#আলোছায়া
কলমে লাবণ্য ইয়াসমিন
পর্ব:২৫
ডাইনিং রুমে মিটিং বসেছে। বাড়ির সকলে সেখানে উপস্থিত। নীলুর বাবা মা এসেছেন নীলুকে নিয়ে যেতে। উনারা চাইছেন মেয়ে কিছুদিনের জন্য গ্রামে গিয়ে থাক। জুনায়েদের বুকের মধ্যে ঢিপঢিপ করছে কিছুক্ষণ আগে নীলুকে নিয়ে ও বাড়িতে ফিরেছে। ও চাইছে না নীলু চলে যাক। মিসেস পারভীন বেশ গম্ভীর হয়ে আছেন। বড় ছেলের বিয়েতে ছোট ছেলের বউ থাকবে না এটা উনি মানতে নারাজ। একমাত্র ভরসা হচ্ছে সৈয়দ সাহেব। উনি বললে হয়তো নীলুকে রেখে যাবে। নীলুর কোনো ভাবনা চিন্তা নেই। সে এক দৃষ্টিতে জুনায়েদকে দেখছে। ছেলেটার মনের ভাষা ও পড়তে জানে। নীরবতা ভেঙে সৈয়দ সাহেব নীলুর মাকে বললেন,
> ভাবি সাহেবা মেয়েকে এই সময় নিয়ে যাওয়াটা কি ঠিক হবে?বাড়িতে এতো মেহমান আসবে অথচ আমার মেয়েটা থাকবে না। মন কেমন করবে আমার।
ভদ্রমহিলা মলিন হেসে বললেন,
>বুঝতে পারছি ভাই সাহেব। আমরা যে নিরুপায়। অল্প কিছু দিন মেয়েটার সঙ্গে থাকতে চাইছি। জানিনা ভাগ্যে কি লেখা আছে। হয়তো কখনও সুযোগ পেলাম না।
নীলুর মায়ের কথাগুলো শুনে জুনায়েদের চোখ ছলছল করে উঠলো। সত্যিই তো নীলুর যদি কিছু হয়ে যায় তখন? না না এমনটা কিছুতেই হবে না। ও নীলুর কাছাকাছি থাকবে সব সময়। কথাগুলো ভেবে জুনায়েদ বলে ফেলল,
> আন্টি আপনি আর আঙ্কেল এখানেই থাকেন কিছুদিন। তাছাড়া ভাইয়ার বিয়ের কয়েকদিন যদি আপনারা এখানে থাকেন তবে আমাদের বেশ উপকার হবে সঙ্গে নীলুর সঙ্গে সময় কাটাতে পারবেন।
সৈয়দ সাহেবের কথাটা বেশ পছন্দ হলো। উনি মাথা দুলিয়ে বললেন,
> বাহ দারুণ হবে। তাহলে এই কথায় রইল।আপনারা যাচ্ছেন না। এখানেই থাকবেন। নীলু মা তুমি ডলিকে বলো রুম রেডি করতে।
নীলু অপেক্ষা করলো না দ্রুতগতিতে ডলির কাছে চলে গেলো। জুনায়েদ মনে মনে নিজের বুদ্ধির প্রশংসা নিজেই করল।
বিয়ের দিন ঘনিয়ে আসছে। এর মধ্যে আরেক ঝামেলা শুরু হয়েছে। সৈয়দ সাহেবের বন্ধু বান্ধবীর ছেলেমেয়ে সঙ্গে মিসেস পারভীনের আত্মীয়স্বজনে বাড়ি আগে থেকেই গমগম করে উঠলো। সবাই মিলেমিশে শপিং করছে ঘুরাঘুরি করছে। কিন্তু জুনায়েদের মনে শান্তি নেই। নীলু সন্ধ্যা হলে ওকে রুমে রেখে বাইরে বেরিয়ে যায়। সারা শহরে কোথাও স্টোনের সন্ধান মেলেনি। শেষমেশ ভোররাতে ক্লান্ত শরীর নিয়ে ঘুমিয়ে পড়ে। জুনায়েদ নিজের মতো খোঁজ নিচ্ছে। কয়েক বছর আগে এটা এক তান্ত্রীকের কাছে ছিল তারপর প্রশাসনের কাছে সেখান থেকে গায়েব। পুলিশের মধ্যেই কেউ এটা চুরি করেছে বলে জুনায়েদ ভেবে নিয়েছে। কিন্তু যেই নিয়ে থাক ওটা নিয়ে তার কিসের কাজ? বিক্রি করে চড়া দাম পেয়েছে নিশ্চয়ই। এতোদিনে কয়েকবার হাত বদল হয়েছে। ভয় হচ্ছে পাচার হয়েছে কিনা এটা নিয়ে। জুনায়েদ ল্যাপটপ রেখে নীলুকে নিজের কাছে বসিয়ে বলল,
> সেদিন বলেছিলে তুমি স্টোনের অর্ধেক খবর জেনেছো কিন্তু কিভাবে? বিস্তারিত বলো।
> আমাকে অচেতন ভেবে লোকগুলো বলছিল, এই মেয়েটার খবর করে স্টোনের পার্টির সঙ্গে কথা বলবো। স্টোনটা বিক্রি করলে আমরা কোটিপতি হয়ে যাবো। আলমগীর গেছে স্টোন দেখাতে।হয়তো আজকের মধ্যে বিক্রি হয়েও যেতে পারে। এসব বলছিল।
> তুমি বুঝলে কিভাবে যে তোমার স্টোন নিয়েই কথা বলছে?
> কিভাবে চুরি করেছে সেসব ওরা বলছিল।সেখান থেকে ফিরে আমি কয়েকজনকে পাঠিয়েছিলাম ওটা উদ্ধার করতে। কিন্তু ওরা বলল স্টোন পাওয়া যায়নি। হয়তো বিক্রি হয়ে গেছে। কে বা কারা নিয়েছে সেসব খবর লিক হয়নি।
> কাকে কাকে পাঠিয়েছিলে?
> ডাক্তার তীব্রকে আর হোসেলীকে।
ডাক্তার তীব্রের নাম শুনে জুনায়েদ ভ্রু কুচকে ফেলল। ছেলেটার কাজকর্ম এই জন্য রহস্যময় লেগেছিল। এখান বুঝলো কাহিনী কি। জুনায়েদ নিজেকে স্বাভাবিক রেখে বলল,
> ডাক্তার তীব্র তোমার সম্প্রদায়ের?
> হুম। আমাকে সাহায্য করছিল। আপনার সঙ্গে আমার বিয়ের সময় ও এখানে ছিল না। জানতো না বিয়ের খবর। যখন আপনি আমাকে ওই লোকগুলোর হাতে তুলে দিলেন তখন ও এসেছিল। বাবা মার থেকে খবর নিয়ে আমাকে দেখতে। ও আপনার পাশে বসে ছিল আপনি দেখতে পারেননি।
> ইন্নালিল্লাহ কি একটা বাজে বিষয়। লজ্জাজনক কাজকর্ম করেছি। আমি অনুতপ্ত তোমার কাছে অপরাধী হয়ে গেলাম। তুমি কি এখনো রেগে আছো আমার উপরে?
> হুম অনেক
জুনায়েদ নীলুকে নিজের সঙ্গে জড়িয়ে নিয়ে ওর চুলে মুখ লুকিয়ে নিশ্বাস ফেলল। নীলু চুপচাপ চোখ বন্ধ করে আছে। প্রিয়জনের কাছাকাছি থাকার অনুভূতিটা অনুভব করতে চাইছে। হাজার বছর বেঁচে থাকার চাইতে অল্প সময় তৃপ্তি নিয়ে মৃত্যুটা বেশি সুখের। জুনায়েদ ওকে আজীবন মনে রাখবে কষ্ট পাবে। ওর কথা মনে করে চোখের পানি ফেলবে এটা নীলুর জন্য সুখের মনে হচ্ছে। হয়তো স্বার্থপরের মতো চিন্তাভাবনা তবুও হৃদয়ে কেমন সুখ সুখ অনুভব হচ্ছে। নীলু সিদ্ধান্ত নিলো ওসব স্টোন টিস্টোনের খোঁজ খবর বন্ধ করে এই কয়েকদিন জুনায়েদের সঙ্গে চুটিয়ে সংসার করবে। সংসারজীবনের স্বাদ গ্রহণ করবে। হৃদয় কানাই কানাই পূর্ণ হয়ে যাবে তারপর আর কোনো চাওয়া থাকবে না। নীলুকে চুপচাপ দেখে জুনায়েদ মুখ তুলে বলল,
> তীব্র লোকটাকে কেমন অদ্ভুত লাগে। আচ্ছা ওই লোকটা তোমার সঙ্গে গেম খেলছে নাতো?
নীলু চোখ বন্ধ করেই উত্তর করলো,
> কিসের গেম?
> আরে ধরে নাও স্টোন সেদিন রাতেই ও নিজের দখলে নিয়ে নিয়েছে। এখন তোমাকে পাওয়ার জন্য চেষ্টা করছে। আমার যতদুর ভাবনা ছেলেটা তোমাকে পছন্দ করে। ও চাইছে তুমি স্টোনের জন্য ওর হয়ে যাও।
নীলু দ্রুত জুনায়েদকে ছাড়িয়ে ওর মুখোমুখি হয়ে ভ্রু কুচকে বলল,
> হতেও পারে তবে স্টোন আমাকে ছাড়া অচল। ওটার ক্ষমতা শুধু আমার কাছে আসলেই প্রকাশ পাবে। তাছাড়া তীব্র ভাইয়া আমাকে পছন্দ করে ক্ষতি কেনো চাইবে?
> তোমার জ্ঞানকাণ্ড যে খালি এটা আমার অজানা নেই। যাইহোক ওসব ছাড়ো বাইরে লোকজন এসেছে যাবেনা দেখা করতে?
নীলু নড়াচড়া করে সোজা হয়ে বসে বলল,
> আজ থেকে আমি পুরোপুরি শুভ্র ভাইয়ার বিয়েতে অংশগ্রহণ করছি।সঙ্গে আপনার দায়িত্ব নিবো। শাড়ি পড়তে মানা করতে পারবেন না কিন্তু।
জুনায়েদ ওর চোখের পাপড়ি টেনে দিয়ে বলল,
> বউ সাজতে চাইছো ভালো কথা ওসব শাড়ি টাড়ি পড়তে হবে না। হোচট খেয়ে পড়বে তখন সম্মান যাবে আমার।
নীলু মুখ ফুলিয়ে উঠে গেলো। এই লোকটার সঙ্গে ওর অতিরিক্ত প্রেম জানি ভাগ্য সহ্য করতে পারেনা। কিছুক্ষণের মধ্যেই ঝগড়া লেগে যায়। নীলু দ্রুতগতিতে একটা শাড়ি নিয়ে বাথরুমে চলে গেলো। জুনায়েদ ল্যাপটপ রেখে বাইরে গেলো।
ডাইনিং রুমে সকাল সকাল সব জড় হয়ে আড্ডা দিচ্ছে। জুনায়েদ চুপচাপ চা খাচ্ছে আর গল্প শুনছে। অভ্র গল্প করছে বাকিরা শুনছে। কোন দেশের কোন রাজকন্যার গল্প।এই ছেলেটাকে ওর পছন্দ না। কিন্তু এই বাড়ির সবার পছন্দের। লামিয়া জুনায়েদের মামাতো বোন। চাচাতো ভাইবোনদের মধ্যে তারা, অলি, আফরোজ আরও অনেকেই আছে। গল্পের টানটান উত্তেজনা শুরু হয়েছে। রাজকন্যাকে যে রাজপুত্র ভালোবাসতো তার সঙ্গে বিয়ে না হয়ে রাজা মেয়েকে একটা সাধারণ প্রজার সঙ্গে বিয়ে দিয়ে দিয়েছে। রাজকন্যা নিজের ভাগ্যকে মেনে নিয়ে তার সঙ্গে থাকতে চাই কিন্তু রাজপুত্র সেটা চাই না। সে চাইছে রাজকন্যাকে জোরজবরদস্তি করে অনেক দূরে নিয়ে চলে যাওয়ার।
ভালোবাসার মানুষকে অন্য একজনের সঙ্গে দেখতে সে নারাজ। তাছাড়া রাজকন্যার যোগ্য শুধু রাজপুত্র কোনো সাধারণ প্রজা হতেই পারেনা। জুনায়েদের বিরক্ত লাগছে এইসব আজাড়ে গল্প শুনতে। মগের মুল্লুক পেয়েছে। রাজকন্যা রাজার অসুবিধা নেই আইছে আরেকজন ভালোবাসা দেখাতে। জুনায়েদ কিছু বলতে গেলো তার আগেই লামিয়া বলল,
> ভাইয়া রাজকন্যা রাজা দুজন যেখানে মেনে নিয়েছে সেখানে রাজপুত্র কেনো ঝামেলা করবে। তাছাড়া ভালোবাসা থাকলে কুঁড়েঘরেও সুখ পাওয়া যায়। আমার মনে হচ্ছে রাজপুত্র বেশি বেশি করছে।
অভ্র বেশ বিরক্ত হলো লামিয়ার কথা শুনে তবুও ও নিজেকে শান্ত রেখে বলল,
> আরে জীবন নাটক সিনেমার মতো নাকি? রাজার সঙ্গে প্রজার সম্পর্ক কিভাবে সমান হবে বল? গল্পের মধ্যে কথা বললে কিন্তু আমি আর বলবো না।
অভ্রুর হুমকি শুনে উপস্থিত সকলের ভয় লেগে গেলো। সকলে এক সঙ্গে লামিয়াক বকে দিলো। বেচারি চুপমেরে বসে গেলো। মনে তার হাজারো প্রশ্ন ঘুরাঘুরি করছে। অভ্র সবাইকে থামিয়ে বলা শুরু করলো,
> রাজকন্যা নিলাদ্রি ছিলেন ভীষণ নরম মনের মানুষ। প্রথমে সে স্বামীর সঙ্গে মানিয়ে নিতে না পারলেও দিন যতই গড়ালো ততই সে স্বামীর প্রেমে অন্ধ হয়ে যেতে লাগলো। তার চোখে রঙিন স্বপ্ন,সে নিজের মান সম্মান রাজ মর্যাদা ভূলে যেতে লাগলো। কিন্তু রাজপুত্র তো মানবে না। সে কৌশল করে রাজকন্যার কাছাকাছি চলে গেলো ছদ্মবেশে। রাজকন্যার আশেপাশে থাকার লোভ তাকে পাগল করে তুলল। সে রাতের আধারে রাজকন্যাকে দেখে চোখের তৃপ্তি মেটাই। শুধু সুযোগের অপেক্ষায় থাকে কখন তাবে নিজের করে পাবে। তারপর একদিন সেই সুযোগ আসল। রাজপুত্র একটা যড়যন্ত্র করে…
অভ্রর গল্প থামলো কারণ নীলু শাড়ীর আচল টেনে ঘোমটা দিয়ে খটখট শব্দ করে সিঁড়ি দিয়ে নেমে আসলো। সকলের চোখ সেখানে। নীলু আজ বেশ সুন্দর করে শাড়ি পড়েছে। সঙ্গে হাত ভর্তি কাচের চুড়ি। নতুন বউয়েরা যেভাবে সাজে সেভাবে। জুনায়েদের রাগ হচ্ছে। অভ্র সেদিকে হা করে তাকিয়ে সকলের উদ্দেশ্যে বলল,
> গল্প আজকের মতো বন্ধ আগামীকাল আবারও বলবো। এখন নীলুর হাতের ব্রেকফাস্ট খাবো।
অভ্রর কথা শেষ হলো না। লামিয়া ফটফট করে বলল,
> জুনায়েদ ভাইয়ের বউকে তুমি ভাবি কেনো বলোনা?
অভ্র কটমট করে ওর দিকে তাকাল। এই মেয়েটা বড্ড বাচাল। যখন তখন কথা বলে মুড নষ্ট করে। জুনায়েদ অভ্রুর দিকে তাকিয়ে আছে। এই ছেলেটার সঙ্গে থাকলে কেমন অস্বস্তি হয় কিন্তু কেনো? এটাইও কি মানুষ নাকি তীব্রের মতো অন্য কিছু। জানতে হলে নীলুর সঙ্গে কথা বলতে হবে।
(চলবে)
ভুলত্রুটি মার্জনা করবেন। এক পর্বে গল্পটা শেষ হচ্ছে না। দয়াকরে কেউ কিছু মনে করবেন না।
আসুন নামাজ ও কোরআন পড়ি