই।
কেয়া অর্ষাকে দেখে বলল,’এতক্ষণ লাগে তোর আসতে? বোস এখানে।’
অর্ষা পাশে বসল। কেয়া পার্লারের মেয়েটিকে বলল,’এইটুকু দিলে তো আমার মেহেদী দেওয়া শেষ। এরপর ও’কে দিয়ে দেবেন।’
‘ইশ না! আমি মেহেদী দেবো না। আমার ভালো লাগে না।’ মুখ বাঁকিয়ে বলল অর্ষা।
কেয়া ধমক দিয়ে বলল,’চুপ! এত নিরামিষ কেন তুই? আমার বিয়ে সূতরাং আমার কথা রাখতে হবে।’
‘আমার ভাল্লাগে না তো!’
‘চলেই তো যাব আজ। রাখবি না আমার কথা?’
অর্ষা দীর্ঘশ্বাস নিয়ে বলে,’পেয়েছ তো এক অজুহাত! আচ্ছা দেবো। হ্যাপি?’
কথার মাঝেই কেয়ার হাতে মেহেদী দেওয়া শেষ। এবার অর্ষার পালা। মেহেদী দিতে তার বিরক্ত লাগলেও চুপ করে বসে থাকে। মেহেদী শুকানো পর্যন্ত অপেক্ষা করা তো আরো বেশি বিরক্তের।
মেহেদী দেওয়ার পর শাড়ি পরা, সাজগোজ এসব করতে গিয়ে বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা হয়ে যায়। কুসুম একটু পরপর এসে তাড়া দিয়ে যাচ্ছে তাড়াতাড়ি রেডি হওয়ার জন্য।
এবারও এসে সে বলল,’হলো তোদের?’
কেয়া বলল,’হুম। শেষ।’
কুসুম অনেকক্ষণ পর্যন্ত তাকিয়ে থেকে বলল,’তোকে সুন্দর লাগছে।’
কেয়া মুচকি হাসল। কিছুক্ষণ বাদেই সবাই কমিউনিটি সেন্টারে চলে যাবে। এরমাঝে দুই গাড়ি ভর্তি লোকজন আগেই চলে গেছে। বারান্দায় দাঁড়িয়ে কথা বলছে কেয়া আর অর্ষা। কেয়া আজ শ্বশুরবাড়ি চলে যাবে এই দুঃখে কান্নাকাটি করেই অর্ষা শেষ। কেয়া বারবার ও’কে সান্ত্বনা দিয়ে বলছে,’আমাদের তো আবার দেখা হবে নাকি? তুই এভাবে কাঁদছিস কেন বল তো? মেকাপ নষ্ট হয়ে যাবে তো!’
রুহুল তখন বাইরে থেকে বাড়িতে আসে। অর্ষা আর কেয়াকে কাঁদতে দেখে বলে,’কী হয়েছে?’
কেউই কিছু বলল না। রুহুল কান্নার কারণ অনুমান করতে পেরে এই ব্যাপারে আর কিছু বলল না। সে অর্ষাকে বলল,’তোর ভাবি বাইরে আছে। তিয়াসকে গিয়ে নিয়ে আয় তো। জ্বালাচ্ছে খুব।’
অর্ষা চোখের পানি মুছে বাইরে চলে যায়। গাড়ি এখন একটা। বাকি আত্মীয়রা আগেই চলে গেছে। এখন সব বাচ্চারা আর কাজিনরা আছে। কুসুম ওদের সাথে চেঁচামেচি করছে। যাতে ওরা পরে যায়। ওরাও নাছোড়বান্দা ওরা এখনই যাবে। এদিকে আগের দুটো গাড়িও এখনো এসে পৌঁছায়নি। অর্ষাও ওদের বোঝাতে সক্ষম হয়নি। তাই সে গিয়ে রুহুলকে আবার এদিকে পাঠিয়ে দেয়।
গ্যাঞ্জাম পার্টির সকলে এসে পড়ে তখন। অর্ষাকে বলে,’বের হবি কখন?’
তিয়াস অর্ষার কোলে ঘুমিয়ে পড়েছে। অর্ষা ও’কে কোলে নিয়ে মৃদু ঝাঁকুনি দিতে দিতে বলল,’এইতো বের হব।’
রুহুল ওদেরকে বুঝিয়ে বাড়ির ভেতর ঢোকে। অর্ষাকে বলে,’যা কেয়াকে ডেকে আন। তোরা আগে চলে যা। গাড়ি আসতেছে। আমরা পোলাপান যা আছে ওদেরকে নিয়ে পরের গাড়িতে যাব।’
অর্ষা রুমে যায় কেয়াকে ডাকতে। কিন্তু কেয়া নেই। তিন রুমের এক রুমেও পাওয়া গেল না। ওয়াশরুমেও না। অদ্ভুত ব্যাপার! এবার সবাই মিলে খোঁজা শুরু করে। পুরো বাড়ি তন্ন তন্ন করে খুঁজেও কেয়াকে পাওয়া গেল না। ওর গায়ের লেহেঙ্গা, অলংকার সবকিছু বিছানার ওপর ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রাখা। কোথায় গেছে কেউ জানে না। তবে আহনাফদের দেওয়া একটা কিছুও যে নেয়নি সেটা একদম স্পষ্ট। ফোনও বন্ধ। রুহুল এবং কুসুমের দিশেহারা অবস্থা। কুসুম কাঁদছে। রুহুল মাথায় হাত দিয়ে বারান্দায় বসে পড়ে।
পরক্ষণে সে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে অর্ষার দিকে তাকায়। বসা থেকে উঠে এসে অর্ষাকে জিজ্ঞেস করে,’কেয়া কোথায়?’
অর্ষা কাঁদছিল। ভাইয়ের এহেন প্রশ্ন শুনে বিস্ময় নিয়ে তাকিয়ে থাকে। কেয়া কোথায় সেটা তো তার জানার কথা নয়। সে থতমত খেয়ে বলে,’আমি কীভাবে জানব?’
‘কেয়ার সাথে লাস্ট তুই-ই কথা বলছিস। তুই ছিলি ওর সাথে। বল কেথায় গেছে?’ রুহুল রেগে জিজ্ঞেস করে।
অর্ষা কাঁদতে কাঁদতে কাকুতি-মিনতি করে বলে,’ভাইয়া বিশ্বাস করো আমি সত্যিই জানিনা।’
‘জানিনা বললে তো শুনব না। ও কোথায় গেছে? পালিয়েছে? সত্যি করে আমায় বল। কার সাথে পালিয়েছে?’
‘আমি জানিনা।’
রুহুল এবার সজোরে একটা থা’প্পড় দিয়ে বলে,’তুই সব জানিস। তুই-ই ও’কে পালাতে সাহায্য করেছিস।’
অর্ষা মাথা নত করে দাঁড়িয়ে কাঁদতে থাকে। রুহুল রাগে হিতাহিত জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছে। একটু থেমে দম নিয়ে বলে,’তুই যখন ওকে পালাতে সাহায্য করেছিস। তখন ওর বদলে বিয়েটা তুই-ই করবি।’
অর্ষা চমকে তাকায়। কাঁদতে কাঁদতেই বলে,’আমি কেন উনাকে বিয়ে করব? আমি বিয়ে করব না।’
‘তোর কোনো কথাই শুনছি না। তোর সাথেই এখন আহনাফের বিয়ে হবে।’
রুহুল জহির চৌধুরীকে ফোন করার পূর্বে তিনিই খবর পেয়ে ছুটে এসেছেন। হন্তদন্ত হয়ে বাড়ির ভেতর প্রবেশ করে বলেন,’কী হয়েছে?’
রুহুল অপরাধীর মতো মাথা নত করে বলে,’কী থেকে কী হয়ে গেল বুঝতে পারিনি আঙ্কেল। কেয়া যে কেন চলে গেল, কোথায় চলে গেল কিচ্ছু জানি না আমি। ও এমন কিছু করবে সত্যিই বুঝতে পারিনি।’
জহির চৌধুরী কী বলবেন বুঝতে পারছেন না। তিনি বিমর্ষ হয়ে বললেন,’তুমি কি বুঝতে পারছ রুহুল? এটা শুধু বিয়ে নয়। আমার মান-সম্মানের বিষয়। আমার বড়ো ছেলের বিয়ে! কত আত্মীয়-স্বজন। অনুষ্ঠান, আয়োজন সবকিছু ভেস্তে যাবে। মান-সম্মান কি ফিরিয়ে আনা যাবে?’
‘কিচ্ছু হবে না আঙ্কেল। আপনাদের যদি কোনো আপত্তি না থাকে তাহলে আমার বোনকে আমি আহনাফের হাতে তুলে দিতে চাই। ও’কে তো আপনারা আরো ভালো করে চেনেন। নতুন করে ও’কে তো চিনতে হবে না।’
তিনি চিন্তিত হয়ে অর্ষার দিকে তাকিয়ে বললেন,’কিন্তু! অর্ষা কি রাজি হবে?’
কুসুম সাথে সাথে বলল,’ও রাজি। কোনো সমস্যা নেই। আহনাফ মানবে তো?’
‘কেয়া পালিয়েছে শুনে তো তোমার আন্টির মাথা নষ্ট হয়ে গেছে। কান্নাকাটি শুরু করে দিয়েছে। আহনাফের কানেও কথাটা চলে গেছে। জানোই তো আমার ছেলে কতটা ইন্ট্রোভার্ট। গম্ভীর হয়ে আছে। কোনো প্রতিক্রিয়া এখনো দেখায়নি। অর্ষার কথা আমেনাকে আমিও বলেছিলাম। তোমরা কী বলো না জেনেই আহনাফকে কিছু বলতে বারণ করেছি।’
রুহুল বলল,’আপনি আহনাফকে মানান। আমরা অর্ষাকে নিয়ে আসছি।’
.
কেয়া পালিয়েছে শুনে আহনাফ নিশ্চুপ হয়ে যায়। সে কষ্ট পেয়েছে। অপমানিত হয়েছে। বিয়ে না করে এভাবে যদি চলেই যাবে তবে আগেই কেন ‘না’ করল না? কেন বিয়েতে রাজি হয়ে শেষমেশ এভাবে তাকে এবং তার পরিবারকে সকলের সামনে অপদস্থ করল! এক ধাক্কা সামলাতে না সামলাতেই আরেক ধাক্কা খেল যখন বাবা এসে কেয়ার বদলে অর্ষার সাথে বিয়ের কথা বললেন। আহনাফ সঙ্গে সঙ্গে প্রস্তাব নাকচ করেছে। সে এই বিয়ে করতে রাজি নয়। কোনোভাবেই যখন আহনাফকে মানানো যাচ্ছিল না তখন জহির চৌধুরী বললেন,’এখন বাবা হয়ে কি আমি তোর পা ধরব বল? কেয়া পালিয়েছে এই খবর অলরেডি রটে গেছে। কেয়ার বদলে অর্ষার সাথে বিয়ে হবে এটাও এখন এক কান থেকে আরেক কানে চলে গেছে। এখন তুই যদি অর্ষাকে বিয়ে না করিস বুঝতে পারছিস কী অবস্থা হবে? আমার মান-সম্মান তো নষ্ট হবেই সাথে অর্ষারও!’
আহনাফ ক্ষেপে বলে,’অযথা তোমরা নির্দোষ মেয়েটাকে কেন শাস্তি দিচ্ছ বলো তো?’
‘আমরা কিছু করিনি। ওর ভাই-ভাবিই বলেছে। অর্ষাও রাজি। বাবা শুধু তুই রাজি হয়ে যা।’
বাবা-মা ও আত্মীয়-স্বজন এবং অর্ষার সম্মানের কথা ভেবে আহনাফ বিয়েতে রাজি হয়ে যায়। কেয়ার বদলে বউ সেজে এখন বসে আছে অর্ষা। পাথরের মূর্তির মতো হয়ে আছে। শুধু চোখ থেকে টপটপ করে পানি পড়ছে। কমিউনিটি সেন্টারে সবাই থাকলেও আহিল নেই। গ্যাঞ্জাম পার্টি আফরিনকে জিজ্ঞেস করে জানতে পারল, ছোটো ফুপি কানাডা থেকে সরাসরি এখানে আসবে। তাই আহিল ওদেরকে রিসিভ করতে গেছে। ওর জন্য আর অপেক্ষা করা গেল না। বিয়েটা হয়ে যায় অনাকাঙ্ক্ষিতভাবে।
চলবে…
#যেদিন_তুমি_এসেছিলে
#পর্ব_১৭
#মুন্নি_আক্তার_প্রিয়া
_________________
অসংখ্য উজ্জ্বল জ্যোতির মাঝে থেকেও চারিদিকে ঘোরতর শর্বরী দেখছে অর্ষা। নিকষ কালো আঁধারে যেন পুরো কমিউনিটি সেন্টার ছেঁয়ে আছে। হৈচৈ, কথাবার্তা তার কর্ণকুহরে পৌঁছালেও মস্তিষ্ক আহরণ করতে পারছে না। অকস্মাৎ জীবন নামের অধ্যায়টি যে এমনভাবে পরিবর্তন হয়ে যাবে, সেটা তো সে কল্পনাতেও ভাবেনি। তার অসাড় মস্তিষ্ক একটু বিশ্রাম চাইছে। একলা থাকার আরজি করছে। তবে অর্ষার এসব মুখ ফুটে বলার অবকাশ নেই।
লম্বা ঘোমটার আড়াল থেকেই সে কিছুটা মাথা উঁচু করে তাকায়। সামনে অনেক মানুষজন থাকলেও তার দৃষ্টি গিয়ে আটকায় গ্যাঞ্জাম পার্টির সদস্যদের দিকে। ওদের অসহায়, করুণ দৃষ্টি অর্ষার ওপরেই যে স্থির ও নিবদ্ধ; তা বুঝতে একটুও বেগ পেতে হয় না তাকে। টুপ করে কয়েক ফোটা অশ্রু তার গাল বেয়ে চিবুকে এসে ঢেকে। হাতের টিস্যু দ্বারা অশ্রু মোছার বৃথা চেষ্টা বেশ কয়েকবার করেছে। লাভ হয়নি। চোখের পানি আজ ফুরাচ্ছে না। বারবার অশ্রুপূর্ণ হয়ে যাচ্ছে তার আঁখিদ্বয়। অনাকাঙ্ক্ষিত সবকিছু আনন্দের হয় না। সুখের হয় না। অন্তত অর্ষা তো বাস্তবতা এবং নিজের জীবন দিয়েই সেটাই উপলব্ধি করতে পারছে। তার অবচেতন মন আহিলকে খুঁজছে। ও কেন নেই বিয়েতে?
অর্ষার নানাবিধ ভাবনার মাঝে আফরিন এসে পাশে দাঁড়ায়। একটু ঝুঁকে অর্ষার কানের কাছে বলে,’খিদে পায়নি? খাবে চলো।’
অর্ষার ঠোঁট ভেঙে কান্না পাচ্ছে। কথা বলতে গিয়ে টের পায় তার কণ্ঠও রোধ হয়ে রয়েছে। সে মুখে কিছু বলতে পারল না। শুধু দু’পাশে মাথা নাড়িয়ে বুঝে দিলো খাবে না।
আফরিন জোর করার সাহস পেল না। মেয়ে হওয়ার সুবাদে অর্ষার জায়গায় সে নিজেকে একবার কল্পনা করেছিল। এমন অপ্রত্যাশিতভাবে যদি তার বিয়ে হতো তাহলে সেও তো মানতে পারত না। তবে সে জানে, তার ভাই কোনো অংশে কম নয়। যেকোনো মেয়েই ভাগ্যবতী হবে তার ভাইকে স্বামী হিসেবে পেলে। কিন্তু তবুও! প্রতিটা মেয়েরই তো বিয়ে নিয়ে আলাদা শখ, স্বপ্ন, ইচ্ছে থাকে। অর্ষারও হয়তো ছিল। অর্ষার চেয়ে তার বেশি কষ্ট লাগছে ভাইয়ের জন্য। পছন্দ করা মানুষটা এভাবে ঠকিয়ে গেল? এই মুহূর্তে তার সব রাগ গিয়ে পড়ছে কেয়ার ওপর!
বিয়ে সম্পন্ন হওয়ার পরে যতটা আনন্দ, নাচ-গান হৈ-হুল্লোড় হওয়ার কথা ছিল ততটা না হলেও কম হয়নি। তবে যেই দুটো মানুষকে ঘিরে এত আয়োজন তারাই শুধু নিরব, নিশ্চুপ থেকে গেছে। বিয়ের আনন্দ নিতে পারেনি। একজন কান্নাকাটি করে হলেও নিজের দুঃখ প্রকাশ করতে পেরেছে। কিন্তু আহনাফ! সে তো মুখ ফুটে বলা দূরে থাক; কাউকে মনের কষ্টটাই বোঝাতে পারছে না।
আহিল ফুপিকে নিয়ে কমিউনিটি সেন্টারে উপস্থিত হয়। তখন ওর কাজিনরা নাচছিল। চারদিকে শুধু গানের শব্দ। একপাশে গ্যাঞ্জাম পার্টিকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে ও সেদিকে যায়। জহির চৌধুরী বোনকে অন্যদিকে নিয়ে যায়।
‘তোদের মুখ এমন ফাটা বেলুনের মতো লাগছে কেন? খেতে দেয়নি নাকি তোদের?’ পাঞ্জাবির কলার পেছনের দিকে টেনে কথাগুলো বলল আহিল। যা গরম পড়েছে!
রেশমি মুখ গোমড়া করে বলল,’খেতে দেবে না কেন? বিয়ের আগেই খেয়েছি আমরা।’
‘তোরা যে পেটুক সেটা আমি জানি। কিন্তু তুই মুখ গোমড়া করে রেখেছিস কেন? তোরও বিয়ে হবে। কাঁদিস না। বিয়ের আগেই যে খেয়ে বসে আছিস, এখন কি আমি একা খাব?’
ওরা একজন আরেকজনের দিকে মুখ চাওয়া-চাওয়ি করে বলল,’তোকে ছাড়াই বিয়ে হয়ে গেছে তুই জানিস?’
‘হু। আব্বু ফুপিকে ফোন করেছিল। কী সমস্যা নাকি হয়েছে তাই বিয়েটা তাড়াতাড়ি হওয়া দরকার। পরে ফুপু বলল, সমস্যা নেই। বিয়ে যেন দিয়ে দেয়। পৌঁছে তারপর কী হয়েছে শুনবে। কিন্তু কী সমস্যা হয়েছিল বল তো?’
একটু থেমে আশেপাশে তাকিয়ে বলল,’বাই দ্য ওয়ে, অর্ষা কোথায়?’
এবার সকলের মুখ পাংশু বর্ণ ধারণ করে। কী বলবে এখন তারা? ওর প্রাণপ্রিয় বান্ধবীর ওর-ই অনুপস্থিতিতে বিয়ে হয়ে গেছে?
‘কী হলো? অর্ষা কোথায়?’ সকলের মুখাবয়ব দেখে ফের প্রশ্নটি করল আহিল।
সেসময়ে আফরিন সেখানে এসে উপস্থিত হয়। আহিলের হাত ধরে বলে,’আমার সাথে আয়। কথা আছে।’
‘কোথায় যাব? এখানেই বল।’
‘এখানে অনেক শব্দ। আমার সাথে আয়।’
আহিল বন্ধুদের দিকে একবার তাকিয়ে আফরিনের সাথে একটু দূরে যায়। একপাশে দাঁড়িয়ে বলে,’বল কী বলবি।’
‘বিরাট সমস্যা হয়ে গেছে।’
‘সমস্যা কিছু হয়েছে শুনেছি। কিন্তু কী সমস্যা হয়েছে?’
‘কেয়া পালিয়েছে।’
আহিলের মুখ থেকে অস্ফুটস্বরে বেরিয়ে আসে,’হোয়াট!’
‘হ্যাঁ। কমিউনিটি সেন্টারে আসার কিছুক্ষণ আগে বাড়ি থেকেই পালিয়েছে।’
‘তাহলে ভাইয়ের পাশে ঘোমটা দেওয়া মেয়েটা কে?’
আফরিন ভয়ে ভয়ে বলল,’অর্ষা।’
আহিল বিস্মিত দৃষ্টিতে তাকিয়ে রয়েছে বোনের দিকে। বিশ্বাস হচ্ছে না। সে একটু হাসার চেষ্টা করে বলে,’তোরা কি আমার সাথে প্রাঙ্ক করছিস?’
আফরিন হতাশ হয়ে আহিলের দিকে তাকিয়ে থাকে। বিমর্ষ হয়ে বলে,’না, সোনা।’
‘ধুর! মজাই করছিস তোরা। অর্ষা কখনো আমাদের গ্যাঞ্জাম পার্টির কাউকে ছাড়া বিয়ে করবে না। আর আমার অনুপস্থিতিতে ও বিয়ে করবে? অসম্ভব! প্রাঙ্ক করবি বলেই কেয়া আপু অতো বড়ো ঘোমটা দিয়ে রেখেছে তাই না? দাঁড়া, তোদের মজা আমি বের করছি।’ বলে আহিল স্টেজের দিকে এগিয়ে যায়।
আহনাফের গম্ভীর মুখ দেখেও সে কিছু আন্দাজ করতে পারছে না। ভাইও কি এই প্রাঙ্কের সাথে শামিল?
আহিল সরাসরি বলল,’এই কেয়া আপু, থুক্কু ভাবি! ঘোমটা সরাও।’
ঘোমটার আড়াল থেকেই আহিলকে দেখে অর্ষার কান্নার গতি আরো বেড়ে যায়। আহিল বলে,’আর ঢং করতে হবে না। ঘোমটা সরাও বলছি। এখন কিন্তু আমি শুধু সম্পর্কে তোমার বেয়াই না হুহ! দেবরও লাগি। ঘোমটা উঠাবে নাকি আমিই সরাব?’
অর্ষা যেভাবে বসে ছিল সেভাবেই বসে রইল। কিছুটা দূরে আহিলের বাবা-মা, কুসুম আর রুহুল আমিন অপ্রস্তুতভাবে এদিকেই তাকিয়ে ছিল। সকলকে এমন দেখে আহিলের মনেও এবার একটু কু ডাকা শুরু করে। সে ডানপাশে আফরিনের দিকে একটু তাকায়। এরপর চট করে এক টানে অর্ষার ঘোমটা সরায়। নতজানু হয়ে বসে থাকা ক্রন্দনরত অর্ষাকে দেখে তার হাত-পায়ের সঙ্গে দৃষ্টিও যেন অসাড় হয়ে যায় সাথে সাথে। জ্ঞানশূন্য দৃষ্টিতে সে তাকিয়ে থাকে পলকহীন। এখনো তার বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছে। অর্ষা না জানিয়েই বিয়ে করে ফেলল?
সে কোনোরকম সিনক্রিয়েট করল না। ঘোমটা যেভাবে ছিল সেভাবেই রাখল। সকলকে অবাক করে দিয়ে হাসল সে। আফরিনকে বলল,’আপু ক্ষুধা লাগছে আমার।’
আহনাফ যেমন নির্বিকার ছিল তেমনই রইল। আহিলের দিকেও তাকাল না একবার। শুধু অর্ষাই অবাক হয়ে ঘোমটার আড়ালে তাকিয়ে রইল। আহিল এত স্বাভাবিক কেন? তাহলে কি আহিলও জানত কেয়ার বদলে অর্ষার সাথে বিয়ে হচ্ছে? জেনেও আহিল ও’কে সাপোর্ট করল না!
আহিলের কথা শুনে আফরিন বিস্মিত হলেও বিচলিত হলো না। ও’কে নিয়ে যাওয়ার সময় গ্যাঞ্জাম পার্টিকেও ডেকে নিল। একটা অদ্ভুত বিষয়ও আফরিন খেয়াল করল। সেটা হলো, মানুষজনের আড়ালে যাওয়ার পর বন্ধু কিংবা আফরিন কারও সাথেই কোনো কথা বলছে না। চুপচাপ খাচ্ছে শুধু।
খাওয়া শেষ করে উঠে যাওয়ার সময় শুধু সকলের উদ্দেশ্যে বলল,’এটলিস্ট কল করে তোরা আমায় খবরটা জানাতে পারতি!’
সকলে ওর যাওয়ার পথে তাকিয়ে থাকে। সবকিছু চোখের পলকেই এত দ্রুত ঘটে গিয়েছিল যে, আহিল যে বিয়েতে উপস্থিত নেই এটাই কারও মস্তিষ্কে হানা দেয়নি তখন।
বিদায়বেলায় অর্ষার ভাই কিংবা ভাবির জন্য একটুও দুঃখ লাগেনি। শুধু তিয়াস আর কেয়ার জন্যই তার কষ্ট হয়েছে। কেয়ার ওপরও রয়েছে তার চাপা অভিমান। এভাবে না পালালেই কি হতো না? রুহুল আমিন এবং কুসুম অবশ্য অর্ষাকে জড়িয়ে ধরে একটু কান্নার অভিনয় করল। অর্ষা তিয়াসকে কোলে নিয়ে অনেকক্ষণ কান্না করেছে। যখন গাড়িতে উঠছিল তখন তিয়াসও প্রচুর কান্নাকাটি শুরু করে দেয়।
কেঁদে কেঁদে বারবার বলছিল,’ফুপি তোতায় দায়? আমি ফুপি দাব। আমি ফুপিল কাছে দাব।’
কুসুম অনেক চেষ্টা করেও ওর কান্না থামাতে পারে না। গ্যাঞ্জাম পার্টির সকলে গাড়ির কাছে এসে বলল,’কাঁদিস না পাখি। আমরা কাল সকালেই তোর কাছে যাব। আর যা হয়েছে মেনে নে। তুই সুখী হবি ইন-শা-আল্লাহ্।’
অর্ষা প্রত্যুত্তরে কিছুই বলতে পারেনি। শুধু অঝোর ধারায় মাথা নত করে কেঁদেছিল। বাড়িতে পৌঁছে আহনাফ আর কোথাও দাঁড়াল না। অর্ষাকে রেখেই নিজের রুমে চলে গেল। নিয়ম রক্ষার জন্য হলেও অর্ষাকে থেকে যেতে হলো। কত মানুষজন এসেছে অর্ষাকে দেখতে। অর্ষার মানসিক অবস্থা জহির চৌধুরী, আমেনা বেগম, আফরিন ওরা সবাই-ই বুঝতে পারছে। তাই জহির চৌধুরী স্ত্রীকে আড়ালে দূরে ডেকে নিয়ে বললেন,
‘অর্ষাকে ঘরে পাঠিয়ে দাও। অনেক ধকল গেছে মেয়েটার ওপর। মানসিক অবস্থাও ভালো না। এত ভিড়ের মধ্যে থাকলে আরও খারাপ লাগবে। ভিড় কমাও। যারা এসেছে মিষ্টি খাইয়ে পাঠিয়ে দাও। কাল এসে যেন বউ দেখে যায়।’
আমেনা বেগমও তাই করলেন। আফরিন গেল আহিলের রুমে। খাওয়া শেষ করেই আহিল চলে এসেছিল। রুমের দরজাও লক করা।
আফরিন দরজায় নক করে বলে,’আহিল দরজা খোল।’
ওপাশ থেকে দরজা না খুলেই আহিল জানতে চায়,’কী দরকার?’
‘অর্ষাকে নিয়ে এসেছি। তুই আসবি না?’
‘বিয়ে যখন আমাকে ছাড়াই হয়েছে। তখন আমায় ছাড়াই বাকি কাজ হয়ে যাবে। তুই যা এখান থেকে। বিরক্ত করিস না।’
‘আমাদের ভুল বুঝিস না ভাই। পরিস্থিতিটাই অন্যরকম ছিল। কী থেকে যে কী হয়ে গেল! কারোর-ই মাথা কাজ করেনি তখন।’
‘আপু তুই যাবি? আমার অনেক ক্লান্ত লাগছে। ঘুমাব আমি।’
আহিলকে বোঝাতে এলেও আর কথা বাড়াতে পারল না আফরিন। মেজাজ খারাপের সময় কিছু বললে তখন হিতে বিপরীত হয়ে যাবে। এরচেয়ে ভালো মাথা ঠাণ্ডা হোক আগে।
.
অর্ষার পরনে আহনাফের দেওয়া সেই সবুজ শাড়িটা। কিছুক্ষণ আগেই ভারী লেহেঙ্গা পালটে এই শাড়িটা পরেছে। সে অবশ্য ইচ্ছে করে শাড়িটা পরেনি। আফরিন পরিয়ে দিয়েছিল বলেই মুখ ফুটে কিছু বলেনি। সত্যি বলতে তার কথা বলার মতো মন-মানসিকতা এতটুকুও অবশিষ্ট নেই আপাতত। তবে সে এতটুকু তো বুঝতেই পেরেছে, কেন এত শাড়ি থাকতে আফরিন ও’কে এই শাড়িটাই পরাল! কারণ শাড়িটা আহনাফের পছন্দ ছিল।
দরজার পাশে চুপ করে দাঁড়িয়ে আছে সে। আফরিন আর কয়েকজন মেয়ে ও’কে জোর-জবরদস্তি করে এই ঘরে পাঠিয়ে দিলো। আহনাফ ফুল দিয়ে সাজানো বিছানায় উপুড় হয়ে শুয়ে আছে। ঘুমিয়েছে কিনা ঠিক বোঝা যাচ্ছে না। অর্ষার ইচ্ছে করছে এক দৌঁড়ে ঘর থেকে বের হয়ে যেতে। কিন্তু কোথায় যাবে সে? আর থাকবেই বা কীভাবে এখানে? একটা ছেলের সাথে এক রুমে থাকবে, হোক ছেলেটি তার স্বামী! একসাথে থাকতে হলে যেই মানসিক প্রিপারেশন একটা মেয়ের প্রয়োজন হয় সেটা তো তার নেই। তবে?
একবার ভেবেছিল আমেনা বেগমকে অনুরোধ করে বলবে যেন, ও’কে আফরিনের রুমে থাকতে দেয়। এর পূর্বেই আমেনা বেগম অদ্ভুত একটা কাণ্ড ঘটান। অর্ষাকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে কেঁদে বলেছিলেন,
‘মা, আমি জানি তোমার সাথে হয়তো কাজটা অন্যায় হয়ে গেছে। তুমি হয়তো বিয়েতে রাজি ছিলে না। কিন্তু আল্লাহকে তো তুমি বিশ্বাস করো বলো? আল্লাহর ওপর নিশ্চয়ই তোমার বিশ্বাস, ভরসা রয়েছে। জন্ম, মৃত্যু, বিয়ে এই তিনটাই যে শুধুমাত্র আল্লাহর হাতে আছে এটা তো আমাদের অজানা কিছু নয়। নয়তো তুমিই বলো, সবকিছু ঠিকঠাক হওয়ার পর কেয়া কেন পালাবে? আল্লাহ তোমার সাথে আহনাফের জুটি লিখে রেখেছিলেন বলেই যেভাবে হোক বিয়েটা তোমার সাথে হয়ে গেছে। আমার ছেলেটা খারাপ নয় মা। ও’কে তুমি গুছিয়ে নিও। একটু সামলে নিও। সম্পর্কটাকে সময় দিও মা। বড্ড চাপা স্বভাবের আমার ছেলেটা!’
এতকিছু শোনার পর অর্ষার আসলে তখন বলার মতো কিছু ছিল না। আর না ছিল প্রতিবাদ করার মতো কিছু। কী নিয়েই বা প্রতিবাদ করবে? তিনি তো কোনো কথাই মিথ্যা বলেননি।
অর্ষার বুকচিরে ভারী দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে। সে আশেপাশে তাকিয়ে পুরো রুমটা দেখে। রুমের মাঝখানে খাট। বামপাশে ওয়ারড্রব। ওয়ারড্রবের পাশেই ব্যালকোনিতে যাওয়ার দরজা। দরজার সাইডে জুতা রাখার র্যাক। সেখানে বিভিন্ন মডেলের জুতা রাখা। খাটের ডানপাশে টি-টেবিল আর এক সিটের একটা সোফা। তার পাশে ড্রেসিংটেবিল। ঘরের দরজার পাশ দিয়ে রাখা আলমারি। এর আগেও সে অনেকবার এই ঘরে এসেছে। কিন্তু কে জানত একদিন বউ হিসেবেই সে এই ঘরে আসবে?
সে কী করবে বুঝতে না পেরে রুমের ভেতর পায়চারি করা শুরু করে। তার পায়ে যে নূপুর ছিল সেই খেয়াল নেই। এত ধকলের মাঝে কি আর এসব খেয়াল থাকে? নূপুরের ঝুমঝুম আওয়াজে আহনাফের তন্দ্রা ভাব কেটে যায়। সে ঘাড় বাঁকিয়ে এদিকে তাকায়। কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকে। অর্ষার সাথে এর আগে সে অনেক কথাই তো বলেছে। কিন্তু আজ প্রথম তাকে অর্ষার সঙ্গে কথা বলতে গিয়ে ভাবতে হচ্ছে যে কী বলবে! নিয়তি মানুষকে কোথায় এনে ঠেকায় ভাবতেই ওষ্ঠে তাচ্ছিল্য হাসিটা ফুটে ওঠে। শ্লেষ, তাচ্ছিল্য ভাগ্যের প্রতি নাকি নিজের প্রতি সেটা বোঝাও বড্ড দায়।
আহনাফ দীর্ঘশ্বাস লুকিয়ে গুরুগম্ভীর কণ্ঠে বলল,’এভাবে হাঁটছ কেন?’
আকস্মিক আহনাফের কণ্ঠে শুনে অর্ষা একটু চমকে যায়। পায়চারি বন্ধ করে চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকে।
আমতা আমতা করে বলল,’না, মানে এমনি।’
‘শুয়ে পড়ো।’
অর্ষা ইতস্ততভাবে বলল,’কোথায় শোব?’
‘আমার রুমে একটাই খাট। আমি যতটুকু জানি সবাই খাটেই ঘুমায়। তোমার এখানে থাকতে আপত্তি হলে অন্য রুমে গিয়ে ঘুমাও।’
অর্ষা নির্বোধের মতো বলল,’অন্য রুমে কেউ থাকতে দিলো না। এখানেই দিয়ে গেল।’
আহনাফ এবার আর দীর্ঘশ্বাস গোপন রাখতে পারল না। তার মন-মেজাজ ভালো নেই। তবুও সে চাইছে স্বাভাবিক ব্যবহার করতে। কেননা এখানে তো অর্ষার কোনো দোষ নেই। তবে এ কথাও সত্য, অর্ষাকে দেখলেই কেয়ার কথা মনে পড়ে যাচ্ছে।
সে দীর্ঘশ্বাস নিয়ে বলল,’অর্ষা শোনো, আমি অনেক মুভি-সিনেমা দেখেছি। অনেক গল্প এবং উপন্যাসের বইও পড়েছি। তাই আমি জানি, তুমি কী ভাবছ। আমার যতটুকু ধারণা তুমিও অল্প হলেও মুভি দেখেছ, গল্প-উপন্যাসের বই পড়েছ। সেই মোতাবেক আমার ধারণা যদি মিথ্যা না হয়, তাহলে তুমি চাইছ ফ্লোরে কেউ ঘুমাবে নয়তো সোফায়। তবে দুঃখের সাথে জানাচ্ছি, আমি এর কোনোটাই পারব না। এতটুকু সোফায় যেমন আমি শুতে পারব না, তেমনই ফ্লোরে ঘুমানোর অভ্যেস আমার নেই। দুঃখিত এজন্যই যে, আমি কোনো সেক্রিফাইজ করতে পারলাম না। খাটটা যথেষ্ট বড়ো আছে। চারজন মানুষ অনায়াসে শোয়া যায়। তোমার আপত্তি হবে না। এতটুকু বিশ্বাস রাখো, ঘুমের মধ্যে কারও গায়ে হাত-পা দেওয়ার স্বভাব আমার নেই।’
মনের কথাগুলো আহনাফ বুঝে ফেলেছে জেনে অর্ষা লজ্জায় মাথা তুলে তাকাতে পারছে না। কিন্তু সে কীভাবেই বা আহনাফের সাথে এক বিছানায় ঘুমাবে? যে ছেলের কেয়ার স্বামী হওয়ার কথা ছিল; সে-ই ছেলে এখন তার স্বামী!
অর্ষা বিমর্ষ হয়ে বলল,’আপনি অনেক রেগে আছেন তাই না? জানি, আপনি কেয়া আপুকে অনেক ভালোবাসতেন। কিন্তু আমি কী করতে পারতাম বলুন? আমার সত্যিই কিছু করার ছিল না। বিশ্বাস করুন, আমিও চাইনি বিয়েটা করতে।’
আহনাফ এতক্ষণ যেই রাগ, জেদটুকু নিজের ভেতর লুকিয়ে রাখার অদম্য চেষ্টা করছিল, এবার আর কেয়ার নাম শুনে সেটা পারল না। সে অর্ষাকে ধমক দিয়ে বলল,’ঐ মেয়ের নাম নেবে না মুখে! আর কখনো যেন আমি ওর নাম না শুনি। ভালোবাসা এত সহজ?’
অর্ষা চমকে যায়। মুহূর্তেই কাজলটানা নেত্রে অশ্রু জমা হয়। ছলছল দৃষ্টিতে সে আহনাফের দিকে তাকিয়ে থেকে বলে,’আপনি এভাবে কেন কথা বলছেন?’
‘এরচেয়ে ভালো ব্যবহার তোমরা ডিজার্ভ করো না। বিরক্ত লাগছে আমার! সত্যিই আমি আর সহ্য করতে পারছি না।’
পরক্ষণে অশ্রুতে টইটুম্বুর অর্ষার চোখজোড়া দেখে আহনাফ রাগ দমন করার চেষ্টা করে।
সে শীতলকণ্ঠে বলল,’তোমার একটু ভুল হচ্ছে। ভালোবাসতাম না। ভালো লাগতো। ভালোবাসা এত সহজ নয়।’
অর্ষা জড়ানো কণ্ঠে বলল,’তাহলে আপনি আমার সাথে কেন এমন ব্যবহার করছেন?’
‘কারণ তোমাকে দেখলেই আমার কেয়ার কথা বেশি বেশি মনে হয়। যেটা আমি সহ্য করতে পারি না।’
অর্ষা কান্না করে ফেলে। দু’হাতে চোখের ও গালে লেপ্টে থাকা অশ্রু মুছে বলল,’দুঃখিত। আপনি ঘুমান।’
‘লাইট জ্বালানো থাকলে আমার ঘুম আসে না।’
অর্ষা গিয়ে লাইট বন্ধ করে সোফায় বসল। আহনাফও কিছু বলল না। দুজনেই কিছুক্ষণ চুপচাপ ঘুটেঘুটে আঁধার রুমটিতে বসে রইল। অর্ষা যে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে সেটা নিস্তব্ধ রুমে খুব সহজেই বোঝা যাচ্ছে। আহনাফেরই বা কী করার? সেও তো পরিস্থিতির শিকার। অন্ধকারে এক সময় দুজনেরই চোখ সয়ে আছে। দুজন দুজনকে দেখতে না পেলেও অবয়ব ঠিক বুঝতে পারছে। বারবার অর্ষাকে খাটে শুতে বলাতেও আহনাফের স্বভাববিরুদ্ধ এবং ইগোতে লাগছে। এছাড়া অর্ষাও বিষয়টা খারাপভাবে নিতে পারে। তারচেয়ে বড়ো ব্যাপারটা হচ্ছে আহনাফ চায়, অর্ষা তার থেকে দূরে থাকুক। ততটাই দূরে থাকুক, যতটা দূরে থাকলে তার কেয়ার কথা মনে পড়বে না। কেয়ার করা অপমানের কথা মনে পড়বে না। কেয়ার কথা মনে আসতেই রাগে, জিদ্দে তার চোয়াল শক্ত হয়ে ওঠে। বালিশে মাথা রেখে চুপচাপ রাগ নিয়ে শুয়ে থাকে সে। অপরদিকে সোফাতে পা তুলে গুটিশুটি হয়ে বসে থাকে অর্ষা। অর্ধেক রাত্রি কাটে হাঁটুতে মাথা ভর দিয়েই। শেষ সময়ে সে ঐভাবেই সোফায় ঘুমিয়ে পড়ে। ভাগ্য, সময়, পরিস্থিতি কতদিন দুজনকে একসাথে রাখতে পারবে অথবা কতদূর নিয়ে যেতে পারবে তা এই অন্ধকারাচ্ছন্ন রুমে থাকা মানব-মানবীর কেউই জানে না।
চলবে…
[কার্টেসী ছাড়া কপি করা নিষেধ।]