#বৃষ্টিশেষে_প্রেমছন্দ💖
#মুমুর্ষিরা_শাহরীন
৪৩.
তখন সকাল এগারোটা। প্রায় হয়ে যাওয়া দুপুরের কড়া উত্তাপ। অবিনশ্বর গরমে ত্যক্ত বিরক্ত হয়ে না চাইতেও টিকলি নিচে নেমে এলো। উদ্দেশ্য এক বোতল ঠান্ডা পানি ঢকঢক করে গিলে কলিজা ঠান্ডা করা। খুব নিরবে লুকিয়ে চুরিয়ে পা পা টিপে টিপে সিড়ি পার করলো যাতে কারোর চোখে না পড়ে। এখন অবধি সে জামিলুর রেজার মুখোমুখি হয়নি। আল্লাহ আল্লাহ করছে যাতে আরো দুই তিনদিন মুখোমুখি হতে না হয়। কিন্তু আশ্চর্য ভাবে শায়লা আক্তারও কিছু বলেনি। ভিষণ অবাক কান্ড!
বসার ঘরে আসতেই দেখা গেলো সোফায় বসে আছে রুহুল হক আর আকিদা হক। টিকলির ভ্রু জোড়া নিজ দায়িত্বে কুচকে গেলো। গোয়েন্দা নজরে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকতেই জামিলুর রেজা মেয়েকে দেখে বলে উঠলেন,
‘কিরে মা, দাঁড়িয়ে আছিস কেনো? যা খেতে বস। এখনো তো সকালের খাবার মুখে তুলিস নি।’
এতো কান্ড কীর্তির পর জামিলুর রেজার মধুর ডাক শুনে টিকলির আত্মা রীতিমতো লাফিয়ে উঠলো। বুকের ভেতর থেকে প্রবল শব্দে একটা ঢিপঢিপ আওয়াজ শোনা গেলো। কিছু তো একটা জটলা পাকিয়েছে। আকিদা হক উঠে এসে টিকলিকে জোর করে মিষ্টি খাওয়ালো। কোনোমতে চিবিয়েই গলা দিয়ে মিষ্টি নামিয়ে ফেলল টিকলি। শুকনো ঢোক গিলতেই দেখলো টায়রা নেমে আসছে। টিকলি চোখের ইশারায় বুঝালো, ‘কি হচ্ছে?’। টায়রা ঠোঁট উল্টে বুঝালো, ‘জানি না।’ আকিদা হকের সামনে এসে টায়রা দাঁত বের করে হাসি দিলো। অতি ভক্তির সুরে বলল,
‘আরে মামী যে? আসসালামু আলাইকুম। কেমন আছেন? কিসের মিষ্টি খাওয়াচ্ছেন মামী?’
আকিদা হক টায়রার এহেন আচরণে ভীষণ মাত্রায় খুশি হলেন। রীতিমতো খুশিতে গদগদ করতে করতে বললেন, ‘আরে টায়রা তুমিও খাও, নাও নাও। একটা দারুন সুখবর আছে।’
টায়রা পুরো মিষ্টি মুখে নিয়ে বিস্ফোরিত চোখে তাকিয়ে থাকলো। এক পলকে মিষ্টি গলা দিয়ে নামিয়ে ফিসফিস করে বলল,
‘বলেন কি মামী? এই বয়সে? শেষ পর্যন্ত এই বয়সে এসে লজ্জা সরমের মাথা খেয়ে সুখবর নিয়ে আসলেন? এতো বড় ছেলে, ভাগ্নিদের সামনে এসব আস্তাগফিরুল্লাহ মার্কা কাজ করে বসলেন?’
পাশ থেকে টিকলি ফিক করে হেসে দিলো। আকিদা হক কটমট করে তাকিয়ে আরেকটা মিষ্টি পট করে ঢুকিয়ে দিলেন টায়রার মুখে। বড় বড় পা ফেলে আবার গিয়ে সোফায় বসলেন। রুহুল হকের মুখ কোনো কারণে থমথমে এবং চিন্তিত। আকিদা হক সেইরকম হাসি হাসি মুখে বললেন,
‘তা দুলাভাই, বিয়ের ডেট টা এবার ফিক্সড করে ফেলা উচিত।’
রুহুল হক চিবিয়ে চিবিয়ে বললেন, ‘আগে তো ছেলে মেয়ের অনুমতি নাও।’
আকিদা হক হাত নাড়িয়ে মাছি তাড়াবার ন্যায় বললেন,
‘অনুমতি নেওয়ার কি আছে? দুলাভাই তো নিজেই প্রস্তাব দিলেন। তার মানে টিকলির মতামত নিয়েই দিয়েছেন। কি টিকলি তাই তো? আর বাকি রইল রাহুল। রাহুল না করবে না। ফুফি অন্তপ্রাণ বলে কথা!’
শায়লা আক্তার বুক ফুলিয়ে মাথা দুলিয়ে হাসলেন।এরপর আবারো চললো তাদের কথোপকথন। পুরোটা সময় টিকলি নিরব দর্শক হিসেবে সবকিছু শ্রবণ করে গেলো। তার মানে? এরজন্যই কি এতো আদর সোহাগ? এতো তাড়াতাড়ি কীভাবে কি? কি করে এসব হতে পারে? রাহুল ভাইয়া? রাহুল ভাইয়ার সাথে বিয়ে? কীভাবে সম্ভব?
টিকলি কথা বলতে পারছে না। গলা দিয়ে শব্দ বের করে বলতেও পারছে না, ‘আমি এই বিয়ে কিছুতেই করবো না।’ আকস্মিক ঘটনায় সে যেনো বাক প্রতিবন্ধীর ক্ষমতা লাভ করেছে। বোবা হয়ে গেছে।মুখের বুলি হারিয়ে গেছে প্রবাহমান নদীর কোনো এক তীরে। সাতরে, হাতরে কোনোভাবেই খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। কানে লেগে যাচ্ছে তালা। লক হয়ে গেছে গলা। শুধু চারিপাশ ঘন কালো অন্ধকার। চারিপাশের নৈঋত আঁধার থেকেই আবছা আলোয় অনেকগুলো কণ্ঠস্বরে প্রতিধ্বনি হয়ে আসছে একটাই কথা, ‘এবার তুই কি করবি টিকলি?’
শায়লা আক্তার অতি আদুরে কন্ঠে বললেন, ‘এদিকে আয় তো মা।’
টিকলি মায়ের দিকে হতভম্বের মতো তাকিয়ে রইল। নিষ্প্রাণ চোখ দুটোর কোল ঘেঁষে জল গড়বে গড়বে ভাব। টিকলি আর কারোর কথা শুনলো না। এক ছুটে চলে গেলো উপরের নিজের ঘরে। উপস্থিত সবাই অবাক হলে জামিলুর রেজা জোরপূর্বক হেসে বললেন,
‘লজ্জা পেয়েছে।’
,
টিকলি উপরে যেতেই নিভার কল এলো। অবিরাম জলস্রোতের অধিকারী নিষ্প্রভ দু’চোখের চাহনিতে দেখতে লাগলো ফোনের আলো। অনুভূতিহীন কানে শুনতে লাগলো ফোন বাজার শব্দ। বার কয়েক ফোন বেজে কেটে যাওয়ার পর টেক্সট আসলো, ‘প্লিজ টিকলি ফোন তোল। আর্জেন্ট দরকার।’
পরেরবার ফোন আসতেই টিকলি ফোন তুলল। স্তব্ধ শ্বাসে কিছু বলার জোগাড় হলো না। হ্যালো হ্যালো বলতে বলতে ক্লান্ত হয়ে নিভা আসল কথা শুরু করলো। নিভার একের পর এক কথা শুনে টিকলির হৃদপিণ্ড যেনো রক্ত সরবরাহ করা বন্ধ করে দিলো। চোখের সামনে দেখতে পেলো অন্ধকার আগামী ভবিষ্যতের কালো ধোঁয়া। একে একে বন্ধ হয়ে যেতে দেখলো সকল পথ। টিকলি কোন পথে এগোবে এবার? কোন রশি ধরে টানবে? কোন রাস্তা ধরে হাটলে সে নিজের গন্তব্যে পৌঁছাবে?
মিনিট দশেক না গড়াতেই রুহুল হক এবং আকিদা হকদের বিদায় দিয়ে ঘরে হুড়মুড় করে ডুকলেন জামিলুর রেজা, শায়লা আক্তার এবং টায়রা। জামিলুর রেজা নিস্তব্ধ টিকলির পাশে বসে মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বললেন,
‘আর সাতদিন পর তোমার বিয়ে মা।’
তৎক্ষণাৎ টায়রা বিছানার উপর হাটু মেরে বসে আকুতি মিনতি করে বলল,
‘বাবা তুমি বুঝতে পারছো না কেনো? রাহুল ভাইয়া…? রাহুল ভাইয়া কেনো? দেশে কি ছেলের অভাব পড়ছে? ওকে আমি সবসময় ভাই ভাই নজরে দেখেছি। হঠাৎ করেই দুলাভাই এ কনভার্ট হই কি করে বলো তো?’
টায়রা কাদো কাদো চোখে তাকিয়ে বলতেই শায়লা আক্তার টায়রার মাথায় গুতা দিয়ে বললেন,
‘মনে হচ্ছে বিয়ে ওর না তোর হচ্ছে?’
‘উফফ..মা তুমি কথা বলো না তো। তুমি হচ্ছো মেইন কালপ্রিট। তোমারই তো ভাতিজা। তোমার বাপের বাড়ি থেকে সম্বন্ধ এসেছে। মনে মনে নিশ্চয়ই তুমি লুঙ্গি ডান্স দিচ্ছো?’
জামিলুর রেজা গলা পরিষ্কার করে বললেন, ‘সম্বন্ধ আমরা দিয়েছি। আর তুমি লাফালাফি কমিয়ে করো। বড় বোনের বিয়ে হবে নাচবে, গাইবে, খাবে, ঘুরবে, দুলাভাই দেখবে শেষ।’
টায়রা যেনো গুপ্তধন পেয়েছে এমন ভঙ্গিতে আস্তে আস্তে বলল,
‘আরে বাবা আমি তো সেটাই বলছি। দুলাভাই দেখবো কীভাবে? এই দুলাভাইকে তো জন্মের পর থেকে দেখছি। এর মধ্যে দিয়ে দুলাভাই দুলাভাই ফিল পাবো না। একটা ইনটেক দুলাভাই চাই।’
‘ঠাস করে একটা চর মারবো ফাজিল মেয়ে চুপ থাক।’
মায়ের ধমকে টায়রা মুখ ফুলিয়ে বসলো।
জামিলুর রেজা গম্ভীর গলায় বললেন, ‘সাতদিন পর তোমার বিয়ে টিকলি। তৈরি হতে থাকো।’
বাবার কথায় অশ্রুসজল চোখে তাকিয়ে টিকলি মৃদু হাসলো। জামিলুর রেজার বুকটা মোচড় দিয়ে উঠলো। টিকলি হঠাৎ বাবার কাধে মাথা রাখলো। কম্পমান কণ্ঠস্বরে বলল,
‘আমার সাথে এটা তুমি করতে পারো না বাবা। সব জেনেশুনেও কেনো আমাকে আগুনে ফেলে দিচ্ছো?’
জামিলুর রেজা মেয়ের মাথায় হাত রেখে বললেন,
‘বাবা-মা কখনো সন্তানদের খারাপ চায় না। তারা সবসময় সন্তানের জন্য ভালোটাই করে। আমি তোমাকে কক্ষনো ওই বাড়িতে বিয়ে দিবো না। ও বাড়িতে তুমি সুখী হতে পারবে না।’
চোখমুখ শক্ত করে পাষণ্ডের ন্যায় কথাগুলো বলে জামিলুর রেজা ঘরের বাইরে পা রাখলেন। টিকলি উন্মাদের ন্যায় কেদে উঠলো। শায়লা আক্তার মেয়েকে জড়িয়ে ধরে ভাঙা গলায় বললেন,
‘কেনো এরকম করছিস মা? ভুলে যা না ওই ছেলেকে! কি আছে ওখানে?’
টিকলি জবাব দিতে পারলো না বিনিময়ে খামচে ধরলো মায়ের আঁচল। উন্মত্তার ন্যায় কাদতে কাদতে হেচকি উঠে গেলো। ক্ষিপ্ত পাগলামির সুরে বলল,
‘আমি পারবো না মা। তাকে ভুলে যাওয়ার চেয়ে মৃত্যু শ্রেয়। বিয়েটা ভেঙে দাও মা। দয়া করো।’
_______________________________
স্বচ্ছ সাদা মেঘের মাঝখানে রাজকীয় ভাবে তাপ বিকিরণ করছে সূর্যিমামা। গরমের সাথে সামঞ্জস্য রেখে প্রকৃতি শীতল বাতাস বিলাচ্ছে। হালকা বাতাসে সাদা পর্দাগুলোর মৃদু কাঁপাকাঁপি। জানালার পাশেই ক্লান্ত পিপাসায় বসেছিলো দাঁড় কাক। নিভাকে বাড়ি পৌঁছে দিয়ে ভাইয়ের ঘরে এসে আর্দ্র থমথমে মুখে সেখানেই তাকিয়েছিলো বিছানায় এক কোণায় বসে। পুরো বাড়ি নিরব-নিস্তব্ধ। আদর আধশোয়া হয়ে হাতে একটা পেপার ওয়েট ঘুরাতে ঘুরাতে চিন্তিত মুখে বলল,
‘আচ্ছা আর্দ্র, বাবা-মা কি কোনোমতে জেনে গেছে আমরা টিকলি টায়রাকে নিয়ে ঘুরতে গিয়েছিলাম?’
আর্দ্র গোমড়া মুখেই জবাব দিলো, ‘জানি না।’
কপালে কয়েকটা ভাঁজ ফেলে আদর আবার বলল,
‘আমরা যখন নিঝুম দ্বীপ গেলাম। তখনও তো না বলেই গিয়েছিলাম। এমনকি চার-পাঁচদিন থেকেছিলাম। কই তখন তো এতো রিয়েক্ট করেনি। অথচ এবার একদিনও থাকলাম না তাতেই যেনো বাসায় অগ্নিকাণ্ড লেগে গেলো।’
আর্দ্র ঠোঁট উল্টে দিয়ে বলল, ‘আসলেই তো চিন্তার বিষয়।’
তখনি আদরের ফোনটা বেজে উঠলো। ফোন সামনে এনে রাহুলের নাম্বারটা দেখে ভ্রু কুচকে শোয়া থেকে উঠে বসলো। ফোন রিসিভ করে বলল,
‘হ্যালো।’
‘ আসসালামু আলাইকুম ভাই।’
‘ ওয়ালাইকুম আসসালাম। কি ব্যাপার রাহুল? কোনো সমস্যা?’
‘না ভাই।’
‘তাহলে হঠাৎ ফোন দিলে যে? বাসায় আসো। এই উপরতলা থেকে নিচ তলায় ফোন দিতে হয় আবার? যখন তখন এসে পড়বে।’
রাহুল মাথা দুলিয়ে হেসে হালকা আওয়াজে বলল,
‘ভাই আমার বিয়ে। আপনি আমার খুব কাছের ভাই-ব্রাদার। তাই সবার প্রথম আপনাকে জানালাম।’
আদর হেসে বলল, ‘বাহ! ভালো! পেছন থেকে ছক্কা মেরে দিচ্ছো। তা মেয়ে কে?’
‘আমার কাজিন। ফুফাতো বোন।’
‘ওহ, উইশ ইউ ভেরি গুড লাক। কবে বিয়ে?’
‘এইতো ভাই সামনের পনেরো তারিখ। আর সাতদিন পর। আপনার কিন্তু ভাই আসা চাই ই চাই।’
রাহুলের বিয়ের ডেট শুনে আদর চমকালো। চোখ মুখ শক্ত হয়ে এলো। ইচ্ছে করলো দেয়ালে কপাল ঠুকে জিজ্ঞেস করতে, ‘ভাই আর ডেট পাস নাই? পনেরো তারিখে কি বের হইছে? সব জায়গায় এতো পনেরো পনেরো কেনো? এই পনেরো আমার জীবনের কাল। মন চায় সবজায়গা থেকে পনেরো নাম্বারটাকে বয়কট করে দেই। শালা!’ রাহুল হ্যালো বলতেই আদর সম্ভিত ফিরে হেসে বলল,
‘অবশ্যই। কেনো আসবো না? কিন্তু খুব তাড়াতাড়ি ডেট ফাইনাল করে ফেললে। আমি সময় করে উঠতে পারি কিনা বুঝতে পারছি না। মাত্র দুদিন ছুটি নিলাম।’
‘না ভাই আসতেই হবে। কোনো ভাবে ম্যানেজ করবেন।’
আরো কিছুক্ষণ কথা বলে আদর ফোন রেখে আর্দ্রের দিকে তাকিয়ে হতাশ নিঃশ্বাস ছেড়ে বলল,
‘রাহুলের বিয়ে। সাতদিন পর। তোরা তো প্রায় সমবয়সী। কি করলি জীবনে? এখনো বিয়ে করতে পারলি না। দেখ তোর আগে বিয়ে হয়ে যাচ্ছে।’
আর্দ্র পিটপিট করে তাকিয়ে বলল, ‘নিজেরটা আমার উপর গছিয়ে দিচ্ছো? আমি তো তাও সমবয়সী কিন্তু তুমি তো কম করে হলেও দু-তিন বছরের বড়। তবুও তো বিয়ের ফুল ফুটলো না।’
দ্বিতীয় বার হতাশ নিঃশ্বাস ফেলে আদর বলল,
‘বললাম তো আজ বাসায়। দেখি কি হয়? বিয়ের ফুল ফোটে কিনা? না ফুটলে একাই বিয়ে করে বউ নিয়ে একাই সেটেল হয়ে যাবো।’
বাইরে দাঁড়িয়ে দুই ছেলের সম্পূর্ণ কথোপকথন কানে লাগলো মনোয়ারা খানের। বুকটা তার ধক করে উঠলো। শীঘ্রই কিছু একটা করতে হবে। দুই ছেলেরই মতিগতি তিনি ধরতে পারছেন না। হাব-ভাব ভালো নয়। বড় কোনো ঝড়ের পূর্বাভাস!
_________________________________
টিকলির যেনো বাকশক্তি, বোধবুদ্ধি, শ্রবণশক্তি সব লোপ পেয়েছে। শূন্যে এক ধ্যানে নিবিষ্ট মনে তাকিয়ে আছে। ঘরের ফ্যান চলছে ফুল স্পিডে তবুও ঘেমে নেয়ে একাকার। টায়রা টিকলির কাধে হাত রেখে বলল,
‘আমার মনে হয় তোর উচিত ভাইয়াকে সব বলা।’
টিকলি আহত দৃষ্টিতে টায়রার দিকে তাকিয়ে ভেজা গলায় বলল, ‘একটু আগেই নিভা ফোন করেছিলো।’
টায়রা সচেতন দৃষ্টিতে তাকালো, ‘কি বলল?’
হা করে মুখভর্তি শ্বাস নিয়ে টিকলি বলল, ‘উনার বাড়িতে ঝামেলা হয়েছে। উনি নাকি বাড়িতে বলে দিয়েছেন আমাকে বিয়ে করতে চান। এরপর থেকেই অশান্তি। উনার বাবা মানবে না।’
টায়রা বিরক্তি ঠেলে কপাল চাপড়িয়ে বলল, ‘বালের সব ভেজাল একসাথেই লাগে? ভাইয়ার বাসায়ও আজকেই ঝামেলা লাগলো আমাদের বাসায়ও আজকেই তোর বিয়ের কথা উঠল। কাহিনি কি?’
জানালার ফাঁক গলিয়ে আকাশের দিকে তাকালেই বুক চিরে বেরিয়ে এলো কষ্টে ভরা দীর্ঘশ্বাস। অস্ফুট কণ্ঠে টিকলি বলল,
‘এমন অবস্থায় আমি কি করে আমার বিয়ের কথা উনাকে বলবো? তারউপর সাতদিন পর বিয়ের ডেট। এ খবর শুনলে উনি…’
টিকলি জোরালো শ্বাস ফেলল। কিছুক্ষণ পর শক্ত মনোবল নিয়ে বলে উঠলো, ‘নাহ..আগে আমি চেষ্টা করি। দেখি বিয়েটা ভাঙতে পারি কিনা। বাবা-মার মন গলে কিনা? তারপর উনাকে বলবো। উনার একার দায় তো নয়। সম্পর্ক টাতে আমারও কিছু করণীয় আছে।’
‘যা ভালো মনে হবে কর। তবে মনে রাখিস হাতে কিন্তু মাত্র সাতদিন সময়।’
টিকলি মুখে আর কথা বলল না। প্রচন্ড কাদার ফলে ভীষণ রকম মাথা ব্যাথা করছে। মাথা কাজ করার সিস্টেম টা বোধহয় বন্ধ হয়ে গেলো। টিকলি বোধহয় পাগল হয়ে যাবে। পাশ থেকে ফোনটা বেজে উঠলো। দূর্বল হাতে ফোনটা কানে ধরতেই ওপাশ থেকে ক্লান্ত গলায় কেউ বলল,
‘কি করছেন?’
টিকলি যেনো দেহে প্রাণ ফিরে পেলো। চোখ বন্ধ করে শুকনো ঠোঁট দুটো ভিজিয়ে তৃপ্ততা নিয়ে বলল, ‘কিছু না।’
‘বাসায় কোনো সমস্যা হয়েছে?’
‘না। আপনার বাসায়?’
আদর কিছুক্ষণ থেমে হালকা গলায় উত্তর দিলো, ‘না।’
টিকলি নিরবে মৃদু হাসলো। বলল, ‘কোনো সমস্যা হয়নি? কেউ কিছুই বলেনি?’
‘না। আপনাদের কেউ কিছু বলেনি?’
‘নাহ্। কে আর কি বলবে?’
টিকলি দীর্ঘশ্বাস নিলো। আদরের ভ্রু জোড়া কুচকে গেলো। কথায় বলে না চোরে চোরে মাসতুতো ভাই! চোরের মন নাকি চোর বুঝতে পারে কিন্তু ধরতে পারেনা। আদর সন্দেহ কন্ঠে বলল,
‘আপনার কণ্ঠটা কেমন যেনো শুনাচ্ছে। এনিথিং রং টিকলি? আপনি কি কেদেছেন?’
টিকলি ঠোঁট চেপে ধরলো। চোখ দিয়ে গড়ালো পানি।শব্দহীন ভাবে কেদে উঠলো। কিছু সময় অতিবাহিত হলো নিরবে। চোখ মুছে নাক টেনে ভাঙা গলায় টিকলি বলল,
‘এমনি। শুধু চারিপাশ খুব বিরক্ত লাগছে বুঝলেন ডাক্তার? মনে হচ্ছে আমি কোনো বিষাক্তময় পরিবেশে বাস করি।’
আদর স্মিত হাসলো। বলল,
‘মন-মানসিকতা খারাপ থাকলে আশেপাশের সবকিছুই বিরক্তিকর ঘটনা ঘটছে বলে মনে হয় আর এই বিরক্তির তিক্ততা বিচ্ছিন্ন করে তুলে আমাদের আপন মানুষজনদের কাছ থেকে। বিরক্ত দূরে ঠেলে ফেলে দিন টিকলি। শক্ত হয়ে উঠে দাড়ান। কঠোর হন। মনোভাব এমনভাবে সৃষ্টি করুন, আপনার জন্য আপনি সব। আপনার জন্য আর কেউ নেই এই পৃথিবীতে।’
টিকলি অস্ফুটস্বরে কেদে উঠলো আবারো। মাথা ঝাঁকালো কিন্তু মুখ ফুটে কিছু বলতে পারলো না। আদর জর্জরিত কণ্ঠে বলল,
‘আপনি ঘুমান টিকলি। একটু রেস্ট নিয়ে মাথা ফ্রেশ করুন। আমার কথাগুলো বারবার ভাবুন। ঘুম থেকে উঠার পর যা আপনি চাইছেন কিন্তু তা পাচ্ছেন না তা বারবার আয়নার সামনে গিয়ে বলুন। যেমন, ‘আমি টিকলিকে চাই। পৃথিবী ভেঙেচুরে, চূর্ণবিচূর্ণ করে, ধূলিসাৎ করে হলেও আমার তাকেই চাই। একমাত্র তাকেই চাই।’ দেখবেন হালকা লাগবে নিজেকে।’
আদরের কথায় যাদুমিশ্রিত কোনো মধু ছিলো। আদরের কথা শুনেই থেমে গেলো টিকলির অশ্রুধারা। বলের মতো মাথায় ঢপ খেতে লাগলো শুধু একটাই কথা, ‘আমি টিকলিকে চাই।’ বারবার মনেতে বেজে উঠলো সেই কম্পাংক উদ্বিয়মান কণ্ঠস্বর, ‘পৃথিবী ভেঙেচুরে, চূর্ণবিচূর্ণ করে, ধূলিসাৎ করে হলেও আমার তাকেই চাই। একমাত্র তাকেই চাই।’ যাদুর মতো চট করে টিকলির ভেতরে দৃঢ় এক অদৃশ্য বল চলে এলো। আদরের মতো করে সেও আয়নার সামনে গিয়ে বারবার বলল,
‘আমি উনার আছি উনারই থাকবো। পৃথিবী উল্টে যাক, ধ্বংস হয়ে যাক, এফোড়-ওফোড় হয়ে যাক তবুও আমি উনার। উনি আমার। প্রথম জীবনেও উনি আমার শেষ জীবনেও আমি উনার।’
চলবে❤️
উপন্যাসের শেষের দিকে এসে সাড়া কমে গেলো। এটা কি মানা যায়? দয়া করে সাড়া দিবেন। এতে লেখার মনোবল বাড়ে।