#যেদিন_তুমি_এসেছিলে
#পর্ব_২৪
#মুন্নি_আক্তার_প্রিয়া
___________________
আহনাফ থানায় এসে অর্ষার নিখোঁজ হওয়ার ডায়েরি করে গিয়েছিল। সেই সাথে সকল ইনফরমেশন, ছবি এবং সমস্ত ঘটনাও বিস্তারিত বলেছে। পুলিশ তাদের সর্বোচ্চ সহায়তা করবে বলে জানিয়েছিল। কিন্তু তবুও মনের ভেতর ভয়ের দানা ধীরে ধীরে বীজ এবং অল্প সময়ে তা বিশাল মহিরুহের আকার ধারণ করেছিল। অস্বস্তি, দুশ্চিন্তায় গাট হয়েছিল আহনাফের সমস্ত তনু-মন। সে অর্ষাকে সহ্য করতে পারে না, এ কথা ঠিক। তাই বলে সে তো কখনোই অর্ষার ক্ষতি চায়নি আর চায়ও না। তার সমস্ত রাগ গিয়ে পড়েছিল তখন বাবা-মায়ের ওপর।
অন্যদিকে বাবা-মা যখন শুনল অর্ষাকে এয়ারপোর্ট গিয়ে পায়নি তখন তাদেরও দুশ্চিন্তার শেষ ছিল না। আমেনা বেগম তো কান্নাকাটি জুড়ে দিয়েছিলেন। জহির চৌধুরী একটু পরপর আহনাফকে ফোন করে জিজ্ঞেস করছিলেন, অর্ষাকে পাওয়া গেছে কিনা। রাগে-ক্ষোভে বাবা-মাকে দু/চারটা কথা শুনিয়ে দিতে গিয়েও নিজেকে সামলে নিয়েছিল আহনাফ।
দুশ্চিন্তাগ্রস্ত মন ও অসাড় হওয়া শরীর নিয়ে যখন সে বাড়িতে পৌঁছাল, তার ঠিক মিনিট দশেক পর-ই থানা থেকে ফোন আসে। পুলিশ যখন জানাল, অর্ষাকে তারা পেয়েছে তখন মনে হলো অনেক বছর বাদে সে কোনো খুশির খবর পেয়েছে। কোনো কিছু না ভেবে তখনই আবার বেরিয়ে পড়েছিল থানায় আসার জন্য।
বিধ্বস্ত অর্ষাকে মাথা নত করে চেয়ারে বসে থাকতে দেখে কয়েক সেকেন্ডের জন্য হলেও তার বুকটা ধ্বক করে কেঁপে উঠেছিল। কোনো ক্ষতি হয়নি তো? তার ভাবনার প্রহর ফুরাবার পূর্বেই মুখ থেকে বেরিয়ে এসেছিল অর্ষার নামটি। আর এরপর প্রবল বৃষ্টিপাতের মতোন অর্ষার ছুটে এসে বুকে ঝাঁপিয়ে পড়াটা ছিল বিশাল মরুভূমির বুকে এক পশলা বৃষ্টির মতো। যদিও তখন ভয়টা ক্রমশই বাড়ছিল।
এই মুহূর্তে আহনাফ এবং অর্ষা দুজনেই পুলিশ স্টেশনে রয়েছে। আহনাফের গা ঘেঁষে পাশাপাশি বসে আছে অর্ষা। আহনাফের এক হাত জড়িয়ে ধরে হাতের বাহুতে গাল ঢেকিয়ে রয়েছে। অর্ষার শরীরের কাঁপুনি স্পষ্ট টের পাচ্ছিল আহনাফ। সে পুলিশের কাছে বিস্তারিত সব শুনেছে। এই ঘটনার পর অর্ষার মতো মেয়ের ভয় পাওয়াটা অস্বাভাবিক কিছু নয়। অন্য কেউ হলে তো ভয়েই জমে যেত! সেখানে অর্ষা নেহাৎ-ই সহজ-সরল, শান্ত ও ভীতুগোছের মেয়ে। আল্লাহ্ যে ও’কে রক্ষা করেছে এতেই আহনাফ মনে মনে আল্লাহকে শুকরিয়া জানায়।
আহনাফ ক্ষীণস্বরে বলে,’অর্ষা? তোমার কি শরীর খারাপ লাগছে?’
অর্ষা ফোঁপাচ্ছিল। বাচ্চাদের মতো ঠোঁট উল্টিয়ে বলল,’নাহ্!’
অথচ তার গায়ে তখন প্রচণ্ড জ্বর। কীরকম পাখির ছোট্ট ছানার মতো আহনাফের গা ঘেঁষে রয়েছে। অন্য সময় হলে অর্ষা লজ্জাতেই সামনে আসতো না, আর সেখানে তো! আহনাফ দীর্ঘশ্বাস নেয়। যে দুটো পুলিশকে অর্ষার জিনিস-পত্র আনার জন্য পাঠানো হয়েছিল তারা কিছুক্ষণ বাদেই সব নিয়ে ফিরে আসে।
আহনাফ সবকিছু চেক করে পুলিশকে ধন্যবাদ জানায়। অর্ষা তখনো আহনাফকে ছাড়েনি। যেন ছাড়লেই সে আবার হারিয়ে যাবে। তাছাড়া অচেনা এই ভিনদেশে এখন অর্ষার একমাত্র ভরসার কেন্দ্রবিন্দু তো আহনাফ-ই। সেটা এ দুজন মানুষ স্বীকার করুক বা না করুক; বাস্তবতা তো এটাই।
পুরোটা রাস্তায়ও অর্ষা আহনাফের হাত ছাড়েনি। বাড়ি ফিরে অর্ষাকে সোফায় বসাল সে। অর্ষার জন্য পানি আনতে গিয়ে দেখল দেয়ালের আড়াল থেকে ক্যাথিওন উঁকি দিয়ে তাকিয়ে আছে। দৃষ্টি তার অর্ষার দিকে আটকে রয়েছে। মনে মনে হয়তো ভাবছে,’এই নতুন মানুষটার আমদানি হলো কোত্থেকে আবার?’
আহনাফ পানি এনে দিলে অর্ষা বিনাবাক্যে পানিটুকু পান করে। নিস্তেজস্বরে বলে,’ভালো লাগছে না। ঘুমাব।’
অর্ষাকে ধরে উঠিয়ে আহনাফ বলল,’চলো।’
দুটো বেডরুম আহনাফের ফ্ল্যাটে। সে যেই রুমে থাকে তার পাশের রুমে অর্ষাকে নিয়ে যাবে ভাবল। পরক্ষণে ভাবল রুমটা গোছানো হয়নি। আজ বরং অর্ষা তার রুমেই থাকুক। পরে না হয় ঐ রুমে শিফট্ করবে। সে অর্ষাকে নিজের ঘরে নিয়ে শুইয়ে দিলো।
মাথায় হাত দিয়ে ব্যথায় কোঁকাচ্ছে অর্ষা। সে জড়ানো কণ্ঠে অনুরোধ করে বলে,’প্লিজ! আপনি কোথাও যাবেন না। এখানেই থাকুন।’
‘যাচ্ছি না কোথাও। তুমি একটু শুয়ে থাকো।’
আহনাফ ফাস্টএইড বক্স থেকে থার্মোমিটার নিয়ে জ্বর মেপে দেখল ১০৩ ডিগ্রি জ্বর। অস্ফুটস্বরে বলল,’সর্বনাশ! অনেক জ্বর।’
এরপর সে জ্বরের ট্যাবলেট নিয়ে অনেকটা জোরপূর্বক অর্ষাকে খাইয়ে দিলো। পাশে বসে কিছুক্ষণ জলপট্টি দিয়ে জ্বর নামাল। সকাল হলে ডাক্তারের কাছে নিতে হবে।
অর্ষা ঘুমানোর পর ফোন হাতে নিলো। বাবা-মা অনেকগুলো কল আর ম্যাসেজ করেছে। আহনাফের এই মুহূর্তে কথা বলতে ইচ্ছে করছে না। তাই সে ঘুমন্ত অর্ষার ছবি তুলে মাকে হোয়াটসএপে পাঠিয়ে সাথে লিখল,’চিন্তা কোরো না। অর্ষা এখন আমার কাছেই আছে। ঘুমাচ্ছে। কাল সকালে ফোন করব।’
এরপর ফোন চার্জে দিয়ে মাঝখানে কোলবালিশ রেখে সেও অর্ষার পাশে শুয়ে পড়ল। লাইট নেভায়নি আজ। যখন তখন অর্ষার ঘুম ভেঙে যাওয়ার সম্ভাবনা আছে আজ। অন্ধকার দেখে ফের যদি ভয় পায়? এই আশঙ্কায় লাইট জ্বালিয়েই রাখল। যদিও লাইটের আলোয় তার ঘুম আসে না, কিন্তু কিছু করারও তো নেই। পাশ ফিরে শুতে গিয়ে দেখল ক্যাথিওনও এই রুমে এসেছে। চেয়ারের ওপর গুটিশুটি হয়ে ঘুমাচ্ছে।
আহনাফ মৃদু হাসে ক্যাথিওনের দিকে তাকিয়ে। মনে মনে বলে,’ভাগ্যিস তুই গ্লাসটা ভেঙেছিলি!’
_______
সকাল ৭:২৪
সারা রাত দুশ্চিন্তায় ঠিকমতো ঘুমাতে পারেনি আহিল। আমেনা বেগম অবশ্য এসে ভয়ে ভয়ে অর্ষার পৌঁছানোর খবর জানিয়ে গেছেন। তবে আহিল তার কথায় কোনো রেসপন্স করেনি। সকাল হতেই একে একে সব বন্ধুর নাম্বারে ফোন করে ইমার্জেন্সী দেখা করার কথা বলে। ওর হঠাৎ দেখা করার কথায় সবার পিলে চমকে ওঠে। নিশ্চয়ই এতক্ষণে সব জেনে গেছে আহিল আর তাই সবাইকে দেখা করতে বলছে।
সকাল নয়টায় সবার রেস্টুরেন্টে থাকার কথা। আহিল রেডি হয়ে সাড়ে আটটার দিকে বের হয়। ডাইনিংরুম থেকে রেণু জিজ্ঞেস করে,’ভাইজান নাস্তা করবেন না?’
‘না।’ বলে আহিল চলেই যাচ্ছিল, আবার কী ভেবে যেন ফিরে আসে।
ডাইনিংরুমে কেউই নেই। সে রেণুকে জিজ্ঞেস করে,’বাবা-মা কোথায়?’
‘ঘুমাইতাছে। রাতে ঘুম হয় নাই তো তাই।’
‘রেণু আপা, তুমি কি জানতে অর্ষার সুইজারল্যান্ড যাওয়ার কথা?’
রেণুর বুকটা কেঁপে ওঠে এবার। আহিল শান্তভাবে জিজ্ঞেস করলেও, ওর চোখে-মুখে থাকা রাগের আভাস স্পষ্ট টের পাওয়া যাচ্ছে।
‘কী হলো? জানতে?’ রেণুকে নিরব দেখে ফের প্রশ্নটি করে আহিল।
রেণু ভয়ে ভয়ে বলে,’অর্ষা আপা যাওয়ার আগের দিন জানছিলাম।’
আহিল কিছু বলল না। শুধু তেড়ছাভাবে হেসে সেখান থেকে প্রস্থান করল।
গ্যাঞ্জাম পার্টির সকলেই রেস্টুরেন্টে ছিল। নিজেরা নিজেরা আলোচনা করছিল আর ভাবছিল কী করে আহিলকে হ্যান্ডেল করবে। আহিলকে রেস্টুরেন্টে প্রবেশ করতে দেখে সকলেই নড়েচড়ে বসে। আহিলও বেশ স্বাভাবিক ভঙ্গিতেই এগিয়ে এসে একটা চেয়ার টেনে বসে পড়ল।
সবার দিকে তাকিয়ে দেখে সকলে ওর দিকেই ত্রস্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে রয়েছে। আহিল ভ্রুঁ কুঁচকে বলে,’কী?’
ওরা অপ্রস্তুত হয়ে পড়ে। আশিক অনেকটা সাহস সঞ্চয় করেই জিজ্ঞেস করল,’হঠাৎ জরুরী তলব?’
আহিল কিছুটা সময় চুপ করে রইল। এরপর লম্বা দম নিয়ে বলল,’যাক তোরা যখন আসল প্রসঙ্গে চলে এলি, তখন আমিও আর ভনিতা না করি।’
একটু থেমে ফের বলল,’অর্ষা যে সুইজারল্যান্ড গেছে তোরা জানিস?’
সকলে একবার মুখ চাওয়া-চাওয়ি করে সমস্বরে বলল,’জানি।’
‘কবে থেকে জানতি?’
সবাই এবার নিরুত্তর। আহিল বলল,’চুপ করে থাকবি না। কবে থেকে জানতি তোরা? যাওয়ার পর জেনেছিস নাকি আগে থেকেই জানতি?’
এবারও সবাই চুপ করেই থাকে। আহিল বেশ শান্তভাবে বলে,’উত্তর দিবি না তোরা?’
লামিয়া ভাঙা ভাঙা স্বরে বলে,’বেশ কিছুদিন ধরেই জানতাম।’
‘সবাই?’
‘হুম।’
আহিলের চোখে-মুখে এবার স্পষ্ট ক্রোধ ফুটে ওঠে। সেই সাথে পুরো মুখখানা অভিমানে ছেঁয়ে যায়। বিতৃষ্ণায় মুখ তেতো হয়ে ওঠে।
সে কিছুক্ষণ নিরব থেকে নিজেকে ধাতস্থ করে। অভিমানী কণ্ঠে বলে,’তোরা সবাই সব জানতি শুধু আমি বাদে। এমনকি অর্ষাও আমায় কিছু জানানোর প্রয়োজন মনে করল না। ওয়েল! দরকার নেই। তোদের কাউকেই আমার আর দরকার নেই। ভালো থাক তোরা।’
জুঁই বলে,’দোস্ত তুই রাগ করিস না। আমাদের কথাটা শোন।’
‘না, না আমি রাগ করছি না। রাগ করবই বা কাদের ওপর? অর্ষার ওপর? তোদের ওপর? আমার পরিবারের ওপর? লাভ নেই তো। তোরা আমায় আপন ভাবিস না সেটা আমার বোঝা হয়ে গেছে।’
‘দেখ দোস্ত, তুই আহনাফ ভাইয়ার ওপর রেগে আছিস। এভাবে বিয়েটাও মানতে পারিসনি। অন্যদিকে আহনাফ ভাইয়া এবং অর্ষা দুজনের কেউই কাউকে বোঝার সুযোগটুকু পাচ্ছিল না। এভাবে যদি ওরা দূরে দূরে থাকত তাহলে সম্পর্ক গড়ার আগেই সম্পর্কটা ভেঙে যেত। তাই অর্ষার সুইজারল্যান্ডে যাওয়াটা প্রয়োজন ছিল। তোকে আগেই জানানো হয়নি কারণ, তাহলে তুই রাজি হতি না। আর তুই না বললে অর্ষাও কখনো যেত না। তাই পুরো বিষয়টা তোর থেকে গোপন রাখা হয়েছিল। ভুল না বুঝে ঠান্ডা মাথায় ভেবে একটু বোঝার চেষ্টা কর।’ বলল আশিক।
‘বললাম তো ভুল বুঝিনি। তোরা যেটা ঠিক মনে করেছিস, সেটাই করেছিস। অর্ষা তোদের ফ্রেন্ড; তাই ওর ভালোমন্দও শুধু তোরাই ভাবিস। অর্ষা আমার বাবা-মায়ের বড়ো ছেলের স্ত্রী; তাই ওর ভালোটা শুধু তারাই বোঝে। কিন্তু আমি! আমি কে বল? আমি কেউ নই। ওদেরও না, তোদেরও না। যাই হোক, উঠছি আমি। ভালো থাকিস তোরা।’
‘প্লিজ! রাগ করিস না। এবারের মতো আমাদের ক্ষমা কর। স্যরি দোস্ত।’
আহিল শুনল না কিছু। একরাশ চাপা অভিমান সঙ্গে নিয়ে রেস্টুরেন্ট থেকে বেরিয়ে গেল।
.
.
জুরিখ শহরের এক পরিচিত ডাক্তার রয়েছে আহনাফের। সকাল হতেই আহনাফ তাকে বাড়িতে নিয়ে আসে। রাতে অবশ্য অর্ষার জ্বর অনেকটাই কমে এসেছিল। সে অর্ষাকে দেখে প্রেসক্রিপশন লিখে দিলো।
ডাক্তার চলে যাওয়ার পর অর্ষার ঘুম ভাঙে। সে যেদিকেই তাকাচ্ছে সেদিকেই শুধু সাদা রঙের ছড়াছড়ি। বেড কভার, বালিশের কভার, জানালার পর্দা সবকিছু সাদা রঙের। সে মাথাটা দু’হাতে ধরে উঠে বসে। হঠাৎ মাথা আবার চক্কর দিয়ে ওঠায় বিছানায় শুয়ে পড়ে। ডান হাতটা বিছানার ওপর রাখতেই নরম, উষ্ণ, তুলতুলে কিছু অনুভব করে সে। চোখ মেলে তাকিয়ে দেখে সবকিছু চারদিকে ঘুরছে। ঝাপসা লাগছে। সে আবার চোখ বন্ধ করে ফেলে।
কিছুক্ষণ সময় নিয়ে নিজেকে ধাতস্থ করে। ততক্ষণে ঐ উষ্ণ জিনিসটা আরো বেশি করে অনুভব করছে সে। কী সেটা বোঝার জন্য পাশে তাকাতেই দেখতে পায় সাদা ধবধবে একটা বিড়াল তার হাতের ওপর শুয়ে রয়েছে। খানিকক্ষণ স্তব্ধ হয়ে থাকে সে। এরপর যারপরনাই আকাশ-পাতাল কাঁপিয়ে জোরে চিৎকার দেয়। হাতটা তড়িৎবেগে সরিয়ে দৌঁড়ে রুম থেকে বের হয়।
অর্ষার চিৎকার শুনে ভয় পেয়ে যায় আহনাফ। এদিকে ক্যাথিওনের-ও ঘুম ভেঙে গেছে। সেও অর্ষার পিছু দৌঁড় দেয়। এটা দেখে তো অর্ষা আরো জোরে চিৎকার করতে শুরু করে। ডাক্তারকে এগিয়ে দিতে বের হয়েছিল আহনাফ। গার্ডেন থেকে দ্রুতপায়ে সে বাড়ির দিকে আসে। মেইন দরজা চাপানো ছিল। অর্ষাও বের হতে যায় আর আহনাফও ভেতরে ঢুকতে যায়; যার ফলে দারুণ এক ধাক্কা খায় দুজনে। টাল সামলাতে না পেরে অর্ষার পরে যাওয়ার উপক্রম। সেই সময়ে আহনাফ তার শক্তপোক্ত হাতে অর্ষাকে ধরে ফেলে। সাপোর্ট পেয়ে অর্ষাও এবার শক্ত করে আহনাফকে জড়িয়ে ধরে।
আহনাফ জানতে চায়,’কী হয়েছে? তুমি চিৎকার করছ কেন?’
তখন দেখতে পায় সামনে ক্যাথিওন দাঁড়িয়ে ওদের দিকেই তাকিয়ে রয়েছে। আহনাফ বলে,’বাই এনি চান্স, তুমি ক্যাথিকে দেখে চিৎকার করোনি তো?’
অর্ষা এবার মুখ তুলে তাকায়। চোখদুটো পিটপিট করে বলে,’ক্যাথি?’
আহনাফ ক্যাথিওনের দিকে ইশারা করে বলল,’আমার বিড়াল! বিডিতে বলেছিলাম ওর কথা।’
অর্ষা ঘাড় ঘুরিয়ে ক্যাথির দিকে তাকাল। ক্যাথিকে এমন গম্ভীর দেখাচ্ছে কেন? বিড়ালও রাগটাগ করে নাকি? সে আহনাফকে কিছু বলার জন্য আহনাফের মুখের দিকে তাকায়। পরক্ষণে খেয়াল করে, আহনাফের মুখটা এত কাছে কেন? এবং আরো ভালো করে লক্ষ্য করে দেখে, সে তো আষ্টেপৃষ্ঠে আহনাফকে জড়িয়ে ধরে রেখেছে। সে এটাও খেয়াল করে, সে অক্টোপাসের মতো পেঁচিয়ে ধরলে কী হবে; আহনাফ একদম হাত দুটো সরিয়ে সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে। অর্থাৎ সে অর্ষাকে জড়িয়ে ধরেনি। মনে মনে প্রবোধ গুনল অর্ষা। নিজেকে ধিক্কার জানাল। কী লজ্জা! কী লজ্জা!
‘তোমার ভয় আর লজ্জা পাওয়া শেষ হলে আমায় ছাড়ো।’ বলল আহনাফ।
অর্ষা দ্রুত ছেড়ে দেয় আহনাফকে। ক্যাথিওনকে কোলে নিয়ে সামনে আসতেই অর্ষা আবার চেঁচিয়ে ওঠে। চিৎকার করে বলে,’ও’কে নিয়ে সামনে আসবেন না।’
‘আশ্চর্য! ও কি তোমাকে খেয়ে ফেলবে নাকি?’
‘আমার ভয় লাগে।’
আহনাফ ক্যাথিওনকে নামিয়ে দিয়ে অর্ষাকে বলল,’ফ্রেশ হয়ে খেতে আসো।’
অর্ষা যেই রুমে ছিল, সেই রুমে গিয়েই ফ্রেশ হয়ে আসে। আহনাফ হালকা-পাতলা কিছু নাস্তা এনে টেবিলে রেখেছে।
অর্ষাকে দেখতে পেয়ে আহনাফ বলল,’খেয়ে নাও তাড়াতাড়ি।’
‘এত তাড়াহুড়া কেন?’
‘বাইরে যাব। ওষুধ আনতে।’
‘আমি তো এখন ঠিক আছি।’
আহনাফ কিছু না বলে খেতে লাগল। অগত্যা অর্ষাকেও চুপচাপ খাওয়া শুরু করতে হয়।
খাওয়ার পর্ব চুকিয়ে আহনাফ বলল,’তুমি রেস্ট নাও। আমি বাহির থেকে আসছি।’
অর্ষা ব্যস্ত হয়ে বলল,’না। আমি এই বিড়ালের সাথে বাড়িতে থাকব না।’
‘ওর নাম ক্যাথিওন।’
‘ঐতো!’
‘তো কী করবে? সাথে যাবে?’
‘আপনার সমস্যা না হলে যাব।’ মাথা নত করে, নিচুস্বরে বলল অর্ষা।
আহনাফ শ্লেষেরসুরে বলল,’যে নিজের সমস্যার কথা ভাবে না, সে নাকি এখন আমার সমস্যার কথা ভাবতে শুরু করেছে।’
অর্ষা আহত দৃষ্টিতে তাকায়। আহনাফ বলল,’রেডি হয়ে নাও।’
.
অর্ষাকে নিয়ে ডাক্তারের কাছে যাওয়ার জন্য বের হয় দুজন। রাতে এতসব ঘটনা ঘটে গেছিল যে, সুইজারল্যান্ডে আসার সব আনন্দই মাটি হয়ে গেছিল। সকালবেলা সুইজারল্যান্ডের সৌন্দর্য দেখে সে অভিভূত হচ্ছে। দু’পাশে থাকা বিশাল বিশাল আলপাইন গাছের মাঝখানে সরু রাস্তা। চারপাশে প্রকৃতির অপরূপ সৌন্দর্য। পথে যেতে যেতে পাশে একটা লেকও দেখতে পেল। স্বচ্ছ লেকের পানি। যেন এতটুকুও ময়লা নেই কোথাও। পুরো শহর একদম পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন।
আহনাফ আজ অফিসেও গেল না।বাইরে থেকে ফিরে এসেও বাসায় রইল। ফোনে কাদের সঙ্গে যেন কথাও বলল। ওষুধের ডোজ বেশি হওয়ায় দুপুরে খেয়ে অর্ষা ঘুমিয়েছিল। ঘুম যখন ভাঙে তখন বাইরে অন্ধকার। বাংলাদোশের কথা খুব মনে পড়ছে তার। বন্ধুদেরকেও ভীষণ মিস করছে সে। সবাই কেমন আছে? ওরা-ও কি অর্ষাকে মিস করছে? বুকচিরে বেরিয়ে আসে ভারী দীর্ঘশ্বাস।
অর্ষা ফ্রেশ হয়ে রুম থেকে বের হয়। আহনাফকে ড্রয়িংরুমে না পেয়ে ডাকল সে,’শুনছেন? কোথায় আপনি?’
পাশের রুমের দরজা খোলার শব্দ পেয়ে সে পিছু ফিরে তাকায়। ফোন হাতে আহনাফ দরজার সামনে দাঁড়িয়ে রয়েছে। জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল,’ঘুম ভাঙল?’
অর্ষা ওপর-নিচ মাথা দোলাল। আহনাফ বলল,’বসো তুমি। আমি আসছি।’
অর্ষা গিয়ে সোফায় বসল। আহনাফ ফিরে এসে বলল,’তোমার ফোন কোথায়?’
‘ঘরে।’
‘নিয়ে আসো।’
অর্ষা গিয়ে ফোনটা নিয়ে এলো। আহনাফ নিজে ফোনে সীম ঢুকিয়ে দিয়ে, ওয়াইফাই কানেক্ট করে দিলো।
অর্ষা খুশি হয়ে বলল,’আমি আপনাকে এখনই সীমের কথা বলতাম। থ্যাঙ্কিউ।’
আহনাফ এ কথার কোনো উত্তর না দিয়ে ধমক দিয়ে বলল,’এরকম স্টু’পিড মার্কা একটা কাজ কীভাবে করলে তুমি? অবশ্য তুমি তো স্টু’পিড-ই। তোমার দ্বারাই এমন কর্ম সম্ভব।’
অর্ষা বিস্ময়ে থ বনে যায়। সে আবার কী করল এখন? শান্ত মানুষটা হঠাৎ এমন ফায়ার হয়ে গেল কেন? সে কাচুমুচু হয়ে জিজ্ঞেস করে,’বকছেন কেন? কী করেছি আমি?’
‘কী করেছ তা আবার আমাকেই জিজ্ঞেস করা হচ্ছে? একা কেন এসেছ সুইজারল্যান্ড?’
অর্ষা নিরুত্তর।
আহনাফ বলল,’চুপ করে থাকবে না। বলো কেন এসেছ একা? ভয় করেনি? যদি সত্যিই কোনো অঘটন ঘটে যেত?’
কণ্ঠ খাদে ফেলে অর্ষা বলে,’আপনি আমায় নিতে এয়ারপোর্ট যাবেন ভেবেছিলাম, তাই ভয় করেনি তখন।’
আহনাফ থমকে যায়। কী বলবে সে এই কথার পিঠে? ও’কে চুপ থাকতে দেখে অর্ষা মাথা তুলে তাকায়।
ভয়ে ভয়ে বলে,’একটা অনুরোধ করি?’
‘কী?’
‘আঙ্কেল-আন্টির সাথে রাগারাগি করবেন না প্লিজ! যা হওয়ার তা তো হয়েই গেছে। রাগারাগি করলে তো আর সবকিছুর সমাধান হয়ে যাবে না।’
আহনাফ নিশ্চুপ। অর্ষা ঢোক গিলে বলল,’রাগ করবেন না তো তাদের সাথে? বলেন?’
বুক ভরে শ্বাস নিয়ে আহনাফ চিবিয়ে চিবিয়ে বলল,’ননসেন্স মেয়ে! তুমি সুস্থ হও শুধু। তোমাকে আমি বাংলাদেশ রেখে আসব।’
‘কেন?’
‘কেন আবার কী? তুমি এখানে কেন থাকবে?’
‘আপনি কেন থাকেন?’
‘আমার ভালো লাগে তাই থাকি।’
‘আমারও এই দেশটা ভালো লেগেছে। অনেক সুন্দর।’
‘তো?’
অর্ষা ঢোক গিলে বলল,’তো আমিও থাকতে চাই।’
‘মামা বাড়ির আবদার?’
অর্ষা বিড়বিড় করে বলল,’না, স্বামী বাড়ির আবদার!’
‘কী বলো?’
‘কিছু বলিনি। আপনি সবসময় এমন রেগে যান কেন?’
‘তোমার মুখে তো দেখি ভালোই কথার খই ফুটেছে।’
‘স্যরি।’
‘হয়েছে। এখন আর স্যরি বলতে হবে না। বাবা-মা তোমার সাথে কথা বলতে চেয়েছে ফোন দিও।’
‘আচ্ছা।’
‘রাতে কী খাবে?’
‘আপনার ইচ্ছে।’
আহনাফ একটু চুপ থাকল। এরপর বলল,’এখন কী খাবে? চা নাকি কফি?’
‘ইচ্ছে।’
‘ইচ্ছে, ইচ্ছে, ইচ্ছে! সব যদি আমারই ইচ্ছে তাহলে এখানে আসার আগে আমার ইচ্ছে জানতে চাওনি কেন?’ বিরক্ত হয়ে বলল আহনাফ।
অর্ষা ভয়ে ঢোক গিলে। সোফা থেকে উঠে এক পা, দু’পা করে পেছাতে থাকে। উদ্দেশ্য দৌঁড়ে রুমে চলে যাবে। তার আগেই সে পিছে না দেখে ক্যাথির পায়ে পাড়া দেয়। সঙ্গে সঙ্গে দাঁতমুখ খিঁচে ক্যাথি ‘ম্যাউ, ম্যাউ’ করে ওঠে। অর্ষাকে আর পায় কে। সে ভয়ে দৌঁড়ে গিয়ে আহনাফের পেছনে লুকায়।
আহনাফের পরনের টি-শার্ট খামচে ধরে বলে,’ও সবসময় আমার সামনেই কেন পড়ে?’
‘একটু কিছু হলেই তুমি কেন আমায় জড়িয়ে ধরে?’
অর্ষা বলল কী? আর তার কথার পিঠে আহনাফ এটা বলল কী? তাই সে লক্ষ্য করে দেখল, আহনাফের কথা সত্য। সে সত্যিই পেছন থেকে জড়িয়ে ধরেছে। তৎক্ষণাৎ ছেড়ে দিয়ে স্বাভাবিক ভঙ্গিতে কথা বলার চেষ্টা করে বলল,’কই না তো!’
এরপর সেখান থেকে সরতে গিয়ে সোফার সাথে পা লেগে সোফাতেই পড়ে যায়। ভয়ে মৃদু চিৎকার দিয়ে ওঠে।
‘এখানে এসে কি মাথার স্ক্রু ঢিলা হয়ে গেছে নাকি তোমার? এমন বিহেভিয়ার করছ কেন?’
অর্ষা হাসার চেষ্টা করে বলল,’না মানে শরীরটা মনে হয় আবার খারাপ লাগছে!’
একটু নড়তে গিয়ে আবার হলো বিপরীত ঘটনা। এবার তো সোফা থেকে সোজা নিচেই পড়ে গেল। ওর একেক বার একেক রকম কাণ্ডে আহনাফ অবাক না হয়ে আর পারল না।
সে অর্ষার দিকে একটা হাত বাড়িয়ে দিয়ে বলল,’ওঠো।’
চলবে…
[কার্টেসী ছাড়া কপি করা নিষেধ।]