চন্দ্রমহল পর্ব-০৫

0
831

চন্দ্রমহল -০৫
১৩.
প্রলয় দুপুরে খাবার সময় বনলতাকে খুঁজলো।সেদিনের পর বেশ কয়েকদিন কেটে গেছে বনলতা তার সামনে আসে না।ভুল করে দেখা হয়ে গেলেও এড়িয়ে যায় অন্য দিকে।
প্রলয়ের কেমন পাগল পাগল লাগছে নিজেকে।কিভাবে সে বনলতাকে বুঝাবে জমিদারের রক্ত দেহে বইলেই সবাই এক রকম হয় না।কেউ কেউ সত্যি সত্যি পাহাড়সম ভালোবাসা বুকে জমিয়ে রাখে শুধুমাত্র একজনের জন্য।কারো কাছে ভালোবাসা মানে এক নারীতে মজে যাওয়া।
কেউ প্রেমিকার হাসিমুখ দেখার জন্য জীবন বাজি ধরতে জানে।
খেতে বসেও খেতে পারলো না প্রলয়। উঠে চলে গেলো খাবার টেবিল থেকে।নিজের কক্ষের দিকে যাবার সময় দেখতে পেলো প্রভাত একটা মদের বোতল নিয়ে করিডরে দাঁড়িয়ে আছে। হাতে একটা গ্লাস তাতে কিছুটা মদ আছে।মদের গ্লাসে চুমুক দিতে দিতে প্রভাত গুনগুন করে গান গাইতে লাগলো।
তারপর প্রলয় কে দেখে টলতে টলতে এগিয়ে গিয়ে বললো,”হ্যালো ব্রাদার,খাবে নাকি এক পেগ?”

প্রলয় নাক-মুখ কুঁচকে বললো,”দাদা হচ্ছে কি এসব,দূরে যাও দাদা।আমাকে ছুঁবে না।আমার ঘেন্না লাগে এসব।”

প্রভাত হেসে বললো,”আরে ভাই আমার,এরকম একটা খুশির দিনে যদি একটু মদ না খাই তবে পূর্ব পুরুষেরা ভীষণ মাইন্ড করবে বুঝলি,আয় আয়,দুই ভাই মিলে খাই।”
প্রলয় দু পা পিছিয়ে গিয়ে বললো,”বড় দাদাদের নিয়ে খাও।আমাকে যেতে দাও।”

প্রভাত টলতে টলতে দেয়াল চেপে ধরে বললো, “আজকে হেব্বি মজা হবে রাতে,নতুন একটা মাল এসেছে।আমার শ্রদ্ধেয় পিতার পরে মালটাকে আমি চেখে দেখবো। ”

প্রলয়ের কান লাল হয়ে গেলো ভাইয়ের এরকম বেহায়াপনা দেখে।ভাইকে পাশ কাটিয়ে যেতে যেতে শুনলো প্রভাত বলছে,”এতোদিন কোথায় ছিলেন বনলতা সেন,আজ বাবার পরে আপনাকে আমি মন ভরে আদর করবো।আপনার সেই টসটসে ঠোঁট লিচুর মতো মিষ্টি লাগে দেখতে,আমি শালা কিছুতেই বুঝি না এতো রূপ যৌবন নিয়ে একটা মেয়ে এভাবে থাকে কেমনে! ”

প্রভাতের কথা কানে যেতেই প্রলয়ের দুই কান লাল হয়ে গেলো। ছুটে এসে ভাইয়ের শার্টের কলার চেপে ধরে বললো,”কি বলছিস তুই এসব দাদা,আমার বনলতা কোথায়?”

-“তোর বনলতা মানে কি হ্যাঁ? তুই ও কি ওর যৌবন নদীতে ডুবেছিস না-কি ছোট ভাই?পাবি পাবি তাহলে,অপেক্ষা কর।আমি তো ভাবতাম তুই হলি এই জমিদার বংশের শুদ্ধতম পুরুষ। আজ তো দেখছি না তুই ও এই লাইনের।
শোন,আগে বাবা তারপর আমি তারপর কিন্ত তুই পাবি।বাবার হয়তো আজ সারা রাত লাগবে।আমি বুঝি না শালা এই বয়সেও বাবার এতো তেজ কেমনে আসে!”

প্রভাতের কথা শেষ হতেই প্রলয় চিৎকার করে উঠে বলে, “দাদা এসব কি বলছিস তুই,বনলতা আমার ভালোবাসা। আমি সবাইকে খুন করে ফেলবো আমার বনলতার একটু কিছু হয় যদি।”

প্রভাত টলতে লাগলো। ঝড়ের বেগে প্রলয় ছুটলো তিন তলার দিকে।গিয়ে দেখে রাজেন্দ্র নারায়ণ এর কক্ষের বাহিরে ছয়জন পেয়াদা দাঁড়িয়ে আছে।দরজায় বাহিরে থেকে তালা দেওয়া।
উদ্ভ্রান্তের মতো প্রলয় জিজ্ঞেস করলো,”ভিতরে কে আছে?বাবা কোথায়?”

একজন পেয়াদা জবাব দিলো,”জমিদার বাবু গিন্নিমায়ের ঘরে,ভিতরে একটা মেয়ে আছে।বাবু বলে গেছেন পাহারায় থাকতে এই মেয়ে যেনো পালাতে না পারে,উনি দরজায় তালা দিয়ে গেছেন।”

প্রলয় দরজায় দুই লাথি দিতেই পেয়াদারা চেপে ধরলো প্রলয় কে।প্রলয় ছুটলো মায়ের কক্ষের দিকে।মায়ের কক্ষের দরজা বন্ধ পেয়ে জানালায় গেলো,কিন্তু জানালা ও বন্ধ।দরজা ধাক্কাতে লাগলো প্রলয় কিন্তু ভিতর থেকে কেউ কোনো সাড়া দিলো না।

হতাশ হয়ে প্রলয় আবার রাজেন্দ্র নারায়ণের কক্ষের সামনে এলো।আবারও দরজায় লাথি দিতে পেয়াদারা চেপে ধরলো তাকে।এবার আর প্রলয়কে আটকাতে পারলো না।একজনের হাত থেকে তলোয়ার টেনে হাতে নিয়ে প্রলয় রুখে দাঁড়ালো।তারপর বললো,”আয় কে আসবি আমার সামনে? সবকটার গর্দান কেটে নিবো আমি।আমার বনলতার যদি একটু ক্ষতি হয়,আমি এই পুরো পৃথিবী তছনছ করে দিবো।আমি কাউকে ছাড়বো না,স্বয়ং জমিদার রাজেন্দ্র নারায়ণ সিংকে ও না।”

প্রলয়ের হাতে তরবারি দেখে সেপাহিরা পিছিয়ে গেলো।সবাই জানে জমিদারের চার পুত্রের মধ্যে অস্ত্রচালনাতে প্রলয় ওস্তাদ ব্যক্তি।

প্রলয় বললো,”চাবি দে তাড়াতাড়ি। নয়তো এই কক্ষের সামনে তোদের ছয়জনের মুন্ডু গড়াগড়ি খাবে এক মিনিটের মধ্যে। ”

ক্রোধে গর্জনরত প্রলয়ের দুই চোখ ইটের ভাটার মতো জ্বলছে।এই মহলের সবচেয়ে শান্ত ব্যক্তি প্রলয়,আজ তার ধ্বংসাত্মক রূপ দেখে ভয়ে পকেট থেকে একজন পেয়াদা চাবি বের করে দিলো।
দ্রুত হাতে প্রলয় কক্ষের তালা খুললো।তারপর দরজা ধাক্কা দিতেই দেখলো দরজা ভেতর থেকেও বন্ধ।

১৪.
স্বর্ণলতা অবাক নয়নে তাকিয়ে আছে বনলতার দিকে। যেনো মেয়েকে নয়,নিজেকে দেখছে।বনলতার হাসি অবিকল তার মতো। ১৬ বছর ধরে স্বর্ণলতা শুধু এই আশায় বুক বেঁধে ছিলো তাকে নিশ্চয় তার বনলতা রক্ষা করবে।একমুহূর্তের জন্যও তিনি আশাহত হন নি।
সম্পূর্ণ আলো-বাতাস বিহীন এই কামরাটিতে কখনো বুঝা যায় না এখন দিন না-কি রাত।দেয়ালে থাকা ঘড়িটা ছাড়া আর কিছু নেই এই কক্ষে যা দেখে জানা যাবে এখন সকাল নাকি বিকেল।পুরো কক্ষে একটা বিশালাকৃতির পালঙ্ক।
একপাশে একটা আলমারি,আলমারি ভর্তি শাড়ি গহনা।সাথে একটা শৌচাগার। এছাড়া পুরো কক্ষ খালি।

স্বর্ণলতা মেয়েকে জড়িয়ে ধরে বললেন,”প্রতিরাতে যখন ঘড়িতে ১২টা বাজতো,আমি নতুন করে স্বপ্ন দেখতাম যে আজকে আমি মুক্তি পাবো।আমার সেই স্বপ্ন কখন ভাঙ্গতো জানিস তুই?১১.৫৯ মিনিটে আমার সেই স্বপ্ন ভেঙে যেতো,আবার ১২টা বাজলে আমি স্বপ্ন দেখতাম নতুন একটা দিন,নিশ্চয় আজকে আমার মেয়ে আমাকে খুঁজে পাবে।
ঈশ্বরের কাছে কতোদিন প্রার্থনা করেছি কিন্তু ঈশ্বর আমার ডাকে এতোদিন সাড়া দেয় নি।তোর বাবা বলতো,মন থেকে যদি তুমি ঈশ্বরের কাছে কিছু চাও যা তোমার জন্য মঙ্গলের ঈশ্বর তা তোমায় নিশ্চয় দিবে।তোমার কাছে দেরিতে মনে হলেও সঠিক সময়ে তোমাকে সেই জিনিস ঈশ্বর দিবে।আমাদের কিসে,কখন মঙ্গল হবে তা আমাদের চাইতে ঈশ্বর ভালো জানে।তাই কখনো নিরাশ হয়ো না স্বর্ণলতা।
আমিও নিরাশ হই নি।দেখ আজ ঈশ্বর আমার ডাকে সাড়া দিয়ে তোকে পাঠিয়েছে। জানিস আজকে তুই আসার আগে জমিদার আমাকে কি বলেছে,১৬ বছর আগে যেই ইংরেজগুলোর সাথে হাত মিলিয়ে রাজেন্দ্র নারায়ণ তোর বাবা আর কাকাকে পুড়িয়ে মেরেছে,তারা আগামী সপ্তাহে আবারও আসবে।ওরা এখন ইংরেজ সরকারের অনেক বড় কর্মচারী। আমাকে আবারও ওদের হাতে তুলে দিবে জমিদার সেই রাতের জন্য।তারপর থেকেই আমার মনে হয়েছে এর থেকে সঠিক সময় আর নেই আমার বনলতার আমাকে মুক্ত করতে আসার।আমার ঈশ্বর তোকে সঠিক সময়ে পাঠিয়েছে। ”

বনলতা উঠে দাড়িয়ে বললো,”মা উঠো এবার।আমাদের পালাতে হবে এবার।”

আলমারি থেকে একটা ব্যাগ নিয়ে তাতে মায়ের কয়েকটা শাড়ি আর সমস্ত গহনাদি ঢুকিয়ে নিলো।

তারপর মা মেয়ে এসে জানালার সামনে দাঁড়ালো। কিন্তু জানালার মোটা গ্রিল ভাঙার মতো কিছু পেলো না।তাছাড়া তিন তলা থেকে নিচে নামা বনলতার জন্য সহজ হলেও স্বর্ণলতার জন্য অসম্ভব।

কিছুক্ষণ ভেবে বনলতা সিদ্ধান্ত নিলো দরজা দিয়েই বের হবে।মায়ের দিকে তাকিয়ে বললো,”মা,আমি এখন একটা ঝুঁকিপূর্ণ কাজ করবো।তবে আমি যাই করি,আমার যাই হোক তুমি থামবে না।ছুটবে তুমি।তোমার দিকে কেউ নজর দিবে না আমাকে ধরতে ব্যস্ত থাকবে সবাই।আমি সর্বোচ্চ চেষ্টা করবো তোমার সাথে আসার,কিন্তু তবুও যদি না পারি তবে তুমি আমার অপেক্ষায় থেকো না।
জমিদার বাড়ির পিছনে একটা পুকুর আছে।পুকুরের চারপাশে দেয়াল দেওয়া। দেয়ালের একধারে দেখবে অনেক ঝোপঝাড়। এই ঝোপঝাড়ের ভেতরে আমি দেয়াল অনেকটা ভেঙে রেখেছি।ভাঙা দেয়ালের এপাশ ওপাশ দুই পাশেই এই ঝোপ আছে।অনেক দিন আগেই আমি এই ঝোপ লাগিয়েছি এখানে,কোনো একদিন ব্যবহার হতে পারে ভেবে।তাই কেউ এখনো জানে না এই দেয়াল যে ভাঙা। ওই ঝোপ দিয়ে তুমি বের হয়ে যাবে।ওপাশে বের হলেই দেখবে একটা নদী আছে,জমিদার বাড়ির সামনে থেকে যেই নদী দেখা যায় সেটা।একটা নৌকা বেঁধে রেখেছি আমি ওখানে,তালা দেওয়া নৌকায়।এই নাও চাবি,নৌকায় উঠে তুমি পিছন দিক দিয়েই চলে যাবে।কিছুদূর গেলেই তাঁতীপাড়া পাবে,ওখানে গিয়ে রমনা বুড়ির সন্ধান করবে তুমি।আমার নাম বললেই বুড়ি তোমায় আশ্রয় দিবে।বুড়ি ছাড়া অন্য কেউ জিজ্ঞেস করলে বলবে তুমি বুড়ির বোনঝি চন্দনা। বেঁচে থাকলে আবারও দেখা হবে মা,আর মরে গেলে জেনে নিও,তোমার স্বামী বীর ছিলো,তোমার শ্বশুর বীর ছিলো,তোমার ছেলে বীর ছিলো,তোমার মেয়েও তাদের মতো হয়েছে।ভীতুর মতো পালিয়ে যায় নি।জেনে রেখো মা,তোমার মেয়ে যদি মরে যায় তবে তার আগে এই জমিদার আর সেই লোকগুলোর মৃত্যু দিয়ে তবেই মরবে যাদের জন্য আমার পুরো পরিবারকে নিঃশেষ হয়ে যেতে হয়েছে। আর যদি না মরে তবে তখনও জানবে পৃথিবী থেকে এক দল পাপীকে বিদায় দিয়েছে তোমার মেয়ে।”

স্বর্ণলতা মেয়েকে জড়িয়ে ধরলেন,মায়ের পদধূলি নিয়ে বনলতা বললো,”যুদ্ধে সন্তানকে হাসিমুখে বিদায় দিতে হয় মা,কান্না করে না।মায়ের হাসি মুখ সন্তানের জন্য সাহস,অনুপ্রেরণা হিসেবে কাজ করে। ”

স্বর্ণলতা তবুও হাসতে পারলো না।মেয়েকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে বললো,”আমার যে আর কেই নেই মা তুই ছাড়া। আমি তোকে হারাতে চাই না।১৬ বছর পরে তোকে খুঁজে পেয়েছি,একটা বার তোকে আদর দিতে পারি নি,কিভাবে বল নিজের জীবন নিয়ে পালাবো শত্রুদের মাঝে তোকে রেখে দিয়ে।আমি যাবো না মা তোকে ছেড়ে। ”

বনলতা মায়ের দু হাত শক্ত করে ধরে বললো,”এভাবে বলতে নেই মা,আমার বুকের ভেতর যে আগুন জ্বলছে সেই আগুনে এই জমিদারকে না পোড়ালে যে আমার শান্তি হবে না মা।তুমি থাকলে আমার পিছুটান থাকবে।আমাকে আমার স্বপ্ন পূর্ণ করতে দাও মা।যদি ঈশ্বর বাঁচিয়ে রাখে তবে জীবিত দেখা হবেই তোমার সাথে মা,আমি আবার তোমার কোলে ফিরবো অসুর বিনাশ করে।
যদি বেঁচে না থাকি,তবে চিতায় তোলার আগে তুমি আমাকে কপালে একটা গভীর চুমু খেও,আমার এতো বছরের মায়ের আদর পাবার আকাঙ্ক্ষা মিটে যাবে মা।আমার মাথার দিব্যি রইলো মা,তুমি পিছন ফিরে তাকাবে না।ছুটতে থাকবে তুমি।”

চলবে…..
জাহান আরা

আজকে বড় করে পর্ব দিছি কিন্তু😒এবার সবাই কমেন্ট করবেন।এতো কষ্ট করে লিখতে পারি আপনারা একটা কমেন্ট করতে পারেন না😏

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here