Journey part-4

0
520

#Journey

#৪

জেসমিন মাথা থেকে পুরাতন কথা ঝেড়ে ফেলার চেষ্টা চালায়।কিন্তু মায়াবী চেহারার সেলিম এমন এক মিষ্টি চেহারা দৃষ্টি নিয়ে পিঙ্গল রঙের চোখজোড়া দিয়ে ওর দিকে তাকায় যে নিজেকে দূরে রাখতে পারে না।ছেলেটাকে বুকে জড়িয়ে কিছুক্ষন নিজেদের মাঝে গল্পে মেতে উঠে।ওর আধো আধো ইতালীয় ভাষা শুনে খুব মজা পায়।জাফারের দিকে তাকায়,
“ওর বয়স কত?”
“তিন বছর চলছে,মানে দুই বছর চার মাস তিন দিন”
“ওয়াও!দিনও মনে রাখেন?”
“হুম,আমার সবই তো ও!”
“হুম।সেলিম,তুমি কি উর্দু বলতে পার?”
“নো,নুন পুসসো!”
জেসমিন হাহা করে হেসে ফেলে।কথাটা হবে “নোন পোসসো”, কিন্তু সেলিমের সব কিছুতেই বাংলার উ-কার ব্যবহারের অভ্যাস।ওর উচ্চারণগুলো শুনলেই কি ভীষণ আদর আদর লাগে! জেসমিন সেলিমের গালের সাথে গাল ঘষতে থাকে।সেলিম খুব মজা পায়।ও আবার ওর মজার উচ্চারণ দিয়ে বলতে থাকে,
“Aunty sei così dolce” (আন্টি তুমি অনেক মিষ্টি)
জেসমিনও হেসে সেলিমের গাল টেনে বলে,
“Papà, sei così dolce, molto bravo” (বাবা,তুমিও অনেক মিষ্টি,অনেক ভাল)

ওদের দুজনের মিশে যাওয়ার সুযোগে জাফার বেশ কয়েকটা ছবি তুলে রাখে।জেসমিন সেটা খেয়াল করতেই বলে,
“কয়েকটা স্মৃতি সংরক্ষণ করেছি,কিছু মনে করবেন না তো?পারমিশন নেইনি!”
“আরে নাহ,সমস্যা।আরও কয়েকটা ছবি তুলেন আমাদের”
দুজনে মিলে পোজ দেয়,জাফার ছবি তুলে দেয়।এসব করতে করতে স্টেশ্চলে আসে ট্রেন।জেসমিনের ভালো ক্ষুধা পেয়েছে,লাঞ্চ কিনতে বের হতে হবে।জাফারকে জিজ্ঞাসা করতেই সেও খাবার কিনবে বলে জানায়।এবার সেলিম জেসমিনের সাথেই বের হচ্ছে,ওর হাত ধরে রেখেছে আর অনর্গল ইতালীয় ভাষায় বকবক করেই যাচ্ছে।জেসমিনের বেশ মজা লাগছে।জার্নিটা এত ইন্টারেস্টিং হবে,কে জানত!

খাবার কিনের ট্রেনে ফিরে সবাই খাবার খেতে ব্যস্ত হয়ে যায় সেলিম বায়না ধরে আন্টির সাথে খাবে,জেসমিনও খুশি হয়ে যায়।জাফার কৃত্রিম অভিমান দেখায়,
“পাপাকে ভুলে গেছে সেলিম!”
সেলিমও ঝটপট উত্তর দেয়,
“সেলিম পাপাকে ছুটি দিয়েছে।পাপাকে সেলিম সবসময় জ্বালায়,এখন সেলিম আন্টিকে জ্বালাবে।পাপা,এখন তোমার ছুটি”
বয়োজ্যেষ্ঠ দুজন হেসে ফেলে।খাওয়া দাওয়া শেষ হতেই জাফার কথা তোলে,
“জেসমিন,আপনি কিন্তু বলেন নি আপনার আর উনার ঘটনা।আমার খুব শুনতে ইচ্ছা করছে”
“ঘটনা তেমন কিছুই না আসলে।আমরা একত্রে পড়েছি,তখন খুব কাছের বন্ধু ছিলাম।তবে হয়ত ও আমার যতটা কাছের ছিল,আমি ততটা কাছের ছিলাম না।কারণ ওর অনেক কিছুই জানতাম না আমি”
“যেমন?”
“ওর প্রেমিকা ছিল,ওশানা।আমি সেটা জেনেছি তাও আবার ওদের ব্রেকাপের পর আর ইটালী আসার দুমাস আগে।ব্যাওপারটা খুব কষ্ট দিয়েছিল।এত কাহের বন্ধু,অথচ ওর এত ক্লোজ একটা ব্যাপার আমি কোনোদিন জানতেও পারিনি।তবে যেহেতু বিদায়ের একদম আগ মুহুর্তে জেনেছি,তাই তেমন বেশি কষ্ট পাওয়ার সুযোগ আসে নি,তার আগেই সে উড়াল দিয়েছে!”
“ওহ…স্যাড।আমি খুব সরি,আমি। ভেবেছিলাম আপনারা বুঝি খুব কাছের…কিছু মনে করবেন না,আমি অজান্তেই কষ্ট…”
“ধুউউউউর!কষ্টের কি আছে?সে আসলে শুধুই বন্ধু,তানাহয় এত গ্যাপও থাকবে কেন? বাদ দিন।আমার জীবন কিন্তু ওকে ঘিরে আবর্তিত হয়নি,কিংবা আমি ওকে নিয়ে কখনো পড়ে থাকিনি।আমার জীবনে আরো অনেক কিছু ছিল”
“আচ্ছা,ইন্টারেস্টিং তো!Can I hear them?I mean,may I if you want?”
“জানি না,নিজের কথা বলতে ইচ্ছা করছে না,আবার মনে হচ্ছে,বলেই দেই…কেমন ওত সিসিলিতে।ভেনিস কোথায় আর সিসিলি কোথায়!আবার মনে করুন,আমাদের দেখা হওয়ার সম্ভাবনাও তেমন নেই।আপনি আমাকে তাই বলতে পারেন,এতে কিন্তু মন অনেক হালকা হবে।আবার ধরুন, যদি বিশ্বাসের কথা বলেন,তাহলে আপনার কথাগুলোও আমার কাছে গচ্ছিত থাকবে।আমি আপনার পরিচিত কেউ না যে,আপনার কথা কাউকে বলব,বা আপনার একান্ত ব্যাক্তিগত কথাগুলো কারো কাছে বলে আমি উপকারও পাব না।তাই আমার মনে হয় আপনি দ্বিধা ঝেড়ে বলতে পারেন।”

জেসমিন পেপসি স্ট্র দিয়ে টানতে থাকে আর ভাবতে থাকে।জাফার ভুল বলেনি।ওর সাথে কি আবার দেখা হবে?হবে না।আর বললেও বা কি?ও বলবেই বা কাকে?তাছাড়া ছেলেরা মেয়েদের মত পেট পাতলা হয় না!যেটা সত্য সেটাই ব্যাপার।জেসমিন কিছুটা ভরসা পায়।হাতের পেপসির গ্লাস বিনে রাখতে রাখতে বলতে শুরু করে,

“আমার জীবনটা আমাকে দেখলে যেমনটা মনে হয়,ঠিক তার উল্টো। আমি সবসময় হাসিখুশী থাকি,মন খারাপ করি না,মুখ কালো করিনা,কিন্তু আমার জীবনটা অতটাও সুখী না।অবশ্য কারো জীবনই অতটা সুখী হয় না।একটা কথা আছে,মানুষ সুখের আশায় টাকার পিছনে ছুটে,সেই টাকার পিছনে ছুটে চলাই এক সময় সুখ কেড়ে নেয়।আমার জীবনটাও তাই।

আমরা দুই ভাই বোন,ছোট পরিবার।ছোটবেলার অন্তত যত স্মৃতি মনে পড়ে সবটাই সুখের ছিল।বড় হওয়ার পর যত গলযোগ লেগে যায়।আমার বাবার অনেক টাকা পয়সা ছিল,বাবা বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় বড় ইন্ড্রাস্ট্রিয়ালিস্টদের মাঝে একজন ছিলেন।ছিল বলছি কারণ টাকা পয়সা থাকলেও তিনি এখন আর এখানে নেই।বাবা মারা গেছেন প্রায় ১০বছর হয়ে গেছে।সে অনুযায়ী আমাদের জীবনে তেমন পরিবর্তন আসেনি,কারণ ঐ যে,টাকা! বাবা মারা যাওয়ার পর মাও কেমন যেন হয়ে গেল,ছন্নছাড়া। ক্লাব,মহিলা সমিতি,নানারকম সামাজিক কর্মকান্ডে নিজেকে ব্যস্ত করে রাখেন,কিন্তু ওদিকে আমরা দুই ভাই বোন যে,সে খেয়াল যেন মায়ের নেইই।ভাইয়া ব্যস্ত হয়ে যায় নিজের বন্ধু বান্ধব,আড্ডা,ঘুরাঘুরি এসব নিয়ে,আমি হয়ে যাই একা।

আমার বাবা মায়ের সম্পর্কটা খুব মধুর ছিল না,তারা অনেক ঝগড়া করত বিশেষত মা।খুব বাজে একটা পরিস্থিতি মাঝে মাঝে।বাবা মায়ের গায়ে হাত তুলত।মাও চুপ থাকত না,সেও বাবাকে মারত।আমি আর ভাইয়া তখন আমাদের যার যার ঘরে বালিশে কান,নাক মুখ চেপে না দেখার,না শোনার ভাণ করতাম,অনেকটা উট পাখির মত,যেন নিজেরা লুকিয়ে ভাবছি দুনিয়া আমাদের দেখছে না!বাবার মৃত্যুর পর তাই এসব বদলায়ও নি,বরং আরও খারাপ দিকে গেছে।মা মায়ের মত ব্যস্ত,ভাইয়া ভাইয়ার মত ব্যস্ত,আর আমি একা এতবড় বাড়িতে এক গাদা চাকর চাকরানীদের সাথে পড়ে থাকতাম।এভাবে থাকতে থাকতে নিজের মাঝে নিজেই গুটিয়ে যেতে থাকি।তখন মাত্র কলেজে পড়তাম।উঠতি বয়সে একটা মানুষ কত পরিবর্তনের মুখোমুখি হয়,এসব শেয়ার করার জন্য,পরামর্শ চাওয়ার মানুষের দরকার হয়।কিন্তু আমি কাউকে পাইনি।বন্ধু বান্ধবদের সাথে থাকতাম ঠিক,তবে ভেতরে থাকা ক্ষতগুলো কাউকে দেখাতাম না।

ধীরে ধীরে এইচএসসি আসল,একা একাই অনেক পরিশ্রম করেছি।আমার ইচ্ছা ছিল,যে করেই হোক,নিজেকে নিজের মত গড়তেই হবে,সবার উপর জেদ উঠে গিয়েছিল।এতে এক দিক থেকে ভাল হল,এইচএসসিতে খুব ভাল হল, ঢাকা ইউনিভার্সিটিতে চান্স হল। আপনি তো জানেন না হয়ত,এটাকে প্রাচ্যের অক্সফোর্ড বলে। ভার্সিটিতে উঠলাম,জীবন অন্যরকম হয়ে গেছে,আমিও বদলে গেছি।সেখানে যাওয়ার পর অনেক বন্ধু বান্ধব পেলাম,রাইফের সাথে বন্ধুত্ব গাঢ় হল।রাইফের সাথে তো তেমন কিছুই ছিল না,এখনও হয়ত নেই,সবই আমার ভ্রম কিংবা দ্বিধা।

গ্রেজুয়েশনের পর সবাই কেমন যেন ছন্নছাড়া হয়ে গেল,আমরা যারা পোস্ট গ্রেজুয়েশন করলাম,তাদের মাঝে কিছুটা সখ্যতা ছিল।পোস্ট গ্রেজুয়েশনের পর সেটাও উধাও হয়ে গেল। যে যে যার যার রাস্তায় চলে গেলাম,আমি নিজেও ছোট একটা চাকরিতে ঢুকলাম,বান্ধবীরা বেশিরভাগ বিয়ে করে ফেলল।জানি না কিভাবে,ঠিক ঐ সময়ে আমার মায়ের আমাকে নিয়ে চিন্তা করার সময় হল!”

এটুকু বলে জেসমিন নিঃশ্বাস নিয়ে থামে।ভ্রু কুঁচকে ও নখের দিকে তাকিয়ে আছে খুব মনোযোগ দিয়ে,যেন বাকি গল্পটুকু এই নখের ভেতর আছে।জাফার একটু আনইজি ফিল করছে,জেসমিন কি ধ্যানে চলে গেল?ওর ধ্যন ভঙ্গ করবে নাকি? ওদিকে জেসমিন এমন করে চোখ নিচু করে চুপ করেই আছে।এটা মূলত ওর অভ্যেস,কথা বলতে বলতে যখন নার্ভাস হয়ে যায়,সিদ্ধান্তহীনতায় ভোগে,তখন এরকম দুম করে চুপ হয়ে যায়।জেসমিন নিজে থেকেই হুট করে হেসে ফেলে।জাফার চিন্তায় পড়ে যায়,এই মেয়ে হুট করে কোথায় যেন ডুব দেয়,আবার হুট করে স্বাভাবিক হয়ে যায় কেন! ওকে হাসতে দেখে কিছুটা স্বাভাবিক কন্ঠে জিজ্ঞাসা করে,
“তা,আপনার মা আপনার কোন বিষয় নিয়ে হুট করে এত মনোযোগী হল বললেন না?”
জেসমিন স্কার্ফ ঠিক করতে করতে বলে,
“ওহ,হ্যাঁ,মা…কি যেন বলছিলাম?… হুম,আমাকে খেয়াল করার কথা।মায়ের হঠাৎ মনে হল আমি বড় হয়ে গেছি, আমার বিয়ে দেয়া দরকার,এবং এটা তারই দায়িত্বের মাঝে পড়ে! শুরুতে আমি খুব অবাক হলেও কিছুদিন পর একটা ভালো লাগা কাজ করছিল,মায়ের শেষ পর্যন্ত আমাকে নিয়ে ভাবার সময় হল!একদিন মা আসল,এসে পাশে বলল, তোর জন্যে একটা ছেলে দেখেছি,সোহানা ভাবীর বোনের ছেলে।ছেলের অনেক টাকা,জনতা ব্যাংকে চাকরি করে,বাবা সাকসেসফুল বিজনেসম্যান। ছেলের সব দিক থেকে ঠিকঠাক… এরকম করে করে ছেলের ব্যাপারে অনেক কিছু বলে ফেলল।আমি ভাবলাম,ছেলে নিশ্চয়ই অনেক ভাল।চিন্তা করলাম,এই ছেলের সাথেই সব সেটআপ করব।তার উপর মা এত দিন পর বলছে,তার কথা কিভাবে ফেলি!আমিও মনস্থির করে ফেললাম।”

জাফার একটু থামাল,
“আপনাদের কি বিয়ে হয়েছিল?”
জেসমিন রহস্য করে বলল,
“মাত্র তো শুরু!এখনও আরো অনেক কিছু ঘটা বাকি!”
ওদের কথা বলায় ব্যঘাত ঘটাতেই সেলিম জেসমিনের কাছে এসে বলল,
“আন্টি,আমি তোমার সাথে ঘুমাব!”
“আচ্ছা বাবা,আসো,আমার পাশে বসো”
“না,আমি কোলে ঘুমাব”
জাফার সেলিমকে ডাকে,
“বাবা,আন্টিকে ডিস্টার্ব করে না,আসো,পাপার কাছে আসো”
“না!আমি আন্টির কাছেই ঘুমাব”
জেসমিন হেসে সেলিমকে কোলে তুলে নেয়।ওর কোলে বসে ওর গলা জড়িয়ে ঘুমানোর চেষ্টা করে ছোট মানুষটা।জেসমিনের খুব ভালো লাগে,সেলিমের কাছ ছোট বাচ্চার মিষ্টি একটা ঘ্রাণ আসছে।ওর কপালে চুমু খেয়ে বুকের সাথে চেপে ধরে।কিছুক্ষণ পর সত্যি সত্যি বাচ্চাটা ঘুমিয়ে পড়ে।মাশাল্লাহ, কি শান্ত একটা বাচ্চা! জাফারের কোলে তখন ওকে দিয়ে দেয়।ছেলেকে পাশের সিটে শোয়াতে শোয়াতে জাফার বলে,
“আপনার কথা কিন্তু শেষ হয়নি।”

জেসমিন একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে,জাফারকে কি সব বলবে?নাকি কিছু গোপন করবে?মন বড় দ্বিধায় ভুগছে।

চলবে…

লেখনীতে, #AbiarMaria

**সরি দেরী করার জন্য,খুব ব্যস্ততা যাচ্ছে ইদানিং***

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here