#ক্যামেলিয়া
#সাদিয়া_খান(সুবাসিনী)
#পর্ব-৬
(১৬)
বাবা মারা যাওয়ার চার দিনের মাথায় সেসব আত্নীয় মানুষ মেয়েটার বিয়ে নিয়ে তাদের বাড়িতে এসেছে, যারা বলেছিল
“বাবা মারা গেল।এখন তো এক বছর বিয়ে শাদী দেওয়া যাবে না।গুরু দশার বছর চলবে।”
জাফরিনের মায়ের কাছে কথাটা বলার সাথে সাথেই ভদ্রমহিলা কিছুটা নড়েচড়ে বসলেন।তার ভাব ভঙ্গিতে মনে হচ্ছিলো তিনি মনে হয় রাজী হয়ে যাবেন।কারণ তাকে বুঝানো হচ্ছে তার মেয়েও তার কাছে থাকবে।এখন তার জীবনে আর আছেই কী?যার স্বামী নেই, তার কিছুই নেই।মেয়ে বিয়ে দিলেই সে পরের বাড়ি চলে যাবে অথচ বাড়ির মেয়ে বাড়িতে রাখতে আপত্তি কিসের?
জাফরিন কিংবা তার দুই বোন চুপচাপ বসে কথাগুলো শুনছিল।তাদের মাঝে এখন আর এতটা শক্তি নেই যে তারা সবার সাথে লড়াই করবে।
জাফরিনের মা স্তম্ভিত দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে মেয়ের দিকে। তার বার বার মনে পড়ে যাচ্ছে যেবার জাফরিন হলো সেরাতের কথা।চারিদিকে কামিনী ফুলের সৌরভে খা খা করছিল।এত শান্ত রাত যেন সে জীবনে কখনো পায়নি।বাইরে মৃদুমন্দ সমীরণ বইছে। পুরো উঠানে খেলা করছিল জোৎস্না। সেই রাতের মধ্য ভাগে হুট করেই প্রসব বেদনা উঠে তার। হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার প্রয়োজন হয়নি।বাড়িতেই সাধারণ ভাবে জন্ম হয় তার। মেয়েটা যেন তার মাকে আর কষ্ট দিতে চাচ্ছিলো না।তাই এত শান্ত ভাবে জন্ম নিয়েছিল।তার গায়ের রঙ এবং রাতের পরিবেশ মিলিয়ে মনে হচ্ছিলো সবচেয়ে দামী ফুল যেন ফুটেছে। জাফরান রঙের সাথে মিল রেখে নাম রাখা হলো জাফরিন।অত্যন্ত দামী সেই বস্তু এবং পৃথিবীর সব কিছুর উর্ধে হচ্ছে তার এই তিন সন্তান।অথচ এই মানুষ গুলো কী না তাকে তুচ্ছতাচ্ছিল্য করছে?
তাকে নিয়ে তামাশা করতে চাইছে?
নিজের মাঝেই নিজেকে হাতড়ে বেড়াচ্ছে জাফরিনের মা। স্বামীর রেখে যাওয়া তিন সন্তান এখন তার সব কিছু।যে মারা গেছেন তার জন্য সৃষ্টিকর্তার নিকট দোয়া চাইতে পারে কিন্তু তার জন্য অন্য কিছু বির্সজন দিবে কেন?
“আমার জাফরিনের বিয়ে?”
“হুম।ফয়সালের সাথে। তোমাদের হাতে গড়া ছেলে ও। জাফরিনের থেকে বছর পাঁচের বড় হবে। ও কীসে কম আছে?”
“জানেন? আমার মেয়েটা কানাডা লেখাপড়া করতে যাবে?”
“ওটা তো ওর বাপে থাকতে, এখন কী আর তা সম্ভব?”
“কেন সম্ভব না?আমার মেয়ে কোনো খেলনা না।যখন মনে হলো বরযাত্রী এসে ফিরে যাবে আবার পরদিন অন্য মেয়েকে বিয়ে করতে এসে আবার বিয়ে করতে চাইবে। তার পরদিন আপনারা হাই স্কুলের গন্ডি পার হয়নি এমন ছেলের কাছে আমার মেয়েকে বিয়ে দিতে চাইবেন আর আমার মেনে নিতে হবে?”
সুফিয়া বেগমের শান্ত স্বরে বলা কথাগুলো শুনে সবাই নিশ্চুপ হয়ে বসে রইল।এরপর ওর বড় চাচা বলল,
“মেয়েরে কোন জজ ব্যারিস্টার বানাবা?সারা জীবন তো আমার ভাইয়ের রক্ত চুইষা খাইছো।এখন কী লাশটারেও শান্তি দিবা না?”
” স্ত্রী-সন্তানদের দায়িত্ব পালন করা কে রক্ত চুষে খাওয়া বলে? যদি এটাই বলে তবে এটাই।আমার মেয়ের ভবিষ্যৎ নিয়ে আপনাদের এত ভাবতে হবে না।”
“এই বাড়িতে তাহলে থাকতে পারবে না বলে দিলাম।এটা আমার ভাইয়ের বাড়ি।”
“আর আমার স্বামীর।”
“আইনী নিয়ম অনুসারে আমরাও এখন এই বাড়ির অংশীদার।কারণ আজমলের কোনো ছেলে নেই।”
“ততক্ষণ অবধি যতক্ষণ অবধি বাড়ি আপনার ভাইয়ের নামে ছিল।কিন্তু এই বাড়ি তো এখন আম্মার নামে।”
মায়ের উপর প্রতিটা মানুষের ক্ষিপ্ত আচরণ দেখে এগিয়ে এসে জাফরিন কথাটা বলল।সবাই অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল,
“মানে?কবে চুরি করে লিখে নিছে তোর মায়ে?”
“চুরি করে লিখে নেওয়ার কী আছে?বাবার সারা জীবনের উপার্জন, তার স্থাবর সম্পত্তি সব মায়ের নামে করে দিয়েছেন।এটা পাঁচ বছর আগেই হয়েছে।”
“আর শহরের বাড়িগুলা?”
“আমাদের তিন বোনের নামে।”
“ধানের জমি?”
“বাবা যেগুলো রেখেছিলেন, সেগুলো মায়ের অবর্তমানে এক অংশ চলে যাবে এতিম খানায়।আর বাকীটা আপনাদের নামে।”
“এই চুটকি মুটকি নিয়ে আমরা কী করবো?তোর বাপে মরে গেছে কিন্তু যে কাজটা করে গেল জীবনেও কব্বরে শান্তি পাবো না।”
“চিন্তাভাবনা করে কথা খরচ করবেন।কারণ আপনি এখনো আমার বাড়িতেই আছেন।আর কথা বলছেন আমার বাবার সম্পর্কে।সে নিজের যা ছিল তা আমাদের নামে দিয়ে গেছেন আর দাদার যে জমিগুলো আব্বা পেয়েছিলেন সেসব তো আমাদের দেয়নি।সেসব আপনাদের কেই দিয়ে গেছেন।সে কীভাবে বেঈমানী করলো?”
“সেরা সেরা গুলা তোদের দিয়ে গেছে তাই তো বলি।এত হেডাম দেখাও কার পাওয়ারে।”
বাজার করার উদ্দেশ্যে ইউভান এবং তার বাবা বাহিরে গিয়েছিল। বাড়ি ফিরে এসব শুনতে পেরে তিনি বললেন,
“আপনারা মানুষ হিসেবে নিম্নবর্গের। আপনাদের থেকে তো এরা নিরাপদ নয়।”
জাফরিনের বড় চাচা ঘর থেকে বের হতে হতে বলল,
“বিয়ে তো ফয়সালের সাথেই হবে। রাজী না হলে গ্রাম বাসী সেই ব্যবস্থা করবে।”
(১৭)
“আমার কোনো প্রেমিক নেই,
আছে শুধু অন্ধকার।
নেই কোনো বন্ধু
আছে এক রাশ মেঘ।
কই? আমার তো আসে না বসন্ত!
না আসে শরৎের মেঘপুঞ্জ।
আমার আছে শুধুই আমিই
যার রয়েছে নিজের সাথেই নিজের যুদ্ধ।
জাফরিনের সোশ্যাল একাউন্ট স্টক করার সময় স্ট্যাটাস চোখে পড়লো মাশহুদের। মেয়েটার কয়েকটা ছবি দেখছিল সে। যে কেউ বলতে পারে আজমল সাহেব এর মেয়ে সে। চেহারায় বেশ মিল রয়েছে। বিশেষ করে হাসিতে। আপাতত তার আগ্রহ জাফরিনের মুখশ্রী নিয়ে নয়। তার আগ্রহ জাফরিন কে নিয়ে। আজ তাদের বাড়িতে যা যা হয়েছে সব শুনতে পেরেছে সে। ছদ্মবেশে একজন প্রাইভেট ডিটেকটিভ আশ্রয় নিয়েছে তাদের মাঝেই।জাফরিনের উপর চব্বিশ ঘন্টা নজর রাখছে।
তার বিষয়ে তিনটে ব্যাপার খুব করে সামনে এসেছে। জাফরিন মূলত দু হাতেই লিখতে পারে। রাতের অধিকাংশ সময় সে আকাশের দিকে তাকিয়ে কাটায় এবং তাকে কঠিন ভাষায় না বলে নরম সুরে বললে সে বিনাবাক্য ব্যয়ে সব মেনে নেয়।
যদিও এসব কাজ তার নিজের নয় তবে ইচ্ছাকৃত ভাবেই জাফরিনদের সাথে যোগাযোগ করার দায়িত্ব নিয়েছে সে।
এখন বাংলাদেশে সময় কত হবে?রাত দশটা?তবুও সে ডায়াল করলো জাফরিনের মায়ের নাম্বারে। অফিশিয়াল ফোন থেকে নয়, নিজের ফোন থেকে।
কয়েকবার রিং হওয়ার পরেই ভেসে এলো জাফরিনের কণ্ঠস্বর।
(১৮)
ইশান বসেছিল বারান্দায়।এখান থেকে জাফরিনদের বাড়ির উঠান স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। জাফরিন কফির মগ হাতে নিয়ে ইউভানের পাশে এসে বসলো।রাত তখন গভীর হচ্ছে। ইউভান কারোর সাথে ফোনে কথা বলছিল।জাফরিন এগিয়ে আসায় তার দিকে ফোন এগিয়ে দিলে জাফরিন কথা বলা শুরু করলো।কথা বলার
সময় এক পর্যায়ে জাফরিনকে কিছুটা দুঃখী লাগছিল।সে সময় ইউভান পুনরায় তার মাথায় হাত রাখে।ঈশান মনে মনে তাকে জঘন্য গালি দিয়ে বসে। ঠিক যেন দুশ্চরিত্র লোক ইউভান। যে বাহানা খুঁজে শুধু নারী শরীর স্পর্শ করার।কথা শেষ করে তারা ল্যাপটপে ব্যস্ত হয়ে গেল।
ঈশানের পিছনে কখন আশার বাবা এসে দাঁড়িয়েছে সে খেয়াল করেনি।রাতের অন্ধকারে আশার বাবা এক জঘন্য পরিকল্পনা করছিল।
তাদের ধারণা ইউভানের সাথেই জাফরিনের বিয়ে হবে।আগে ধারণা করতো আজ তারা একদম নিশ্চিত হয়েছে। তবুও তারা এক পরিকল্পনা করে চলেছে।
রাতের সবাই যখন ঘুমে তখন জাফরিনের বাবার সব ভাই-বোনেরা বসলেন এক ঘরে। তারা জাফরিনের ভালোর জন্যই এই কাজটা করতে চলেছে। যেহেতু আগামীকাল জাফরিনের দুই বোন এবং তার মামারা সবাই ফিরে যাবে এবং তাদের সাথে জাফরিন কিংবা তার মা কে যেতে দিবে না তারা। কারণ স্বামী মারা গেলে চল্লিশ দিন বাড়ি ছাড়ার নিয়ম অনেক দিন আগে থেকেই তারা মেনে আসছে। জাফরিনের মা কেও সেই নিয়ম পালন করতে হবে।না চাইলে স্বামীর দোহাই দিয়ে হলেও রাখতে হবে। সবাই যখন চলেই যাবে তখন দুই মা মেয়ে থাকবে এক ঘরে। ফয়সালের কোনো কাজ নেই।তার কাজ শুধু ভোর সকাল বেলা জাফরিনদের বাড়ি থেকে এলোমেলো ভাবে বের হবে।পূর্ব পরিকল্পনা অনুযায়ী দুই একজন মানুষ তাকে দেখবে, কিছুটা ঝামেলা হবে এবং এরপর যখন তাকে জিজ্ঞেস করা হবে যে সে কোথায় ছিল?
সে শুধু বলবে রাতে জাফরিনের সাথে ছিল।ব্যস বাকীটা তাদের বিয়ের ব্যবস্থা গ্রামের মানুষ করে দিবে।
চলবে(এডিট ছাড়া, ফেসবুক আপডেটের কারণে রিচ একদম নেই।তাই অনেকের কাছে গত পর্ব পৌঁছায়নি।
যারা গল্পটা পড়ছেন তারা অনুগ্রহ করে রেসপন্স করবেন।কেনোনা আপনারা রেসপন্স করলেই অন্যদের টাইমলাইনে পৌঁছে যায়।আপনাদের জন্যই লিখছি, যদি আপনারাই না পড়তে পারেন তবে আর কী বলবো…)