সুপ্ত_প্রেমাসুখ পর্ব-৫৫

0
675

#সুপ্ত_প্রেমাসুখ
#ইলোরা_জাহান_ঊর্মি
#পর্বঃ৫৫

দ্বিতীয়বার পুনরায় আবার বিয়ে হলো এরেন-ইলোরার। কিন্তু এবারের অনুভূতিগুলো সম্পূর্ণ অন্যরকম ছিল। কারণ প্রথমবার বিয়েটা আকস্মিক দূর্ঘটনায় হয়েছিল। তাই কোনো অনুভূতিও ছিল না তাতে। এবারে দুজনের মত আছে বলেই অনুভূতিগুলো মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে। রেজিস্ট্রি পেপারে সাইন করার সময় ইলোরা কান্নায় ভেঙে পড়েছিল। এই মুহূর্তগুলো যে কোনো মেয়ের জন্যই কষ্টকর। শিশুকাল থেকে যেই পরিবারে বড়ো হয়, সেই পরিবার ছেড়ে অন্য একটা পরিবারকে আপন করে নেয়াটা খুব সহজ কাজ নয়। বিয়ের ঝামেলা মিটিয়ে সন্ধ্যার দিকে এরেনের বাবা-মা আর আত্মীয়-স্বজন সবাই বাড়ি ফিরে গিয়েছেন। এরেনের সাথে জারিন আর তার চারজন কাজিন রয়ে গেছে। রাতের খাবারের পর আস্তে আস্তে বাড়ি ফাঁকা হতে শুরু করল। ইলোরার বন্ধুমহলও বিদায় নিয়ে চলে গেল। রাত নয়টার দিকে ছোটোরা সবাই ইলোরার রুমে আসর বসাল। উদ্দেশ্য, বাসর ঘরে বিঘ্ন ঘটানো। প্ল্যানটা অবশ্য রনির। বাসর ঘর সাজানো হয়েছে তাই সবাই বড়ো পাটি বিছিয়ে মেঝেতে গোল হয়ে বসল। ইলোরা এরেনের পাশে দীর্ঘক্ষণ বসে থাকলেও এখনও সে মুখ খোলেনি। এরেন ফিসফিস করে বারবার ডাকা সত্ত্বেও সে ফিরেও তাকায়নি। হতাশ হয়ে এরেন ডাকাডাকি বন্ধ করে দিয়েছে। আপাতত সবার পূর্ণ মনোযোগ আড্ডায়। সবাই মিলে সিদ্ধান্ত নিয়েছে গানের কলি খেলবে। সিদ্ধান্ত মতো শুরুও করে দিলো। একজন একটা গান গাইছে, সেই গানের শেষ অক্ষর দিয়ে অপরজন গাইছে। গানে গানে আড্ডা বেশ জমজমাট হয়ে উঠেছে। এদিকে গানের তালে তালে যে ঘন্টার পর ঘন্টা পার হয়ে গেছে, সে খেয়াল কারোর নেই। ইলোরাও আড্ডায় মশগুল হয়ে আছে। এরেন গালে হাত দিয়ে সবার কীর্তি দেখে যাচ্ছে। এরা সবাই যে তার বাসর রাতটা ভেস্তে দেয়ার মতলবে আছে তা তার বুঝতে বাকি নেই। অথচ এতে তার বউয়েরই কোনো ভ্রুক্ষেপ নেই। বেচারা এরেন শুধু সময় গুণছে কখন এই আড্ডা শেষ হবে। ঘড়ির কাঁটা যখন বারোটার দাগ ছুঁলো, সাকিব হুট করে উঠে দাঁড়িয়ে অনন্যাকে উদ্দেশ্য করে বলল,“অনু, অনেক রাত হয়েছে। এবার ওঠো।”

সাকিব বলার সাথে সাথে অনু উঠে পড়ল। রনি হন্তদন্ত হয়ে উঠে সাকিবকে টেনে ধরে নিচু স্বরে বলল,“ওই দোস্ত, এত তাড়াতাড়ি কই যাস?”

সাকিবও নিচু স্বরে বলল,“শালা, নিজের বোনের বাসর ঘরে বড়ো ভাই বসে থাকলে কেমন দেখায়? এতক্ষণ আটকে রাখছিস, এখন ছাড়।”

“আরে আমরা তো বন্ধুর বাসর ঘরে আছি।”

“থাক তুই। আমারে আর টানিস না। মান সম্মান কিচ্ছু থাকবে না আমার।”

সাকিব রনির হাত ছাড়িয়ে দ্রুত রুম থেকে বেরিয়ে গেল। পেছন পেছন অনন্যাও চলল। রনি পেছন থেকে বলল,“ভাবি, তুমি অন্তত থাকো।”

অনন্যা যেতে যেতে বলল,“মাফ করেন ভাই।”

রনি বিরক্তি নিয়ে পুনরায় নিজের জায়গায় গিয়ে বসে পড়ল। জারিন এরেনের মুখের দিকে তাকিয়ে ঠোঁট টিপে হেসে সেও উঠে পড়ল। তার দেখাদেখি তার কাজিনরাও উঠে পড়ল। রনি অবাক হয়ে বলল,“আরে তোমরা উঠছ কেন? আড্ডা তো শেষ হয়নি।”

জারিন বলল,“পাঁচ মাস পর আমাদের বাড়িতে আবার বাসর ঘর সাজিয়ে বাকি আড্ডা দিব। এখন ঘুম পাচ্ছে।”

মিথিলা মুখ ফুলিয়ে বলল,“এত সহজে ছেড়ে দিবেন আপু?”

জারিন হেসে বলল,“পরেরবার পুষিয়ে নিব। এত সহজে ছেড়ে দেয়ার পাত্রী নই আমি।‌ এখন বরং তোমরা হাতিয়ে নাও।”

জারিন তার কাজিনদের নিয়ে চলে গেল। তাদের দেখাদেখি ইলোরার কাজিনরাও সবাই একে একে দাঁত কেলিয়ে উঠে চলে গেল। রনি আর মিথিলা চেষ্টা করেও কাউকে আটকাতে পারল না। শেষে শুধু বাকি ছিল ডালিয়া, মিথিলা আর রনি। ডালিয়া উঠে বলল,“মিথি চল। আমার ঘুম পাচ্ছে।”

মিথিলা বলল,“তোমার ঘুম পাচ্ছে তো তুমি যাও। আমাকে ডাকছো কেন?”

ডালিয়া মিথিলার হাত টানতে টানতে বলল,“আরে চল না মেহমানদের বিছানা গুছিয়ে দেই।”

মিথিলা ত্যাড়াভাবে বলল,“তার জন্য অনু আপ্পি আছে। তোমার ইচ্ছা থাকলে তুমি যাও। আমি যাচ্ছি না। সব সাধু হয়ে গেছে!”

ডালিয়া চেষ্টা করেও মিথিলাকে টেনে তুলতে পারল না। হতাশ হয়ে সে নিজেই চলে গেল। মিথিলা আর রনি গোঁ ধরে বসে রইল। ইলোরা ভ্রুকুটি করে ওদের দিকে তাকিয়ে আছে। এরেন ভ্রু উঁচিয়ে বলল,“আপনাদের কি এই রুমেই ঘুমানোর ইচ্ছা আছে?”

রনি হাই তুলে বলল,“উঁহু। আমাদের হাতে কিছু গুঁজে দেন, আমরা চুপচাপ চলে যাই। সবাই তো বোকার মতো চলে গেল আমার প্ল্যানে জল ঢেলে দিয়ে।”

এরেন প্রশ্ন করল,“কত?”

মিথিলা ফট করে বলে উঠল,“দুজনকে দশ দশ দিলেই হবে।”

ইলোরা আবাক হয়ে মিথিলার মুখের দিকে তাকাল। এরেন মাথা দুলিয়ে পকেট থেকে ওয়ালেট বের করল। মিথিলা আর রনি উৎসুক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল। এরেন ওয়ালেট থেকে দুটো দশ টাকার নোট বের করে দুজনের সামনে ধরে বলল,“নিন, দুজনের দশ দশ।”

রনি আর মিথিলা চোখ বড়ো করে ফেলল। ইলোরা ঠোঁট টিপে হাসছে। রনি শক্ত মুখে বলল,“শালা, এমন দিনেও কিপ্টামি করস? তোর বাসর রাত ক্যানসেল।”

এরেন বলল,“তুই ক্যানসেল করার কে?”

“আমি ভিলেন।”

মিথিলা বলল,“এটা ঠিক না ভাইয়া। এত সহজে কিন্তু আমরা ছাড়ছি না।”

এরেন গলা ঝাড়া দিয়ে বলল,“রনি, বলছি যে তোরও কিন্তু একদিন বাসর হবে। আমি ভাবছি তোর বিয়েই যদি না হয় তাহলে বাসর হবে কীভাবে?”

রনি সন্দিহান কন্ঠে বলল,“কী বলতে চাস?”

“তোর বিয়েতে যদি আমি ভিলেন হয়ে দাঁড়াই না, তাহলে কিন্তু তোর হাওয়া ফুস মামা।”

রনি চোখ গোলাকার করে বলল,“শালা ব্ল্যাকমেইল শুরু করছোস? তুই জীবনে ভালো হবি না। মিথি ওঠ।”

রনি মিথিলাকে উঠতে বলে নিজেও উঠে পড়ল। মিথিলা কপাল কুঁচকে বলল,“মোটেও না। আপনি ছাড়লেও আমি ছাড়ব না।”

রনি মিথিলার হাত ধরে জোর করে টেনে নিয়ে যেতে যেতে বলল,“আমার সব স্বপ্নে বাঁশ দিয়া দিব, বোঝার চেষ্টা কর পুঁচকি।”

এরেন শব্দ করে হেসে উঠল। পরক্ষণেই ইলোরার মুখের দিকে তাকিয়ে থেমে গেল। কিছুটা ঝুঁকে এসে বলল,“হাই ম্যাম। রাগ কমেছে?”

ইলোরা এক নজর এরেনের দিকে তাকিয়ে গুমোট মুখে উঠে দাঁড়াল। এরেনও উঠে দাঁড়াতেই সে দ্রুত পায়ে গিয়ে ড্রেসিং টেবিলের সামনে দাঁড়াল। তারপর একটা একটা করে গহনা খুলতে লাগল। এরেন গিয়ে দরজা বন্ধ করে ধীর পায়ে এগিয়ে গিয়ে ইলোরার পাশে দাঁড়াল। ইলোরা তার দিকে না তাকিয়ে চুপচাপ গহনা খোলায় মনোযোগ দিলো। এরেনও চুপচাপ দাঁড়িয়ে এক দৃষ্টিতে ইলোরার দিকে তাকিয়ে রইল। ইলোরা একটা একটা করে সব গহনা খুলে চুল খুলতে লাগল। চুল এত ক্লিপ দিয়ে আটকানো হয়েছে যে খুলতে গিয়ে বারবার প্যাঁচ লেগে যাচ্ছে। ইলোরার বিরক্তি এসে গেল। মুখে একরাশ বিরক্তি নিয়েই সে ক্লিপগুলো টেনে টেনে খোলার চেষ্টা করল। বিধায় ক্লিপের সাথে চুলও ছিঁড়ে চলে এল। এরেন দু’পা এগিয়ে গিয়ে ইলোরার হাত ধরে আটকে দিয়ে বলল,“চুল ছিঁড়ে যাচ্ছে। আমি খুলে দিচ্ছি।”

ইলোরা থেমে গেল। চুল থেকে হাত নামিয়ে সে চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইল। আপাতত সে এই বিরক্তি থেকে মুক্তি পেলেই বাঁচে। এরেন মুচকি হেসে ইলোরার চুল থেকে সযত্নে একটা একটা করে ক্লিপ খুলে দিলো। ক্লিপ খোলা শেষ করে চুলগুলো পিঠে ছড়িয়ে দিলো। তারপর হুট করেই ইলোরার দুহাত নিজের মুঠোবন্দী করে কাঁধে থুতনি রাখল। সঙ্গে সঙ্গে ইলোরা এরেনের থেকে সরে যাওয়ার চেষ্টা করল। এরেন মুচকি হেসে বলল,“বৃথা চেষ্টা করে লাভ নেই ম্যাম। আমি না ছাড়লে আপনি সরতে পারবেন না।”

ইলোরা আড়চোখে একবার আয়নার দিকে তাকাল। এরেনও আয়নার দিকে তাকিয়ে ছিল বিধায় চোখাচোখি হয়ে গেল। ইলোরা দ্রুত দৃষ্টি ফিরিয়ে হাত মোচড়াতে লাগল। এরেন ইলোরার মাথায় একটা চুমু খেয়ে ছেড়ে দিয়ে বলল,“ফ্রেশ হয়ে আসো।”

ইলোরা গাল ফুলিয়ে দ্রুত পায়ে গিয়ে আলমারি খুলল। একটা থ্রি-পিস বের করতেই পেছন থেকে এরেন বলল,“চেঞ্জ কোরো না। শাড়িতে সুন্দর লাগছে।”

ইলোরা কী ভেবে হাতের থ্রি-পিসটা পুনরায় আলমারিতে রেখে দিয়ে নিঃশব্দে ওয়াশরুমে চলে গেল। সে ফ্রেশ হয়ে বেরোনোর পর এরেনও নিঃশব্দে ওয়াশরুমে ঢুকে গেল।


“আপনি কি থাকবেন না বাড়ি চলে যাবেন?”

মিথিলার প্রশ্নে রনি তার মাথায় চাটি মেরে বলল,“কথাও শিখিসনি? কোথায় বলবি আজ আর যাওয়ার দরকার নেই। কাল তো আবার আসতেই হবে। তা না, বলছিস থাকব না চলে যাব। গাধা!”

“থাকতে ইচ্ছে করলে থাকেন। না বলেছে কে? আমার ঘুম পাচ্ছে, গুড নাইট।”

মিথিলা ঘুরে চলে যাওয়ার জন্য পা বাড়াতেই রনি হঠাৎ তার হাত ধরে হেঁচকা টান দিয়ে দেয়ালের সাথে চেপে ধরল। মিথিলা হকচকিয়ে গিয়ে ঢোক গিলল। ভয়ার্ত কন্ঠে বলল,“কী করছেন? এটা বাড়ি, কেউ দেখলে কেলেঙ্কারি হয়ে যাবে।”

রনি মিথিলার মুখের দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল,“কেউ নেই তো। এতক্ষণে সবাই শুয়ে পড়েছে।”

মিথিলা কাঁপা গলায় অনুরোধ করে বলল,“প্লিজ ছাড়ুন। আমার খুব ভয় লাগছে।”

রনি মিথিলার আরেকটু কাছে এগিয়ে যেতেই মিথিলার সারা শরীরে কম্পন ধরে গেল। রনি ঠোঁট এলিয়ে হেসে বলল,“এমনিতে তো সবসময় মুখ দিয়ে খই ফোটে। কাছে এলেই কাঁপা-কাঁপি শুরু হয় কেন?”

মিথিলা অসহায় মুখে তাকাতেই রনি মিথিলার কপালে ঠোঁট ছুঁয়ে দিলো। মিথিলা চোখ দুটো খিঁচে বন্ধ করে ফেলল। রনি হেসে মিথিলাকে ছেড়ে চলে যাওয়ার জন্য ঘুরে দাঁড়াতেই সামনে জারিনকে চোখে পড়ল। জারিনের চোখ দুটো ছলছল করছে। রনি এক নজর তাকিয়েই দ্রুত পায়ে হেঁটে সেখান থেকে সরে গেল। মিথিলা ভীষণ অপ্রস্তুত হয়ে এলোমেলো দৃষ্টিতে জারিনের দিকে তাকাল। জারিন ধীর পায়ে এগিয়ে এসে মিথিলার সামনে দাঁড়াল। মিথিলা জিব দিয়ে শুকনো ঠোঁটটা ভিজিয়ে নিয়ে মৃদু কন্ঠে বলল,“আপনার কি কিছু লাগবে আপু?”

জারিন মিথিলার প্রশ্নটা এড়িয়ে গিয়ে মিথিলার কপালে হাত রাখল। মিথিলা কিছুটা চমকে উঠল। জারিন মিথিলার কপাল থেকে হাত নামিয়ে মলিন হেসে বলল,“ভয় পেয়ো না। তোমার কপাল মাপছিলাম। শুনেছি কপাল পাঁচ আঙুল হলে তারা সৌভাগ্যবতী হয়। যদিও এটা কুসংস্কার। তবে তোমার কপাল পাঁচ আঙুল না হলেও, ভাগ্যটা সত্যিই বিশাল।”

মিথিলা অবাক হয়ে ফ্যালফ্যাল করে জারিনের মুখের দিকে তাকিয়ে রইল। রনির মুখে সে শুনেছিল জারিন রনিকে ভালোবাসে। কিন্তু এই মুহূর্তে তার এসব কথার অর্থ মিথিলার কাঁচা মস্তিষ্কে ঠিক ঢুকল না। জারিন ছোটো একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে মিষ্টি হেসে বলল,“এক গ্লাস পানি খাওয়াবে?”

মিথিলা মাথা দুলিয়ে বলল,“হ্যাঁ হ্যাঁ, এক্ষুনি নিয়ে আসছি।”


এরেন ফ্রেশ হয়ে ওয়াশরুম থেকে বেরিয়ে দেখল ইলোরা বিছানার একপাশে গুটিসুটি মেরে শুয়ে আছে। এরেন ভালো করেই জানে ইলোরা ঘুমায়নি। শুধু শুধু চোখ বন্ধ করে পড়ে আছে। এরেন মুচকি হেসে এগিয়ে গিয়ে ইলোরার পাশে বসল। শরীরে টকটকে লাল বেনারসী শাড়ি জড়ানো, খোলা চুল, মুখে একরাশ স্নিগ্ধতা ছড়িয়ে থাকা মেয়েটা শুধুই তার ব্যক্তিগত মানুষ। ইলোরাকে সূক্ষ্ম চোখে নিরীক্ষণ করে এরেন ইলোরার দুপাশে হাত রেখে মুখের কাছে ঝুঁকে পড়তেই ইলোরা ফট করে চোখ খুলে ফেলল। এরেন পাঞ্জাবি খুলে রাখায় স্যান্ডো গেঞ্জির ফাঁক দিয়ে তার লোমশ বুকটাই আগে চোখে পড়ল। এরেনকে এত কাছে দেখে সে লাফিয়ে উঠে বসল। এরেন সোজা হয়ে বসে বলল,“হাসবেন্ডকে দেখে এমন লাফিয়ে উঠতে হয়? বোকা মেয়ে!”

ইলোরা মুখ ফুলিয়ে পা ভাঁজ করে বসল। এরেন ইলোরার দিকে এগিয়ে যেতেই ইলোরা পিছিয়ে যেতে যেতে মৃদু কন্ঠে বলল,“এগোচ্ছ কেন?”

এরেন দুষ্টু হেসে বলল,“এটা আবার জিজ্ঞেস করা লাগে না-কি? আজ আমাদের ফুলশয্যার রাত না? এমন রাতে কি হাত-পা গুটিয়ে বসে থাকব?”

এরেন ইলোরার কাছাকাছি যেতেই ইলোরা পাশ থেকে একটা বালিশ এনে মাঝে রেখে এরেনকে বাঁধা দিয়ে অভিমানী গলায় বলল,“একদম এগোবে না। আমি কিন্তু রেগে আছি।”

এরেন দুষ্টু হাসি মুখে ঝুলিয়েই বালিশটা টান দিয়ে সরিয়ে বলল,“রাগলে তোমাকে আরও সুন্দর লাগে গো বউ।”

ইলোরা এবার গিয়ে খাটের সাথে ঠেকল। আর কোনো পথ না পেয়ে সে এরেনের বুকে হাত দিয়ে আটকানোর চেষ্টা করে বলল,“মিষ্টি মিষ্টি কথা বলার দরকার নেই। কাছে আসবে না বলছি।”

“আমার বউয়ের কাছে আমি আসব। তাতে তোমার কী?” কথাটা বলতে বলতে এরেন হুট করে ইলোরাকে কোলে তুলে উঠে দাঁড়িয়ে বেলকনির দিকে হাঁটা দিলো। ইলোরা হাত-পা ছুঁড়ে বলল,“আরে, পড়ে যাব। নামাও বলছি।”

এরেন বেলকনিতে গিয়ে ইলোরাকে কোল থেকে নামিয়ে দিলো। ইলোরা সরতে যেতেই এরেন ইলোরার দুপাশে রেলিংয়ে হাত রেখে আটকে ফেলল। ইলোরা অভিমানী মুখটা অন্যদিকে ফিরিয়ে নিতেই এরেন বলল,“এই ইলোনি, সরি বলেছি তো।”

ইলোরা গুমোট মুখে এরেনের দিকে তাকিয়ে বলল,“সরি বললেই খালাস? আমি যে কষ্ট পেয়েছি তা কিছু না?”

এরেন অপরাধীর মতো মুখ করে বলল,“আর কোনোদিনও এমন কষ্ট দিব না। প্রমিস।”

ইলোরা ভ্রু জোড়া কুঞ্চিত করে অপর দিকে ঘুরে দাঁড়িয়ে রেলিংয়ে হাত রাখল। এরেন ইলোরাকে পেছন থেকে আলতো করে জড়িয়ে ধরে বলল,“চলো আজ সারারাত জেগে ঐ থালার মতো সুন্দর চাঁদ দেখি।”

ইলোরা হামি তুলে বলল,“আমার ঘুম পাচ্ছে।”

এরেন কপাল কুঁচকে তাকিয়ে বলল,“তুমি আসলেই আনরোমান্টিক।”

ইলোরা বাইরের দিকে দৃষ্টি রেখে বলল,“তো বিয়ে করেছ কেন? রোমান্টিক কোনো স্মার্ট মেয়েকে বিয়ে করতে।”

এরেন সশব্দে একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল,“কী করব? আমার যে এই আনরোমান্টিক মেয়েটাকে ছাড়া চলবেই না।”

ইলোরার ঠোঁটের কোণে স্মিত হাসির রেখা ফুটে উঠল। এরেনের বুকে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে সে চোখ বন্ধ করে বলল,“সব কেমন ম্যাজিকের মতো মনে হচ্ছে। এমন কিছু হবে সত্যিই ভাবিনি।”

এরেন ইলোরার মাথার সাথে নিজের মাথা ঠেকিয়ে বলল,“আমি ভেবেছিলাম। সাকিব যখন তোমাকে আমার বাড়ি থেকে নিয়ে এসেছিল, তখনই আমার ধারণা হয়েছিল ও কিছু একটা করবে। আর যাই হোক, তোমাকে ও কষ্ট পেতে দিবে না। তোমাকে একটু বেশিই ভালোবাসে।”

ইলোরা চোখ খুলে বলল,“কিন্তু কখনও মুখে প্রকাশ করতে পারে না।”

এরেন হেসে বলল,“ভাইদের ভালোবাসা এমনই হয়। বোনকে নিজের জীবনের থেকে বেশি ভালোবাসলেও তা মুখে প্রকাশ করে না। তাদের ভালোবাসাটা সবসময়ই অপ্রকাশিত, কিন্তু খুব মজবুত।”

ইলোরা হুট করে প্রশ্ন করে বসল,“তুমি আমাকে কতটা ভালবাসো?”

এরেন হাসিমুখেই জবাব দিলো,“যতটা ভালোবাসলে তোমার আর এক ফোঁটাও ভালোবাসার অভাব হবে না, ততটা। কিন্তু আমি হয়তো কোনোদিন আমার সম্পূর্ণ ভালোবাসাটা প্রকাশ করতে পারব না। তবু যুগ যুগ ধরে এভাবেই ভালোবাসতে চাই।”

ইলোরা আবার চোখ বন্ধ করে নিল। এরেনের বুকে মাথা ঠেকিয়ে চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইল। মিনিট খানেক পর ঘাড়ে গরম নিঃশ্বাস পড়তেই সে চোখ খুলল। ততক্ষণে এরেন তার ঘাড়ে মুখ গুঁজে দিয়েছে। ইলোরা কেঁপে কেঁপে উঠল। এই স্পর্শ সে আগেও পেয়েছে। কিন্তু আজ যেন অনুভূতিগুলো সম্পূর্ণ অন্যরকম লাগছে। হয়তো এটাই নতুন শুরুর অনুভূতি। এরেনের হাত ইলোরার শাড়ি ভেদ করে পেট ছুঁতেই ইলোরা দুহাতে খপ করে এরেনের হাত চেপে ধরল। এরেন ইলোরার ঘাড়ে লম্বা একটা চুমু খেয়ে ইলোরাকে নিজের দিকে ঘুরে দাঁড় করিয়ে কোমর ধরে কাছে টেনে নিল। ইলোরা লাজুক হেসে মাথা নিচু করল। এরেন বলল,“ইলোনি, আজকের দিনে আমার থেকে তোমার কিছু চাওয়ার নেই?”

ইলোরা এরেনের বুকে মুখ গুঁজে বলল,“ঐ যে বললে যুগ যুগ ধরে এভাবেই ভালোবাসতে চাও। এতেই আমার সব পাওয়া হয়ে গেছে। এর থেকে বেশি কিছু চাওয়ার নেই আমার।”

এরেন দুহাতে ইলোরাকে নিজের সাথে মিশিয়ে নিয়ে বলল,“আমার তো চাওয়ার আছে।”

ইলোরা প্রশ্ন করল,“কী?”

এরেন ইলোরার কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিস করে বলল,“ছোট্ট একটা ইলোনি চাই। এখন না, তোমার অনার্স শেষ হওয়ার পর।”

ইলোরা লজ্জায় এরেনের বুকে আরও মিশে গেল। এরেন বলল,“ভাবছি হানিমুনে যাব। আপত্তি আছে?”

ইলোরা মাথা দুলিয়ে না বুঝাল। এরেন আবার প্রশ্ন করল,“কোথায় নিয়ে যাব জিজ্ঞেস করবে না?”

ইলোরা পুনরায় মাথা দুলিয়ে মৃদু কন্ঠে বলল,“উঁহু। যেখানেই নিয়ে যাও, শুধু এভাবে আগলে রাখলেই হবে।”

এরেন শব্দ করে হেসে বলল,“বুকের মধ্যে ঢুকে যাবে না-কি আজ?”

“তুমিই তো বলো আমাকে বুকের মধ্যে ঢুকিয়ে রাখতে ইচ্ছে করে।”

“তা তো করেই।”

ইলোরা কিছুক্ষণ চুপ থেকে আবার বলল,“আমি কতটা ভয় পেয়েছিলাম জানো? দম বন্ধ করা পরিস্থিতি ছিল। কোনোভাবে ঐ লোকটার সাথে বিয়ে হলে সত্যি সত্যিই মরে যেতাম।”

এরেন ইলোরাকে আরেকটু চেপে ধরে কপট রাগ দেখিয়ে বলল,“চুপ। আমি তোমাকে এত সহজে ছাড়তাম ভেবেছ? তবে হ্যাঁ, যদি আটকাতে না পারতাম তাহলে খুব সুন্দরী একটা মেয়ে দেখে বিয়ে করে নিতাম।”

ইলোরা এরেনের বুক থেকে মাথা উঠিয়ে ভ্রুকুটি করে তাকিয়ে বলল,“মনে মনে এসব চলে?”

এরেন হেসে ইলোরার কোমর থেকে হাত সরিয়ে তার মুখটা দুহাতে তুলে ধরল। আদুরে গলায় বলল,“যুগ যুগ ধরে আমার মনে ইলোনি নামক ঔষধটাই জেঁকে বসে থাকুক। আমার প্রেমাসুখ সারাতে যে একমাত্র এই ঔষধটাই সক্ষম।”

ইলোরা মুখটা গোল করে করে বলল,“ঔষধের মতো আমাকে পানি দিয়ে গিলে খাওয়ার মতলব?”

“সম্ভব হলে তো তা-ই করতাম। এটা যে আমার একান্তই ব্যক্তিগত ঔষধ। আচ্ছা? আমার ঔষধটা এত সুন্দর কেন বলো তো?”

ইলোরা মুচকি হেসে বলল,“তোমার দৃষ্টি সুন্দর বলে।”

“ইশ্! আমার না এখন খুব আফসোস হচ্ছে?”

“কেন?”

“ঐ যে আগেই বাসর করে ফেললাম। তখন কি আর জানতাম তার দুদিন পর সত্যি সত্যিই বাসর হবে? আজ আমাদের প্রথম বাসর হত। আহারে!”

ইলোরা এরেনের বুকে হালকা করে ঘুষি মেরে বলল,“শুরু হয়ে গেছে অসভ্যের মতো কথা?”

এরেন হেসে ইলোরাকে নিজের সাথে জড়িয়ে নিয়ে হাজারো কথামালা সাজাতে লাগল। ইলোরাও এরেনের বুকে মাথা রেখে তার সাথে গল্প করতে মশগুল হলো। এভাবে অনেকটা সময় পার করার পর এরেন হঠাৎ মৃদু স্বরে ডাকল,“ইলোনি?”

ইলোরা ছোটো করে সাড়া দিলো,“হুঁ।”

“আজ আমাদের সম্পর্কটা নতুনভাবে শুরু হয়েছে। আজ থেকে আর কোনো বাঁধা থাকল না। আমি যখন ইচ্ছা তোমাকে এভাবে নিজের সাথে জড়িয়ে রাখতে পারব। স্বাধীনভাবে তোমাকে নিয়ে ঘুরে বেড়াতে পারব।”

“হুম।”

“চলো আজ আমরা নতুন শুরুটা আবার নতুনভাবেই করি। একে অপরের অস্তিত্বে সম্পূর্ণ মিশে যাই।”

ইলোরা ঠোঁটে ঠোঁট চেপে মাথা নিচু করে ফেলল। এরেন ইলোরার কপালে ঠোঁট ছুঁয়ে তাকে পাঁজাকোলা করে রুমের দিকে পা বাড়াল। ইলোরা এরেনের বুকে মুখ গুঁজে ফেলল। আজ থেকে শুরু হলো তাদের ভালোবাসার এক নতুন অধ্যায়।

চলবে…………………….🌸

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here