আলোছায়া পর্ব-১৩

0
1964

#আলোছায়া
কলমে: লাবণ্য ইয়াসমিন
পর্ব:১৩

ঘড়ির কাটা নয়টা ছুইছুই। বাড়িতে থমথমে পরিবেশ বিরাজ করছে। নীলু রুমে বসে আছে। মনটা ভীষন খারাপ। মন খারাপ হলে শরীর ও কেমন খারাপ হয়ে যায়। জুনায়েদ সন্ধ্যায় বেরিয়েছে এখনো ফিরে আসেনি। নীলু জানে সে আসবে না। হয়তো অনিকের সঙ্গে নয়তো মন খারাপ করে বসে আছে। পারভীন বেগম নিজের রুমে আছেন। রাতের খাবার নিয়ে কারো মাথাব্যথা নেই। গলা দিয়ে হয়তো নামবেও না। নীলু আকাশের দিকে তাকিয়ে বেলকনীতে দাঁড়িয়ে আছে। পর্ব আকাশে চাঁদ উঠছে কিছুক্ষণের মধ্যেই চারদিকে জোছনা ছড়িয়ে পড়বে। জুনায়েদ খোলা আকাশের নিচে হাটুর মধ্যে মাথা নামিয়ে বসে আছে। সব কিছু এলোমেলো লাগছে। শহরের কোলাহল ছেড়ে এই নির্জনে এসে কিছুটা হলেও স্বস্তি লাগছে। রাস্তার পাশের ঝিঝিগুলোর ডাকগুলো ভীষন বিরক্তিকর লাগছে। জুনায়েদ ভেবেছিল অনিকের কাছে যাবে কিন্তু যাওয়া হয়নি। শুধু শুধু নিজের ঝামেলায় ছেলেটাকে অশান্তিতে ফেলার মানে হয়না। এভাবেই রাতটা পার হলো। জুনায়েদ বাড়িতে ফিরে আসেনি। সকাল হতেই শুভ্র হন্তদন্ত হয়ে নীলুর রুমে উকিঁ দিয়ে কড়া নাড়লো। নীলু এতক্ষণ বেলকনিতে দেওয়ালে হেলান দিয়ে ঘুমিয়ে ছিল। গতকাল রাতে চোখ লেগে এসেছিল তাই রুমে আসার সময় পাইনি এখানেই ঘুমিয়ে গিয়েছিল। হঠাৎ দরজায় শব্দ শুনে ও উঠে গিয়ে দরজা খুলে দিলো। শুভ্র ভেতর এসে মাথা নিচু করে বলল,

> অনিকের নাম্বার আছে? জুনায়েদের খোঁজ নেওয়া দরকার।

নীলু অবাক হয়ে কয়েক সেকেন্ড শুভ্রর দিকে তাকিয়ে বলল,

> জানিনা। তবে উনার ফোনটা রুমেই আছে।

নীলু কথাটা বলে ভেতরে গিয়ে জুনায়েদের ফোনটা নিয়ে এসে শুভ্রর হাতে দিয়ে দিলো। শুভ্র ফোন নিয়ে চলে যেতে গিয়ে ফিরে এসে বলল,

> আম্মুকে সঙ্গে নিয়ে কিছু খেয়ে নাও। চিন্তা করোনা আমি ওকে ফিরিয়ে আনবো।

নীলু মাথা নাড়িয়ে নিচে চলে গেলো। পারভীন বেগম সোফায় বসে আছে। উনাকে আজ বেশ ক্লান্ত লাগছে। নীলু ধীরগতিতে এসে উনার পাশে গিয়ে বসলো। নীলুকে পেয়ে পারভীন বেগমের উদাসীন ভাবটা কেটে গেলো। উনি নীলুকে জড়িয়ে নিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন,

> তোর সঙ্গে খুব অন‍্যায় করে ফেলেছি রে মা। কখনও ভাবিনি ছেলেটা এমন কিছু করে ফেলবে।

> আম্মু উনি সত্যিই ভালো খারাপ না। তুমি ওকে আমার হাতে ছেড়ে দাও সব ঠিক করে ফেলবো।। দেখবে তোমার ছেলে ঘুড়ির মতো আমার পিছু পিছু ঘুরছে।

> তুই এখনো অনেক ছোট এতোসব বুঝবি না। স্বামীর চোখের কাটা হয়ে বিরক্তি নিয়ে সারাজীবন পার করা যায় না। তুই রক্তে মাংসে গড়া মানুষ কোনো কাঠের পুতুল না যে ভালোবাসা ছাড়া সংসার করবি।তুই আজ থেকে জুনায়েদের আশেপাশেও যাবি না। তোর জিনিসপত্র আমার রুমের পাশের রুমে নিয়ে আসার ব‍্যবস্থা করছি। আজ থেকে তোরা আলাদা থাকি।

পারভীন বেগম একদমে কথাগুলো বলে থামলেন।নীলু মন খারাপ করে হু বলে পারভীন বেগমের ঘাড়ে মাথা রাখলো। কাজের কর্মফল তাকেই ভোগ করতে হয়। এখানে ওর কিছুই করার নেই। শুধু মানবিক কারণে জুনায়েদের পাশে থেকেছে। তাছাড়া লোকটা খারাপ না। কথাগুলো ভেবে ও দীর্ঘশ্বাস ফেলল। পড়ন্ত বিকেলে শুভ্র জুনায়েদকে নিয়ে বাড়িতে ফিরলো। জুনায়েদ শেষরাতে অনিকের বাড়িতে গিয়ে উঠেছিল। ওখানেই ছিল সারাদিন। শুভ্র গিয়ে নিয়ে এসেছে। বাড়িতে ঢুকে জুনায়েদ চুপচাপ নিজের রুমে গিয়ে ধপ করে বিছানায় বসে পড়লো। ও নিজেকে শুধরে নেবার কঠিন প্রতিজ্ঞা করেছে। একটা রাত নির্জনে ভেবেছে তারপর এই সিদ্ধান্ত। জুনায়েদ এলোমেলো পায়ে আলমারি খুলে নিজের শার্ট নিয়ে আসার সময় অবাক হলো এখানে নীলুর কাপড় রাখা ছিল তার কিছুই নেই। জুনায়েদ সন্দেহভাজন দৃষ্টিতে আশেপাশে তাকিয়ে দেখলো রুমে নীলুর চিহ্ন পযর্ন্ত নেই। মনের মধ্যে নাড়া দিয়ে উঠলো। মেয়েটাকে ওর থেকে দূরে রাখা হয়েছে কথাটা ভেবে ও দীর্ঘশ্বাস ফেলল। মনে হলো ঠিকই করেছে। ও তো মানুষের পর্যায়ে পড়ে না। মানুষ হয়ে মানুষকে খুন করতে চেয়েছিল এর থেকে নিকৃষ্ট আর কি হতে পারে। মেয়েটা যেখানেই থাক ভালো থাক। ওর সঙ্গে থাকলে ওর জীবনটা নষ্ট হয়ে যাবে। শুধু নিজের স্বার্থের কথা ভাবলে চলবে না। জুনায়েদ বাথরুমে গিয়ে গোসল করে বাইরে বেরিয়ে এসে দেখলো ট্রি টেবিলের উপরে খাবার রাখা আছে। ও সোফায় গিয়ে প্লেটে তুলে নিয়ে খেতে শুরু করলো। কয়েকবার মুখে দিয়ে আর গলা দিয়ে নামলো না। প্রায় দুদিন পেটে দানাপানি পড়েনি হঠাৎ খাবার পেটে যাওয়ায় কেমন ব‍্যথা করে উঠছে। জুনায়েদ খাবার রেখে বিছানায় গিয়ে গুটিসুটি মেরে শুয়ে পড়লো।। কিছুক্ষণের মধ্যেই ও গভীর ঘুমে তলিয়ে গেলো।

জুনায়েদ বাড়িতে ফিরে আসাতে পারভীন বেগমের তেমন কোনো প্রতিক্রিয়া হলো না। রাতের খাওয়ার সময় ডলিকে দিয়ে ওর খাবার রুমে পাঠিয়ে দেওয়া হলো। মনে হলো এই বিশাল বাড়িতে জুনায়েদ একদম একা একজন মানুষ। ওর সঙ্গে ঘরে বাইরে কারো কোনো সম্পর্ক নেই। এই নির্জনতাই ওর বড় শাস্তি। অরিন এখনো এই বাড়িতেই আছে। পারভীন বেগম ওর সঙ্গেও তেমন কথা বলছে না।

রাতে নীলু বেলকনীতে দাঁড়িয়ে আছে। শরীর বেশ ক্লান্ত। হাতে একদম সময় নেই। যত দিন যাচ্ছে ওর জন্য বেঁচে থাকাটা ততই কঠিন হচ্ছে। অন‍্যদিকে জুনায়েদের আজ ঘুম আসছে না। সন্ধ্যায় ঘুম থেকে উঠেছে। রাতে বাইরে বের হলে হয়তো মনটা ভালো লাগবে কথাটা ভেবে ও চুপচাপ রুমের দরজা ভেজিয়ে বাইরে বেরিয়ে পড়লো। জুনায়েদ পায়ে হেটে বের হলো। দারোয়ান ওকে পায়ে হেটে বাইরে আসতে দেকে কিছুটা অবাক হলো। জুনায়েদ সেসবে তোয়াক্কা করলো না। হাতে একটাখানা সিগারেট ধরিয়ে নিলো। সিগারেট খাওয়াটা গতকাল থেকে শুরু করেছে। প্রচণ্ড ধোয়াতে চোখমুখ লাল হয়ে যায় কাশি আসে তবুও নিজেকে কষ্ট দিতে এই পন্থা অবলম্বন করা। কয়েকটান দেবার পরে ওর মনে হলো এটা নিছক বোকামি ছাড়া কিছুই না। জুনায়েদের বাড়িটা শহরের শেষ সীমান্তে। ওদের বাসার উত্তরে ছোটখাট একটা জঙ্গল পড়ে। জঙ্গলে শেষে বড় মাঠ পেরিয়ে গ্রামের দেখা মিলে। কখনও ওর গ্রামে যাওয়ার ইচ্ছে করেনি। গ্রাম সম্পর্কে তেমন ধারণাও নেই।। জুনায়েদ কথাগুলো এলোমেলো ভেবে জঙ্গলের রাস্তায় গিয়ে বসে পড়লো। গাছের ফাঁক দিয়ে চাঁদের টুকরো টুকরো জোছনা ওর গায়ে এসে আলো ঝলমল করছে। কিছুদূরে একটা গাছে জোনাক পোকাতে ছেয়ে আছে। পরিবেশটা বেশ দারুন। আলো ঝলমলে শহরে রাতের সৌন্দর্য এভাবে কখনও উপলব্দি করা হয়নি। ও মুগ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে।কিন্তু সময়টা বেশিক্ষণ স্থায়ী হলো না। হঠাৎ কারো পায়ের শব্দে ওর ঘোর কেটে গেলো। জুনায়েদ কান খাড়া করে শুনতে পেলো জঙ্গলের মধ্যে কারো পায়ের শব্দ। ও দ্রুত উঠে দাড়িয়ে পড়লো। শব্দটা ওর দিকের এগিয়ে আসছে। জুনায়েদ ভ্রু কুচকে থাকতে থাকতেই একটা ছেলের অবয়ব দেখতে পেলো। ছেলেটা ওর সামনে এসে থামলো। জুনায়েদের আগেই ছেলেটা গম্ভীর কন্ঠে বলল,
> এখানে কি করছেন?

> বসে আছি। আপনার পরিচয়?

> আমার পরিচয় জানতে চাও? অপেক্ষা করো।

ছেলেটা কথাটা বলেই জুনায়েদের দিকে আলো টাইপের কিছু একটা ছুড়ে দিলো। জুনায়েদ চোখ বন্ধ করে নিলো ভেবেছিল ছুড়ে দেওেয়া আলোটা ওর মুখে লাগবে কিন্তু এমন কিছুই হলো না। কেউ একজন ওকে ছিটকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে নিলো। জুনায়েদ পড়ে গিয়ে দ্রুত উঠে দাঁড়িয়ে আশেপাশে কাউকে পেলো না। সামনে পেছনে কেউ নেই।তবে জঙ্গলের মধ্যে ধস্তাধস্তির শব্দ হয়ে থেমে গিয়ে আবারও সেই নির্জনতা ছেয়ে গেলো। এখানে কি হলো তার কিছুই ওর বোধগম্য হলো না। তবে বুঝলো ছেলেটা ওকে মারতে চাইলো কিন্তু কেউ একজন ওকে বাঁচিয়ে দিলো। জুনায়েদ এখন লোকটার জন্য অপেক্ষা করবে কি ভাবতে ভাবতেই ওর নাম ধরে কেউ ডেকে উঠলো। জুনায়েদ রাস্তার দিকে এগিয়ে যেতেই দেখলো লাইট হাতে দারোয়ান ওকে খুঁজতে এসেছে। জুনায়েদ দারোয়ানের কাছাকাছি হতেই লোকটা বলল,

> বাবা তুমি এখানে আর আমি তোমাকে খুঁজতে খুঁজতে হয়রান। তাড়াতাড়ি বাড়িতে চলো নীলু মা আমাকে পাঠালো তোমাকে খুঁজতে।

জুনায়েদ উত্তর করলো না। লোকটার সঙ্গে পা মিলিয়ে হেটে চলল। নীলুর উপরে ওর ভীষণ অভিমান জমেছে। খুব চিন্তা হচ্ছে কিন্তু একবারও দেখা করতে পারেনি। জুনায়েদের কাউকে লাগবে না। কথাটা ভেবে ও দারোয়ান চাচাকে ফেলে গটগট করে বাড়িতে চলে আসলো।। নীলুর রুমটা ওর একদম বিপরীতে জুনায়েদ ইচ্ছা করলেও ওকে দেখতে পাবে না। পারভীন বেগম খুব ভালো করে জানে ছেলের বেপরোয়া স্বভাবের কথা। মেয়েটাকে ওর ধারে কাছেও রাখবেন না । জুনায়েদ রুমে গিয়ে জুতা পায়েই ধপ করে শুয়ে পড়লো। রুমের লাইট সেভাবেই জ্বালানো থাকলো।

সকাল সাতটা বাজে ঘুম ঘুম চোখে জুনায়েদ উঠে বসলো। নীলুর আটটার সময় ক্লাস আছে। কথাটা ভেবে ও বাথরুমে গিয়ে ফ্রেসে হয়ে ডাইনিং রুমে গিয়ে ডলিকে বলল,

> খালা নীলুকে বলুন আমি রেডি। ক্লাসে যেতে চাইলে যেনো আসে।

জুনায়েদের কথায় ডলির উত্তর করার আগেই থমথমে কন্ঠে পারভীন বেগম উত্তর করলো,

> ডলি ওকে বলে দে নীলুর চিন্তা ওর না করলেও চলবে। কোথায় নিয়ে গিয়ে মেরে গুম করে দিবে আমার ভরসা নেই। নীলু শুভ্রর সঙ্গে যাবে।

কথাটা জুনায়েদের কাছে খুব তিক্ত শোনালো। মনে হলো মা ওকে একটুও ভালোবাসে না। জুনায়েদ এবার সৈয়দ সাহেবের সামনে গিয়ে বলল,

> আমি অফিসে বসতে চাই। আমার কাজটা বুঝিয়ে দিলে ভালো হবে। বিশাল কিছু না পারি ছোটখাট কাজ করতে চাই।

সৈয়দ সাহেব কিছুক্ষণ ভেবে উত্তর দিলেন,

> হুম অফিসে আসো দেখা হচ্ছে।

জুনায়েদ কথাশেষ করে উপরে চলে গেলো। পারভীন বেগম স্বামীকে কিছু বলতে চেয়েছিলেন তার আগেই উনি বললেন,

> এতোটা কঠিন হলে ছেলেটা আরও খারাপ হয়ে যাবে। এবার ঠিক শুধরে যাবে দেখো।

> গেলেই ভালো। তবে আমার কিন্তু একটুও বিশ্বাস নেই তোমার ছেলের উপরে। ঠিক তোমার মতোই হয়েছে।

> মাথা গরম স্বভাটা তোমার মতোই পারভীন। শুধু শুধু আমাকে দোষ দেওয়া তোমার স্বভাব হয়ে গেছে।

সকাল সকাল সৈয়দ হাসেবের তর্কাতর্কি করতে ইচ্ছা হলো না। উনি চায়ের কাপ নিয়ে উঠে পড়লেন। নাস্তা করে অফিসে যেতে হবে। নীলু রেডি হয়ে শুভ্রর গাড়িতে গিয়ে বসলো। শুভ্র কানে ফোন গুজে হন্তদন্ত হয়ে গাড়ি ছেড়ে দিলো। গুরুত্বপূর্ণ একটা মিটিং আছে হাতে সময় কম তাড়াতাড়ি অফিসে পৌঁছনোর আছে। শুভ্র গাড়িতে বসে কান থেকে ফোনটা রেখে পাশে নীলুকে দেখে হতাশ চোখে সামনে থাকালো। নীলু আজ নীল রঙের ড্রেস পড়েছে। শুভ্র রাস্তায় একবারও ওর দিকে থাকালোনা।ভার্সিটির সামনে ওকে নামিয়ে দিয়ে অফিসের দিকে চলে গেলো। জুনায়েদ আজ ক্লাসে আসেনি অফিসে গেছে। ওর জন্য সৈয়দ সাহেব আলাদা কেবিন ঠিক করেছেন। তবে শুভ্রর মতো এতোটা সুন্দর না। জুনায়েদ যদি নিজেকে প্রামাণ করতে পারে যোগ্য হয়ে উঠে তবে ওকেও শুভ্রর মতো ট্রিট করা হবে। সারাদিন ওর অফিসেই কেটে গেলো। শুভ্র মিটিংয়ে বসেছে এখনো সেখানেই আছে বাইরে বের হবার খোঁজ নেই। জুনায়েদ বারবার ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখছে। তিনটা ছুইছুই নীলুর ক্লাস দুইটাই শেষ হয়েছে। মেয়েটা রাস্তায় দাঁড়িয়ে আছে নাকি বাড়িতে পৌঁছে গেলো জানা দরকার। কথাটা ভেবে ও হন্তদন্ত হয়ে বাইরে বেরিয়ে গেলো।

(চলবে)

ভুলত্রুটি মার্জনা করবেন।

আসুন নামাজ ও কোরআন পড়ি।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here