কৌমুদিনী পর্ব-৩২

0
3470

#কৌমুদিনী
#তাফসিয়া_মেঘলা
#পর্ব ৩২

৬২
অনূভুতি গুলো বড্ড অবাধ্য, অদ্ভুত জিনিসের প্রতি মানুষকে আকৃষ্ট করে দেয় দূর্বল করে দেয়৷ তেমন শ্রেয়াস নিজেকে অদ্ভুত মেয়েতে হারিয়েছে যে মেয়ে কারো অনুভূতি মূল্য দিতে যানে না৷
মেয়েটা বড়ই শক্ত অনুভূতি হীন৷ এমন কি অন্যের অনূভুতির ও তোয়াক্কা করে না৷
চন্দ্রিকাকে নিচে পরে যেতে এক মূহুর্তের জন্য থমকে গিয়েছিলো শ্রেয়াস নিজের প্রাণ পাখি যেন উরে যাচ্ছিলো এখনই৷
শ্রেয়াস গিয়ে চন্দ্রিকাকে ধরতেই র’ক্তাক্ত অবস্থায় চন্দ্রিকা শ্রেয়াসের হাত সরিয়ে দেয় শক্ত কন্ঠে বলে,
“দূর্বল নই আমি৷ দূর্বল ভাববেন না আমায়৷ আমি ঠি’ক আছি৷ ”
জোরে জোরে শ্বাস টেনে কথা গুলো বললো চন্দ্রিকা৷ শ্রেয়াসে রাগ হলো এই অবস্থাতেও এই মেয়ের শরীরের জোর কমে না না কমেছে গলার স্বর৷ শ্রেয়াস রাগে দাতে দাত চেপে বলে,
“আপনি ঠিক নেই চন্দ্রাবতী জেদ করবেন না৷ ”
চন্দ্রিকা তাও শরীরের জোর দেখিয়ে বললো,
“আমি ঠিক আছি তমাকে ডেকে দিন শুধু৷ ”

গু’লির শব্দে মেহনুবা, তমা আর চন্দ্রিকার মা অন্দর মহল থেকে বেরিয়ে বাগানেই এসেছিলো চন্দ্রিকাকে এমন র’ক্তা’ক্ত দেখে থমকে যায় তিনজনই৷ তমার খেয়াল আসতেই নিজেকে সামলে এগিয়ে আসে চন্দ্রিকার দিকে৷
তমা এগিয়ে আসতেই চন্দ্রিকা কোন মত বললো,
“আমাকে উঠতে সাহায্য করো৷ ফারহান ভাইকে স্বাস্থ্য কেন্দ্রে পাঠানোর ব্যাবস্থা করো৷ ”
তমা এবার ফুপিয়ে উঠলো ক্রোধান্বিত কন্ঠে বললো,
“আপিনিও ঠিক নেই আপনাকেও নিয়ে যেতে হবে৷ ”
চন্দ্রিকা দাতে দাত চেপে ব্যাথা সহ্য করছে বোঝাই যাচ্ছে অথচ মুখে বলছে ঠিক আছে কি অদ্ভুত মেয়ে৷ র’ক্ত পরা বাড়ছে৷

চন্দ্রিকার মা মেয়ের অবস্থা দেখে নিজেকে সামলাতে পারলো না জ্ঞান হারালো এখানেই৷ মেহনুবা যেন থমকে গেলো, মিফতার মুখখানা ভেসে উঠলো চোখের সামনে৷ এবারো একই ঘটনা ঘটলো? বা’চাতে পারলো না তার চন্দ্রিকাকেও? পাথর হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো৷ শ্রেয়াস আর তমা মিলে চন্দ্রিকাকে গাড়িতে বসালো৷ আয়াশ এম্বুলেন্স কল করে ফারহানের দিকে এগিয়ে এলো৷ নাড়ি পরিক্ষা করে দেখলো এখনো নাড়ি স্ফন্দ বন্ধ হয়নি তবে কমে আসছে৷ জানিয়ে দিলো সবাইকে ফারহান কে পাওয়া গেছে চন্দ্রিকা ‘ইনকাউন্টার’ করেছে তবে এখন পর্যন্ত কিছু হয়নি৷ তাকে আসামি স্বাস্থ্য কেন্দ্রে নিয়ে যাওয়া হবে৷
আয়াশ চন্দ্রিকা মেয়েটাকে দেখে অবাক হয় বিশেষ করে পরিচয় পাওয়ার পর৷ শক্ত কঠিন চরিত্রের একজন নারী তার দেখা৷ মেয়েদের তো এমনই হওয়া উচিত তাই না?

৬৩
চন্দ্রিকার জ্ঞান যখন ফিরলো তখন দ্বিপ্রহর চলছে৷ অপরেশনের দীর্ঘ তেরো ঘন্টা পর জ্ঞান ফিরলো চন্দ্রিকার জীর্ণ শরীর হলেও মনের দিক দিয়ে যেন এখনো শক্ত রয়েছে৷ জ্ঞান ফেরার পর কারো সাথে কোন কথা বলেনি৷
গু’লি টা বুকে লাগেনি কাধের কিঞ্চিৎ নিচে লেগেছে তাই বেশি ক্ষতি হয়নি৷

শ্রেয়াস তখন কেবিনের বাইরে পায়চারি করছিলো মেহনুবা আর চন্দ্রিকার মা বসে আছে চন্দ্রিকার কাছেই৷ চোখ খুলে দুজন চমৎকার নারী কে দেখতেই যেন ফুরফুরে হয়ে উঠলো সব কিছু৷ এরাই চন্দ্রিকার শক্ত মনের গোপন রহস্য, তার মনোবল, অনুপ্রেরণা৷ নয়তো সেই কবেই ঝরে যেতো চন্দ্রিকা নামক মেয়েটি৷
হঠাৎই স্মৃতি চারন হলো অতীতের কিছু তিক্ত ভয়ংকর স্মৃতি যা হয়তো যে কোনো নারীর জন্য ভয়ংকর মুহূর্ত৷

সে দূর্ঘটনার পর মিফতাই তাকে সামলে নিয়েছিলো চঞ্চল চন্দ্রিকা কঠিন রুপে নিজেকে পরিচিত করেছে সবার সামনে৷ অনুভূতিহীন হয় নাকি কেউ? চুপচাপ হয় নাকি মেয়েরা? কোন বড় দূর্ঘটনাই মানুষকে কঠিন করে তোলে৷ তবে সে ঘটনার পর তো চন্দ্রিকার ভে’ঙে পরা উচিত ছিলো? কিন্তু মেহনুবা সেই ভে’ঙে পরা চন্দ্রিকাকে নিজের মনের মত করে গড়ে তুলেছে কঠিন করেছে যেন মানুষ কোন নারী কে কখনো শক্ত না বলে৷

চন্দ্রিকা সর্বদাই চঞ্চল প্রকৃতির মেয়ে ছিলো আর চন্দ্রিকার চঞ্চলতা কে কেউ পছন্দ না করলেও প্রশ্রয় না দিলেও তার বড় বোন মল্লিকা তাকে সবসময় ভালোবাসতো৷ চন্দ্রিকার প্রাণ ছিলো মল্লিকা, নিজের প্রাণ প্রিয় বোন মল্লিকাকে চোখের সামনে ধর্ষণ আর হতে দেখেও কিছু করতে পারেনি, সে দিন শুধু মল্লিকার নয় সদ্য যৌবনে পা রাখা সতেরো বছর বয়সী চন্দ্রিকার ও সে দিন ধর্ষণ হয়৷ ধর্ষিতা চন্দ্রিকা বাঁ’চতে পারলেও মল্লিকা তার চোখের সামনে আত্মহত্যা করেন৷
মল্লিকার ভালোবাসার মানুষই মল্লিকা এবং তাকে ধর্ষণ করে আর তা স্বচোক্ষে দেখে চন্দ্রিকা৷ তবে লোকটার মুখ দেখেনি চন্দ্রিকা মুখ ঢাকা ছিলো৷

চন্দ্রিকা আর মল্লিকা দুই বছরের ছোট বড় ছিলো৷ মল্লিকা চন্দ্রিকার জানামতে মল্লিকা কোনো পুলিশ অফিসার এর সাথেই প্রেমের সম্পর্কে জরিয়ে ছিলো৷ দুই বছরের সম্পর্ক ছিলো তাদের৷ মল্লিকা নিজের থেকে বেশি ভালোবাসতো লোকটাকে৷ চন্দ্রিকা খোলামেলা স্বভাবের থাকলেও, মল্লিকা চাপা স্বভাবের ছিলো জানায়নি কাউকে এ কথা৷ সে দিন মল্লিকার কোন ভাবে জানতে পারে তার প্রেমিক মাদক ব্যাবসায় জরিত, পুলিশে জয়েন করার আগে থেকে এ নিয়ে সে পুলিশ অফিসারের সাথে ঝগড়াও হয়৷ আড়াল থেকে চন্দ্রিকা শুনেছিলো তবে লোকটি পিছনে ফিরে থাকায় দেখতে পারেনি মুখটা৷ সে দিন চমকেছিলো বেশ চন্দ্রিকা তার বোন দুই বছর যাবত প্রেম করছে তা সে জানে না৷ ঝগড়ার এক পর্যায় মল্লিকা সে ছেলেকে থাপ্পড় ও মারে এবং এ ও বলে সে বলে দিবে সবাইকে৷ মল্লিকার কাছে প্রমাণ ও ছিলো৷

কিন্তু সে দিন আর মল্লিকা আর চন্দ্রিকা দু’জনই বাড়ি ফিরতে পারেনি মাঝ রাস্তা থেকে কয়েকজন এসে তুলে নিয়ে যায়৷ মল্লিকাকে প্রমান গুলো দিয়ে দেওয়ার জন্য জোর জবরদস্তি করে মল্লিকা প্রমাণ না দেওয়ায় প্রথম মল্লিকাকে তারপর চন্দ্রিকাকে ধর্ষণ করা হয় হাত পা বে’ধে৷ নিজের চোখের সামনে সেই নির্মম দৃষ্য দেখে এবং ওইটুকু বয়সে নিজেও ধর্ষিতা হয়৷ মল্লিকাকে ধর্ষণ করার পর বেশি র’ক্তক্ষরণের ফলে অচেতন হয়ে পরে মল্লিকার অচেতন থাকা অবস্থায় তারা চন্দ্রিকাকে ধর্ষণ করে৷ যে দু’জন ধর্ষণ করেছে তাদের দু’জনের মুখই বা’ধা ছিলো৷ মল্লিকা প্রমাণ না দিলে তারা চন্দ্রিকাকে খু’ন করতে চেয়েছিলো মল্লিকা তাদের প্রমান দিয়ে দেয়৷

র’ক্তাক্ত অচেতন চন্দ্রিকা আর মল্লিকাকে তুলে মহলের সামনে রাস্তায় ফেলে রেখে যায় মাঝরাতে৷ চন্দ্রিকার মা মহলে গিয়ে জানিয়েছিলো বিকেলেই চন্দ্রিকা আর মল্লিকা কে পাওয়া যাচ্ছে না৷ আহসান মীর দেহরক্ষী দের দিয়ে খোঁজ লাগায়৷ পরের দিন সকালে মহলের সামনে চন্দ্রিকা আর মল্লিকাকে এমন দেখে সবাই চমকে উঠে৷ এ ব্যাপার টা মহলের কিছু দেহরক্ষী, আহসান মীর মেহনুবা, চন্দ্রের মার আর মিফতা ছাড়া কেউ জানে না৷ স্বাস্থ্য কেন্দ্রে নিয়ে যাওয়া হয় দু’জনের অবস্থাই করুন ছিলো৷ জ্ঞান ফেরার পর চন্দ্রিকা আরো বেশি ভে’ঙে পরে৷ শরীরের অবস্থা দিন দিন আরো খারাপ হতে থাকে৷ মল্লিকা সুস্থ হতে থাকলেও স্বাস্থ্য কেন্দ্রেই চন্দ্রিকার সামনেই আত্মহত্যা করে৷ চন্দ্রিকা সে ব্যাপার নিয়ে বেশি ভয় পাওয়ার ফলে ট্রেম্পুরারি এট্যাক হয়৷ যার ফলে হাত পা কিছু দিনের জন্য কার্যকর বন্ধ করে দেয় তবে সে চোখ মেলে সব কিছুই দেখতে পারতো চন্দ্রিকা আর মল্লিকাকে এক কেবিনেই রাখা হয়েছিলো চন্দ্রিকার চোখের সামনে মল্লিকা ফা’সি দিয়ে আত্মহত্যা করে৷

চন্দ্রিকা সে দিন থমকে যায় শরীরের কার্যকারিতা ফিরে পেলেও নিজের চোখের সামনে একের পর এক এমন ঘটনায় আরো ভে’ঙে পরে৷ চন্দ্রিকার মাও মেয়েদের এমন অবস্থায় অসুস্থ হয়ে পরে৷ তখন মেহনুবা আর মিফতাই ছিলো চন্দ্রিকার ভরসা৷ চোখের সামনে নিজের প্রান প্রিয় বোন কে কাফনে মোরাতে দেখে৷ চন্দ্রিকার সামনে ওই চার পায়ার খটিয়ায় করে তার প্রাণ প্রিয় বোন কে নিয়ে যাওয়া হয় সেই অন্ধকার গৃহে৷

মেহনুবা আর মিফতা সেই ভে’ঙে গুড়িয়ে যাওয়া চন্দ্রিককে একটু একটু করে নতুন পরিচয়ে গরে তুলে৷ প্রতিষ্ঠিত করে৷ আর হাস্যজ্বল চঞ্চল চন্দ্রিকা? সে তো মল্লিকার সাথেই সেই অন্ধকার গৃহে মাটিচাপা পরে গেলো৷ আহসান মীর চেয়েও সে দিন কিছু করতে পারেনি কারণ প্রমান ছিলো না৷ মল্লিকা বেঁ’চে থাকলে হয়তো সেই পুলিশ অফিসার কে ধরা যেতো? চন্দ্রিকা তো দেখেও নি চিনেও না প্রমাণ ছাড়া কাকে শাস্তি দিবে আইন? তবে মল্লিকা সে দিন হার মেনে আত্ম’হ’ত্যা করলেও চন্দ্রিকা হার মানেনি৷ নিজেকে অন্যরুপে পরিচালিত করেছে চন্দ্রিকা৷ নারীরা দূর্বল নয় বোঝাতে হবে তো? শাড়ি চুরি পরলেই দূর্বল নয় সে নারী৷ শারী চুরি পরেও সে সকল মানুষ দের শাস্তি দেওয়া যায় যারা মেয়েদের দূর্বল ভাবে৷ আমাদের সমাজে অনেক আইন রক্ষক নামে ভক্ষক রয়েছে যারা সারা জীবন অন্যায় বিরুদ্ধে কাজ করবে বলেও সারা জীবন অন্যায়কে প্রশ্রয় দিয়ে যায়৷

অনুভূতি হীন মানুষ হয় নাকি? তবে এ অনুভূতি কে কখনো জাগ্রত নিজেই করেনি অনুভূতিরা যে মেয়েদের দূর্বলতা৷ এমন ভালোবাসার কাছেই হেরে যায় হাজার মল্লিকা, ধর্ষিতা গায়ে দাগ লেগে গেছে না? ধর্ষিতা দের কি অনুভূতি থাকতে হয় নাকি? মনে রঙ থাকতে হয় নাকি? শ্রেয়াস তো না জেনে জেদ ধরে বসে আছে জানলে হয়তো আর চন্দ্রিকার কথা মুখেও আনবে না?

হঠাৎ কেবিনের দরজা খোলার শব্দে ধ্যান ভা’ঙলো চন্দ্রিকার৷ আয়াশ আর শ্রেয়াস এসেছে৷ আয়াশ কেবিনে ঢুকতেই চন্দ্রিকা প্রশ্ন ছুড়ে দিলো,
“ফারহান ভাই কেমন আছে?”
আয়াশ চন্দ্রিকার সামনে দাঁড়িয়ে বললো,
” ম্যাম ফারহানের জ্ঞান ফিরেনি তবে শ্বাস চলছে৷ গুলিটা বাম বুকে লেগেছে মনে হয়না বেশিক্ষণ আছে৷ ”
আয়াশের কথা শুনে চন্দ্রিকা ফোস করে নিশ্বাস টানলো৷ অতঃপর সবার দিকে তাকিয়ে বলে,
“আমার রাজকুমার এর সাথে ব্যাক্তিগত কিছু কথা আছে৷ ”
চন্দ্রিকা বলার সাথে সাথেই আয়াশ বেরিয়ে গেলো মেহনুবা আর চন্দ্রকার মা ও বেরিয়ে যায়৷ তারা বের হতেই চন্দ্রিকা বলে,
“আপনি কি বলবেন না আমায় কিছু?”
শ্রেয়াস গম্ভীর কন্ঠে উত্তর দিলো,
” বিয়েটা হোক৷ ”
চন্দ্রিকা এবার রেগে গেলো৷ এই ছেলে অবুঝের মত কেন করে? চন্দ্রিকা কাঠকাঠ কন্ঠে বলে,
“আপনি মরিচিকার পিছনে ছুটছেন৷ আপনি,,,”
চন্দ্রকাকে অর্ধেক কথার মাঝে থামিয়ে বলে,
“আপনার সুস্থ হওয়া জরুরি৷ আপনি সুস্থ হলে আমাদের বিয়ে হবে চন্দ্রাবতী আমি আপনার অপেক্ষায় আছি৷ আপনাকে আমার প্রয়োজন৷ বিয়ে না হলে কিছুই বলবো না আমি৷ ”
চন্দ্রিকা আর কথা বাড়ালো না শক্ত কন্ঠে শুধু এইটুকু বললো,
“বিয়ের ব্যাবস্থা করুন রাজকুমার৷ আজই বিয়ে হবে৷ ”

চলবে,

[নোটঃ ১৩৭৩ শব্দ]

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here