আলোছায়া
কলমে: লাবণ্য ইয়াসমিন
পর্ব: ২৩
জুনায়েদ চোখ বন্ধ করে শুয়ে আছে কিছুতেই ঘুম আসছে না। নীলুর সত্যিটা জানা অনেক জরুরী ছিল কিন্তু মেয়েটা কিছুতেই মুখ খুলছে না।।ওর ইচ্ছা করছে উঠে গিয়ে আচ্ছা করে ধোলাই করতে। কতবড় সাহস ওর থেকে কথা লুকিয়ে রেখেছে। তারপর আবার বাড়িতে ইনোসেন্ট মুখ করে সবাইকে বোকা বানানো। জুনায়েদ কথাগুলো ভেবে পাশ ফিরতে গেলো কিন্তু সোফায় ওকে ধরছে না পড়ে যাচ্ছে। শেষমেশ উপায় না পেয়ে বাইরে বেরিয়ে আসলো। ডাইনিং রুমের সোফা বেশ বড় সেখানে ঘুমালে কোনো অসুবিধা হবে না। কথাটা ভেবে ও ডাইনিং রুমে এসে ধপ করে শুয়ে পড়লো।
ভোরবেলা ফজরের আযানের সময় জুনায়েদ জেগে উঠলো কিন্তু বুকের উপর প্রচণ্ড ভারি অনুভব করলো। জুনায়েদ ভালোকরে দেখে ওর চোখ দুটো বড়বড় হয়ে গেলো। নীলু ওকে ঝাপটে ধরে ঘুমিয়ে আছে। জুনায়েদ ওর মুখের দিকে তাঁকিয়ে আছে। নীলুর চুলগুলো এলোমেলো হয়ে উড়ছে। এমন সরল মুখটার আড়ালে একটা হিংস্র মুখ লুকিয়ে আছে কথাটা ভেবে ওর মুখটা কঠিন হয়ে উঠলো। জুনায়েদ রেগে গিয়ে নীলুর কাধে হালকা ধাক্কা দিয়ে বলল,
> এই মেয়ে উঠো। ঘরে বাইরে শান্তি কোথাও তোমার জন্য একটু শান্তি নেই। ফাজিল মেয়ে একটা। এমন ভাবে ঘুমিয়ে আছে মনে হচ্ছে ভাজা মাছ উল্টে খেতে জানে না।।
জুনায়েদের হাকডাকে তেমন কোনো ফল হলো না। নীলু বরং ধাক্কা খেয়ে ওকে আরও ঝাপটে ধরে গভীর ঘুমে তলিয়ে গেলো। জুনায়েদ নড়াচড়া করতে পারছে না। একদম ফ্রিজ হয়ে আছে। ওর ইচ্ছে করেছে নীলুকে আছাড় দিতে কিন্তু সব ইচ্ছে তো আর পূরণ হবার না। এভাবে কতক্ষণ শুয়ে থাকবে ভাবতে ভাবতে ও আরও রেগে গেলো। ও এবার নীলু দুবাহু খামচে ধরে ধমক দিয়ে বলল,
> ওই উঠো কিন্তু নয়তো ফেলে দিবো ফাজিল মেয়ে।
নীলু এবার চমকে উঠে পিটপিট করে চোখ খুলে দেখে, তাড়াতাড়ি উঠে বসতে গিয়ে আবারও হুমড়ি খেয়ে পড়লো। জুনায়েদ বিরক্ত হচ্ছে ওর চোখেমুখে প্রকাশ পাচ্ছে। নীলুর ভাবমূর্তি দেখে তেমন কিছুই বোঝা যাচ্ছে না। ও কোনরকম উঠে ঘুম ঘুম কন্ঠে বলল,
> ষাঁড়ের মতো চেচামেচি করছেন কেনো। বাড়িতে লোকজন আছে কি ভাববে? চুপ থাকেন।
জুনায়েদ উঠে বসে বিরক্তি নিয়ে বলল,
> তোমার সাহস দেখে অবাক হচ্ছি। আমার উপরে শুয়ে আছো কার হুকুমে?
নীলু সোফায় হেলান দিয়ে চোখ বন্ধ করে বলল,
> সামান্য এইটুকু কারণে আপনি ডাকছেন? আমি তো ভাবলাম আপনি অশুদ্ধ হয়ে গেছেন। আমার ঘুম পুরোপুরি হয়নি আরও ঘুমাতে হবে। যত ঘুম ভালো হবে তত শরীর ভালো থাকবে।
> তোমাকে ঘুমাতে মানা করেছি? আমার উপরে এসেই কেনো তোমার ঘুমাতে হবে? আমি তোমাকে অবিশ্বাস করছি। তাছাড়া চেয়েছিলাম তোমাকে ভালোবাসার চেষ্টা করতে কিন্তু এখন আর সম্ভব না। দয়াকরে আমার আশেপাশে ঘুরঘুর করবে না।
জুনায়েদ দাঁতে দাঁত লাগিয়ে এক দমে কথাগুলো বলে থামলো। নীলু থতমত মুখে বসে আছে। কন্ঠ চেপে ধরেছে চাপা কান্নাতে। প্রিয়জনের ঘৃণার পাত্রী হয়ে বেঁচে থাকার চাইতে মৃত্যু ভালো। হঠাৎ করে ওর মনে হলো কি দরকার ছিল নিজের স্বার্থের কথা ভেবে কথাগুলো লুকিয়ে রাখার। তার চেয়ে আনন্দের সঙ্গে মারা যেতো। জুনায়েদ ওকে চুপচাপ দেখে আরও কিছু বলতে চাইলো কিন্তু পারলো না। সিঁড়িতে শুভ্র দাঁড়িয়ে আছে। ও কিছু শুনেছে কি বোঝা গেলো না। তবে উচ্চ কন্ঠে হাক ছেড়ে বলল,
> জুনায়েদ অসভ্যের মতো চেচামেচি করছিস কেনো? লোকজন জানলে কি বলবে? নীলুর সঙ্গে আবারও ঝগড়া করেছিস? তোর মতিগতি বুঝতে পারছি না। এই ওর গায়ের সঙ্গে চিপকে আছিস আবার এইতো বোম্বাই মরিচের মতো জ্বলছিস।
> ভাইয়া তুমি চুপ থাকো। এই মেয়েটা মহা পাজি। ওর সঙ্গে আমি কিছুতেই থাকবো না।
জুনায়েদ হন্তদন্ত হয়ে বাইরে বেরিয়ে গেলো। শুভ্র ধীরগতিতে নিচে নেমে এসে নীলুর পাশে বসলো। মেয়েটা ফুপিয়ে ফুপিয়ে কাঁদছে। ওর কান্না দেখে শুভ্রর খারাপ লাগছে কিন্তু কি বিষয়ে এমন ঝগড়া হলো ঠিক বুঝতে পারছে না তাই জিঞ্জাসা করলো,
> কি হয়েছে বলবে আমাকে? এভাবে কান্নাকাটি করলে শরীর খারাপ হবে। আমাকে বলো আমি সাহায্য করবো।
নীলু কি বলবে ভেবে পেলো না তাই কান্না থামিয়ে বলল,
> রুমে ঘুম আসছিল না তাই ওর পাশে গিয়ে ঘুমিয়েছিলাম। বিশ্বাস করুণ আমি ইচ্ছা করে ওর উপরে ঘুমাইনি ও নিজেই…..
শুভ্র বাকি কথা শুনলো না। তাড়াতাড়ি উঠে পড়লো। এই মেয়েটার মাথায় জ্ঞান বুদ্ধি কমকম। কাকে কি বলছে ঠিক পাচ্ছে না। নীলু চোখের পানি মুছে নিলো। কথাগুলো শুভ্রকে ও ইচ্ছে করে বলেছে। এগুলো না বললে আরও প্রশ্ন উঠতো। নীলু টলতে টলতে নিজের রুমে গিয়ে ধপাস করে বিছানায় শুয়ে পড়লো। জুনায়েদ কোথায় যেতে পারে সে ওর নখদর্পনে। আপাতত ঘুমের অনেক দরকার।
সকাল আটটা বাজে। সবাই নাস্তার টেবিলে বসে আছে। নীলু বারবার জুনায়েদের দিকে তাঁকিয়ে দেখছে। ছেলেটা গরুর মতো খাচ্ছে আশেপাশে থাকাচ্ছে না। নীলুযে ওর দিকে তাঁকিয়ে আছে সে ও বুঝতে পারছে। কিন্তু এই মেয়ের চোখে চোখ রাখতে ও নারাজ। নীলু হতাশ হয়ে প্লেটের পাশে হাত নামিয়ে তার উপরে নিজের থুতনি রেখে চোখ বন্ধ করলো। ওকে এভাবে দেখে পারভীন বেগম কৌতূহলী হয়ে বলল,
> কিরে শরীর খারাপ?
নীলু চোখ বন্ধ করেই বলল,
> না ভীষণ মন খারাপ। তোমার ছেলে আমাকে বকেছে।।
পারভীন বেগম রেগে জুনায়েদের দিকে তাঁকালেন। জুনায়েদ খাওয়া শেষ করে গাড়ির চাবি ঘুরাতে ঘুরাতে বেরিয়ে গেলো। মনে হলো এখানে কিছুই হয়নি। ও এই মেয়ের ড্রামা দেখে জ্বলছিল। মুখ খুললে ভয়ংকর কিছু হয়ে যেতো। আপাতত ঝগড়া ঝামেলা চাইছে না। ওকে যেতে দেখে পারভীন বেগম বিরবির করে ছেলেকে কয়েকটা বকা দিয়ে শুভ্রকে বলল,
> আজকে তোর সময় হবে?
শুভ্র খাবার মুখে নিয়ে বলল,
> কেনো?
> আয়ানার সঙ্গে শপিং করতে যেতে বলছিলাম। তাছাড়া তুই একা না সঙ্গে নীলু আর অভ্র যাবে। আমাকে সকালবেলায় ফোন করেছিল তোদের কাছে কিছু জিঞ্জাসা না করেই আমি রাজি হয়েছি। মেয়েটা আশা নিয়ে থাকবে।
> মিটিং ছিল। তোমার ছেলে যদি সামলে নিতো তবে যেতে পারি।
> আচ্ছা জুনায়েদকে আমি বলে দিবো। ছেলেটা হয়েছে মহা পাজি। সব জায়গাই খিচুরি পাকিয়ে বেড়ায়।
> ঝগড়ু একটা। পায়ে পা লাগিয়ে ঝগড়া করে তোমার ছেলে। মেয়ে হলে বেশ ভালো হতো।
> নীলু তুই গিয়ে রেডি হয়ে আসেক।
নীলু আচ্ছা বলে চলে গেলো। যাওয়ার ইচ্ছে ছিল না কিন্তু শাশুড়ির কথার বাইরে কথা বলতে পারলো না। শেষমেশ রাজি হলো। ক্লাসে যাওয়ার চাইতে শপিং করতে যাওয়া মজার ভেবে ও উৎসাহ নিয়ে সুন্দর একটা ড্রেস পড়ে বের হলো। শুভ্র ওকে সঙ্গে নিয়ে আরিয়াদের বাসার সামনে থেকে ওদেরকে তুলে নিয়ে শপিংমলের উদ্দেশ্যে বের হলো। আজ সারাদিন শপিং ঘুরাঘুরি আর খাওয়া দাওয়া করবে। শপিংমলে আয়ানা শুভ্রর সঙ্গে হাটছে আর নীলু অভ্রর সঙ্গে। অভ্র ওকে দেখে ফিসফিস করে বলল,
> তোমাকে দারুণ লাগছে। এমনিতেও তুমি দেখতে সুন্দর তারপর এই ড্রেসটাতে আরও সুন্দর লাগছে।
নীলু ওর কথায় তেমন রিয়েক্ট করলো না। মুখ স্বাভাবিক রেখে ওর মতোই ফিসফিস করে উত্তর দিলো,
> লোকের বউয়ের দিকে নজর দিতে নেই। রূপের আগুনে ঝলসে যাবে। বেশি তাকাবেন না। নজর খারাপ ধরে নিবো। ভাববো আপনি বুঝি লুচ…
অভ্র ওর কথা থামিয়ে দিয়ে বলল,
> আমাকে অপমান করতে চাইলে করতেই পারো। তোমার কথায় কখনও আমি অপমানিত হয়েছি বলে মনে হয়না। তুমি আমার নিজের মানুষ।
> আপনি কিন্তু সীমান্ত ছাড়িয়ে যাচ্ছেন।
নীলু রেগে যাচ্ছে। হঠাৎ শুভ্র পেছনে তাকিয়ে নীলুকে এভাবে রাগ করতে দেখে অভ্রকে বলল,
> ওর সঙ্গে রসিকতা করতে যেওনা। জুনায়েদ জানলে তোমার অবস্থা খারাপ করবে। এমনিতেই সে রেগে আছে। সকালবেলায় যা কাণ্ড ঘটিয়েছে।
আরিয়া বেশ উৎসাহ নিয়ে জিঞ্জাসা করলো কি করেছে?
> সেসব পরে বলবো এখন আসো সবাই।
অভ্রর চোখমুখ কঠিন হয়ে উঠেছে। নীলু সেদিকে না তাকিয়ে ফিসফিস করে বলল,
> সব নিয়তি।
> নিয়তি আমি কর্ম দ্বারা বদলে দিবো। কর্ম দ্বারা ভাগ্য নিয়ন্ত্রণ করা যায় আশাকরি কথাটা তোমার অজানা না।
> অসৎ কর্ম দিয়ে ভাগ্য নিয়ন্ত্রণ করতে চাও কি দুঃসাহস তোমার অর্বাচিন বালক?
হঠাৎ এমন তর্কাতর্কির মধ্যেই পাশ থেকে একটা বিদ্রুৎ এর বাল্প বেঙে পড়লো। কিছুটা শর্টসার্কিট হয়ে আগুন ছুটলো তেবে পরে শান্ত হলো। অভ্র নিজেকে শান্ত করে বুঝালো নীলুকে রাগালে ঝামেলা হয়ে যাবে। তর্কাতর্কি পরে করবে।
চলবে
ভুলত্রুটি মার্জনা করবেন।
আসুন নামাজ ও কোরআন পড়ি।