#প্রেমনোঙর_ফেলে
লেখনীতেঃ মিথিলা মাশরেকা
৩৪.
-আই লাভ ইউ মিস্টার গ্যাংস্টার! আই লাভ ইউ!
-এজন্যই বুঝি খইয়ের ক্ষতি করতে চাইছিলে তুমি ইচ্ছে? টু শো ইউর ক্রেজিনেস?
ভালোবাসার মানুষটাকে ভালোবাসি বলার পর, ঠোটের কোনে ফোটা উচ্ছ্বাসের হাসিটা পরের দু সেকেন্ডেই মিইয়ে গেলো ইচ্ছের। প্রাপ্তর বুক থেকে আস্তেধীরে মাথা তুলে তাকালো ওর দিকে। ওর কাতর চেহারার দিকে অবুঝের মতো তাকিয়ে রইলো কিয়দক্ষন। হাত আলগা হয়ে এসেছে ইচ্ছের। প্রাপ্ত পিছিয়ে সরে দাড়ালো ওর বাহুডোর থেকে। ইচ্ছের বধুবেশকে দু চোখে ভরে নিলো যেনো। কপাল থেকে উল্টে পরা ঠিকলি, নাক থেকে খুলে পরা নথ, এলোমেলো চুল, মাথা থেকে সরে যাওয়া ঘোমটা। ওকে ভালোবাসি বলার একরাশ পাগলামি ইচ্ছের সর্বাঙ্গে। অথচ এই পাগলামি তো ওরই করা উচিত ছিলো। কিন্তু সুযোগটাই বা পেলো কোথায়? যে মুহুর্তে বাবাকে বলতে গিয়েছে খইয়ের সাথে আংটিবদল করবে না, সে মুহুর্ত থেকেই খই নিখোজ। আর এখন সাফোয়ানের কাছে শুনতে পেলো, সে মেয়েটা আইসিইউতে। মৃত্যুমুখে। আর তার কারন, ইচ্ছে। ওর ভালোবাসা। আস্তেধীরে ইচ্ছের কপালের টিকলিটা ঠিক করে দিয়ে, ছোট চুলগুলো কানে গুজে দিলো প্রাপ্ত। ওর কপালে ঠোট ছুইয়ে মৃদ্যুস্বরে বললো,
-আমিও ভালোবাসি। তোমাকেই ভালোবাসি মিস রকস্টার। তোমাকেই।
ইচ্ছে বিমুঢ়। প্রাপ্তর কোন কথাকে ধরবে, কোন কথাকে ধরবে না, বুঝে উঠতে পারছে না ও। প্রাপ্ত ইচ্ছের এক গালে হাত রাখলো আলতোভাবে। অসহায়ের মতো করে বললো,
-আমরা দুজন একে অপরকে ভালোবাসি। কিন্তু এরমাঝে খই কেনো শাস্তি পেলো ইচ্ছে? ও কি দোষ করেছে?
ইচ্ছের মাথা ফাকা লাগছে এবার। এসব কি বলছে প্রাপ্ত, কিছুই বুঝে উঠতে পারছে না। কোনোমতে মুখ দিয়ে বের করলো,
-এ্ এসব তুমি কি বলছো?
-আজকে আংটিবদল ছিলো আমার আর ওর। কিন্তু যখন রাকা জানালো, তুমি বিয়ের আসর ছেড়েছো আমার জন্য, তখন আমিও এনগেইজমেন্ট ক্যান্সেল করতে গিয়েছিলাম ইচ্ছে। তারপরও খইকে কেনো শাস্তি দিলে তুমি? ও তো কোনো দোষ করেনি।
“খইয়ের সাথে প্রাপ্তর আংটিবদল” এই কথাটা শুনেই শব্দহীন ঝড় বইতে লাগলো যেনো ইচ্ছের চারপাশে। ঘাড় খানিকটা কাত করে অপলক দৃষ্টিতে শুধু তাকিয়ে রইলো ও প্রাপ্তর দিকে। যে মানুষটার জন্য সব ছেড়ে আসলো, সে মানুষটা অন্য কাউকে জীবনসঙ্গীনি করতে চলেছিলো। অথচ প্রাপ্তর এই জীবনসঙ্গীনির জায়গাটা ওর নিজের জন্য বরাদ্দ বলে ভেবে রেখেছিলো। কেনো ভেবে রেখেছিলো? কোনোদিন কি তার কোনো কারন দেখিয়েছে প্রাপ্ত? তবে ও কেনো ভেবে রেখেছিলো? এতোবড় ভুল কি করে করে ফেললো ও? নিজের কাছে নিজেকেই অচেনা মনে হতো লাগলো ইচ্ছের। ওকে চুপ দেখে প্রাপ্ত এবার ইচ্ছের দুগাল ধরে বললো,
-কেনো করলে এমন ইচ্ছে? কেনো? শুধুমাত্র তোমার হবু বর রাকীন শাফায়াতের অনৈতিক নোটিশ খইয়ের কাছে ছিলো বলে? তাই বলে ওর ক্ষতি করতে চেয়েছিলে তুমি? হুম?
…
-এজন্য নয়? তবে কেনো ইচ্ছে? প্রথমদিন যখন তোমার গিটার ভেঙেছিলাম, কি বলেছিলে তুমি? তোমার আবেগকে আঘাত করার প্রতিত্তর তুমি দেবে। তা না করার আগ পর্যন্ত নাকি আমার উপর থেকে রাগ মিটবে না তোমার। তাহলে এজন্যই কি আজ…আজ খইকে বিপদে ফেলতে চাইছিলে তুমি ইচ্ছে? এজন্যই?
…
-আচ্ছা? তুমি কি বলেছিলে সেদিন রাকাকে? ইউ উইল নেভার ফল ইন লাভ। ইউ উইল রাইজ ইন লাভ! ভালোবেসে উত্তল হবে তুমি তাইনা ইচ্ছে? ভালোবাসার পাগলামো দেখাবে তুমি। আজ তোমার মনে হলো, ভালোবাসো তুমি আমায়। আর আজই আমার আর খইয়ের আংটিবদল হওয়ার কথা। তবে কি তার জন্যই খইয়ের ক্ষতি করতে চেয়েছিলে তুমি ইচ্ছে? তোমার আমার মাঝ থেকে ওকে সরিয়ে দেওয়ার জন্য? এভাবে ভালোবাসার পাগলামো দেখাতে চেয়েছিলে তুমি ইচ্ছে? এভাবে?
চোখ বন্ধ করে দাতে দাত চেপে রইলো ইচ্ছে। ধীরস্থির গলায় যে অপবাদে প্রাপ্ত ওকে অপমান করতে শুরু করেছে যে, নিজেকে সামলানো দায় হয়ে গেছে ওর। তবুও একবর্নও বললো না ও। যে ইচ্ছে নিজের আত্মসম্মানের জন্য নিজের বাবাকেও ছাড় দেয়নি, প্রাপ্তর সমস্ত অপবাদ সয়ে নিলো চুপচাপ। আজ কেনো যেনো ওর প্রতিবাদ করতে ইচ্ছে করছে না। কেনো যেনো নিজেকে জাহির করতে ইচ্ছে করছে না। কেনো করবে? প্রাপ্ত ওকে যদি ভালোই বাসে, তবে অবিশ্বাস কেনো করবে ওকে? কেনো ভুল বুঝবে? শুধু ভাবতে লাগলো, ভালোবাসি বলে কেউ কাউকে কি করে এতোটা ভুল কি করে বুঝতে পারে? হয়তো পরিস্থিতির জন্য। ইচ্ছে প্রাপ্তকে এতোটুকোও দোষ দিলো না। সবরকম পরিস্থিতির জন্য প্রস্তুত করতে লাগলো নিজেকে। এরমাঝে ডক্টর এসে বললো,
-পেশেন্টের জ্ঞান ফিরেছে।
প্রাপ্ত একধ্যানে ইচ্ছের দিকে তাকিয়ে রইলো। ইচ্ছে চোখ মেলে তাচ্ছিল্যে হেসে বললো,
-খই ভালো আছে। গিয়ে দেখে আসো ওকে।
-ইচ্ছে…
-দেখা করে এসো।
প্রাপ্ত হাতের পিঠে নাক ডলা মেরে পা বাড়াচ্ছিলো ভেতরে যাবে বলে। ডক্টর ওকে বাধা দিয়ে বলে উঠলেন,
-সরি? আপনি কোথায় যাচ্ছেন? পেশেন্ট তো ইচ্ছের সাথে দেখা করতে চায়।
অবাকচোখে ডক্টরের দিকে তাকালো প্রাপ্ত। ইচ্ছে ভাবলো, হয়তো হসপিটালে আনার জন্য খই ধন্যবাদ দেবে ওকে। ডক্টরের দিকে নিমীলীতদৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে বললো,
-ইটস্ ওকে ডক্টর। আগে ওই যাক।
-সরি। পেশেন্টকে এই মুহুর্তে উত্তেজিত করা যাবে না। গেলে আপনাকেই এলাউ করবো আমরা। ওনাকে না।
ইচ্ছে প্রাপ্তর দিকে তাকালো। ততোক্ষনে সাফোয়ান এসেছে। ডক্টর আবারো বললো,
-মিস ইনায়াত? ভেতরে যাবেন আপনি?
সাফোয়ান এগিয়ে এসে বললো,
-অবশ্যই উনি যাবেন। ইনফ্যাক্ট উনিই আগে যাবেন। আজকে উনি যদি ব্লাড ডোনেট না করতো, খইকে বাচানো যেতো না। তাই ওনার সাথেই আগে খই দেখা করুক।
বিস্ফোরিত চোখে সাফোয়ানের দিকে তাকালো প্রাপ্ত। কি বলছে সাফোয়ান? তবে ওকে যে বললো, এক্সিডেন্টটা ইচ্ছের গাড়িতে হয়েছে। পুরোটা আবারো ভাবতে লাগলো প্রাপ্ত। কেয়ারটেকার বলেছিলো, খই স্বেচ্ছায় বেরিয়েছে মিষ্টিঘর থেকে। যদি খইয়ের এক্সিডেন্ট ইচ্ছে জেনেবুঝে করাতো তাহলে ওকে হসপিটালে নিয়ে আসলো কে? ইচ্ছেই বা এখানে কি করছে? আর ব্লাড দেওয়ার কথাই বা সাফোয়ান কেনো বলবে? দিশেহারার মতো প্রাপ্ত মাথার চুল উল্টে ধরলো নিজের। খইকে অসুস্থ্য দেখে, ইচ্ছের গাড়িতে এক্সিডেন্ট করেছে শুনে, কিসব বলে দিলো ও? ডক্টর বললেন,
-চলুন মিস ইনায়াত। পেশেন্ট ওয়েট করছে আপনার জন্য। বেশ অনেকবার নাম নিয়েছে আপনার।
ইচ্ছে ডক্টরের সাথে পা বাড়ালো চুপচাপ। প্রাপ্তর মাথা ঠান্ডা হলে হয়তো সবটা বুঝতে পারবে ও, এটা ও জানে। কিন্তু ততোক্ষন অবদি সবটা ঠিক থাকবে তো? ভেতরে ভেতরে বারবার মনে হচ্ছে, শেষবারের মতো একটু শান্তি চাই ওর। কোনো ভুল বোঝাবুঝি চাইনা। কোনো লাভক্ষতির পসরা চাই না। কোনো জবাবদিহিতা চাই না। শুধু শান্তি চাই! একটু শান্তি। কেবিনের দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকলো ইচ্ছে। খই আধশোয়া হয়ে বেডে বসে। ওর মাথায়, হাতে ব্যান্ডেজ, ক্যানোলা, স্যালাইন চলছে। ওকে দেখেই খই উৎফুল্লভাবে বলে উঠলো,
-ইচ্ছে!
মৃদ্যু হাসি নিয়ে এগোলো ইচ্ছে। আলতোভাবে খইয়ের গালে হাত রেখে বললো,
-এখন কেমন আছো খই?
খই ইচ্ছের হাতের উপর হাত রাখলো নিজের। চোখ বন্ধ করে কাদতে লাগলো তারপরই। ইনিশা থেকে বেরোনোর কিছুক্ষন পরই ওর সিএনজিটার সামনে গাড়ি নিয়ে দাড়িয়ে যায় নিজাম। ওর সাথে আরো দুজন ছিলো। ঝামেলা এড়াতে মাঝরাস্তায় ওকে রেখেই সিএনজিচালক পালিয়ে যায়। উপায়ন্তর না দেখে ছুট লাগিয়েছিলো খই। আর তখনই ইচ্ছের গাড়িতে এক্সিডেন্ট হয় ওর। জ্ঞান ফেরার পর একঘন্টা আগের স্মৃতির সাথে যুক্ত হয় ওর একযুগ আগের স্মৃতিও। যে স্মৃতিতে রয়ে গেছে ওর নাম, খেয়া, ওর মা নাফিজা বেগম, বাবা নওশাদ সাহেব, নিজের প্রানের চেয়েও প্রিয় বোন ইচ্ছে, আর ভালোবাসা বোঝার আগে থেকেই ভালোবাসার জায়গা জুড়ে নেওয়া, রাকীন। নিজের ছোটবেলার যে স্মৃতির জন্য সাহেরা মাকে প্রশ্ন করে করে কষ্ট দিতো, সে স্মৃতি যখন আজ ওর ফিরে এসেছে, সেই মা-ই ওর কাছে নেই। আজ ও ওর নিজের নাম, পরিচয় জানে। ও অনাথ না। ও তো ইচ্ছেরই বোন, খেয়া! ওকে কাদতে দেখে ইচ্ছে বললো,
-কাদছো কেনো তুমি?
খেয়া চোখ মেললো। বললো,
-কি অদ্ভুত জীবন। তাইনা রে ইচ্ছে? যখন আমি নিজেকে চিনি নি, তখন হয়তো তোরা আমাকে খুজেছিস। আজ আমি নিজেকে চিনলাম, তোদেরকে চিনলাম, অথচ দেখ! এখন তুই আমাকে চিনতে পারছিস না! আমার সাথেই কেনো এমন হবে ইচ্ছে? কেনো?
ভ্রু কুচকে তাকিয়ে রইলো ইচ্ছে। খেয়া বললো,
-বড়মা ঠিকই বলতো, ইচ্ছেনদীতে যদি খেয়াতরী না থাকে, তবে সে খেয়ার অস্তিত্ব থাকবে না। তোর থেকে দুরে সরে সত্যিই খেয়ার অস্তিত্ব ছিলো না ইচ্ছে! সে তো ভাদুলগাঁয়ে সাহেরা মায়ের মেয়ে হয়ে বেচে ছিলো। খই! দেখনা! আজ আবার নিয়তি আচমকাই তাকে মনে করিয়ে দিলো, তোর সাথে জরিয়ে তার আরো একটা পরিচয় আছে। খইই খেয়া! তোর হারিয়ে যাওয়া বোন!
কথা শেষ করে শব্দ করে কাদতে লাগলো খেয়া। শ্বাস আটকে খেয়ার কথাগুলো শুনলো ইচ্ছে। বুঝে উঠতেই নিজের সাথে মিশিয়ে নিলো ও খেয়াকে। গায়েমাথায় হাত বুলিয়ে ওর চোখেমুখে অজস্র চুমোয় ভরিয়ে দিলো। সুখের অশ্রুজল বাধ মানলো না ইচ্ছের। বাকিসব কিছু ভুলে গেছে ও। কাদতে লাগলো খেয়াকে জরিয়ে। কিছু হারিয়েছে বা হারাতে চলেছে কিনা, জানে না ও। শুধু মনে হলো, হারানোর মাঝেও প্রাপ্তির এ কান্না স্বস্তির, এ কান্না প্রশান্তির…
#চলবে…
- [ অগোছালো মনে হয়েছে? জ্বী। রিচেইক করিনি। অগোছালো লিখেছি আজ। পর্ব আরো বড় করা উচিত ছিলো। পেরে উঠলাম না। সত্যি বলতে আপনাদের কারো কারো মন্তব্যে আমি আশাহত। খই উরফ খেয়া চরিত্রকে প্রাধান্য দেওয়াটা অনেকেই মানতে পারছেন না। যেখানে আমি আগেই বলেছি, চারটে চরিত্রই সমান গুরুত্বপুর্ন। বাকি তিনটে চরিত্রের সাথে খেয়ার সমন্বয় কতোটা জরুরি ছিলো, গল্পের প্লটে তা দেখিয়েছি আমি। নাকি আমিই ব্যর্থ? আপনাদের অনুধাবন কি বলে?
শেষ হওয়া সব গল্পের লিংক, চলমান গল্পের আর পেতে এবং গল্প সম্পর্কিত আড্ডা দিতে জয়েন করুন মিথিমহল। গ্রুপ লিংকঃ
https://www.facebook.com/groups/233416685257163/?ref=share_group_link ]