বৃষ্টিশেষে প্রেমছন্দ পর্ব-১১

0
1930

#বৃষ্টিশেষে_প্রেমছন্দ❤
#মুমুর্ষিরা_শাহরীন

১১.
বাতাসের শনশন শব্দ কেটে ছুটে চলেছে মোটরসাইকেল। পিচঢালা রাস্তার দু’পাশে ইয়া বড় বড় মোটা মোটা গাছ। দূর-দূরান্ত পথের দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকলেই মনে হয়, এ যেনো এক শিল্প! কোনো শিল্পী খুব নিখুঁত ভাবে রং তুলি দিয়ে এই রাস্তার দৃশ্যপট এঁকে গেছেন একের পর এক। বৃষ্টির পানিগুলো ঝলমলে রোদ্দুরে ঝিলিক দিচ্ছিলো। পানিতে ভেসে উঠেছে খয়েরী দেহের সবুজ পাতার গাছগুলোর প্রতিচ্ছবি। নাম কি গাছগুলোর? কড়ই গাছ বুঝি? টিকলি মুগ্ধ হয়ে দেখছিলো সাথে দু চোখ ভর্তি কৌতুহল নিয়ে ভাবছিলো। হঠাৎ আদরের থমথমে মুখের দিকে চোখ যেতেই টিকলি আস্তে করে বলল,

‘বাদর সাহেব, আপনি কি রেগে আছেন?’

তখনের করা টিকলির ওভার রিয়েক্ট এখনো আদরের মনে গেঁথে আছে। যদিও এরপরে তাদের অনেক স্বাভাবিক কথাবার্তা হয়েছে তবুও ঘুরেফিরে আদরের মনে হচ্ছে, মেয়েটা ওমন করে রিয়েক্ট করলো কেনো? না জেনে বুঝে এতো তেজি গলায় কেনো কথা বলল? এক মুহুর্তের জন্য আদরকে সে খারাপ ভেবেছে বলেই না আদরের সাথে একা আসতে চায়নি। ওতো উঁচু গলায় কথা বলতে পেরেছে। ভেবেই আদরের খারাপ লাগলো। আগ বাড়িয়ে কারোর উপকার এর জন্যই সে করতে যায় না। অকারণে না জেনেবুঝে কারোর উপর উঁচু গলায় কথা বলা কিংবা তেজী স্বরে কথা বলা আদরের একদম পছন্দ না। আর তা যদি হয় নিজের সাথে তাহলে তো কথাই নেই। নাকের পাটাতন ফুলিয়ে আদর উত্তর দিলো,

‘সবকিছু বাদ দিন। আগে বলুন আমাকে কি বলে ডাকলেন?’

টিকলি জিব কেটে অন্যদিকে ঘুরে খুব গোপনে হাসলো। কোনোরকম হাসি চেপে রেখে আবারো প্রশ্ন করলো, ‘আমরা এখন মোক্তারিয়া ঘাটে যাচ্ছি তাই না বাদর থুরি আদর সাহেব?’

নাক ফুলিয়ে আদর এক বাক্যে বলে দিলো, ‘না।’

আত্মা ধক করে উঠলো টিকলির। এখন তো তাদের মোক্তারিয়া ঘাটেই যাওয়ার কথা। সেই ঘাট থেকে স্পিডবোট কিংবা ট্রলারে করে বন্দরটিলা ঘাট। এছাড়া তো আর কোনো রুট নেই। সব তো টিকলি ঠিকঠাক জেনেই এসেছে। তবে? তবে কি টিকলি ভুল করলো এই মানুষটাকে বিশ্বাস করে?

দুরুদুরু বুকে টিকলি বলল, ‘কি বলছেন আপনি?’

‘সরি মিস. টিকটিকি আমরা মোক্তারিয়া ঘাটে যাচ্ছি না। তার আগে আমরা যাবো কমলার দিঘি। ড্রাইভারদের সাথে আগেই কথা বলে নিয়েছি। কমলা দিঘি দেখে তারপর আমরা যাবো মোক্তারিয়া ঘাট।’

টিকলি চোখ বুজে বুকে হাত দিয়ে প্রশান্তির শ্বাস ফেলল। আর একটু হলেই তার প্রাণ পাখি উড়ে চলে যেতো বন্ধ কোনো কুটিরে। টিকলি যখন বুকে ডান হাত রেখে নিঃশ্বাস নিচ্ছিলো তখন মোটরসাইকেল একটা বিটের উপর দিয়ে গেলো। অসতর্কতাবশত টিকলি প্রায় ঝুঁকে পরেই যেতে নিয়েছিলো। আদর তাড়াতাড়ি এক হাত দিয়ে টিকলিকে আটকানোর চেষ্টা করলো। টিকলি কোনোরকম নিজেকে সামলে নিয়ে আদরের কাধে আবারো হাত রেখে বসলো। ঝাঁজালো গলায় উঁচুস্বরে আদর বলল,

‘কাউকে অযথা সন্দেহ করলে এমনই হয়। মেয়ে মানুষের সন্দেহের বাতিক বেশি লোকে ঠিক বলে।’

টিকলি বড় বড় করে চেয়ে সূক্ষ্ম কন্ঠে বলল, ‘অপমান করছেন?’

‘না পূজা করবো আপনাকে।’ ত্যাড়া উত্তর আদরের।

টিকলি নাক ফুলিয়ে বসে রইল এবং এই সিদ্ধান্তে উপনীত হলো যে, সে আর এই লোকটার সাথে কথাও বলবে না আর সন্দেহও করবে না। লোকটার কথা তো নয় যেনো তীরের ফলা।

,

সামনের ড্রাইভারদের অনুসরণ করতে করতে ওরা কমলার দিঘি এসে পরলো। পথের মাঝেই একটা জায়গায় দু’ পাশে বিশাল বড় বড় ঝাউগাছ আর মাঝখানে মাটির সরু রাস্তা। রাস্তাটা এতো সরু যে ঝাউগাছের ডাল-পালা শরীরের সাথে বাড়ি খেয়ে যাচ্ছিলো।

দু’পাশের ঝাউবনের ভিড়ে ওরা যখন যাচ্ছিলো তখন প্রকৃতির আবেশে টিকলির মুগ্ধকরা নয়নে একটা ঝাউগাছের চিকন ডাল এসে বাড়ি খেলো। টিকলি কুকরিয়ে উঠলো। আদর প্রায় সাথে সাথে মোটরসাইকেল থামালো। ওদের সাথে থামলো পেছনের আর্দ্রর মোটরসাইকেল ও। সামনের যে ড্রাইভার ওদের দিকে নজর রাখছিলো সেই ড্রাইভার সামনের দুজনকে বলল মোটরসাইকেল থামাতে। সবাই এগিয়ে আসতেই ছোট-খাটো একটা ভিড় জমে গেলো। টায়রা দেখলো টিকলির বাম চোখের ভ্রুর উপর কেটে গেছে। অল্প থেকে চোখ টা বেঁচে গেলো।

আর্দ্র হন্য হয়ে নিজের ব্যাগ থেকে পানি নিয়ে এলো। টায়রা টিকলির মুখে পানি ছিটিয়ে দিয়ে বলল, ‘কারোর কাছে কোনো মলম বা ওষুধ হবে?’

আদর দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে সব দেখছিলো। এতোক্ষণে সে নিজের ব্যাগটা আর্দ্রর দিকে ছুড়ে মেরে বলল, ‘ব্যথার মলম আর ওয়ান টাইম ব্যান্ডেজ আছে। ‘

টায়রা যখন টিকলির কাটা স্থানে মলম দিয়ে দিচ্ছিলো তখন টিকলি অবাক চোখে তাকিয়ে দেখছিলো আদরকে। একটা মানুষ এমন হতে পারে? এ কেমন মানুষ? টিকলিকে এতো হেল্প করলো। টিকলির জন্য মোটরসাইকেল ভাড়া করে নিজে চালিয়ে এলো। অথচ টিকলির ব্যাথার সময় সে পাথর হয়ে দাঁড়িয়ে রইল?

টিকলি উঠে দাড়ালো। টায়রা বলল, ‘পারবি তো যেতে? ব্যাথা করছে?’

‘না। তোরা চল।’

যে যার মোটরসাইকেলে উঠে বসলো। টিকলি আদরের পেছনে উঠে বসতেই আদর বলল, ‘মাথা নিচু করে রাখবেন। পারলে আমার পিঠের সাথে মাথা ঘেঁষে রাখবেন।’

টিকলির মনে আবারো হাওয়ায় দোলনা দুলল। ঠিক যখনি এই মানুষটাকে খারাপ ভাবে ঠিক তখনি এই মানুষটা আরো বেশি ভালোয় পরিণত হয়ে যায়। গাড়িগুলো সব আবার চলতে শুরু করলো টিকলি একটু মন খারাপ করে জিজ্ঞেস করলো,

‘আপনি ওমন পাষাণ হয়ে দূরে দাঁড়িয়ে তাকিয়ে তাকিয়ে দেখছিলেন কেনো?’

‘কেউ যদি নিজ থেকে ইচ্ছে করে ব্যাথা পায় তাহলে তো এমনি করা উচিত। ডোন্ট কেয়ার ভাব তাইনা?’

‘আমি ইচ্ছে করে ব্যথা পেয়েছি?’ টায়রার অবাক কণ্ঠ।

‘তা নয়তো কি? আপনি যদি ওতো হা করে এই ঝাউ গাছের দিকে না তাকিয়ে থেকে মাথা নিচু করে চোখ বন্ধ করে রাখতেন তাহলেই তো আর এই দূর্ঘটনা ঘটতো না। এখানে কারোর কিছু হলোনা কিন্তু আপনি চোখ টোখ কানা করে বসে রইলেন।’

খাঁটি সোনার কথা। কিন্তু টিকলির পছন্দ হলো না। গোমড়া মুখে বসে থাকলো। সবসময় কি সব দোষ তার হয়?

দু মিনিটের মাথায় তারা কমলার দিঘির বীচের কাছে থামলো। দেখলো দু একজন পর্যটক এসেছে এই কমলার দিঘি ঘুরতে। কমলার দিঘি তেমন একটা পরিচিত পর্যটন কেন্দ্র নয় তবে হাতিয়ার স্থানীয় জনগনের কাছে এটি বেশি জনপ্রিয়। কমলার দিঘি মূলত একটি চর। একে কমলার দ্বীপও বলা যায়। এর চারিপাশ হাজার হাজার কেওড়া গাছ দ্বারা ঘেরাও। বিস্তৃত জায়গা জুড়ে এই কেওড়া বন। বাংলাদেশের বনবিভাগ থেকে একসময় এই জায়গায় অসংখ্য কেওড়া গাছ লাগানো হয়েছিলো যাতে নতুন জেগে উঠা চরকে আকড়ে ধরে রাখতে পারে। এর পাশেই রয়েছে একটা দিঘি। মাটির রং এখন মেটে রঙের হলেও একসময় কিছুটা লাল-কমলা ছিলো বলে এর নাম কমলার দিঘি।

বঙ্গোপসাগরের অতি নিকটে মেঘনা নদীর পাড় ঘেঁষে জেগে উঠা এই চরের মাইলের পর মাইল সবুজ কেওড়া গাছের বেষ্টনীতে বেষ্টিত সবুজ ঘাসের চাদরে ঢাকা বিস্তৃত মাঠ, সুবিশাল আকাশ, চিকমিক সাদা বালুর বীচ। সাগরের তীরে চরের ধবধবে সাদা বালু রৌদ্রময় উষ্ণ। এছাড়াও, রয়েছে সারি সারি কেওড়া গাছ, যা দেখলে চোখের পাতা মুগ্ধতায় ডানা ঝাপটানো বন্ধ করে দেয়।

কেওড়া গাছের আশেপাশে রয়েছে অসংখ্য শ্বাসমূল। স্থানীয় মানুষজন সম্ভবত একে ‘বুম/ভূম’ বলে।

সামনেই দেখা যাচ্ছে বঙ্গোপসাগর। সাগরের পাড়ে সুমধুর ঠান্ডা বাতাস। গাছেরা দুলছে অবিরাম। অন্তহীন নৃত্যে মেতে উঠেছে তাদের ডাল-পাতা। চিকচিক ভেজা উষ্ণ বালুময় ভূমিতে পা দিতেই সুরসুরি লাগছে। টায়রা এক্সাইটমেন্টে কথা হারিয়ে ফেলেছে। প্রকৃতির আকর্ষনে আপ্লুত সে। আদর আর্দ্র দুজন চোখে সি ব্লু রঙের একই সানগ্লাস পরে দাঁড়িয়ে ছিলো। পেছন থেকে ড্রাইভাররা তাড়া দিলো। আর্দ্র আদর এগিয়ে গেলো মোটরসাইকেলের দিকে। ওরা যেতেই টায়রা টিকলিকে খোঁচা দিয়ে বলল,

‘তুই ওই ভাদ্রর সাথে যা, আমি আদর ভাইয়ার সাথে যাবো।’

আর্দ্র তখন ডাকতে এসেছিলো ওদের। টায়রার কথা শুনে সে তেজীয়ান গলায় বলল, ‘মিস. ফুটা টায়ার নিজেকে এতো প্রায়োরিটি দিবেন না বা ইম্পোর্টেন্ডও ভাববেন না। আপনাকে নিয়ে যেতে আমার বয়েই গেছে। ‘

আর্দ্র টিকলির হাত ধরে বলল, ‘তুমি আসো তো আপু। আমি তোমাকে নিয়ে যাবো। কোনো টায়ার ফায়ার বহন করার মতো ইচ্ছে আমার নেই।’

টায়রা নাক ফুলিয়ে ভেংচি কাটলো। বলল, ‘ক্ষমতা থাকার লাগে এই টায়রাকে বহন করতে।’

‘সেই ক্ষমতা আমি চাই না। কোনোভাবে পেলেও সেই ক্ষমতা আমি বিকিয়ে দিবো।’ আর্দ্র বলল দূর থেকে গলা উচিঁয়ে। আর্দ্রর এমন ধারার কথা শুনে টায়রার মনে ক্ষিপ্ত বাতাস বইলো। এদিকে টিকলিকে কোনো কথা বলার সুযোগ না দিয়েই তাকে টেনে হিচড়ে নিয়ে যাচ্ছে আর্দ্র।

আদর মোটরসাইকেলের সাথে হেলান দিয়ে বেঁকে দাঁড়িয়ে মুখ দিয়ে শিষ বাজাচ্ছিলো। হঠাৎ সে দেখলো আর্দ্র টিকলির হাত ধরে টেনে নিয়ে যাচ্ছে। তা দেখে আদর স্বাভাবিক ভঙ্গিতে সানগ্লাসটা খুলল চোখ থেকে। টিকলি অসহায় ভাবে এক ঝলক তাকালো আদরের দিকে। এই তাকানোর অর্থ কি আদর জানে না। তবে তার মনে বিষন্ন সুর বয়ে গেলো। শিষ বাজানোর তাল কেটে গেলো। কিছুক্ষণের নিস্তব্ধতা ছুয়ে গেলো। তারপর আবারো স্বাভাবিক ভাবে সানগ্লাস টা চোখে পরে সে মোটরসাইকেলে উঠে বসলো।

আর্দ্র তখন মোটরসাইকেল স্টার্ট দিয়ে দিয়েছে। টিকলি আদরের দিকে একবার তাকিয়ে উঠে বসলো আর্দ্রর পিছনে। টায়রা এসে দাড়িয়েছে তখন আদরের পাশে। আদর টায়রার দিকে তাকিয়ে জোরপূর্বক হাসি দিয়ে বলল, ‘ হঠাৎ বাইক চেঞ্জ?’

‘কিছু না ভাইয়া। এমনি।’

টায়রা কিছুই বলল না আদরকে। আর এই না বলা ‘এমনি’ কথাটাই আদরের বুকে সুইয়ের মতো বিধে রইল। ‘আপনি একবার আমাকে বলে গেলেন না?’ এই প্রশ্নটা অজান্তেই আদরের মনে বারংবার ঘুরপাক খেলো। এমনি এমনি মোটরসাইকেল চেঞ্জ করার কি আদেও কোনো কারন ছিলো? এটা কি আমাকে অপমান করা নয়? আমাকে কিছু না বলে হুট করে অর্ধেক রাস্তায় এসে আমারই ছোট ভাইয়ের সাথে সে চলে গেলো। এটা কি কোনোভাবে আমাকে রিজেক্ট করা হলো না? আদরের মুখ ভারী হয়ে গেলো। গম্ভীর গলায় সে বলল,

‘উঠে বসো টায়রা।’

চলবে❤️

সাড়া কমে গেছে হঠাৎ করেই। গল্পটা কি ভালো লাগছে না?

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here