বিয়ের বেনারসি গায়ে জড়িয়ে, জানালার ধারে দাঁড়িয়ে নিজ বরযাত্রীকে ফেরত যেতে দেখছে জাফরিন।তাদের হাতে পায়ে ধরে মিনতি করে চলেছে দুই বোন জামাই। বিয়েটা না ভাঙার জন্য অথচ বিয়ের সমস্ত আয়োজনকে নষ্ট করে দিয়ে আগত যাত্রী বউ ছাড়া ফেরত চলে গেলো।একটু আগে খবর এসেছে কন্যার বাবার বিদেশে দশতলা বিল্ডিং থেকে পড়ে স্পট ডেথ হয়েছে।হাজার হোক কোনো গার্ডিয়ান ছাড়া এরকম এতিম মেয়েকে বিয়ে করা যায় নাকী?
একদিকে পিতৃ হারানোর শোক অন্য দিকে ভালোবাসার মানুষের প্রত্যাখান। সব মিলিয়ে জাফরিনকে শোকের পুতুলে পরিণত করলো।বাবা আজমল শিকদার এবং মা সুফিয়া বেগমের তৃতীয় সন্তান জাফরিন।বড় বোন আনিসা এবং মেঝ বোন আলেয়া বিবাহিত।
আশেপাশের মানুষ আফসোস করতে লাগলো।আজ যদি তার একটা ভাই থাকতো, তবে তাদের অভিভাবক হতো।মেয়েটার বিয়ে এভাবে ভাংতো না।বিয়ের শাড়ি গায়ে জড়িয়েই এগিয়ে এলো ঘরের বাইরে। তার কোমর অবধি চুল হাতে প্যাঁচ দিয়ে খোঁপা করে বসলো মায়ের কাছে। তাকে দেখে তার মা আরোও কান্নায় ভেঙে পড়লেন।দূর দেশে স্বামীর মৃত্যু, মেয়ের বিয়ে ভাঙ্গা এসব সহ্য করতে না পেরে জ্ঞান হারালেন সুফিয়া বেগম।
দুই বোন বার বার মূর্ছা যাচ্ছে। তার চাচা ব্যস্ত ও দেশের লোকের সাথে কথা বলতে। কিছুক্ষণ পূর্বেই তার ভাই মারা গেছেন।
জাফরিন উঠে দাঁড়ালো।এগিয়ে এসে চাচার কাছ থেকে ফোন নিয়ে বলল,
“আমি জাফরিন শিকদার বলছি, আজমল শিকদার এর ছোটো মেয়ে। আমার বাবা এখন কোথায়?”
জাফরিনের এমন কাঠ কাঠ কন্ঠস্বর শুনে তার চাচা তাকিয়ে রইলেন মেয়েটার দিকে। ফোনের অপর পাশেও ব্যক্তিটার মধ্যেও মনে হলো কিছুটা পরিবর্তন এলো।দুটো কাশি দিয়ে অপর পাশে থাকা মেয়েটি বলল,
“ম্যাম, আপনাদের জন্য একটা দুঃসংবাদ রয়েছে।”
“আপনি বলুন, আমার বাবা কোথায়?”
“ম্যাম নিজেকে শান্ত করুন।”
“আমার কণ্ঠে নিশ্চয়ই অশান্তির কিছুই পাচ্ছেন না আপনি।বলুন আমার বাবা কোথায়।”
ফোনের অপর পাশ থেকে ইংরেজিতে কেউ কিছু বলে নির্দেশ দিলেন কিছু বলতে। দোভাষী মেয়েটা তখন বলল,
“দুঃখিত ম্যাম।আপনার বাবা কিছু সময় পূর্বে ইন্তেকাল করেছেন।আমাদের কোম্পানির নতুন একটা বিল্ডিংয়ের কাজ শুরু হয়েছিল।উনি এটার দায়িত্বে ছিলেন।সকাল থেকে হয়তো উনার শরীর ভালো ছিল না।সাইডের কাজ চলাকালীন সময়ে উনি কোনো কারণ বশত নিচে পড়ে গিয়েছিলেন এবং উনার স্পট ডেথ।”
মেয়েটির কথা শেষ হলেও জাফরিন কিছুই বলতে পারলো না।তার গায়ে থাকা সোনার গয়না গুলো পড়ন্ত বিকেলের রোদের আলোয় ঝলমল করছে। গায়ের বেনারসিতে এখনো লেগে আছে বাবার পছন্দের আঁতর এর গন্ধ।আজকের দিন নিয়ে সে কতই না স্বপ্ন দেখতো। নিজ হাতে কিনে পাঠিয়েছিলেন মেয়ের বিয়ের সকল গয়না, এমনকি বেনারসিও। তাকে এই সাজে দেখবে বলে যে মানুষ অপেক্ষা করেছিল সেই মানুষ আজ নেই।
“আমি কী আমার বাবাকে দেখতে পারি?”
“দুঃখিত ম্যাম।লাশ এখন হাসপাতালে আছে।”
“আমার বাবা সত্যি কী নেই?”
ফোনটা কেটে দিয়ে মাটিতে বসে পড়ল জাফরিন।তার চাচাতো বোন আশা এসে দৌড়ে তাকে জড়িয়ে ধরলো।জাফরিন যেন শক্ত পুতুলে পরিণত হয়েছে। তার চোখ দিয়ে কোনো পানি ঝরছে না।বিয়েতে আসা মেহমানগুলো নিশ্চুপ দাঁড়িয়ে দেখছে। আশেপাশের মানুষ আফসোস করছে। জাফরিনকে নিয়ে ঘরে যাওয়া হলো।ড্রয়িং রুমে বসে থাকা বড় দুলাভাইয়ের উদ্দেশ্যে সে বলল,
“ভাই, এই আয়োজন সব শেষ করুন।সামিয়ানা নামান।আমার বড্ড দম ফাপড় লাগছে ভাই। আমার বড্ড দম ফাপড় লাগছে।”
বড় বোন জামাই জাফরিনের যেন সত্যিকারের অর্থে ভাই।আধ ঘন্টার মধ্যে সব আয়োজন সরিয়ে ফেললেন।ধীরে ধীরে সন্ধ্যে হলো।ডাক্তার ডেকে স্যালাইন করা হলো সুফিয়া বেগমকে।
তার নাম্বারে বার বার কল আসছে। কল দিচ্ছে আত্মীয় স্বজন সবাই।তাদের খোঁজ নিতে। বিয়ে বাড়িতে মৃত্যুর শোক সবাইকে চিন্তায় ফেলে দিয়েছিল।সবাই যার যার মতোন ব্যস্ত, কেউ ভাবছে বিদেশে তাদের বাবা মারা গেছে তাহলে কোম্পানি না হলেও কোটি টাকা দিবে। আবার কেউ ভাবছে এই সম্পত্তির সব তো মেয়েরা পাবে না। ভাইয়ের ছেলেরাও অংশীদার হবে।
দুই একজন তো সব কিছুই ছাড়িয়ে এসেছে।তারা বলছে যে মারা যাওয়ার সে তো গেছেই। লাশ আনার কী দরকার? লাশ না আনলে টাকা বেশি দিবে।
বাকী কয়েক জনের মাথা ব্যথা হচ্ছে জাফরিনকে নিয়ে। বিয়ে হলো না, প্রেমের সম্পর্ক ছিল।এখন এই মেয়েরে কে বিয়ে করবে? বিয়ের দিনেই যে মেয়ের বাবা মারা গেল সেই মেয়ে যে সংসারে যাবে সেই সংসার টিকবে?
(২)
স্পেনের মাদ্রিদ শহরে নেমে এসেছে রাত। তবুও এই শহর ব্যস্ত। ব্যস্ত শহরের মাঝেই নিজ এপার্টমেন্টে ট্রেড মিলে সর্বোচ্চ গতিতে দৌড়াতে থাকা ছেলেটির সমস্ত ধ্যান নিজেকে শান্ত করার। কিন্তু বার বার সে ব্যর্থ হচ্ছে। আজ সকালের ঘটনা সে ভুলতে পারছে না। নিছক এক্সিডেন্ট হিসেবে জানা এই ঘটনা কী সত্যি তাই।ঘামে ভিজে উঠেছে তার পিঠ।গায়ে থাকা পাতলা সাদা টি-শার্ট ভিজে উঠে তার দেহ অবয়ব স্পষ্ট। কপালে জমেছে বিন্দু বিন্দু নোনা জল।ধীরে ধীরে গতি কমিয়ে দিয়ে নেমে এলো ট্রেড মিল থেকে।একজন পরিচারিকা গ্লাস এগিয়ে দিতেই সে বলল,
“হোয়াট হেপেন্ড টু এমিলি?ইজ শী হেয়ার?”
পরিচারিকা সম্মতি জানিয়ে বাইরে চলে যেতেই ভিতরে প্রবেশ করলো বয়স পঁচিশ এর এক মেয়ে।মেয়েটি প্রবেশ করার অনুমতি চাইলো।অনুমতি পাওয়ার পর রুমে প্রবেশ করে এগিয়ে দিলো একটা লাল রঙা ফাইল।
যে ফাইলটাতে রয়েছে মৃত ইঞ্জিনিয়ার আজমল শিকদার এর পরিবারের তথ্য। তার পরিবার এই মুহুর্তে বাংলাদেশে অবস্থান করছে।
আজ তার মেয়ের বিয়ে ছিল। এই দিনের জন্য ছুটিও চেয়েছিলেন কিন্তু কোম্পানি ইস্যু করেননি।
ভদ্রলোক আজ মারা গেছেন।ভদ্রলোক
যে কোম্পানিতে চাকরি করতেন সেই কোম্পানির একমাত্র উত্তরাধিকার হলেন মাশহুদ শেখ।আটাশ- ঊনত্রিশ বছর বয়সী মাশহুদ একজন সফল ব্যবসায়ী।তার বুদ্ধি কিংবা যুক্তিতর্ক এনে দিয়েছে সফলতা।
তার দাদা ছিলেন একজন বাংলাদেশী নাগরিক।এদেশে এসে প্রণয়ের সম্পর্ক হয় তার দাদীর সাথে। সে থেকে আর দেশে ফিরেন নি তিনি।অথচ দেশের মানুষের প্রতি ছিল আলাদা টান।আজকের ঘটনার মতোন ঘটনা মাঝে মধ্যেই সামাল দেয় তার কোম্পানি কিন্তু আজ যে মেয়েটা কিছু সময় পূর্বে তার বাবার কথা জিজ্ঞেস করছিল সেই মেয়ের কথা কিংবা কণ্ঠস্বর তাকে ভিতর থেকে চঞ্চল করে তুলেছে। খবর নিয়ে জানতে পেরেছে তার বিয়েটাও আজ ভেঙ্গে গেলো।মানুষ হিসেবেই তার খারাপ লাগছিল।এমিলিকে চলে যাওয়ার আদেশ দিয়ে দীর্ঘ সময় নিয়ে শাওয়ার নিলেন মাশহুদ। পেটানো শরীর বেয়ে ঝরে পড়া প্রতিটি পানিই যেন আজ তার ভিতরের অস্থিরতা লুকিয়ে রাখতে ব্যর্থ।
ফিরে এসে আজমল সাহেবের স্ত্রীর নাম্বারে একটি ম্যাসেজ পাঠালো সে।অপেক্ষায় রইল যদি কোনো রিপ্লাই আসে।
(৩)
রাত গভীর হতেই সমাবেশ বসেছে জাফরিনদের বাড়িতে।কাকা,ফুপু, ফুপারা যে যার মতোন কথা বলে চলেছে।বেশি কথাই হচ্ছে জাফরিনের বিয়ে নিয়ে।আগেই বলেছিল বিয়ে দিতে দেয়নি।এখন বিয়ের আসর ভাংগলো,এই মেয়ে কে নিবে?
কথা বলতে বলতে তারা জিজ্ঞেস করলেন,
“লাশ কী আনতেই হবে?”
জাফরিনের বড় ভাই তার বোনকে ধমক দিয়ে বললেন,
“চুপ থাক,এটা কেমন কথা।লাশ আনবো না কেন?”
“না মানে দশতলা থেকে পড়ছে। কেমন অবস্থায় আছে কে জানে?”
কথা গুলো হজম করতে পারলো না জাফরিন ঘর থেকে বেরিয়ে কিছুটা উচ্চস্বরে বলল,
“কিচ্ছু না থাকুক,খালি হাড় থাকুক তাও আমার বাবার লাশ আমি আনবো।আপনারা সিদ্ধান্ত দেওয়ার কে?আজ আমার পরিবারের এতবড় বিপদে আপনারা আসর বসিয়ে পান খাচ্ছেন?কসম করে বলতেছি, আমার বাপের লাশটা নিয়ে যে একটা কথা বলবে তাকে আমি লাশ দেখতেও দিবো না।আমাদের মনে আর কষ্ট দিয়েন না আপনারা।”
মায়ের কাছে ফিরে তার মাথায় জল পট্টি দিচ্ছিলো সে।বাইরে তাকে বেয়াদব উপাধি দেওয়া হচ্ছে।এতে তার কিছু যায় আসে না।যে লোকেরা আজকেই এসব বলতে পারে তাদের দিয়ে কিছু আশা করা যায় না।
পাশে থাকা মায়ের ফোন হাতে নিয়ে দেখতে পেল বিদেশি নাম্বার থেকে ম্যাসেজ এসেছে,
There is no compensation for your loss. However, I am sorry for your grief. Take care of yourself.
Mashood Sheikh (CEO)
ম্যাসেজটা পড়ে ক্রুর হাসি ফুটে উঠলো জাফরিনের অধরে। সে ফিসফিস করে বলল,
“আমার বাবার কোনো রোগ ছিল না মাশহুদ সাহেব।সে মাথা ঘুরে পড়ে যায়নি।এটা আমার বিশ্বাস।”
চলবে
#ক্যামেলিয়া
#সাদিয়া_খান (সুবাসিনী)
#পর্ব-১
#ছবিয়ালঃমুক্তা
(যারা গল্প পড়েন তারা একটু রেসপন্স করবেন। কারণ পেজের রিচ নেই বললেই চলে।)