কৌমুদিনী পর্ব-১৯

0
1514

#কৌমুদিনী
#তাফসিয়া মেঘলা
#পার্টঃ১৯

৩৭

থমথমে হয়ে বসে আছে আয়াশ সে যেন ভাবনা হারিয়ে ফেলেছে৷ কি করবে কি করা উচিত তার বোধগম্যই হচ্ছে না, ফাঁকা মস্তিষ্ক নিয়ে বসে আছে চুপ হয়ে৷ বুঝতে পারছে না কেউ, কি চলছে তার মাঝে! রেগে আছে নাকি বিস্মিত সে৷ আর এমন একটা ঘটণায় বিস্মিত হওয়াই উচিত নয় কি?
এতো দিন ধরে সবাই একটা অন্য ধারণা নিয়ে ছিলো, কিন্তু এটা যখন শুনবে সবাই তাদের মতই বিস্মিত হবে?
আয়াশের নিরবতা ভাবাচ্ছে সবাইকে৷ সবাই চুপ করে থাকলেও আয়াশের সাথে সবসময় থাকা কন্সটেবল জারিফ চুপ করে থাকলো না৷
আয়াশের নিরবতা ভঙ্গ করে কন্সটেবল জারিফ কিছুটা নিম্ন কন্ঠে প্রশ্ন ছুড়লেন আয়াশের পানে,
” স্যার নবাব কে কি ফোন করবো নাকি বার্তা পাঠাবো কাউকে দিয়ে? নাকি আপনি যাবেন?”
আয়াশ উত্তর দিলো না জারিফের প্রশ্নের৷ চুপ করে রইলো৷ আয়াশ এতো কি ভাবছে কে জানে? পুলিশ যেহেতু এমন কত বিস্ময়কর ঘটনা জানবে ত’দ’ন্তে নতুন মোর আসবে তাই বলে এমন চুপ হয়ে যাবে নাকি? আয়াশ কি ঘটনাটা জানাতে চাইছে না কাউকে? চুপ হয়ে আছে কেন?
আয়াশের উত্তর না পেয়ে কন্সটেবল জারিফ ফের বলে,
“এত্ত বড় একটা ঘটনা জানাবেন না কাউকে? তারা একটা ভুল ধারণা নিয়ে আছে স্যার তাদের এসব জানতে হবে৷ ”

আয়াশ তো বলেনি জানাবে না৷ এ জারিফ সব সময় এক লাইন বেশি বুঝে৷ আয়াশের রাগ হচ্ছে তাই চুপ করে আছে৷ কিছু ভাবতে পারছে না তার শরীর রাগে শির শির করে কাঁপছে কিছুক্ষণ পর পর৷ নিজের পরা পোশাক টা কে আজ তার ছোট বলে মনে হচ্ছে৷ যারা মানুষের নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকে তারাই যদি মানুষ খেকো হয়ে উঠে কেমন লাগে?

মানুষের নিরাপত্তা কোথায় তাহলে আজকাল? আইন রক্ষকই আইন ভক্ষক হয়ে দাঁড়িয়েছে৷
শাহনেওয়াজ এমন কাজ কি করে করতে পারলো কে জানে? কিন্তু করলোই বা কেন এমনটা?
শাহনেওয়াজ মিফতাকে খু’ন করেছে৷ যেটাকে সবাই স্ট্রোক বলে আসছে ওটা স্ট্রোক নয় একটা খু’ন৷
সে রেকোর্ডে স্পষ্ট এ কথা বলা হয়েছে৷ আশরিফ ব্যাপারটা জানতো৷ সে রেকর্ডে আশরিফ সোজাসুজি জিগ্যেস করেছে সেখানে,
‘রাজকুমারী মিফতাকে কেন খু’ন করলে?’
শাহনেওয়াজ যেন এ কথায় চমকায়নি সে সেখানে পৈচাশিক হেসে শুধু বলেছে,
” তাহলে জেনে গেছেন কমিশনার সাহেব? ”
শাহনেওয়াজ এর প্রতিউত্তরে আশরিফ ক্রুদ্ধ হয়ে বলেছিলো,
” যা করলে এর পরিনাম ভালো নয় শাহনেওয়াজ! এর জন্য তোমার অনেক ভোগান্তি আছে৷ ”
শাহনেওয়াজ তাচ্ছিল্য হেসে একই স্বরে বলেছে,
“আপনি আমায় ভয় দেখাচ্ছেন? আপনি চুপ না থাকলে আপনার মাদক ব্যাবসার খবরটা নবাবের কানে চলে যাবে৷ সেটা আপনার জন্য বোধহয় বেশি সুখকর হবে না কমিশনার সাহেব?”
এরপর আশরিফ ক্রুদ্ধ কন্ঠে বলে,
“খু’নটা করলে কেন?”
শাহনেওয়াজ গম্ভীর কন্ঠে উত্তর দিলো,
“আপনাকে বলতে বাধ্য নই৷”
এর পর আর আশরিফ কিছু বলেনি নিরব ছিলো৷ তখন শাহনেওয়াজ শুধু বলেছিলো,
“দেখা করুন৷ ”
তারপর কেটে দিয়েছিলো তারপর আর কোন রেকর্ড নেই৷
শাহনেওয়াজ খু’ন করেছে? কিন্তু কেন? আর কিভাবে? ডাক্তার তো বলেছিলো স্ট্রোক? ডাক্তার মিথ্যা বললো কেন? আচ্ছা আদৌ কি মিথ্যা বলেছিলো ডাক্তার? ডাক্তার নিজে বলেছিলো ময়না তদন্তের কথা কিন্তু নবাব শুনেনি৷ সবার চোখ ধুলো দিলেও ডাক্তারের চোখ রোগীর রোগ এড়ায় না৷ ফারহান বলেছিলো হেমোরেজিক স্ট্রোক৷ তার যতটুকু ধারণা হেমোরেজিক স্ট্রোকে মস্তিষ্কের র’ক্তনালী ছিঁড়ে র’ক্তপাত হয়। আর সেদইন তারা মিফতাকে র’ক্তাক্তই পেয়েছিলো তাহলে এখানে খু’ন করা হলো কি করে?

মাথা আর নাক মু’খ থেকে র’ক্ত ক্ষরণ হয়েছিলো রাজকুমারী মিফতার৷ খু’ন টা করলো কি করে যে স্ট্রকের মত হলো?
স্ট্রোক কথাটা রিপোর্টে আসলো কেন? আর ফারহানের মনে হয়েছিলো কেন এটা সাধারণ মৃ’ত্যু নয় ? আর শাহনেওয়াজই বা খু’ন করলো কি করে? রিপোর্ট টা কি নকল ছিলো? প্যাথ ল্যাবে একবার যেতে হবে একবার ভাবলো আয়াশ৷ যেখানে মিফতার পরিক্ষা নীরিক্ষা করা হয়েছে৷

রিপোর্ট টা ফারহান করেনি ফারহান তখন রায়হান এর সাথে অপরেশন থিয়েটারে ছিলো৷ ওই রিপোর্টে কোন সমস্যা আছে৷ সব কেমন ঘোলাটে অস্পষ্ট হয়ে উঠেছে৷
এ কেমন পরিস্থিতিতে পরেছে? এ রহস্য উন্মোচন করতে গিয়ে আরো রহস্যের ভেতরে প্রবেশ করছে দিন দিন৷ রহস্য বিস্তৃত হচ্ছে প্রগাঢ় হচ্ছে দিন দিন৷
রাজকুমারী মিফতা এমন কি করলো যে খু’ন করে দিলো শাহনেওয়াজ? আর আশরিফই বা বললো না কেন? নিজের কুকীর্তি ঢাকার জন্য? আর করলো তো করলো কি করে? শাহনেওয়াজ তো শ্রেয়াসের বন্ধু ছিলো তাহলে হঠাৎ এমন কি হলো যে বন্ধুর বোন কে খু’ন করে দিলো? এখন এই রহস্য উন্মোচন করার তেমন কোন সূত্র নেই না আছে মিফতার লা’শ ময়না তদন্ত করলে কিছুতো প্রমাণ বা সূত্র পাওয়া যেতো? খালি হাতে কি করবে? হঠাৎ মাথায় এলো শাহনেওয়াজ এর বাড়িতে যাওয়া উচিত হুম হয়তো সেখানে কিছু পাওয়া গেলে কিছু পাওয়া যেতেও পারে?

কিন্তু এর আগে নবাব আহসান মীর কে জানাতে হবে৷সে দাম্ভিক মানুষ এর পর আর মানুষ কে ভরসা করতে পারবে তো? আর শ্রেয়াস? কাছের বন্ধুর এ কুকীর্তির কথা শুনে ঠিক থাকবে তো?
আহসান মীর দাম্ভিক রাগী হলেও তার মত মানুষ খুব কম দেখেছে আয়াশ৷ রাজ বংশের পূত্র আহসান মীর সে চলটা এখানে এখনো যায়নি৷ মূলত যাদের বেশি ধন দৌলত থাকে তাদেরই জমিদার বলে মানুষ৷ সে হিসেবে আহসান মীরেরো টাকার কোন কমতি নেই রাজ বংশের পূত্র হওয়ায় পূর্ব থেকেই সব কিছু অঢেল৷ আবার সংসদ সদস্য ও সে! রাজনীতি তার রক্তে৷ গ্রামের মানুষ এখনো তাদের শাসক হিসেবেই মানেন৷ এতো কিছু থাকা শর্তেও সে অহংকারহীন৷

আয়াশের জানা মতে শ্রেয়াস, শাহনেওয়াজ আর ফারহান লন্ডনেরর বাস গৃহে বড় হয়েছে শ্রেয়াস থেকে কোন অংশে কম দেখেনি৷
কিছুটা বড় হওয়ার পর শাহনেওয়াজ দেশে এসে পড়া লেখা করলেও ফারহান আর শ্রেয়াস আসেনি লন্ডনেই তাদের পড়া লেখা শেষ করে৷ দু’জন এক সাথে ডাক্তারি সার্টিফিকেট পায়৷ এক সাথে থাকলেও ফারহানের সাথে তার তেমন ভাব নেই৷ কিন্তু শাহনেওয়াজ এসে পরলেও শাহনেওয়াজ এর সাথে বন্ধুত্ত ছিলো রক্তের ভাইয়ের মত৷ শাহনেওয়াজ শ্রেয়াসের প্রাণ ছিলো৷ ফারহান ডাক্তারি পেশাটা ধরে রাখলেও শ্রেয়াস দেশে আসার পর পেশাটা ধরে রাখেনি৷
নিজের প্রাণ প্রিয় বন্ধু নিজের বোনেরই হত্যা করেছে এ কথা আদৌ মানতে পারবে শ্রেয়াস?

৩৮

রসুই ঘরের সামনে থাকা ছোট চৌকিখাট টা ভে’ঙে পরে আছে নিচে৷ পানির মাটির কলস টা সহ মাটির ফুলদানি গুলোও গুড়ো গুড়ো হয়ে আছে৷
বৈঠক খানার নরম গদিটায় বসে আছে ফারহান হাত থেকে ফিনকি র’ক্ত ঝরছে সে দিকে তার ব্রুক্ষেপ নেই৷ তার এখন তার চন্দ্রকে প্রয়োজন তার চন্দ্রকে শ্রেয়াস নিয়ে গেছে এটাই শুধু মাথায় ঘুরছে তার৷ আজ সে বড্ড উন্মাদ হয়ে আছে৷
মুখশ্রী রক্তিম হয়ে আছে চন্দ্রিকার মা বেপরোয়া ভাবে রসুইঘরে কাজ করতে ব্যাস্ত এদিকে মারজিয়া কিছুক্ষণ পর পর মা মেয়ে কে অকথ্য ভাষায় গালি দিচ্ছে৷ উপরে উপরে সে রাগ দেখালেও সে আজ খুশি এক টা পদ বিদেয় করা গেছে এ যেন সে বিশ্ব জয় করে নিয়েছে৷ ঢিঙ্গি মেয়েটাকে তার সহ্য হয় না৷
অকারনেই মেয়েটাকে দেখলে তার রাগ হয়, চন্দ্রিকার মা আছে তাতে তার রাগ নেই চন্দ্রিকার মা চলে গেলে তার কাজ করে দিবে কে?
ও থাকুক মেয়েটা বিদেয় হয়েছে এই অনেক৷ মাঝে মাঝে ইচ্ছে করতো ও মেয়েকে বি’ষ খাইয়ে মেরে দিতে৷ ও দিন তো সিড়িতে তেল ও ফেললো তাও ও মেয়ে ঠিক আছে৷ আজকাল ছেলেটা ওই মেয়ের মাঝে কি পেয়েছে সে বুঝে পায় না৷

সে ছেলের ক্ষানিকটা দূরে দাঁড়িয়ে ছেলেকে লক্ষ করলো মাথা নিচু করে আছে৷ ছেলেটা তার অনেক কষ্টের পাওয়া বিয়ের ছয় সাত বছর সে অক্ষম ছিলো মানুষ কত না কটু কথা শুনিয়েছে৷ তারপর রানী মেহনুবা একদিন কি এক বিলেতি ডাক্তার দেখালো তার তিন মাস পরই ফারহান পেটে আসে৷ সে এই ছেলেকে ছোট থেকে আগলে আগলে রেখেছে ছেলের এমন অবস্থা সহ্য হচ্ছে না তার৷ ক্ষানিকটা সাহস জুগিয়ে সামনে গিয়ে খপ করে কা’টা হাত টা ধরলো মারজিয়া ছেলের৷ অতঃপর বললো,
” আব্বা শান্ত হ৷ হাতটায় মলম দিতে দে৷ ”
ফারহান মায়ের হাত ঝটকা দিয়ে সরিয়ে ক্রুদ্ধ দৃষ্টিতে তাকালো৷ মাতে মারজিয়ে থতমত খেলেও ছাড়লো না হাত ফের ধরলো৷
ফারহানের কি হলো কে জানে? কেমন নরম হয়ে গেলো র’ক্ত মাখা হাত দিয়েই মুখে হত বুলিয়ে৷ দু হাত দিয়ে খামছে ধরলো নিজের চুল হঠাৎ বাচ্চদের মত শান্ত অভিযোগী কন্ঠে বললো,
” মা চন্দ্র ভালো না৷ ও আমার ছোঁয়ায় কষ্ট পায় ওই রাজকুমারের ছোঁয়ায় কেমন চুপটি করে ছিলো৷ ওই রাজকুমার শ্রেয়াস নিয়ে গেলো আমার চন্দ্রিকাকে এনে দাও ওর থেকে আমার চন্দ্রিকাকে এনে দাও মা৷ ”
এইটুকু বলে থামলো অতঃপর ফের সেই রগচটা গম্ভীর একরুখে কন্ঠে বললো,
“নয়তো মে’রে দিবো শেষ করে দিবো সব৷ শেষ করে দিবো৷”

চলবে,

[রিচেক হয়নি ভুল গুলো শুধরে নিবেন🖤]

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here