#ক্যামেলিয়া
#সাদিয়া_খান(সুবাসিনী)
#পর্বঃ২২
বাবার বেডরুমে প্রবেশ করে বিছানায় গা এলিয়ে দিলো জাফরিন।এখন গভীর রাত, এখানে আসার পর ইউভান এবং মায়ের সাথে কথা বলেছে সে। এই মুহুর্তে সে বড্ড ক্লান্ত, তাছাড়া ক্ষুধাও পেয়েছে বেশ বড়সড় আকারে।পেটের মধ্যে ক্ষুধা যেন ঘূর্ণিপাক দিচ্ছে। কী খাবে সে?ব্যাগ খুলতেই মনে পড়লো তা মা ব্যাগে দুটো চিড়ে ভাজা মোয়া দিয়েছে।জাফরিন আনতে চায়নি কিন্তু তার মা জোড় করে দিয়েছেন।যেন ক্ষুধা রাখলে দুটো মুখে দিয়ে এক গ্লাস পানি খেয়ে নিতে পারে।সেই মুহুর্তে বিরক্ত লাগলেও এই মুহুর্তে জাফরিন বুঝতে পারছে তার মা তার এই সময়ের কথা চিন্তা করেই হয়তো দিয়েছেন।বিছানায় বসে প্রথম জাফরিনের যে কথাটা মনে হলো, তা হলো তার বাবার ঘরের জিনিসপত্র অনেকটা এদিক সেদিক করা কিন্তু বুঝার উপায় নেই।নিশ্চয়ই তার বাবার পুরো ফ্ল্যাটে তল্লাশী চালানো হয়েছে। শুধু তাই নয় জিনিসপত্র ওলট পালট করে তারা ভেবেছে জাফরিন এখানে প্রথম বার আসবে আর এই বিষয়টা প্রথম বারে কেউ বুঝবে না।এবার নড়েচড়ে বসলো সে। তার স্পষ্ট ধারণা জন্মে গেল।যদি কেউ এখানে ঢুকে তল্লাশি নিতে পারে তবে অবশ্যই গোপন কোনো ক্যামেরা কিংবা রেকর্ডার রাখাটা অবাককর বিষয় হবে না। যদি ক্যামেরা লাগানো থাকে তাহলে তো!
ভাবতেই কিছুটা অবাক হয়ে গেল সে৷তার বাবার লুকানো ম্যাসেজ কে সে রান্নাঘরে ঢুকে দেখেছিল, সেই কভারটা এখনো তার পাশেই পরে আছে৷তাকে দ্রুত এটা নষ্ট করে ফেলতে হবে, এছাড়াও বড় পয়েন্ট হচ্ছে। তাকে এই বাসাতে সব সময় এক অভিনয় করে যেতে হবে। সে একজন পিতৃহীন অসহায় মেয়ে। যার প্রতিটি পদক্ষেপ বড্ড নড়বড়ে হবে।কথায় কথায় বিপদে পড়ে যাওয়া মেয়েটার সাহায্যে বন্ধু বেশে এগিয়ে আসা ব্যক্তিগুলোই যে তার চির শত্রুপক্ষ।
নিজের পরিকল্পনাকে এক সাইডে রেখে জাফরিন প্যাকেট খুলে মোয়া বের করে। দুটো মোয়া খেয়ে পানি খায় দু গ্লাস। পেট আপাতত কিছুটা শান্ত হয়েছে বলেই হয়তো তার দু চোখে ভর করে ঘুমের প্রজাপতি।ঘুমিয়ে পড়তেই তার স্বপ্নে এসে ডাক দেয় তার বাবা।না নতুন স্বপ্ন নয়, সব তার অতীতের খন্ড খন্ড অংশ।যেখানে সে জাফরিনকে হাতে কলমে শিখিয়েছিল কেমিস্ট্রির কিছু গুপ্ত পদ্ধতি।
(৫১)
ট্রেড মিলের উপর সর্বোচ্চ গতিতে দৌড়ে চলেছে মাশহুদ। নিজেকে শান্ত করার জন্য তার দৌড়াতে হয়, ঠিক যেমন সে দৌড়েছিল তার মায়ের পিছনে কিন্তু সে পিছন ফিরে তাকায়নি।তবুও মাশহুদ দৌড়াতেই অধিক পছন্দ করে।বিজনেসের সকল ডিলের প্ল্যান সে এই ট্রেড মিলে দৌড়ানোর সময়েই ঠিক করে।দীর্ঘ সময় পর নেমে এলো সে। গলায় জমে থাকা বিন্দু বিন্দু ঘাম মুছে নিলো তোয়ালে দিয়ে।কপালের সামনে লেপ্টে আছে এক গাছি চুল। আজ তার একটা গুরুত্বপূর্ণ মিটিং রয়েছে।ফ্রেশ হয়ে নিচে নেমে এলো সে। ডায়নিং টেবিলে বসে অপেক্ষা করছেন তার দাদা-দাদী।গ্র্যানির পাশের চেয়ারে বসে স্মিত হেসে বলল,
“গ্র্যানি,আমি তোমাকে অনেক মিস করেছি এই কয়েক দিন।”
“অহ হানি,আমিও। তুমি তো বিজনেস ডিলে গিয়েছিলে। তো আমার জন্য কি নিয়ে এসেছ?”
“গ্র্যানি, আমি জানি না যা এনেছি তোমার পছন্দ হবে কী না। কিন্তু সবটাই আমাদের সবার জন্য।
তুমিই তো বলো, সব বিষয় সবার জন্য ভালো হয় না। পৃথিবীতে এমন কিছু ঘটনা ঘটে যা আমার অনুকূলে থাকে না কিন্তু যদি সেই ঘটনার কারণে কেউ বা কারোর উপকার হয় তবে অবশ্যই আমদের সে কাজ করা উচিৎ। তাই না?”
নাতনীর প্লেটে দুটো ডিম তুলে দিয়ে ভদ্রমহিলা বললেন,
“কী এনেছো?কোথায় গিয়েছিলে?”
“বাংলাদেশ।”
বিস্ফারিত চোখে তাকিয়ে রইলেন মাশহুদের দাদা।বাংলাদেশ শুনেই বুকের ভিতর বইতে লাগলো এক বিশাল তুফানী ঝড়। মানসপটে ভেসে উঠলো ষোড়শী এক মেয়ে, যার দুই পাশে দুটো বিনুনি,নগ্ন দুই পা। যে পায়ে সে হেঁটে আসছে এক গুচ্ছ লাল পদ্ম নিয়ে। তার মুখের হাসি, দুই চোখের খুশি। এরপর দৃশ্য বদলে গেল।সে দেখতে পেল লাল বেনারসিতে সেই পদ্মকে।গভীর রাতের সেই দুটো নরম হাত, যে আবেগে খামছে ধরেছে তার বুক। নরম অধরের স্পর্শ, উন্মুক্ত কেশে আড়াল উদাম পিঠে এসে পড়া এক ফালি রোদ।
কিন্তু! কেন সে হারিয়ে গেল? দেশেই বা কেন যুদ্ধ লাগলো?আর সেই যুদ্ধে হারিয়ে গেল তার সেই পদ্মটা। স্ত্রীর ডাকে হুশে ফিরলেন ভদ্রলোক।তার স্ত্রী তাকে প্রশ্ন করলেন,
“কী হয়েছে তোমার?ও বাংলাদেশে গিয়েছিল ডিয়ার, বাংলাদেশ। তোমার দেশে…. ”
“হুম।”
“দাদা তুমি কেন ফিরলে না ওদেশে?দেশটা তো সুন্দর।”
“কারণ মুক্তিযুদ্ধে স্ব-পরিবারে নিহত হয় যুদ্ধে।যে দেশে কেউ নেই, সে দেশে হতাশ বুকে ঘুরে ফিরতে যায়নি।আমি যেতে দেইনি।”
“কিন্তু যাওয়া উচিৎ ছিল গ্র্যানি।হতে পারতো কেউ একজন বা কেউ কেউ পুরো জীবন পার করে দিচ্ছে দাদার অপেক্ষায়?”
“না রে। কারণ তোমার যায়েদ আংকেলের বাবা নিজে নিশ্চিত করেছিল তারা কেউ বেঁচে নেই।আর সে এখানে চলে এলো তোমার দাদার কাছে।যদি আমাদের সেখানে কেউ থাকতো তবে আমরা যেতাম না?”
এত কথোপকথনের মাঝেও কিছুই বলেননি মাশহুদের দাদা।সার্ভেন্টের সহায়তায় নিজ রুমে চলে এলেন।তার প্রথম স্ত্রীর স্মৃতি চারণে।বেঁচে থাকলে সে দেখতে কেমন হতো? তাকে কী এখনো মাছের মাথাটা বেছে দিতে হতো?সে কী এখনো দুধের উপরে পড়া ঘন সর খেতে ভালোবাসতো?
(৫২)
এই কয়েক ঘন্টাতেই বেশ বিরক্ত লাগছিল জাফরিনের।ভাতের জন্য মন কেমন করছে।নিশ্চয়ই সুপার শপ গুলোতে সব পাওয়া যাবে কিন্তু এই মুহুর্তে তার কিছু খাওয়াটা অধিক প্রয়োজন।বাবার রান্নাঘরের ক্যাবিনেট খুলে দেখতে পেল কফি,দুধ রাখা আছে। একটা কফি বানিয়ে এদেশিয় ফুড সাইট ঘুরতে লাগলো সে।এমন সময় কলিংবেলটা বাজলো।কফির মগ হাতে দরজা খুললো সে। এমিলি দাঁড়িয়ে আছে।তার দু হাত ভর্তি খাবার।তাকে সাদরে আমন্ত্রণ জানালো জাফরিন।এমিলি প্রবেশ করেই তাকে বলল,
“এটা বাংলাদেশ নয় মিস শিকদার। তাই হুট করেই দরজা খুলবেন না।এই যে স্ক্রীনে দেখে নিবেন কে এসেছে। বাহিরে থাকা ক্যামেরায় আপনি এখান থেকেই দেখতে পারবেন।”
“এখানে ক্যামেরা আছে আপনি কী করে জানলেন?”
“এই হাউস বিল্ডিংটা আপনার বাবা ডিজাইন করেছিলেন তার স্পেশাল টিম নিয়ে। তাদের মধ্যে আমি একজন।আমি উপরের সেক্টরে আছি।”
“আচ্ছা।খাবারের জন্য ধন্যবাদ।”
“এটা কোম্পানির পলিসি।আপনার দায়িত্ব নেওয়া।আপনাকে তৈরি হতে হবে আমরা বের হবো।আজ আপনার এডমিশন হবে।”
“কিছু সময় প্রয়োজন, তাছাড়া ব্রেকফাস্ট করিনি।”
“আমি অনলাইন অর্ডার করছি।আপনি যেতে যেতে খেয়ে নিবেন।আমাদের দেরী করার সময় নেই।”
ইউনিভার্সিটিতে পূর্বেই পৌঁছেছে মাশহুদ।কুঞ্জের সাথে দেখা হওয়ার পর সবটা শুনে কুঞ্জ বলল,
“আজ তবে এটার খোলাসা হয়ে যাবে। শোন আমি ওকে যে কোনো সাবজেক্ট চয়েস করতে বলবো।যেহেতু ও এখানে এডমিশন নিতে চেয়েছে আর ও যথেষ্ট কোয়ালিফাইড। তাই আমার মনে হচ্ছে ও এই সাবজেক্টটাই বেছে নিবে।”
“আর যদি না নেয়?আমরা ওকে যতোটা সাধারণ ভাবে নিচ্ছি ও যদি এর থেকেও সাধারণ হয়। নরমাল একটা সাবজেক্ট কিংবা যে কোনো কিছু?আমার সব ইনভেস্ট ভেসে যাবে।”
“যতটা তুই বলেছিস, এই মেয়েটা পিছিয়ে যাওয়ার মেয়ে নয়। তাকে জানা বোঝার কিংবা দেখার শুরুই হয়নি তবে। এই মেয়ে একটা এজেন্ডা নিয়ে এসেছে।তুই তাকে নিয়ে আসিসনি, সে তোর সাথে এসেছে।এই অষ্টাদশী কন্যা প্রতিশোধের সুবর্ণ সুযোগ খুঁজবে।আর আমরা ওর প্রতিশোধের খেলাতেই ওকেই মাত দিতে হবে।”
ওদের কথার মাঝে এমিলি এসে জানালো সে নিয়ে এসেছে জাফরিনকে।কিছুটা ইতস্তত হয়ে প্রবেশ করলো মেয়েটা।কুঞ্জ হেসে তার সাথে প্রাথমিক আলাপ করে নিলো।অফিসের এক পাশে কাউচে বসে আছে মাশহুদ। কিন্তু জাফরিন একটা বারের জন্যও তার দিকে মুখ তুলে তাকায়নি।কিন্তু যখন সাবজেক্ট চয়েস করতে বলা হলো তখন জাফরিন স্পষ্ট ভাবে বলল তার ইচ্ছেটা। শিকারী নেকড়ের দুর্লভ হাসিটা ফুঁটে উঠলো তখন মাশহুদের ঠোঁটে।সে মনে মনে বলল,
“দেখা যাক, এবার কে এগিয়ে যেতে পারে?তোমার প্রতিশোধ না কি আমার তোমাকে পাওয়ার নেশা।”
চলবে