#বৃষ্টিশেষে_প্রেমছন্দ
#মুমুর্ষিরা_শাহরীন
২৬.
কেটে গেছে দিন পনেরো। ছোট ছোট অনুভূতিতে মত্ত টিকলি-আদরের ফোনালাপ। সপ্তাহে একদিন দুইদিন বিরামহীন আলাপকালে ক্রমেই দূর্বল হয়ে উঠলো আকর্ষণরা। আষাঢ়ে বৃষ্টির পদাচরণ শহর জুড়ে। জল বর্ষণে মুখরিত এবং আরামদায়ক পরিবেশ। বাড়ির পাশে বড় গাছটাতে কদম ফুলে ছেয়ে গেছে। ছাদের একপাশের মাঝারি সাইজের টপে বেলি, জুই, জিনিয়া ফুটেছে। সুন্দর দীপ্তিযুক্ত এই ফুলের সুভাসে বর্ষাকালের আগমন। সাথে অভ্যর্থনা জানায় মেঘলা আকাশকে। আষাঢ় বাদল এমন এক দুপুরে হঠাৎ আদরের ফোন আসবে ভাবতে পারেনি টিকলি। পরিবারের সাথে খেতে বসার সময়টাতেই ফোন এসেছিলো। ফোন কেটে দিলো। সবাই ভ্রু কুচকে তাকালো টিকলির দিকে। খানিকটা ইতস্তত বোধ করে টিকলি জবাব দিলো,
‘নিভা ফোন করেছে।’
টায়রা মুখে খাবার পুড়ে জিজ্ঞেস করলো, ‘তা ধরলি না কেনো?’
‘খেয়ে তারপর কল ব্যাক করবো।’ টিকলি খাওয়ায় মনোযোগ দিলো।
চটপট সবার আগে খাওয়া শেষ করে ঘরের দিকে দৌড়ে এগোলো টিকলি। ঝটপট আদরকে ফোন দিয়েই বলল,
‘সরি সরি। খাচ্ছিলাম। সবাই সামনে ছিলো।’
আদর ব্যস্ত কণ্ঠে বলল, ‘আমি কথা বলার জন্য ফোন দেইনি টিকলি। কথা বলার মতো সময় এখন হাতে নেই। এক্ষুনি অপারেশনে যেতে হবে আমায়। তবে একটা ইনফরমেশন দিতে ফোন করেছি। এক্ষুনি ফোন না দিলে কোনোমতেই শান্তি হচ্ছিলো না।’
‘কি ইনফরমেশন ডাক্তার?’
‘কাল আমি ফ্রি থাকবো বিকালে। চারটায় দেখা করা চাই ই চাই। কোথায় দেখা করবেন এড্রেস টা মেসেজ করে দিয়েন। রাখছি। বায়।’
টিকলিকে কথা বলার সুযোগ না দিয়ে ফোন কাটা হলো। উৎফুল্লে মুখের বুলি কপচিয়ে গেলো। এতোটা খুশি হলো যে, বাইরে প্রকাশ পেয়েও পেলো না। অত্যন্ত চাপা আনন্দে মাতোয়ারা হয়ে উঠলো সদ্য ফুটা প্রেমিক মন। পেছন থেকে তখন কারোর গোয়েন্দার গলা শুনা গেলো,
‘কে ব্যাপার রে তোর? কে ফোন করেছিলো?’
টিকলি ঘাড় ঘুরিয়ে তাকালো। টায়রাকে দেখে নিয়েই জড়োসড়ো হয়ে গেলো। তবুও বাইরে ডাট বজায় রেখে বলল,
‘বললাম না নিভা ফোন দিয়েছিলো।’
টায়রা ভ্রু কুচকে প্রশ্ন করলো, ‘সত্যি? কই দেখি?’
টিকলির ফোন নিতে গেলেই টিকলি দু কদম সরে দাঁড়িয়ে অদ্ভুত ভাবে বলল, ‘ফোন নিতে হবে কেনো? আমি বলছি তো।’
টায়রা অবাক কণ্ঠে বলল, ‘বেশ কিছুদিন যাবত থেকে দেখছি তোর ফোন আসছে বারবার। জিজ্ঞেস করলেই বলিস নিভা ফোন করেছে। নিভার এতো কীসের দরকার তোর কাছে?’
‘এমনি। দরকার থাকতে পারেনা?’
টায়রা মৃদু হেসে বলল, ‘ওহ তাই? দাড়া এক মিনিট।’
টায়রা আকস্মিক ফোন লাগালো নিভাকে। ওপাশ থেকে নিভা ফোন ধরতেই বলল, ‘তুই একটু আগে টিকলিকে ফোন দিছস?’
বৃষ্টিভেজা দিনে ঘুমিয়ে আরাম। দুপুরে খেয়ে নেয়েই কাঁথা মুড়ি দিয়ে ভাত ঘুম দিয়েছে নিভা। টায়রার কথা শুনে ঘুমুঘুমু কন্ঠেই শাসালো সে,
‘থাপ্পড় চিনস? এই কথার জন্য ফোন দেওয়া লাগে আবার? টিকলির সাথে গত সাতদিনে আমার ফোনে কথা হয়নাই। মেসেজ হইছে শুধু।’
টায়রা ভার কণ্ঠে বলল, ‘আচ্ছা তুই ঘুমা। ডিস্টার্ব করার জন্য সরি।’
ফোন কাটতেই টিকলির দিকে তাকালো টায়রা। টিকলি উদাস চোখে আকাশ ফেটে গড়িয়ে পড়া জল-বর্ষন দেখছিলো। ধরা খাওয়া মুখটা লুকিয়ে চুরিয়ে রাখতে চাইলো ওই আকাশের বুকে। টায়রা বলল খানিকটা ধরা গলায়,
‘আমাদের মধ্যে তো কখনো কিছু লুকানো থাকতো না টিকলি। আমাদের মাঝে দূরত্ব সৃষ্টি করে ফেললি আপু?’
শেষ শব্দটা বলেই চোখ মুছে ঘর ছেড়ে দৌড়ে পালালো টায়রা। কিছুটা নিরবে অশ্রু গলিয়ে পরলো টিকলির কোমল ফুলা গালবেয়ে। আচ্ছা, টিকলি কি টায়রার সাথে প্রতারণা করে ফেলল? মিথ্যে কেনো বলল? কেনো কষ্ট দিয়ে ফেলল? টিকলি তো চেয়েছিলো আদরের সাথে আগে ওর দেখা হোক। এরপর বুঝুক ব্যপারটা আসলে কোন পর্যায়ে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছিলো সে। তারপর পুরো ঘটনা টায়রাকে বলবে। হয় টায়রা সারপ্রাইজড হতো নয়তো হতাশ হতো। কিন্তু কি থেকে কি হয়ে গেলো?
________________________________
আর্দ্রর পা ভালো হয়েছে। চলতে ফিরতে অল্প একটু সমস্যা হলেও মানিয়ে নেওয়া যাচ্ছে। দুপুরে খেয়ে ক্লান্ত বিছানায় শরীরটা এলিয়ে দিতেই তার উপর আদেশ এলো ভারসিটি গিয়ে নিভাকে টিফিন বক্সে করে খাবার দিয়ে আসতে। নিভার মা নামক একমাত্র খালামনিটি নাকি নানুবাড়ি গিয়েছে। আর্দ্র বিরক্ত হয়ে বলল,
‘মাত্র খাইলাম আম্মু। এখন পারবো না, যাও। তোমার বোনের এতো বাপের বাড়ি যাওয়া লাগে কেনো?’
মনোয়ারা খানের তেজস্বী কণ্ঠ,
‘তোদের বাপ-বেটার মতো তো আর কেউ এতো খারাপ না। দু বছর হলো বাপের বাড়ি গিয়ে একটা রাত থাকতে পারি না। সকালে যেতে না যেতেই সন্ধ্যায় ফিরে আসতে হয়। ভালো লাগে না আর বাপু? কিসের ঘানি টানছি? মাঝে মাঝে মনে হয় এসব সংসার টংসার সব চুলোয় যাক। যত জ্বালা আমার। আল্লাহ আমার মরণ নেয় না কেনো? কবরে বসে তোদের বাপ-বেটাদের কার্যকলাপ দেখতাম। দেখি মা ছাড়া কেমনে চলিস? এখন তো কথা শুনছিস না। ‘
আর্দ্র চোখ মুখ কুচকে খিচ মেরে বিছনায় শুয়ে মায়ের বিলাপ শুনতে লাগলো। কিছুক্ষণ পর মনোয়ারা খানের নরম কণ্ঠ ভেসে এলো,
‘যা না বাবা। তোর বাবা কি আর এখন ওতো পারে এই শরীরে? আদর ও নেই। হাসপাতালে সারাক্ষণ পরিশ্রম করে যাচ্ছে। মেয়েটা কি না খেয়ে থাকবে? ওর মা কতো করে ফোন দিয়ে বলল, মেয়েটাকে একটু দেখে রাখতে। একটু গিয়ে খাবারটা দিয়ে আয়। মেয়েটাকে বাড়ি আসতে বললাম আসবে না। দুপুরের পরে নাকি স্পেশাল দুটো ক্লাস আছে। ক্যান্টিনের খাবারও খায় না। এই খালিপেটে থাকলে তো মেয়েটার অসুখ করবে। একবেলার খাবারটাই তো। রাতে ওর মা এসে পরবে। যা একটু।’
বিরক্ত নিয়ে উঠে বসে আর্দ্র চিল্লিয়ে বলল, ‘সবসময় ব্ল্যাকমেইল কেনো করো মা? অসহ্য।’
,
সকাল দিক দিয়ে আজ রোদ উঠলেও দুপুর থেকে আকাশের মন খারাপময় মেঘলা। ভারী বর্ষন হবে বোধ হয়। আর্দ্র বাইকে বসে ভারসিটির গেটে দাঁড়িয়ে ছিলো। মিনিট পাঁচেক পর নিভার আগমন। পেছন পেছন গুটিগুটি পায়ে আরেক রমণীর আগমন বার্তা। আর্দ্রর চোখ পরলো নিভা পার করে সেই রমণীর উপর। আর্দ্র তাকালো ভালো মতোন। হেসে খিলখিল করে কথা বলে এগিয়ে আসছিলো ধীরে ধীরে। কি অদ্ভুত তার চুল খেলানোর দৃশ্য, চোখ বড় করার অভ্যাস, মুচকি হেসে হেসে শাসিয়ে কথা বলার ধরন। আর্দ্র নিমিত্তে তাকিয়ে থাকলো। তাকিয়ে থাকতে থাকতেই কেউ সামনে তুড়ি বাজিয়ে বলল,
‘এই আর্দ্র ভাইয়া? কই তাকায় আছো? খাবার দেও। খিদা লাগছে।’
চমকে নিভার দিকে তাকিয়ে আর্দ্র আবারো একই স্থানে দৃষ্টি আবদ্ধ করলো। দৃষ্টিতে কেউ ধরা না দিতেই দেখা গেলো নিভার ঠিক পাশেই দাঁড়িয়ে আছে দৃষ্টি খোঁজা সেই রমণী।
আর্দ্র খাবার দিচ্ছে না দেখে আর্দ্রর হাত থেকে খাবারটা কেড়ে নিলো নিভা। এরপর বলল,
‘মিট মাই ফ্রেন্ড টায়রা…।’
অবচেতনে আর্দ্র বলল, ‘জানি।’
অবাক কণ্ঠে নিভা বলে, ‘জানো?’
সম্ভিত ফিরে আর্দ্র পকেটে হাত গুজে দাড়ালো। একান্ত নিজস্ব ভঙ্গিতে বলল,
‘অবশ্যই চিনি তো ইনাকে। এমন মাথামোটা পাগল বাচাঁল মানুষকে কে চিনবে না বল তো? ঢাকা শহরে এমন মহিলা আর একটাও খুঁজে পাওয়া যাবে বলে তো আমার মনে হয় না।’
টায়রা তেড়ে এসে বলল, ‘ইউ ভাদ্র।’
টায়রার স্টাইলেই আর্দ্র বলল, ‘ইউ ফুটা টায়ার… জাস্ট সাট আপ।’
‘ইউ সাট আপ।’
নিভা বিস্ফোরণ চোখে ওদের দেখতে দেখতে বলল,
‘তোমরা একে অপরকে চিনো কীভাবে?’
আর্দ্র চুপ হয়ে মিনিট খানিক ভাবতে লাগলো এখন কি বলা যায়। তারপর বলল,
‘তুই যে আমাদের বাসায় এসে ছাদে গেলি। তোর ফোনে ময়নাপাখি ২ নামে সেভ করা নাম্বার থেকে ফোন এলো। তখন তোর ফোন আমি রিসিভ করেছিলাম। এই মহিলা তো রীতিমতো আমাকে কিডনাপার বানিয়ে দিয়েছিলো সেইদিন।’
নিভা তবুও বোকার মতোন বলল,
‘আমি তাও বুঝলাম না। ও ফোন দিয়েছে কিন্তু তুমি ওকে চিনলে কীভাবে?’
আর্দ্রকে থামিয়ে দিয়ে টায়রা বলল,
‘আমি বলছি শোন, তোকে বলেছিলাম না নিঝুম দ্বীপে আমাদের সাথে দুজন ছেলে ছিলো। আমাদের অনেক হেল্প করেছে। ইনারাই তারা। আদর এবং এই ভাদ্র।’
নিভা তাকিয়ে থাকলো মিনিট খানিক হা করে। আর্দ্র নখ কামড়ে ভাবতে লাগলো,
‘নিভা না বাসায় গিয়ে আবার আব্বুর সামনে বলে দেয়। আব্বুর সামনে বললেই আব্বু আবার ভাইয়ার বিয়ে নিয়ে লাফাবে। তারউপর এক পা বাড়িয়ে উল্টো পাল্টা ভেবে নিজ দায়িত্বে সবার অজান্তে বিয়ে ঠিকও করে ফেলতে পারে। পরে ভাইয়া আমার গর্দান নিবে।’
টায়রার কথায় আর্দ্রের ভাবনায় ভাটা পরলো,
‘তোর মতো এতো ভালো একটা মেয়ের আর আদর ভাইয়ার মতো এতো সুইট একটা ছেলের এমন বলদ বেয়াদব মার্কা ভাই কীভাবে থাকতে পারে? আমি তো ভেবেই পাগল হয়ে যাই।’
আর্দ্র মুখ থেকে হাত সরিয়ে ঠোঁট বিকৃত করে জবাব দিলো,
‘এ্যাহ… নিজে খুব ভালো মনে হয়। টিকলির মতো এতো ভদ্র একটা মেয়ের এমন একটা অভদ্র ফুটা টায়ার মার্কা বোন কীভাবে থাকতে পারে আমিও ভেবে পাই না। এই তুই কি খায়ে এরে বান্ধুবী বানাইছোস? আবার ফোনে নাম্বার সেভ কইরে রাখছোস ময়নাপাখি ২। বাই দ্যা ওয়ে, ময়নাপাখি ১ কে ?’
আর্দ্র ভ্রু নাচিয়ে প্রশ্ন করলো। নিভা চোখ মুখ কুচকে জবাব দিলো, ‘টিকলি।’
‘ওহ ভালো কথা। আমার বোন আসে নাই? আমার বোনরে তো দেখি না।’
‘আমি তো চোখের সামনেই দাঁড়িয়ে আছি ভাইয়া। কাকে খুঁজো তুমি?’
‘তোরে কে খুজঁছে? টিকলি কই?’
‘আসে নাই মাথা ব্যথা।’
টায়রা অন্যদিকে তাকিয়ে মুখ ভার করে জবাব দিলো। মনটা হঠাৎ খারাপ হয়ে গেলো। টিকলি আজ কেনো আসলো না কে জানে? এমন কখনো হয়নি টিকলিকে ছাড়া টায়রা একা ভারসিটি এসেছে। আজ প্রথম। আর্দ্র আড়চোখে তাকিয়ে থাকলো টায়রার ওই দুঃখী ভারাক্রান্ত মুখটার দিকে। তাকিয়ে থাকতে থাকতে বাইক স্টার্ট দিয়ে শা… করে চলে গেলো ঠিক সেদিন টায়রা যেভাবে চলে গিয়েছিলো।
________________________________
ঝুম ঝুম বৃষ্টি মাথায় নিয়ে তড়িঘড়ি করে রেসটুরেন্ট ঢুকলো টিকলি। জামা ভিজে একাকার। আধভেজা শরীরে রেসটুরেন্টে পা রাখতেই খিদখিদ লাগতে শুরু করলো। দেখা করার কথা ছিলো খোলা আকাশের নিচে মাঠের তেপান্তরে অবাধ্য নদীর ঢেউয়ের পাড়ে কিন্তু এই বৃষ্টিটাই বাধ সাজলো। সবসময় বৃষ্টি ভালোকিছু বয়ে আনে না কিংবা সুখেরও হয়না। ভেজা জামা ঝাড়তে ঝাড়তেই টিকলি ফোন লাগালো আদরকে।
‘এসেছেন আপনি?’
‘জি। বাম পাশের তিন নম্বর টেবিলটা।’
ফোন কানে ধরেই হালকা উঁকিঝুঁকি দিতেই টিকলি পেয়ে গেলো। এখান থেকে লোকটার পেছনের অর্ধঅংশ এবং বাম হাতের বাদামী রঙের ঘড়িটা দেখা যাচ্ছে। দেখা পাওয়া মাত্র এক অনাবিল সুখে, আনন্দে, শান্তিতে টিকলির আত্মা ঠান্ডা হয়ে গেলো। হঠাৎই মনে হলো, স্বার্থক আজকে নার্ভাসনেস এ ভারসিটি না যাওয়া, এই বৃষ্টি, এই কর্দমাক্ত দিন, এই আধ ভেজা শরীর।
কান থেকে ফোন সরিয়ে অনেক আকাঙ্ক্ষা নিয়ে এগিয়ে সামনে যেতেই দেখা হয়ে গেলো খুব অনাকাঙ্ক্ষিত একটা মানুষের সাথে। মানুষটিকে চিনতে মিনিট দুই সময় লাগলো। মাস্কের সেই ফালতু লোকটার কথা মনে পরতেই টিকলি আঙ্গুল তুলে চেঁচিয়ে উঠলো,
‘আপনি….’
আদর বসে অপেক্ষা করছিলো কাঙ্ক্ষিত মানুষটার জন্য। হঠাৎ কারোর বাজখাঁই গলার কন্ঠস্বরে আদর ঘুরে তাকাতেই দেখা গেলো, একটা মেয়ে দাঁড়িয়ে আছে মাথায় স্কাপ, মুখে মাস্ক, জামা কাপড় ভিজে একাকার। মেয়েটার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে আদর বুঝার চেষ্টা করলো তার এমন অভদ্র আচরণের কারণ। ভালো ভাবে পরখ করতেই দেখলো, এটা সেই বোকা পনেরো দিনের প্রেগন্যান্ট মেয়ে। বুঝা মাত্রই আদর চট করে উঠে দাড়ালো। নিজ তেজি গলায় বলল,
‘আপনি??’
টিকলি চোখ বড় বড় করে বলল, ‘আপনি এই টেবিলে কেনো?’
আদর পকেটে হাত ডুকিয়ে তারস্বরে বলল,
‘কেনো টেবিলটা কি আপনার সো কল্ড পনেরো দিনের বাচ্চার বাবা কিনে নিয়েছে?’
‘ফালতু কথা বলবেন না।’
‘ওহ আচ্ছা এটা তবে ফালতু কথা? তাহলে ভালো কথা বলি। আপনার বাচ্চার এখন কত মাস চলছে জানি? উমমম…ঠিক মনে করতে পারছি না। তবে পাঁচ-ছয় মাস তো হওয়ার ই কথা ছিলো। কিন্তু আপনার পেটের তো কোনো ইম্প্রুভমেন্ট নাই। হায় আল্লাহ! বাপের মতো ধোকাবাজ হলো বুঝি? ইশশ আমার এখন আপসোস হচ্ছে নিউরোলজিস্ট না হয়ে গাইনোকোলজিস্ট কেনো হলাম না?’
‘এই দেখুন, বেশি বাড়াবাড়ি করবেন না।’
‘এই দেখাদেখির অভ্যাস টা আর আপনার গেলো না। নিন কি দেখাবেন দেখান?’
‘ইডিয়েট। অত্যাধিক মাত্রায় বাড়াবাড়ি করছেন এবার।’
‘বাড়াবাড়ি আপনি করছেন। সুন্দর দিনের সুন্দর একটা মুহুর্ত সুন্দর একটা মুড আপনাকে দেখেই নষ্ট হয়ে গেলো।’
আদরের এহেন কথায় হঠাৎ একটা আকস্মিক কাজ করে বসলো টিকলি। মুখ থেকে মাস্ক সরিয়ে ঝগড়ায় তাল দিলো,
‘আর আপনাকে দেখে মনে হয় আমার মুড একদম রেললাইনের গতিতে চলছে? আপনাকে আমার বিন্দুপরিমাণ দেখতে ইচ্ছে করে না। আই উইশ আর কখনো আপনার এর ফাটাবাঁশের মতো চেহারার সাথে আমার দেখা না হতো।’
আদর স্তব্ধ, নিস্তব্ধ, নিরব দর্শকের মতো শুনে গেলো। শুধু তাকিয়ে থাকলো ওই মুখখানার দিকে যে মুখটার দিকে তাকালেই হৃদয়-বুক জমিন কেঁপে যায়। ভূমিকম্প শুরু হয় মন-আসমান জুড়ে। ওই চশমার আড়ালে যে দুটো চোখ দেখার আদরের খুব ইচ্ছে ছিলো তা আজও আড়াল হয়ে আছে লেন্সের পেছনে। ইশশ…এই কপাল! এই কপাল থেকে শুরু হওয়া দু গাছি চুল তো আদরের খুব প্রিয়। তবুও আদর বুঝতে পারলো না। ধরতে পারলো না। কণ্ঠ শুনেও বুঝতে পারলো না? কীভাবে সম্ভব?
টিকলি তখনো বলছিলো,
‘কথা বলছেন না কেনো?’
আদর আস্তে করে নিজের মুখ থেকে মাস্ক খুলল। টিকলি চোখ বড় বড় করে তাকালো। আস্তে আস্তে চোখ শীতল হলো। দগ্ধ হলো। পুড়লো। টিকলি হঠাৎ বসে পরলো একটা চেয়ারের উপর। চোখ মুখ ঢেকে রাখলো হাতের দশ আঙ্গুল দিয়ে। মাথার চুল খিচে ধরলো। অনুভব করতে পারলো না কিচ্ছু। হাহাকার বিভীষিকাময় কষ্টে হঠাৎই বুকটা ছেয়ে উঠলো। নতুন নতুন অনুভূতি গুলো কি তবে এখানেই শেষ হয়ে যাবে? এখানেই কি তবে ইতি ঘটে যাবে হয়েও হলো না ভালোবাসার? প্রেম প্রেম গন্ধ কি তবে দুর্গন্ধ ছড়াবে?মরে যাবে কি অনুভব পাখিরা? খুব অজান্তেই… খুব বেশি অজান্তেই ভুল হয়ে গেলো। মস্ত বড় ভুল। কলি বের হওয়া গাছটাতে ফুল প্রস্ফুটিত হওয়ার আগেই মরে গেলো। আর হবে কি কখনো এক হওয়া?
আদর খুব গোপন নিরবে বেরিয়ে গেলো রেসটুরেন্ট থেকে। টিকলি আরো বেশি ভেঙে পরলো। উপরে তাকিয়ে কান্না আটকানোর চেষ্টা করতেই দেখা গেলো আজও সেই রেস্টুরেন্টে। প্রথম যেদিন এই ফালতু লোকটার সাথে দেখা হয়েছিলো। প্রথম যেদিন টিকলি পনেরো দিনের প্রেগন্যান্ট সেজেছিলো। প্রথম যেদিন নিজের অহেতুক বোকামির পরিচয় দিয়ে আদরের কাছে অপমানিত হয়েছিলো। মজার কারণ হয়েছিলো। আদর নামক এই বেয়াদব ব্যক্তি বিরক্তির কারণ হয়ে উঠেছিলো টিকলির মনের কাছে।
চলবে❤️