বৃষ্টিশেষে প্রেমছন্দ পর্ব-১০

0
2202

#বৃষ্টিশেষে প্রেমছন্দ💖
#মুমুর্ষিরা_শাহরীন

১০.
আদর প্রায় দৌড়ে এলো। প্রচন্ড গরমে কানের পাশ দিয়ে চিপচিপে ঘাম জড়ছে। মুখশ্রী হয়ে উঠেছে করুণ লাল। তেজি রশ্মিতে চোখ গেছে কুচকে। হাটুতে ভর দিয়ে হাঁপ ধরা গলায় আদর প্রশ্ন করলো, ‘আমার সাথে যেতে সমস্যা আছে?’

টিকলি অবাক থেকে মাথা নাড়ালো। আদর আবার জিজ্ঞেস করলো হাঁপাতে হাঁপাতেই, ‘সত্যি? একা যেতে সমস্যা নেই তো?’

টিকলি এবার নড়েচড়ে উঠলো। যেনো ঘোর থেকে বেরিয়ে এলো। আদরের প্রশ্নে সে সরাসরি বলল, ‘অবশ্যই আছে। আমি আমার বোনকে ফেলে আপনার সাথে একা যাবো? ভাবলেন কীভাবে?’ টিকলি বলল তেজি গলায়।

আদর অবাক হলো। বিস্ময় সূচক দৃষ্টিতে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে সোজা হয়ে দাড়ালো। শূন্যে ছেড়ে দিলো মুখ ভর্তি রাগী শ্বাস। খানিক গম্ভীরমুখে বলল,

‘আপনি আমি এক মোটরসাইকেলে যেতাম এবং আর্দ্র টিকলি আরেক মোটরসাইকেলে যেতো। এতে আপনার চিপকে বসে থাকতে হতো না। অনেক দূরত্ব রেখে বসে যেতে পারতেন। কাধে হাত চাইলে রাখতে পারতেন আবার নাও পারতেন। যেহেতু আপনার সমস্যা হচ্ছিলো তাই দুটো মোটরসাইকেল ড্রাইভারকে আমি রিকুয়েষ্ট করেছি যাতে আমরা নিজেরাই চালিয়ে যেতে পারি। এবং তারা অন্য আরেকটা মোটরসাইকেল করে আমাদের পথ দেখাবে এবং নজর রাখবে। এতে ভারতি টাকাও নিয়েছে তারা।’

টিকলি খুব গোপনে জিব কাটলো। ইশশ..আগে কথা শুনে তারপর রিয়েক্ট করার উচিত ছিলো। লোকটা বোধ হয় রাগ করলো। কেমন গম্ভীর হয়ে গেলো। টিকলি কানের পাশে চুল গুজে দিয়ে ছোট করে বলল, ‘ওহ।’

আদর খুব ঠান্ডা গলায় বলল, ‘যাবেন নাকি ওদের না করে দিবো?’

‘না না যাবো না কেনো? আসলে আমি দুঃখিত।’

‘ইটস ওকে।’ বলেই গটগট করে হেটে মোটরসাইকেলের ওইদিকে চলে গেলো আদর। টিকলির বুকে আবারো মন খারাপের বরফের ন্যায় ঠান্ডা বাতাস বইলো। ধ্যাত, দিন দিন না সে টায়রার মতো হয়ে যাচ্ছে, কারণে অকারণে উদ্ভট আচরণ করা। কি ভাবলো লোকটা?

,

টায়রা আর্দ্রর সামনে দাঁড়িয়ে হাসি বন্ধ করে আর্দ্রর হাত থেকে আমটা নিয়ে উড়নায় ঘষলো। কামড় দিতে দিতে আর্দ্রর রাগে ফুলে ফেঁপে উঠা মুখখানা দেখে আবারো হুহা করে হেসে উঠলো।
কাঁচা আমটা ছিলো ভীষণ টক। ছাল সুদ্ধ খেতে গিয়ে টায়রার মাড়িতে জোরালো ভাবে কামড় পরলো। অমনি থু থু করে ফেলে দিয়ে সে ডান পাশের চাপা ধরে ‘উউউ’ শব্দ করে উঠলো। টায়রাকে দেখে এবার আর্দ্র হেহে করে হেসে দিলো। টায়রার হাত থেকে আমটা নিয়ে কামড় দিয়ে অংশটুকু হাতে নিলো। ছাল ছাড়িয়ে খেতে খেতে টক খাওয়ার যে শব্দ হয় ‘চ কারান্ত’ সেই শব্দ করতে করতে বলল,

‘বেশি চাপা করলে চাপায় এমনি হওয়া উচিত। আই উইশ এই চাপা আর ভালো না হতো। আল্লাহ!’

টায়রা সাথে সাথে আর্দ্রর বাহুতে একটা থাপ্পড় দিয়ে আবারো চাপা ধরে উউ শব্দ করতে লাগলো। আর্দ্র গরম চোখে তাকিয়ে বলল, ‘এটা কি হলো?’

আস্তে আস্তে টায়রা চাপা নাড়িয়ে বলে, ‘মাইর হলো।’

আর্দ্র টায়রার চুল ধরে আস্তে করে টান দিলো। টায়রা চিল্লিয়ে উঠলো। দূর থেকে টিকলি ওদের ডাকছিলো। আর্দ্র এগিয়ে গেলো সেইদিকে এবং বলল, ‘আসেন নাকি কোলে নিতে হবে?’
‘বেয়াদব।’
‘আপনি।’

________________________________

বিদ্বান, বিচক্ষণ, বহুদর্শী, পারদর্শী আদর খেয়াল করলো হাতিয়া জেলায় মোটরসাইকেল গুলোতে কোনো লাইসেন্স নেই এবং ড্রাইভাররা কোনোরকম সেফটি গার্ড ইউস করে না। মাথায় হেলমেট ড্রাইভারদের ড্রাইভিং লাইসেন্স কিছুই নেই তাদের। এখানে মোটরসাইকেল রয়েছে প্রায় পাঁচ হাজার। পার মান্থ মোটরসাইকেল ড্রাইভারদের দু’শো টাকা ঘুষ দিতে হয়। এছাড়াও খুব সম্ভবত পার ডে দশ টাকা করে দিতে হয়। সুতরাং দেখা যায়, পার মান্থ মোটরসাইকেল থেকে উঠে আসে {(২০০×৫০০০)=১০০০০০০} প্রায় দশ লক্ষ টাকা। (এটি নিশ্চিত নাও হতে পারে)

ভাবনা-চিন্তার যন্ত্র মেশিন অফ করে আদর মোটরসাইকেল স্টার্ট দিলো। টিকলি খুব সন্তর্পণে পেছনে উঠে বসলো। মাঝখানে তার ভেনিটি ব্যাগ রাখলো। তখনের রাগ আদরের এখনো কমেনি। মেয়েটা তখন না জেনেশুনে আদরকে অযথা কথা শুনিয়ে দিয়েছিলো। টিকলি বসেছিলো একদম গুটিসুটি হয়ে। সামনে কোনো বাঁকা ত্যাড়া রাস্তা এলে যে সে ধপাস করে পরে যাবে তা নিশ্চিত। আদর বলল একদম সাপের মতো ঠান্ডা গলায়,

‘আমাকে ধরে বসুন। পরিস্থিতির চাপে পরেই আপনাকে নিয়ে যাচ্ছি এবং আপনিও এই অপরিচিত আমার সাথে যাচ্ছেন। নচেৎ, কোথায় হারিয়ে যেতাম আমরা। তাই এতো আড়ষ্টতার বা লজ্জিত হওয়ার কিছু হয় নি। ট্রাই টু বি ইজি। আমাকে ধরে বসলে আপনি কলংকিত হয়ে যাবেন এমন তো না?’

টিকলি মাথা নিচু করলো। লোকটার কথাগুলো একদম তীরের ফলার মতো। চ্যাটাংচ্যাটাং করে বলা কথাগুলো যেনো একদম বুকে বিঁধে। একটা ঠান্ডা স্বাভাবিক অতি বুদ্ধিমান মানুষও এর কথার জ্বালায় বিব্রত হয়ে পরবে। যে মানুষ কোনোদিন রাগ করেনা সেই মানুষটাও আদরের কথায় ভয়ানক রাগ করবে বলে টিকলির ধারণা। টিকলি চোখ বন্ধ করে আস্তে আস্তে আদরের কাধে হাত রাখলো।

লুকিং গ্লাস মুখ দেখার জন্য নয়। পেছন থেকে কোনো গাড়ি আসছে নাকি আসছে না তা দেখার জন্য। লুকিং গ্লাস ঠিকমতো তুমি দেখতে পারো তার মানে ৩০℅ গাড়ি চালানো তুমি শিখে গেছো। কিন্তু এই প্রথম আদর নিয়মের খেলাপ করলো। লুকিং গ্লাসে টিকলির মুখটাই দেখলো প্রথম। তার মৃদু কাঁপা রক্তলাল ঠোঁট, ফুলে উঠা কপোল, ঘর্মাক্ত ললাট, বন্ধ দুটি অক্ষিপট। সবচেয়ে সুন্দর যেনো সেই নয়নগুলোই। মোটা ফ্রেমের চশমার নিচের সেই বন্ধ আঁখি দুটো ভারী নিখুঁত সুন্দর এবং মিষ্টি। হঠাৎ টিকলি চোখ খুলল। আদর পড়িমরি করে চোখ সরালো এবং আস্তে ধীরে বলল,

‘মাস্ক পরেননি?’

টিকলি মাথা নাড়িয়ে বলল, ‘না। ভুলে গেছি।’

মাস্কের কথা মনে পরতেই মনে পরে গেলো সেই মাস্ক পরিহিতা পনেরো দিনের প্রেগন্যান্ট মেয়েটার কথা। আদরের আবারো রাগ হলো। আদর ইচ্ছে করেই মাস্ক পরেনি। কিন্তু এই করোনাকালে মাস্ক না পরে ঘুরা খুব ই ঝুকিপূর্ণ। কিন্তু তাতে কি? এই এতো সুন্দর সময়গুলোতে মাস্ক পরে সেই মেয়ের কথা চিন্তা করে আদর সময়গুলো নষ্ট করতে চায় না। সে শক্ত গলায় বলল, ‘আর পরবেনও না মাস্ক। আমার সাথে যতক্ষণ আছেন ততক্ষণ পরবেন না।’

টিকলি হা করে চেয়ে থেকে শুধু ঘাড় কাৎ করলো। চোখে চশমাটা ঠিক মতো এঁটে দিয়ে তাকালো ফেলে চলে আসা একের পর এক গাছ-গাছালি, বাড়ি-ঘর, দোকান-পাট, মানুষ-জন, রাস্তা-ঘাট, রাস্তার পাশে বুনোফুল, প্রকৃতির দিকে। এসব মনোমুগ্ধকর দৃশ্য দেখতে দেখতেই টিকলি একটা অসংগতিপূর্ণ কথা ভাবলো,

‘মাস্ক পরলে প্রকৃতি অনুভব করা যায় না। মাস্ক ছাড়াই ঠিকঠাক।’

‘আঙুর ফল টক’ টিকলির বলা কথাটা একদম এই প্রবাদ বাক্যের সাথে না মিলে গেলেও ধাঁচটা প্রায় এরকমই।

,

আদর আর্দ্র যেই মোটরসাইকেল গুলো দিয়ে যাচ্ছে সেই মোটরসাইকেলের ড্রাইভার দুটো যাচ্ছে আরেক মোটরসাইকেল দিয়ে। ভাড়া সম্পূর্ণই আদর বহন করবে। ড্রাইভার গুলো মোটরসাইকেল নিয়ে আগে আগে যাচ্ছে তাদের পেছনে যাচ্ছে আদর ও আর্দ্রর মোটরসাইকেল। কারন তারা রাস্তা চেনে না। ড্রাইভার দুটোর মধ্যে একটা ড্রাইভার ঘাড় ঘুরিয়ে পেছন দিক তাকিয়ে আছে। কারন মানুষগুলো তো চোর ও হতে পারে। হুটহাট মোটরসাইকেল নিয়ে ভেগে চলে যেতে পারে। একমাত্র টাকার নেশায় পরেই মোটরসাইকেল দিয়েছে তাই বলে কি নজর রাখবে না? পেছনে বসা সেই ড্রাইভার লোকটা এক মিনিটের জন্যেও ঘাড় সোজা করেনি। আর্দ্র নিশ্চিত এই ড্রাইভার তার ঘাড় আর জীবনেও সোজা করতে পারবে না। ইশশ….বেচারা তাদের নজরে রাখতে গিয়ে নিজের ঘাড়টাকে খোয়াচ্ছে। কষ্টে আর্দ্রর বুকটা ভেঙে গুড়গুড় হয়ে যাচ্ছে।

আর্দ্রর বুকটা যখন ড্রাইভারের কষ্টে পুড়ে প্রায় খা খা ঠিক তখন তার চোখ গেলো লুকিং গ্লাসে একটা রজোশর্মারী ক্ষেপা রাগিবুন্ড মেয়ের দিকে। যার গাল ফুলা রাগে, জিদে ফুলা ট্যাপা নাক, কপালে কুঞ্চন, ঠোঁট বিকৃত।

আর্দ্র দুষ্টুমি করে জোরে একটা ব্রেক কষলো। টায়রা গিয়ে আছড়ে পরলো আর্দ্রর পিঠে। রোষানলে জ্বলে উঠে টায়রা বলল, ‘আমার বোন এই ভয়ের জন্য মোটরসাইকেলওয়ালা দের বাদ দিয়ে আপনার সাথে নিয়ে যাচ্ছে। আর আপনি সেই ইচ্ছাকৃতভাবে ব্রেক ই কষলেন? ড্রাইভারদের থেকেও অধিক বেয়াদব আপনি।’

মোটরসাইকেল চালাতে চালাতেই আর্দ্র ঘাড় ঘুরিয়ে টায়রার দিকে তাকালো। চোখ লাল করে বলল,

‘আপনি কি সামহাও আমাকে লাউসি (Lousy=লুচ্চা) বলতে চাইছেন?’

টায়রা হাত দিয়ে আর্দ্রর মুখ সামনে ঘুরিয়ে দিলো। কাটকাট গলায় বলল,

‘বলতে চাইছি না, আমি এটাই বলছি। এখন তো এটা বলেছি। একটুপর খুনীর তকমা গায়ে লাগাতে না চাইলে সামনে দেখে বাইক চালান।’

আর্দ্র উচ্চস্বরে বলল, ‘হোয়াট? আমি খুনী? আমি লাউসি? আচ্ছা এখন যে আপনি হাতে দিয়ে আমার গাল ধরে সামনে ঘুরিয়ে দিলেন তাহলে আপনি কি হলেন? লিউড(Lewd),অসচরিত্র, অশ্লিল, নোংরা?’

টায়রা চোখ বড় বড় করে তাকালো। পানিতে ভাসমান চোখ দুটো নিয়ে তাকিয়ে বলল, ‘আপনি আমাকে এসব বলতে পারলেন?’

আর্দ্র আরো তেজি গলায় বলল, ‘তো বলবো না? আমি কি আপনাকে স্বাদে নিয়ে যাচ্ছি? আমরা দু’ ভাই কি পারতাম না একা চলে যেতে? আপনাদের কথা ভেবেই তো হেল্প করা। আর তাছাড়া আপনার বোন তো ভরসা করে আপনাকে আমার সাথে যেতে দিয়েছে আর আপনি আমার সম্পর্কে কত খারাপ মনোভাব পোষণ করলেন!’

টায়রা আবারো কিছু বলতে চাইলো। আর্দ্র আটকে দিয়ে বলল, ‘আর একটা কথা বললে ধাক্কা দিয়ে গাড়ি থেকে ফেলে দিয়ে খুনীর তকমা গায়ে লাগিয়েই ঘুরবো। তাছাড়া আমার গার্লফ্রেন্ড আছে। আপনার প্রতি কোনোরকম এট্রাকশন কাজ করার চান্সই নেই। তাই আজেবাজে চিন্তা গুলো মাঠের বাইরে ফেলে দেন।’

আর্দ্র বড় বড় নিঃশ্বাস ফেলল। টায়রা ধীর কণ্ঠে স্বগোতক্তি করলো, ‘গার্লফ্রেন্ড আছে? সত্যি?’

আর্দ্র বাঁকা হেসে বলল, ‘এমনভাবে বলছেন যেনো ইউ ক্রাশড অন মি।’

টায়রা মুখ ঘুরিয়ে তাকালো। লুকিং গ্লাসে তা দেখে আর্দ্র হেসে দিলো। সেই হাসি যেনো ধনুকের মতো অপমান সূচক হয়ে বিধলো টায়রার হৃদয়ে।

চলবে❤️

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here