সুপ্ত_প্রেমাসুখ পর্ব-৫৯

0
636

#সুপ্ত_প্রেমাসুখ
#ইলোরা_জাহান_ঊর্মি
#পর্বঃ৫৯

“আমার হাতে একটা চিমটি কাটো তো মুন।”

আফসারের কথায় ভ্রু জোড়া কুঞ্চিত করে তাকাল মুনা। আফসার একহাত বাড়িয়ে দিয়ে ফের বলল,“আস্তে করে একটা চিমটি কাটো।”

মুনা কিছুটা অবাক হয়ে প্রশ্ন করল,“কেন?”

“ইয়ে মানে, আমার মনে হচ্ছে আমি স্বপ্নের মধ্যে আছি।”

মুনা বিরক্তি নিয়ে বলল,“ঢং করবেন না তো। পাজি লোক!”

মুনা বিছানা ছেড়ে উঠে চলে যাওয়ার জন্য পা বাড়াতেই আফসার তার হাত ধরে টেনে নিজের কোলের ওপর বসিয়ে দিলো। দুহাতে মুনার কোমর জড়িয়ে ধরে কাছে টেনে মুচকি হেসে বলল,“রেগে যাচ্ছ কেন লাফিং কুইন? তুমি জানো? আমি সত্যিই সারপ্রাইজড! এইটুকু একটা পিচ্চির ভেতরে না-কি আবার আরেকটা পিচ্চিও আছে!”

মুনা শক্ত মুখে বলল,“একদম পিচ্চি বলবেন না, বুইড়া লোক! আমাকে কোন দিক থেকে পিচ্চি মনে হয়? কদিন পর পিচ্চির মা হব।”

আফসার চিন্তিত মুখে বলল,“আমি তো চিন্তায় আছি দুই পিচ্চিকে আমি কীভাবে সামলাব তা নিয়ে। পিচ্চির মাকে সামলাতে আমাকে যা নাকানি-চুবানি খেতে হয়, পিচ্চি তো মায়ের থেকে একধাপ এগিয়ে থাকবে।”

“কথা বলবেন না আর আমার সাথে। ছাড়ুন তো।”

মুনা দুহাত দিয়ে কোমর থেকে আফসারের হাত সরানোর চেষ্টা করতেই আফসার মুনার হাত দুটো পিছমোড়া করে নিজের হাতের মুঠোয় আবদ্ধ করে ফেলল। মুনা রাগত দৃষ্টিতে তাকাতেই আফসার মুনার ঠোঁটে ঠোঁট রাখল। গভীর একটা চুমু খেয়ে সরে আসতেই মুনা লজ্জায় মিইয়ে গেল। মাথা নিচু করে সে কোলের দিকে তাকিয়ে রইল। আফসার মুনার হাত ছেড়ে দিয়ে এক হাতে মুনার পেট স্পর্শ করল। মুখে তৃপ্তির হাসি ফুটিয়ে বলল,“তুমি জানো আজ আমি ঠিক কতটা খুশি? ছোট্ট একটা বেবি আমাকে বাবা বলে ডাকবে। এই ফিলিংসটা আমি প্রকাশ করতে পারব না। তুমি আমাকে সবচেয়ে সেরা একটা গিফট দিতে চলেছ মুন। বলো এ উপলক্ষে আমার থেকে তোমার কী গিফট চাওয়ার আছে।”

মুনা এখনও মাথা নিচু করে বসে আছে। আফসার মুনার মুখটা তুলে ধরে বলল,“বলো।”

মুনা ডানে বায়ে মাথা দুলিয়ে বলল,“কিছু না।”

“কিছু একটা চাও। তোমার যা ইচ্ছা। আমাকেও চাইতে পারো, আমি কিছু মনে করব না। দারুণ সুযোগ কিন্তু।”

মুনা হেসে ফেলল। পরক্ষণেই মুখটা গোল করে বলল,“বেবি আসার পর বেবির আম্মুর কদর যেন কমে না যায়। বেবির সাথে বেবির আম্মুকেও ভালোবাসলেই চলবে।”

আফসার মুনার মুখের কাছে ঝুঁকে নিচু স্বরে বলল,“সে তো বেবির আম্মুকে আমি সবসময়ই ভালোবাসি। এখন যেহেতু সে আমাকে এত বড়ো একটা গিফট দিতে চলেছে, এখন থেকে না হয় একটু বেশি বেশি আদর করব। তাতে চলবে?”

মুনা কপালটা খানিক কুঁচকে ফেলল। মুখ বাঁকিয়ে বলল,“বেহায়া লোক!”

আফসার মুনাকে আলতো করে বুকে জড়িয়ে ধরে বলল,“লাভ ইউ টু।”

মুনা রাগ দেখাতে গিয়েও হেসে ফেলল। লোকটার আনন্দের মাত্রা বুঝতে তার অসুবিধা হচ্ছে না। বাবা হবে শুনেই বাড়ি মাথায় তুলেছে। মুনার নিজেরও কম আনন্দ হচ্ছে না। প্রথম মা হওয়ার অনুভূতিটা হয়তো সম্পূর্ণ অন্যরকম। বেশ কদিন ধরেই মুনার শরীরটা ভালো যাচ্ছিল না। ঘনঘন শরীর খারাপ দেখে তার শ্বাশুড়ি কিছু আঁচ করতে পেরেই আজ আফসারের সাথে মুনাকে ডক্টরের কাছে পাঠিয়েছিলেন। মুনার মা হওয়ার খবর শুনে তার বাবার বাড়ি, শ্বশুরবাড়ির মানুষ সবাই খুব খুশি হয়েছে। আর আফসার তখন থেকে মুনাকে এটা নিয়ে জ্বালিয়ে চলেছে। ওপরে ওপরে রাগ দেখালেও লোকটার এই স্বভাবের সাথে মুনা অভ্যস্ত হয়ে গেছে। কবে যে এই পাজি লোকটাকেই সে ভালোবেসে ফেলেছে, টেরই পায়নি। একদিন সে এই পাজি লোকটার থেকে পালিয়ে বেড়াতে চাইত, অথচ আজ এই লোকটার থেকেই একদিনের জন্যও দূরে থাকতে কষ্ট হয়। লোকটার ভালোবাসার চিহ্নকে নিজের মধ্যে ধারণ করেছে সে। নিয়তি কী অদ্ভুত!


ভার্সিটির গেইটের সামনে গাড়ি থামল এরেন। নিজেই এগিয়ে গিয়ে ইলোরার সিটবেল্ট খুলে দিলো। ঝুঁকে পড়ে ইলোরার কপালে, ঠোঁটে আলতো করে ঠোঁট ছোঁয়াল। ইলোরা মুচকি হেসে বলল,“ভার্সিটি গেইটের সামনেও কী এক অভ্যাস করলে বলো তো?”

এরেনও হেসে বলল,“কী করব বলো? এটুকুই তো আমার সারাদিনের এনার্জি। আবার সেই বিকালে বা সন্ধ্যায় তোমাকে কাছে পাব। আজ লাঞ্চটাও অফিসে বসে করতে হবে। শোনো, সাকিবকে বলেছি তোমাকে বাসায় পৌঁছে দিতে। বা তোমার ইচ্ছা হলে আজ ভার্সিটি থেকে ওই বাড়ি চলে যেয়ো। আমি সন্ধ্যায় এসে তোমাকে নিয়ে যাব।”

ইলোরা মাথা দুলিয়ে সম্মতি জানিয়ে বলল,“আচ্ছা। তুমি কিন্তু লাঞ্চটা করে নিয়ো সময়মতো।”

এরেন মাথা নিচু করে বলল,“যথা আজ্ঞা মহারানি।”

ইলোরা দরজা খুলে বেরোতে যেতেই এরেন বলে উঠল,“এই ওয়েট ওয়েট।”

ইলোরা থেমে গিয়ে প্রশ্নভরা দৃষ্টিতে এরেনের দিকে তাকাল। এরেন তার ওয়ালেট থেকে এক হাজার টাকার একটা নোট বের করে ইলোরার দিকে এগিয়ে ধরে বলল,“এটা নাও। আর ব্রেক টাইমে ক্যান্টিনে গিয়ে কিছু খেয়ে নিয়ো।”

ইলোরা বলল,“আমার কাছে টাকা আছে। গতকালই তো দিলে। আর লাগবে না।”

এরেন ইলোরার হাতে নোটটা গুঁজে দিয়ে বলল,“তোমার জন্য না, মিথিলা আর ডালিয়ার জন্য। কিছু নিয়ে যেয়ো ওদের জন্য।”

ইলোরা আর না করল না। না করলেও যে এরেন আর এই টাকা ফেরত নিবে না তা সে ভালোভাবেই জানে।

“সাবধানে ড্রাইভ কোরো।”

কথাটা বলতে বলতে ইলোরা গাড়ি থেকে নেমে গেল। জানালা দিয়ে আরেকবার ভেতরে উঁকি দিতেই এরেন ঠোঁট প্রসারিত করে বলল,“তুমিও সাবধানে থেকো।”

ইলোরা গেইট পেরিয়ে ক্যাম্পাসে ঢোকা পর্যন্ত এরেন সেদিকে তাকিয়ে রইল। ইলোরা দৃষ্টির আড়ালে চলে যেতেই সেও গাড়ি স্টার্ট করল।


“কাল সকালে বাবা আমাকে নিতে আসবে। কত্তদিন ধরে বাড়ি যাই না। আমার যে কী আনন্দ হচ্ছে!”

ডালিয়ার গদগদ কন্ঠে বলা কথাটা শুনে তাহসিন কপাল কুঁচকে বলল,“এত বাড়ি বাড়ি করস ক্যান? তুই কি তোর শ্বশুরবাড়ি থেকে বাপের বাড়ি যাইতাছোস, যে আনন্দে লুঙ্গি ড্যান্স দিতাছোস?”

ডালিয়া বলল,“তুই এমন করছিস কেন? বাবা-মায়ের সাথে আমার কতদিন ধরে দেখা হয় না জানিস?”

“আমার জানার দরকার নাই। ক্লাস কামাই দিয়া কি এক্সামে লাড্ডু পাইতে চাস?”

“তুই থাম তো।”

মুনা গালে হাত দিয়ে বলল,“ইশ্! তাহসিন ভায়ার খুব কষ্ট হইতাছে, কিন্তু মুখে বলতে পারতাছে না। তুই বুঝতাছোস না ক্যান ডালিয়া?”

ডালিয়া মুখ বাঁকিয়ে বলল,“অত বুঝা লাগবে না।”

তাহসিন বলল,“আমার বেলায়ই কিছু বুঝা লাগে না।”

ইলোরা বলল,“ভাই, তোরা দুইজন আর কতদিন এমন ডুবে ডুবে জল খাবি? এমন কইরা দেড় বছর কাটাইলি। আর কত?”

ডালিয়া বলল,“আমি কোনো ডুবে ডুবে জল খাই না। আমি গ্লাসে চুমুক দিয়ে জল খাই।”

তাহসিন ভেংচি কেটে বলল,“জানা আছে।”

টুম্পা বলল,“এসব বাদ দে। এখন হচ্ছে আমাদের আনন্দ করার সময়, বুঝলি? আমরা খালামনি হতে চলেছি, ভাবা যায়!”

নাদিয়া বলল,“তাই তো! আমাদের মুনা মা হবে! কেমন স্বপ্ন স্বপ্ন লাগে।”

তাহসিন ব্যস্ত হয়ে বলল,“এ মুলা, আমি তো ভাবতাছি আমাগো আফু ষাঁড়ের কথা। বেচারা মা-বাচ্চার তালে পইড়া তো পাগল হইয়া যাইব রে।”

মুনা রাগত স্বরে বলল,“তুই আমার সাইডে কথা কস না-কি স্যারের সাইডে? রাজাকার কোথাকার!”

“সত্য কথা কইলেই রাজাকার? তোরে যে আফু ষাঁড় গত এক বছর ধইরা সহ্য করতাছে এইডাই তোর বাপের ভাগ্য। এই জন্যই তো অন্তু কইত, তোরে বিয়া করলে আফু ষাঁড়ের কপাল ফাইট্টা চৌচির হইয়া যাইব।”

“অন্তু কইত দেইখাই তোর কইতে হইব?”

অরিশা চিৎকার করে বলল,“স্টপ। গাধার দল ক্যাঁচ-ক্যাঁচ থামা। কী শুরু করলি?”

বেশ কিছুক্ষণ আড্ডার পর সাকিবের আগমনে আড্ডার সমাপ্তি ঘটল। সাকিব এখন প্রাইমারী স্কুলে শিক্ষকতা করে। পাশাপাশি সাজিদ হোসেনের ব্যবসার কাজেও যথেষ্ট সহযোগিতা করে। সে স্কুল থেকে ফেরার সময় প্রতিদিন ডালিয়াকে সাথে নিয়ে বাড়ি ফেরে। আজ ডালিয়ার সাথে ইলোরাকেও সাথে নিয়ে যাবে। ক্যাম্পাস থেকে গেইটের দিকে হাঁটতে হাঁটতে যাওয়ার সময় তাহসিন অসহায় মুখে ডালিয়ার দিকে তাকাল। মিনমিনে গলায় বলল,“চলে যাচ্ছিস?”

ডালিয়া মৃদু হেসে বলল,“তাড়াতাড়ি ফিরব।”

“একটা কথা বলব?”

“বল।”

ডালিয়ার উৎসুক দৃষ্টি দেখে তাহসিন ইতস্তত করে বলল,“থাক, বাড়ি থেকে ফির তারপর বলব।”

ডালিয়া মাথা দোলালো। তাহসিন হঠাৎ করেই সবার অগোচরে ডালিয়ার ডান হাতটা নিজের বাঁ হাতের মুঠোয় চেপে ধরল। ডালিয়া কিছুটা চমকে উঠল। দ্বিধা নিয়ে তাহসিনের মুখের দিকে তাকাতেই তাহসিন মুখ কালো করে বলল,“সত্যিই তাড়াতাড়ি ফিরবি তো? কতদিন পর ফিরবি?”

ডালিয়া আমতা-আমতা করে বলল,“হাত ছাড়। সামনে ভাই আছে।”

“ছাড়ব, একটা শর্তে।”

“কী?”

“তুই না বেলী ফুলের মালা গাঁথতে পারিস? গ্রামে গেলে তো গাঁথিস, তাই না?”

“হুম।”

“এবার আসার সময় আমার জন্য বড়ো একটা মালা নিয়ে আসবি।”

“মালা দিয়ে তুই কি করবি?”

“আমার স্পেশাল মানুষের চুলে পেঁচিয়ে দিব।”

ডালিয়া ঠোঁট টিপে হাসল। তাহসিন হাতে একটু চাপ দিয়ে বলল,“আনবি না?”

ডালিয়া তাহসিনের হাতের মুঠো থেকে নিজের হাত ছাড়িয়ে নিয়ে বলল,“আনব।”

টেক্সিতে ওঠার সময় ডালিয়া একবার তাহসিনের মুখের দিকে তাকাল। ছেলেটার মনটা খারাপ হয়ে গেছে তা সে বেশ বুঝতে পারছে। তার নিজেরও তো এখন তেমন আনন্দ হচ্ছে না। মন খারাপটা সুপ্ত রেখে ডালিয়া ঠোঁট জোড়া প্রসারিত করে মৃদু হাসল। তাহসিনও মুচকি হেসে হাত নেড়ে ডালিয়াকে বিদায় জানাল। ডালিয়াদের ট্যাক্সি দৃষ্টির আড়াল হতেই তাহসিন অজান্তেই এক তপ্ত দীর্ঘশ্বাস ফেলল। আজকাল মেয়েটাকে দেখা তার রোজকার অভ্যাসে পরিণত হয়েছে। একদিন না দেখতে পেলেই সুপ্ত অসুখটা মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে। এক নজর দেখতে পাওয়াই যেন এই অসুখের শ্রেষ্ঠ ঔষধ। কিন্তু এই অসুখটার সঠিক নামই সে বুঝে উঠতে পারছে না।


বাড়িতে ঢুকেই ইলোরা মালিহা বেগমকে জড়িয়ে ধরে বলল,“কেমন আছো আম্মু?”

মালিহা বেগম অভিমানী গলায় বললেন,“আম্মু কেমন আছে তা কি দেখার সময় আছে না-কি তোর? বিয়ের দশ মাস হতে চলল। এরমধ্যে তুই কতদিন এ বাড়িতে এসে থেকেছিস বল তো?”

ইলোরা হেসে বলল,“আমি কী করব বলো? আমার তো থাকতে ইচ্ছা করে। তোমার জামাই-ই তো সময় পায় না। সারাক্ষণ কাজের চাপে থাকে।”

পাশ থেকে অনন্যা বলল,“আসল কথা হচ্ছে আপনি নিজেই জামাই রেখে থাকতে পারেন না। আপনার ভাই গিয়ে নিয়ে এলেই আপনি থাকেন? আসতে না আসতেই জামাই এসে নিয়ে যায়। আর আপনিও বাধ্য মেয়ের মতো চলে যান।”

ইলোরা মুখটা ছোটো করে বলল,“নিয়ে গেলে আমি কী করব? সে নিজেও তো এসে থাকতে চায় না।”

“যাইহোক, এখন কি থাকতে এসেছেন না সন্ধ্যায় জামাই রাজা এসে উপস্থিত হবে?”

ইলোরা মিনমিনে গলায় বলল,“সন্ধ্যায় আসবে।”

অনন্যা বাসনগুলো ধোয়া শেষ করে হাত মুছতে মুছতে বলল,“হ্যাঁ, জানতাম। বউ ছাড়া তো দম নিতে পারে না ঐ লোক।”

মালিহা বেগম বললেন,“অমি, যা গিয়ে গোসল সেরে খেতে আয়। কথা পরে বলিস।”

ইলোরা মায়ের কথামতো গোসলে চলে গেল। ওয়াশরুমে ঢোকার আগে ডালিয়ার হাতে এরেনের দেয়া টাকাটা ধরিয়ে দিয়ে বলল,“তুই আর মিথি যা করার করিস। আমি তো কিছু কেনার সময়ই পাইনি।”


সন্ধ্যার দিকে এরেন এল। মালিহা বেগম আগে থেকেই মেয়ের জামাইকে আপ্যায়নের ব্যবস্থা করে রেখেছিলেন। সন্ধ্যার সময়টায় বসার ঘরে বেশ জমজমাট আড্ডা বসল। এরেন আসার সুবাদে বাড়ির সবাই মিলে একসাথে চা-নাস্তা করল। সবাই অনেক বলার পরও এরেন রাতটুকু থাকতে রাজি হলো না। উলটো বলল পরে এসে থাকবে। এখন অনেক কাজের চাপ। ইলোরা রেডি হয়ে সবার থেকে বিদায় নিতে যেতেই সবার মুখ কালো হয়ে গেল। সাজিদ হোসেন মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বললেন,“আটকে রাখার সাধ্য তো আর নেই মা। মাঝে মাঝে আসিস।”

সাকিব এরেনকে বলল,“এরেন, তোর এই ব্যাপারটা কিন্তু আমার একদম পছন্দ না। শ্বশুরবাড়ি বেড়াতে এলে কি তোকে গুম করা হবে?”

এরেন হেসে বলল,“তুই তো জানিসই কাজের কত চাপে আছি।”

“সে তো সবসময়ই থাকিস। তাই বলে শ্বশুরবাড়ি থাকা যাবে না এমনটা তো নয়।”

“আচ্ছা, সময় করে আসব।”

মিথিলা বলল,“আপনার আবার সময় হবে ভাইয়া? এ কথা শুনতে শুনতে মুখস্থ হয়ে গেল, তবু আজও সত্য হলো না।”

এরেন হেসে বলল,“হবে হবে। আম্মু-আব্বু, আসি।”

মালিহা বেগম বললেন,“আবার এসো বাবা।”

সাজিদ হোসেন ইলোরার মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন,“আসিস মা। এ বাড়িতে তোর বড্ড অভাব বোধ করছি।”

ইলোরা ছোটো একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে ঠোঁট প্রসারিত করে মৃদু হেসে বলল,“আসব আব্বু। তুমি ঠিকমতো ঔষধ খাবে কিন্তু।”

সাজিদ হোসেন বললেন,“তা তো খাচ্ছি।”

ডালিয়া বলল,“ইলো, কাল সকালে কিন্তু বাবা আমাকে নিতে আসবে। আবার ফিরলে ভার্সিটিতে দেখা হবে। ভালো থাকিস।”

ইলোরা বলল,“আচ্ছা। কতদিন থাকবি?”

ডালিয়া একটু ভেবে বলল,“এক সপ্তাহের মধ্যেই চলে আসব।”

সবার থেকে বিদায় নিয়ে এরেন ইলোরাকে নিয়ে বাড়ি থেকে বেরিয়ে এল। সাকিব তাদের সাথে গাড়ি পর্যন্ত গেল। গাড়িতে ওঠার আগে ইলোরা বলল,“ভাই, নিজের একটু খেয়াল রাখো। অনু আপ্পি বলল তুমি না-কি ইদানিং খাবারে অনিয়ম করছো?”

সাকিব বলল,“সারাদিন স্কুলে থেকে দুপুরে বাড়িতে আসার তো সুযোগ পাই না। একা একা খেতে ভালো লাগে না। আগের সময়গুলো খুব মিস করি, যখন আমরা সবাই মিলে গল্প করতে করতে খাবার শেষ করতাম।”

কথাটা বলেই সাকিব একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে একটু হেসে পুনরায় বলল,“গাড়িতে ওঠ। বাইরে যা শীত! ঠান্ডা লেগে যাবে।”

ইলোরা মাথা দুলিয়ে গাড়িতে উঠে বসল। এরেনও সাকিবকে বিদায় জানিয়ে গাড়িতে উঠে বসল। এরেন গাড়ি স্টার্ট করতেই সাকিব ভেতরে চলে গেল। মাঝপথে এসে এরেন ব্রেক কষল। ইলোরা প্রশ্ন করল,“কী হলো?”

এরেন সিটবেল্ট খুলতে খুলতে বলল,“চলো চা খাই। তোমার না টং দোকানের চা পছন্দ?”

ইলোরা মৃদু হেসে দ্রুত সিটবেল্ট খুলে গাড়ি থেকে নেমে গেল। প্রায়ই এরেন এমন ভর সন্ধ্যায় তাকে নিয়ে টং দোকানে চা খেতে আসে। তখন অবশ্য গাড়িটা নিয়ে আসে না। হয় পায়ে হেঁটে পথ চলে নয় রিকশায় চড়ে। নিজের হাজারো ব্যস্ততার মাঝেও ইলোরাকে সবসময় খুশি রাখার সর্বোচ্চ চেষ্টা করে সে। এজন্যই মানুষটার প্রতি ইলোরার ভালোবাসা দিনকে দিন বেড়েই চলেছে। তবু ইলোরার মনে হয় ভালোবাসার দিক থেকে সে এরেনের চেয়ে কয়েক ধাপ পিছিয়ে। মানুষটার মতো ভালোবাসা যেন কখনোই সম্ভব হয়ে উঠবে না। অবশ্য ইলোরা চায়ও না ভালোবাসার ক্ষেত্রে এরেনের থেকে এগোতে। তার ধারণা, ভালোবাসা ব্যাপারটাতে নারীদের থেকে পুরুষদের একধাপ এগিয়ে থাকাই উত্তম। এতে সম্পর্কের ভিত মজবুত হয়।

টং দোকানে গল্প করতে করতে চা শেষ করে এরেন প্রশ্ন করল,“ডিনারটা বাইরে থেকে করে যাবে?”

ইলোরা ডানে বায়ে মাথা দুলিয়ে বলল,“একদম না। দুপুরেও বাইরে খেয়েছ। আম্মী এখন না খেয়ে অপেক্ষা করে থাকবে আমাদের জন্য। আমরা বাইরে থেকে খেয়ে গেলে আম্মীর মনটা খারাপ হবে, কিন্তু সে মুখ ফুটে বলবে না।”

এরেন জানে ইলোরা না বলবে, তবু প্রশ্নটা করেছিল। মাঝে মাঝে জানা কথাও আবার জানতে ইচ্ছা করে। মনে সুখ দেয়। এরেন ইলোরাকে নিয়ে গাড়ির দিকে এগিয়ে গেল। আবার প্রশ্ন করল,“এখনই ফিরবে না-কি একটু ঘোরাঘুরি করবে?”

ইলোরা আবার নিষেধ করে বলল,“আর ঘুরতে হবে না। ঠান্ডায় অলরেডি তোমার কাঁপা-কাঁপি শুরু হয়ে গেছে। বাড়ি চলো।”

গাড়িতে উঠে বসে এরেন ঘাড় কাত করে চোখ ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে ইলোরাকে ভালোভাবে নিরীক্ষণ করতে লাগল। ইলোরা ভ্রুকুটি করে প্রশ্ন করল,“কী দেখছো?”

এরেন মুচকি হেসে বলল,“এটা সেই শাড়িটা না, যেটা সাকিবের বিয়ের সময় কিনেছিলাম?”

“হ্যাঁ। তোমার থেকে পাওয়া প্রথম গিফট।”

“এতদিন এটা পরলে না যে?”

“পেলে তো পরব। তুমি যে বাড়িতে শাড়ির দোকান দিয়ে বসেছ, এটা আমি খুঁজেই পাইনি। আজ দেখলাম এটা মিথির জামা-কাপড়ের ফাঁকে পড়ে আছে।”

এরেন ইলোরার হাত ধরে কাছে টেনে নিয়ে এল। মুচকি হেসে বলল,“এই শাড়িটায় তোমাকে দারুণ লাগে। এটা প্রথম দিন পরার পর কিন্তু নতুন করে তোমার প্রেমে পড়েছিলাম। আজ আবার একবার পড়ব না-কি?”

ইলোরা চোখ ছোটো করে বলল,“সে তো তুমি প্রতিদিনই প্রেমে পড়ো।”

এরেন ইলোরার থুতনিতে আঙুল রেখে বলল,“কী করব বলো? আমার লজ্জাবতী যে আমাকে বশ করে নিয়েছে। এখন তার প্রেমে না পড়ে আমার রক্ষা আছে? বাই দ্যা ওয়ে, আমার লজ্জাবতীও যে প্রতিনিয়ত তার নিজের মানুষটার প্রেমে পড়ে, তা কিন্তু সে না বললেও আমি বেশ বুঝতে পারি।”

ইলোরা ভ্রু জোড়া কুঞ্চিত করে বলল,“এসব আজগুবি কথা কে বলল তোমায়?”

এরেন মুচকি হেসে বলল,“কারো বলা লাগেনি। লজ্জাবতী যে প্রতিবার চোরা চোখে আমাকে দেখতে গিয়ে ধরা খেয়ে যায়, তা কি সে জানে? আমি কিন্তু তার চোরা দৃষ্টি প্রত্যেকবারই ধরে ফেলি।”

ইলোরা ভারি অপ্রস্তুত হয়ে পড়ল। এদিক-ওদিক চঞ্চল দৃষ্টি বিচরণ করে আমতা-আমতা করতে লাগল। এরেন যে এভাবে তাকে লজ্জা দিবে বুঝতেই পারেনি। সে তো বিয়ের পর থেকেই মানুষটাকে বারবার চোরা চোখে দেখে। মানুষটার মুখে যে এক আকাশ সুপ্ত সুখ লুকিয়ে আছে! ঐ গভীর চোখ জোড়ায় তো সে বারংবার হারিয়ে যেতে চায়। মানুষটাকে বারবার শুধু ছুঁয়ে দিতে ইচ্ছা করে, লোমশ বুকে মুখ গুঁজতে ইচ্ছা করে, গোছানো চুলগুলো এলোমেলো করে দিতে ইচ্ছা করে, মাঝে মাঝে তার খুব কাছে গিয়ে শক্ত করে জড়িয়ে ধরতে ইচ্ছা করে। কিন্তু সে তো লজ্জায় এসব কথা নিজের মনেই লুকিয়ে রেখেছে। মানুষটার সাথে চোখাচোখি হলে হৃদস্পন্দন বাড়ার ভয়ে তাকে চোরা চোখে দেখে। অথচ সে এতদিন জানতই না এই মানুষটা তার চোরা দৃষ্টি সম্পর্কে অবগত। ইলোরার অপ্রস্তুত ভঙ্গিমা দেখে এরেন মৃদু শব্দ তুলে হেসে হাতের বাঁধন শক্ত করল। ইলোরা লজ্জায় তার দিকে তাকাচ্ছেও না। এরেন এক হাতে ইলোরার মুখটা নিজের দিকে ঘুরিয়ে তুলে ধরল। এরেন মুখের কাছে ঝুঁকে আসতেই ইলোরা চোখ বড়ো বড়ো করে মাথাটা পিছিয়ে নিয়ে বলল,“এটা রাস্তা। ছাড়ো, একদম অসভ্যতামি করবা না।”

এরেন মোটেও সন্তুষ্ট হলো না। বরং ত্যাড়াভাবে বলল,“গাড়িটা সাইডে পার্ক করা, আর কেউ কাঁচ নামিয়ে দেখতে আসবে না। অযথা বাহানা দেখাও তুমি। ভালো তো বাসোই না বরকে। এদিকে বেচারা বর তোমার ভালোবাসা পাওয়ার জন্য সারাটা দিন অপেক্ষা করে থাকে। কখন কাজ শেষ হবে আর কখন বউটার কাছে যাবে সেই অপেক্ষায় দিন পার করে।”

এরেনের কন্ঠে স্পষ্ট অভিমান। ইলোরা সরু চোখে তাকিয়ে বলল,“ইমোশনাল ব্ল্যাকমেইল করার প্রচেষ্টা চলছে মহারাজ?”

“উঁহু, প্রেম চলছে মহারানি।”

দুষ্টু হেসে কথাটা বলেই এরেন ইলোরাকে আরও কাছে টেনে নিল। ইলোরা কিছু বলার আগেই এরেন তার ঠোঁটে ঠোঁট রাখল। ইলোরা প্রথমে সরে যেতে চাইলেও পরে এরেনের কাছে হার মেনে নিল। এরেনের শার্ট খামচে ধরে তার ভালোবাসায় মত্ত হলো। বরাবরই মানুষটার ভালোবাসার কাছে তাকে হার মানতে হয়। তাতে অবশ্য তার বিন্দুমাত্র অনীহা নেই। এই হার মানাটাও যে তার শ্রেষ্ঠ সুখেরই একটা অংশ!

চলবে…………………..🌸

(গল্পটা যতই তাড়াতাড়ি শেষ করতে চাইছি, ততই বেড়ে চলেছে। এবার সিদ্ধান্ত নিয়েছি সত্যি সত্যিই তাড়াতাড়ি শেষ করার চেষ্টা করব।😐)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here