বৃষ্টিশেষে প্রেমছন্দ পর্ব-৪০

0
1385

#বৃষ্টিশেষে_প্রেমছন্দ
#মুমুর্ষিরা_শাহরীন

৪০.
শ্যাতশ্যাতে ভেজা পরিবেশ। পিচ্ছিল উর্বর মাটি। শোনা যায়, গাজীপুরের ভূমি বেশ উর্বর এবং এখানের ফল-ফলান্তির গাছ হয় বিন্যস্ত ভাবে। খেতেও নাকি দারুন তৃপ্তি! ফাউগান ইকো রিসোর্ট টা বেশ বিলাশবহুল। একেকটা ঘর জাকজমকপূর্ণভাবে সাজানো। চোখ ধাধানো সুন্দর। আর্দ্র টায়রা গেছে রিসোর্টের পাশের পুকুরটাতে মাছ ধরতে। তখন প্রায় বিকেল। আকাশ পরিষ্কার। বৃষ্টি নেই। টায়রা খুব উৎসাহ নিয়ে বড়শি ফেলল। সাথে সাথে আর্দ্রও ফেলল। টায়রা মুখ টানা মেরে বলল,

‘ দেখাদেখি মুসলমান।’

আর্দ্র ফুসে উঠলো। পরক্ষণেই কাধ ঝাকিয়ে তৃপ্তিকর ভঙ্গিতে বলল, ‘আমার বড়শিতেই আগে মাছ উঠবে।’

টায়রা কৌতুক হাসি হাসলো। আদর টিকলি ওদের পেছনেই টেবিলে বসে ছিলো। হাসতে হাসতে টায়রা বলল, ‘ওই তোর পেবা দেবর এ কয় কি? নাইছ জোকস।’

আর্দ্রর গা পিত্তি জ্বলে উঠলো। রোষাগ্নি গলায় বলল,

‘আমি পেবা? নিজে কি? পেবি! এসব ঠেলাগাড়ি মার্কা শরীর নিয়ে নাকি তিনি মাছ ধরবে। হুহ..সাত মন তেলও পুড়বে না আর রাধাও নাচবে না।’

টায়রা নাক ফুলিয়ে তর্জনী আঙ্গুল তাক করে বলল, ‘বাজি?’

টায়রার তর্জনী আঙ্গুল বেকিয়ে দিয়ে আর্দ্র বলল, ‘বাজি। যে হারবে সে তিন ঘণ্টা সুইমিংপুলের ঠান্ডা পানিতে থাকবে।’

টায়রা তর্জনী আঙ্গুল ধরে ঝাকিয়ে চোখ মুখ কুকরিয়ে বলে উঠলো, ‘শালার হাত নাকি লোহা?’

তৎক্ষণাৎ আর্দ্র চেঁচিয়ে আদরের উদ্দেশ্যে বলল,

‘ভাইয়া আমাকে শালা ডাকছে। এখন আমি শালী ডাকলেই তো তুমি বকা দিবা।’

আদর ঘাড় ঘুরিয়ে চোখ পাকিয়ে তাকাতেই আর্দ্র মিনমিনে কণ্ঠে বলল, ‘শালী ডাকলেই কি টিকলি আমার বউ হয়ে গেলো?’

আর্দ্রর মিনমিনে গলায় বলা কথাগুলো টায়রার কানে স্পষ্ট হয়ে লাগলো। সে ছি ছি করতে করতে বলল,

‘ভাইয়ের বউয়ের দিকে নজর দেন? শরম লাগে না? চোখের উপর পর্দা লাগান মিয়া।’

‘এই, আপনি আর একটা কথা বলবেন আমি ধাক্কা দিয়ে পুকুরে ফেলে দিবো।’

টায়রা হাতের কবজি থেকে হাতা উঠিয়ে এমন এক ভাব নিয়ে বলল, ‘দেখি কে ফেলে? কার কত দম? এমন এক সিরিয়াস জায়গায় ল্যাং মারবো না বাপ বাপ করে নিজেই পুকুরে ঝাঁপ দিয়ে বলবেন, ছেড়ে দে মা কেদে বাঁচি।’

আর্দ্র নাক ছিটকে টিকলি দিকে ঘুরে বলল, ‘ইহার মতোন আজব বস্তুকে কি খাওয়ায় মানুষ করছো?’

টিকলি ঠোঁট ভাসিয়ে হেসে বলল, ‘আমি মানুষ করতে পারি নাই ভাই। বহুত দুঃখ এই মনে। আপনি মানুষ করেন এবার।’

টায়রা জোরে জোরে কয়েকটা শ্বাস ফেলে টিকলির দিকে রক্তিম চোখে তাকিয়ে থাকতেই হঠাৎ খেয়াল করলো তার বড়শিতে জোড়ালো টান পরেছে। টায়রা সচেতন দৃষ্টিতে বড়শিটাকে হালকা নাড়ালো। বড়শির টান শক্ত হয়ে এলো। টায়রা জোরে বড়শি ধরে টেনে উঠিয়ে নিয়ে আসতেই লাফিয়ে উঠলো। মুখে হাত দিয়ে চিৎকার করে বলল,

‘মাই গড! আমি মাছ পাইছি? অবিশ্বাস্য!’

আর্দ্র হতবুদ্ধ চোখে তাকিয়ে রইল মিনিট খানিক। টায়রা বত্রিশ পাটি দাঁত বের করে হাসতে হাসতে আর্দ্রর সামনে তুড়ি বাজিয়ে বলল,

‘বাজি কমপ্লিট করেন। তিনঘণ্টা সুইমিংপুলে থাকবেন।’

আর্দ্র করুণ চোখে আদরের দিকে তাকাতেই আদর বলল, ‘দাড়ায় আছোস কেন যা। বাজি তো তুই ই দিছিলি।’

আর্দ্র বিরবির করে বলল, ‘এমন ভাই থাকার চেয়ে এই ঠেলাগাড়ির মতো শত্রুও ভালো।’

_______________________________

সোফায় বসে পাকোড়া হাতে গোয়েন্দা সিরিজ দেখছিলো নিভা। কলিংবেলের শব্দে রান্নাঘর থেকে মনোয়ারা খান তার বিষন্ন গলা উঁচিয়ে বললেন,

‘কে এসেছে মা দেখ তো।’

‘দেখছি খালামনি।’

টিভিতে চোখ রেখেই অন্ধের মতো সামনে এগিয়ে গেলো নিভা। দরজা খুলে ঘাড় ফেরাতেই দেখলো নয়ন দাঁত কেলিয়ে তাকিয়ে আছে। নিভা ঘাবড়ে দু’পা পিছিয়ে গেলো। বুকে থু থু দিয়েই ধমক দিলো,

‘আপনি কি বারো মাসই হাসেন? হাসি কি আপনার রোগ?’

নয়নের হাসিহাসি মুখটা মিলিয়ে গেলো। নিভা অসম্ভব রেগে পেছনে তাকাতেই দেখলো রাহুল দাঁড়িয়ে আছে মুচকি হেসে। নিভার পরান টা ছলকে উঠলো। অকারণে ভেতর থেকে হাহাকার বেড়িয়ে এলো। এই মুচকি হাসির অসম্ভব সুন্দর গোপন দুঃখে ভরা মুখটা যখন জানবে, তার ছেলেবেলার ভালোবাসা তাকে নয় অনেক আগেই অন্যকাউকে মন দিয়ে বসেছে। তখন সে কি করবে! রাগ করবে? পাগলামি করবে? ভাঙচুর করবে? নাকি মনের গহীনে সমস্ত লুকায়িত কষ্টের সাথে এই কষ্টও পুষে রেখে কষ্টের পাল্লা ভারী করে নিস্তব্ধ একা রাতে নিঃশব্দে কাদবে?

‘ভেতরে আসতে পারি?’

রাহুলের কথায় নিভা চমকে উঠলো। অবচেতন মনেই দরজা থেকে সরে দাড়ালো। সম্ভিত ফিরতেই দেখা গেলো তার চোখ ছলছল করে উঠেছে। চারিপাশ ঝাপসা, অস্পষ্ট, মেঘাচ্ছন্ন। ঈষদন্ধকার এই মন বুঝে উঠতে পারে না, নিভা কার জন্য কষ্ট পায়? নিজের জন্য নাকি রাহুলের জন্য? কিন্তু নিজের জন্য কষ্ট পাওয়ার কারণ কি? কোনোকিছুই কি কারণ ছাড়া হয়?

মনোয়ারা খান রান্নাঘর থেকে এসে সোফায় রাহুলকে বসে থাকতে দেখেই ব্যস্ত হয়ে গেলেন। প্রফুল্লচিত্তে বললেন,

‘বাবা তুমি? অবশেষে এলে? পায়ের ধুলি পড়লো তাহলে আমার ঘরে?’

রাহুল সৌজন্যে হাসি দিয়ে বলল, ‘এসব কি বলে লজ্জা দিচ্ছেন আন্টি? আমি তো আপনাদের ঘরেই থাকি।’

‘কি খাবে বলো?’

‘কিছু খাবো না আন্টি। ওই বাড়ি ভাড়াটা দিতে এসেছি।’

নয়ন বাড়ি ভাড়া দিতেই মনোয়ারা খান বললেন,

‘আরে রাখো পরে দিও। কি খাবে সেটাই বলো। নিভা পাকোড়া বানিয়েছে। তোমাদেরও দেই।’

রাহুল কিছু বলার আগেই নয়ন বলল, ‘আন্টি সাথে এক কাপ চা দিলে মোড়ের টং দোকানে গিয়ে চা খাওয়ার সময়টা বেঁচে যেতো।’

মনোয়ারা খান মাথা দুলিয়ে হেসে রান্নাঘরে গেলেন। যেতে যেতে বললেন, ‘প্রতিদিন বিকালে আন্টির কাছে এক কাপ চা খাওয়ার আবদারে এসে পরো নয়ন।’

নয়ন মাথা নাড়িয়ে নিভার দিকে তাকিয়ে দাঁত বের করে হাসলো। নিভাও উলটে হাসি ফেরত দিলো। কথা বলতে চাইলে দেখা গেলো কোনো কথা খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। শেষে কোনো কথা খুঁজে না পেয়ে এক অবাঞ্ছিত কথা বলল নয়ন,

‘জানো, প্রতিবার ভাড়া দিতে আমি একাই আসি কিন্তু এবার তোমাকে দেখতে রাহুল এসেছে।’

রাহুল কেশে উঠলো। নিভা অবাক চোখে পানি আনতে চলে যেতেই রাহুল লাত্থি লাগালো নয়নের পায়ে। দাঁত কিড়িমিড়ি করে বলল, ‘তুই কি পাগল?’

‘পাগল হবো কেনো? তুই নিভাকে দেখতে আসোস নাই?’

‘না।’

‘তাহলে কেন আসছোস? তোর পায়ে পড়লেও তো জিন্দেগীতে আসোস নাই।’

‘আমি উনার সাথে কথা বলতে আসছি।’

নয়ন চোখ ঘুরিয়ে বলল, ‘আলটিমেটলি ওই একই কথা হলো।’

‘আর একটা কথা বললে তুই মাইর খাবি। চুপ থাক।’

নিভা পানি এনে রাহুলের সামনে ধরতেই রাহুল উঠে দাঁড়ালো। নিভার দিকে তাকিয়ে মৃদুমন্দ হেসে বলল,

‘আজ ছাদে গেলেন না যে? অসুস্থ?’

নিভা হালকা হেসে মাথা নাড়ালো। রাহুল আবার জিজ্ঞেস করলো, ‘তবে?’

‘ওই বাসায় চলে যাবো তো। ব্যাগ গোছাচ্ছিলাম।’

রাহুল চরম অবাক গলায় বলল, ‘আপনি চলে যাবেন?’

‘জি। কাল সকালে।’

‘আবার কবে আসবেন?’

নিভা এক ঝলক তাকালো। অতৃপ্ত চোখদুটো ঘুরতে লাগলো রাহুলের চোখে মুখে। লোকে বলে, চোখ নাকি কখনো মিথ্যে বলে না। রাহুলের চোখ দুটোকে গাঢ় ভাবে পর্যবেক্ষণ করে নিভা দেখতে পেলো, সেই চোখে তার জন্য মায়া, স্নেহ, বন্ধুত্বপূর্ণ আবেগ ছাড়া আর কিছুই নেই। কিছুই না! দীর্ঘশ্বাস বুকের মাঝে টেনে নিয়ে নিভা উত্তর দিলো,

‘জানি না। দেখি কবে আসা যায়।’

রান্নাঘর থেকে মনোয়ারা খানের ডাক পরলো। নিভা সেদিকে স্বাভাবিক ব্যস্ত পায়ে হেটে চলে গেলো। তবুও রাহুলের মনে হলো, অস্বাভাবিক! কোথাও কিছু আড়াল হয়ে গেলো। নিভার আজ বিকালে ছাদে যাওয়ার পেছনে ব্যাগ গোছানোর কারণটা নিছকই এক অযুহাত। সে ইচ্ছে করেই যায়নি কেননা ব্যাগ সে রাতেও গুছাতে পারতো। নিজেকে গোপন রাখার চেষ্টা বুঝা গেলো নিভার সকল কার্যকলাপে। কথা বলার ধরণও কেমন যেনো খাপছাড়া ঠেকলো রাহুলের কাছে। ‘কি হয়েছে উনার? খারাপ কিছু হয়েছে কি? নাকি চলে যাবেন এজন্য মন খারাপ?’ বুকের মাঝে অজস্র ভাবনা-প্রশ্ন নিয়ে রাহুল ম্লান মুখে সোফায় বসলো।

,

দু’ঘণ্টা হয়েছে আর্দ্র সুইমিংপুলে বসে আছে। সুইমিংপুলটা দেখতে দারুন! গিটার শেপ। টায়রা তা দেখেই আপসোস করে বলেছিলো, ‘ইশশ..আমার গিটারটা যে কেনো আনলাম না!’

তখন শেষ বিকালের আকাশে কালো মেঘের দল হানা দিয়েছিলো। একটু পরেই নামবে ঝুমঝুম বৃষ্টির সন্ধ্যা। টায়রা সুইমিংপুলের পাশে স্লিপিং চেয়ারে বসে আর্দ্রের দিকে তাকিয়ে দুঃখী দুঃখী গলায় বলল, ‘আহারে…কষ্ট হচ্ছে?’

আর্দ্র উত্তর দিলো না। গাল নাক ফুলিয়ে পানির মাঝে ভাসতেই টায়রা এগিয়ে এলো। সুইমিংপুলের সিড়িতে এক পা রেখে চু চু করে আবারো অসহায় গলায় ঠাট্টার ছল বজায় রেখে বলল,

‘থাক রাগ করবেন না। যাওয়ার সময় পাঁচটা লজেন্স কিনে দিবো।’

টায়রার কথার মাঝেই আকাশ ভেঙে বৃষ্টি নামলো। এই বৃষ্টির মাঝে সুইমিংপুলের ঠান্ডা পানিতে আরো এক ঘণ্টা থাকতে হবে ভেবে আর্দ্রের শরীরে এখনি জ্বর উঠে যাচ্ছে। টায়রা উঠে দাড়িয়ে ব্যস্ত কণ্ঠে বলল,

‘যাক ষোলো আনা পূর্ণ হলো। এবার বৃষ্টিতেও ভিজতে থাকুন।’

ভারী বৃষ্টির প্রকটে টায়রা ভিজে গেছে অনেকটাই। সে তাড়াহুড়ো করে চলে যেতে নিলেই আর্দ্র ওর পায়ে এক টান মেরে ওকে ফেলে দিলো সুইমিংপুলে। টায়রা নাকানিচুবানি খেয়ে রোষানলে জ্বলে উঠলো। আকস্মিক পড়ে যাওয়ায় কিছু পানিও খেয়ে ফেলা হলো। ভিষণ মাত্রায় রেগে সে বলল,

‘কি হলো এটা?’

টায়রার মেদ বিহীন কোমড় জড়িয়ে ছিলো আর্দ্রের হাত। টায়রার ভেজা সিক্ত চেহারার দিকে বেশ কিছুক্ষণ অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকেই আর্দ্র তলিয়ে গেলো। টায়রার কোমড় ছেড়ে ডুব দিয়ে আবার উঠে আসলো। মুখ থেকে হাতরে পানি মুছলো। চুলগুলো পেছনে এলিয়ে দিয়ে চোখ মেলে সম্মুখে তাকালো আবারো। স্নিগ্ধ, কোমল, পানিতে ভেজা অকঠিন, মৃদু তেজি যুক্ত টায়রাকে দেখে হঠাৎ আর্দ্র দিশেহারা হয়ে গেলো। আকাশ ফেটে পড়ছিলো অবিরাম ধারায় জলরাশি তার মাঝে পানিতে ভাসমান একই সাথে তারা দুইজন। আর্দ্রের ঘোর ভাঙলো টিকলির চিৎকারে।

‘তুই আবার সুইমিংপুলে কি করিস?’

টায়রা কাদো কাদো গলায় বলল, ‘তোর বদমাইশ খাসি দেবর ফেলে দিয়েছে।’

‘উঠে আয় আমি তোয়ালে নিয়ে আসছি। বৃষ্টিও পড়ছে। ঠান্ডা লেগে যাবে তো।’

টায়রার কথায় আর্দ্র ভাবলেশহীন চোখে তাকিয়ে রইল। কোনো তর্কে বির্তকে না জড়িয়ে চোখ দুটো এক ধ্যানে দেখে গেলো সামনের অপরিসীম সুন্দর শ্যামলা মুখশ্রীর রমণীকে। টায়রা সাতরে পাড়ের কাছাকাছি যেতেই আর্দ্র হাত ধরে টান দিলো। আকস্মিক টানে টায়রা থতমত খেয়ে গেলো। আর্দ্র শক্ত করে টায়রার হাত ধরে বলল,

‘এই সুইমিংপুলেই বাকি এক ঘন্টা থাকতে হবে আপনাকে।’

টায়রা হাত ছাড়ানোর চেষ্টা করেও পারলো না। অসহায় দৃষ্টিতে আর্দ্রের দিকে তাকাতেই আর্দ্র চোখ টিপে দিলো। অতঃপর কিছুক্ষণ চুপ থেকে টায়রা থেমে থেমে প্রশ্ন করলো,

‘কিছু কি করছেন?’

আর্দ্র ভ্রু উঁচিয়ে সিরিয়াস মুডে বলল, ‘মানে?’

‘পানি কি নষ্ট করছেন?’

‘পানি নষ্ট করবো মানে?’

‘গর্দভ নাকি?’

আর্দ্র একটু ভাবতেই বিস্ফোরিত চোখে টায়রার দিকে তাকিয়ে বলল, ‘এতো ফালতু কেন আপনি?’

টায়রা উচ্চস্বরে বলল, ‘এখন আমি ফালতু?’

‘অবশ্যই।’

‘আপনি ফালতু। অসভ্য, ইতর, বেয়াদব দুনিয়ার সমস্ত খারাপ আপনি।’

আর্দ্র টায়রার হাত আরো শক্ত করে ধরে বলল, ‘ভেবেছিলাম মাফ করবো কিন্তু না। এবার থাকুন আমার সাথে আর তা নয়তো বাজি বাতিল করুন।’

টায়রার শরীর হিম হয়ে যাচ্ছে। আর কিছুক্ষন থাকলে যেখানে সে পাক্কা অক্কা পাবে সেখানে আরো এক ঘণ্টা থাকা তো বিলাসিতা ভাই! টায়রা নাক ফুলিয়ে বলল,

‘ছাড়ুন। মাফ করে দিলাম।’

,

সুইমিংপুল থেকে দৌড়ে ঘর অবধি যেতেই টিকলি আধভেজা হয়ে গেলো। তোয়ালে নিয়ে উল্টো ঘুরতেই দেখলো আদর ভয়ার্ত চোখে দরজার কাছে দাঁড়িয়ে তাকিয়ে আছে। টিকলি চোখ দুটোকে কুঞ্চিত করে বলল,

‘কিছু হয়েছে ডাক্তার?’

আদর ভয়ার্ত ভাব বজায় রেখেই বলল, ‘এভাবে দৌড়ে এলেন কেনো? কোনো সমস্যা?’

টিকলি স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল। আদরের ভয়ার্ত দৃষ্টি দেখে ভীষনরকম ভয় পেয়ে গিয়েছিলো সে। হাতের তোয়ালে টা দেখিয়ে বলল, ‘আর্দ্র ভাইয়া টায়রাকে টেনে পানিতে ফেলে দিয়েছে। ওর জন্যই তোয়ালে নিয়ে যাচ্ছিলাম।’

‘তাই বলে এতো দৌড় দিয়ে কেউ আসে? পড়ে টড়ে গেলে তখন? পা ভেঙে ফেলে দিতাম।’

আদর খানিকটা রাগী গলায় বলল। টিকলি ভীষণ বড় এক দীর্ঘশ্বাস ফেলে আদরের মুখোমুখি দাড়ালো। চোখে চোখ স্থির হতেই অভিলাষী চোখ দুটো দ্বারা অতলস্পর্শী হৃদয়ে নিবিড় গলায় প্রশ্ন করলো,

‘আপনি কি আমার থেকেও বেশি দূর্বল হয়ে যাচ্ছেন ডাক্তার? দূর্বল হয়ে পড়লেও এই দূর্বলতার কারণ কি?’

আদর স্থিরতাচিত্রে টিকলির ওই গহন চোখে তাকিয়ে থাকলো। টিকলি হীনবল গলায় বলল,

‘আমি ক্লান্ত হয়ে পড়ছি ডাক্তার। আশেপাশের সবকিছু কেমন যেনো বিশৃঙ্খলায় ভরপুর। আমি কিছু বুঝে উঠার আগেই বাবা সব জেনে গেলো। আবার বুঝে উঠার আগেই আমার উপর কড়া রেস্ট্রিকশন আসলো। এরপর হঠাৎ কিছু না ভেবে আপনার সাথে এসে পরলাম। কেনো এলাম কিছুই বুঝতে পারছি না? কিন্তু এখন চিন্তায় আমার মাথা দুলছে। আপনি বুঝতে পারছেন বাসায় গেলে কি হবে?’

আদরের মুখ থেকে তবুও কথা আসলো না। টিকলি তার অগাধ ধৈর্য্য নিয়ে আদরের কলার চেপে ধরলো। নীল শার্টের ভাঁজ করা কলারটা দুমড়ে মুচড়ে গেলো। টিকলির চোখে বিন্দু বিন্দু পানি জমলো। কিছুক্ষণ প্রগাঢ় নিস্তব্ধতা চলার পর গাঢ় গলায় টিকলি বলল,

‘কথা বলুন। আমি কেনো একবাক্যে আপনার সাথে এলাম? আমাদের সম্পর্কের নাম কি ডাক্তার? শুধুই প্রেম? ভালোবাসা নয়? কেনো আপনার এতো ইগো? আর পাঁচটা প্রেমিক পুরুষদের মতো আপনি কেনো ভালোবাসি ভালোবাসি বলে মুখে ফেনা তুলতে পারেন না? তবে কি আপনি আমায় ভালোবাসেন না?’

টিকলির কলার চেপে ধরা হাত দুটোর উপর আদর হাত রাখলো। মনোহর চঞ্চল প্রেমময় চোখদুটো ভীষণ টিকলি আসক্ত। পরম যত্ন করা গলায় বলে উঠা হলো,

‘আমি আপনাকে এতোটা ভালোবাসি যে ভালোবাসা ভালোবাসি বলে প্রকাশ করা যায় না।’

বাতাস থমকে গেলো। বাইরের তুমুল বর্ষণও স্তব্ধ হয়ে গেলো। নিশ্চল হয়ে এলো পরিবেশ। নিস্তব্ধ হয়ে গেলো টিকলির শরীরের প্রতিটি অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ। কষ্টের মতো অলৌকিক অভিনব সুখে ভেসে গেলো টিকলির হৃদয়ছন্দ।

চলবে❤️

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here