Journey part-7

0
419

#Journey

#৭

জাফার চোখ দুটো বড় বড় করে তাকিয়ে আছে,জেসমিনের কথা বলার অপেক্ষা করছে।

“তারপর আর কি!আমি তার মেয়ে হয়েও তার কাছে ধোঁকা খেতে পারি,কিন্তু আমি মেয়ে হয়ে তো মায়ের সাথে তেমন করতে পারি না!ছোটবেলা থেকে একটা জিনিস বাবা আমার ভেতর গেঁথে দিয়েছিলেন,বাবা মা যতই খারাপ হোক,তারা যদি দেহ ব্যবসাও করে,তবুও সন্তান তাদের সাথে টু শব্দটাও করতে পারবে না! ইসলাম আমাকে এসবই শেখায়।তাই তখন যতই রাগ থাকুক,তখন কাজের লোক ডেকে,ড্রাইভারকে ডেকে মাকে নিয়ে হাসপাতালে যাই।মা তখন ইয়াবা খেয়েছিলেন একসাথে পাঁচটা,তার উপর নেশাগ্রস্ত অবস্থায় হতাশ হয়ে হাতের রগ কেটে ফেলেন।যার ফলে হাত থেকে রক্ত তো গেছেই,নাক মুখ দিয়েও রক্ত গেছে অনেক।মাকে নিয়ে ডাক্তাররা দুইদিন অনেক কষ্ট করে,তৃতীয় দিন মায়ের জ্ঞান ফেরে।মায়ের শোচনীয় অবস্থায় ভাইয়াকেও ডেকেছিলাম।ভাইয়া প্রথমে না আসতে চাইলে যখন জানালাম,এ যাত্রায় হয়ত সে আর থাকবে না,তখন চলে আসে।মায়ের জ্ঞান ফেরার পর নার্স এসে বলে,মা নাকি আমাদের খুঁজছে।

কেবিনের ভেতর ঢুকার পর মা আমার আর ভাইয়াকে ইশারা করেন।মাকে দেখে তখন একটা নিরীক্ষা চালানো রোবট মনে হচ্ছিল,নাকে মুখে সহ শরীর কত জাগায় কত তার,নল লাগানো,শরীরে এম্নিতেই তেমন মাংস ছিল না,দুদিনে যা ছিল তাও নাই হয়ে গেছে।মায়ের হাত ধরতেই তার চোখ থেকে পানি ঝরছিল,আর ঠোঁট কাঁপছিল।সে মাফ চেয়েছিল সেদিন আমাদের কাছে।তারপর বলেছে,বাবার সবকিছু যেন আমরা যেটুকু পারি দেখে রাখি,তার মত না হই।তারপর আমাকে কাছে ডেকে কানে কানে বলেছিলেন, তোমার জন্য ব্যাংকের ভল্টে একটা জিনিস আছে,সেটা তুমি নিও।ভেবেছিলাম তোমাকে দিব সেটা তোমার বিয়েতে,কিন্তু তা আর হল না।নিজ হাতে তোমাকে আমি শেষ করে দিলাম।আমাকে ক্ষমা করে দিও।

এগুলোই মায়ের শেষ কথা ছিল।আমার আর ভাইয়ার হাত ধরা অবস্থায় সে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করে।”

জেসমিন জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে আছে।শেষ বিকেলের শেষ রোদটাও চলে যাচ্ছে,কিছুক্ষন পর সন্ধ্যে নামবে ধুপ করে।জাফার খুঁজে পায় না কি বলবে।জীবন কি এতটাও বিচিত্র হতে পারে?একটা মাও বুঝি এমন হয়?আর সেই মায়ের সন্তানেরাও এত আলাদা হয়?জাফারের খুব খারাপ লাগে,আহ!মেয়েটা মায়ের আদর পেল না কোনোদিন!

জেসমিন জাফারের কাছে অনুমতি নিয়ে নামায পড়ে নেয়,আর ওকেও তাড়া দেয়।হোক জার্নি,তার মানে তো এই নয় যে নামায ছেড়ে দিতে হবে! দুজনেই ইশারায় নামায আদায় করে।নামাযের পর মুনাযাত ধরে আপনা আপনি জেসমিনের চোখ থেকে পানি ঝরতে থাকে।কেন যেন ছোটবেলার মায়ের সাথে কাটানো সব মধুর স্মৃতিগুলো আর মায়ের শেষ দৃশ্যটুকু মনে পড়ছে,মনের ভেতর সেটা বিরাট ঝড় তুলছে।মা কোথায় আছে এখন?স্বর্গে?নাকি নরকে?নাহ,মাকে ভালোবাসার একটু সুযোগ তো আল্লাহ দিতে পারত,তাই না?কেন দিল না?হাজার হোক,ভাল কিংবা খারাপ হোক,মা তো মাই।মায়ের জায়গা কেউ কখনো নিতে পারে না।মাকে যখন ওর ভাইয়া মাটি দিচ্ছিল,জেসমিন দূর থেকে মুখে কাপড় চাপা দিয়ে দেখছিল।সারাজীবন নিজেকে সবার সামনে উন্মুক্ত রাখা মা আজ পরিপূর্ণ পর্দায় ঢাকা।না সে মেয়েকে শিখিয়েছিল,না নিজে কিছু মেনেছিল।যখন সব শেষ,আত্মার পরলোক গমনের সময় চলে আসল,তখন যদি কেউ মাফ চায়,হবে?তাতে কাজ হবে? জেসমিনের খুব ইচ্ছে হচ্ছিল সেদিন মাকে জোর করে নিয়ে আসতে,মাকে বুক দিয়ে আগলে রেখে অনেক ভালোবাসতে,দেখাতে ভালোবাসার কত শক্তি!তাকে ভালো পথে আনতে,তাকে অন্ধকার থেকে মুক্তি দিতে,
মুক্তির পথে আরো একটা পাপে পূর্ণ আত্মাকে আহবান জানাতে,কিন্তু হায়!সময় সেখানেই শেষ!

মনে পড়তে থাকে,মা মারা যাওয়ার পর রুবায়েতের বাবা একদিন ওদের বাসায় আসে।জেসমিনের সামনে বসে পাইপ ফুঁকতে ফুঁকতে বলেন,
“তোমার নষ্টা মা তো টাকা নিয়ে কবরে ঢুকে গেছেন,তা তার মত তোমারও কি সেদিকে হাঁটার ইচ্ছে আছে নাকি,এ্যঁ!”
এই ছোটলোকের কথা শুনে জেসমিনের কান গরম হলেও কিছু করার নেই,হাজার হোক,চার কোটি টাকার গরমে সে তো যা তা বলতেই পারে,এটাই তো সমাজের নিয়ম! জেসমিন দাঁতে দাঁত চেপে সেদিন উত্তর দিয়েছিল,
“আমার মা নষ্টা,সেটা ঠিক আছে,সাথে আপনার ছেলে হচ্ছে এসব নষ্টা তৈরির কারিগর! যদি আমি আমার মায়ের মতই হতাম,তবে সেদিন আপনার ছেলে মাথা না ফাটিয়ে বিছানায় গিয়ে নষ্টামি করতাম।যেহেতু করিনি তাই আমাকে মায়ের সাথে তুলনা দেয়ার মত ঔদ্ধত্য দেখাবেন না।…আর যেখানে টাকার কথা,সেটা আগামী এক মাসের মধ্য পেয়ে যাবেন!”
রুবায়েতের বাবা খলিল আহমেদ মুখ খিঁচিয়ে বলেছিলেন,
“তোমার মত মেয়েরা আমার ছেলের কাছে আসে আর যায়!চাইলেই তোমার মায়ের মত তোমাকেও কিনতে পারি,তাই চিন্তা করে কথা বলবা! আর বেশি কথা বললে সেই এটেম্পট টু মার্ডার কেসে একেবারে ফাঁসিয়ে দিব!”
“আপনার হুমকি আপনার পকেটে রাখুন।ছেলের চরিত্র যে কত খারাপ,তা আমাকে না জানিয়ে ঐ রাতের বেলা বেরোনো মহিলাগুলোকে বলেন।আমার মত মেয়েদের আপনাদের মত বড়লোকের মত দেখতে ছোটলোকেরা কেনার কথা ভাবে,কিন্তু আমাদের পা ধরার যোগ্যতাও আপনাদের নেই!এখন সময় থাকতে আসুন!”

ভালোরকমের বাকবিতণ্ডার ঐ লোক ঘর থেকে বিদায় হয় সেদিন।জেসমিন ভাবে,মা চলে গেলে কি হবে,মায়ের রেখে যাওয়া আপদ কবে যে যাবে! তাই সে আর ওর ভাইয়া,আলআমিন মিলে একমাসের মাঝে ওদের বিশাল বাড়িটা বিক্রি করে সবার দেনা শোধ করে দেয়।আর যা বাকি থাকে,তা দুই ভাই বোন ভাগ করে নেয়।সেখান থেকেই টাকা নিয়ে জেসমিন চলে আসে ইটালি।প্রথমে ভেবেছিল দেশেই থাকবে।কিন্তু ওর ভাইয়া বিয়ে করেছে,তাই তারও একটা প্রাইভেসি আছে।ওদিকে রুবায়েত মাঝে মাঝে সুযোগ পেলেই ওকে খুঁজে বের করে জ্বালাত,রাস্তা ঘাটে উল্টো পালটা মন্তব্য ছুড়ে দিত।তখন রাস্তার মানুষগুলোও ওর দিকে কেমন কেমন করে যেন তাকাত।সব মিলিয়ে বাংলাদেশের জীবনটা ওর বিষিয়ে উঠে।তাই সব ঠিক ঠাক করে বিদেশে পাড়ি দেয়ার সিদ্ধান্ত নেয়,যার ফলে আজ ও সিসিলির পথে।

আকাশ জুড়ে এখন রাত নেমেছে,ঘন নীলচে রাত।সেই রাতের আকাশে ফুটকির মত তারা কতক দেখা যাচ্ছে।ছোট থেকেই রাতের আকাশকে কেন যেন জেসমিনের এক বিশাল চাদর মনে হত,যে চাদরের অনেক অনেক রূপ।ট্রেনের জানালা দিয়ে যখন ও আকাশ দেখছিল,তখন ওপাশে সেলিম উঠে যায়।ঘুম ভেঙে সে বাবার কাছে এটা ওটা আবদার জানায়।এবার বলে এটা খাবে,আবার বলে ওটা খাবে,ট্যাব চায়,কখনো ওয়াশরুমে যেতে চায়,আবার ট্রেনের ভেতর হাঁটাহাঁটি করতে চায়।জেসমিন মুগ্ধ চোখে এসব দেখতে থাকে।কি নিষ্পাপ একটা বাচ্চা! দেখলেই যে এত আদর আদর লাগে ওকে,মন চায় বুকে চেপে আদরের পর আদর করতেই থাকে।

ধীরে ধীরে সময় কাটছে,জেসমিন আর জাফার টুকটাক কথা বলে।জেসমিন বইয়ের দিকে মনোযোগ দেয়।বই পড়তে পড়তে কখন যে ঘুমের দেশে তলিয়ে যায়,নিজেও বুঝে না।হুট করে সামান্য একটা শব্দে ঘুম ভেঙে যায়,দেখে জাফার দাঁড়িয়ে উপরের কম্পার্টমেন্টে হাত দিয়ে কি যেন খুঁজছে।
“কি করছেন?”
“আমার ব্লাংকেটটা খুঁজছি,বেশ ঠান্ডা লাগছে”
বলতে না বলতেই ওর ব্লাংকেট হাতে ঠেকে।সেটা গায়ে জড়িয়ে জেসমিনকে বলে,
“আচ্ছা,আপনি সিসিলির কোথায় যাবেন?মানে আপনার সেই বন্ধু,কি যেন নাম?…উম…রাইফ!উনি কোথায় থাকেন?”
“আমি আসলে জানি না সেসব”
“সে কি!আপনি কি সারা শহর উনাকে খুঁজবেন নাকি!তাহলে কিন্তু এক সপ্তাহ না,দু মাসেও পাবেন না!”
“দেখি,এখনো বুঝতে পারছি না কি করব”
“তা উনার খোঁজ পেলেন কি করে?”
“আমার এক বান্ধবী আছে,সাবিনা।ও অনেক মিশুক,সবাইকে খুঁজে বের করে,তাদের সাথে যোগাযোগ করে,তাদের বর্তমান অবস্থা নিয়ে বলা যায় এক প্রকার গবেষণা করে ফেলে।আমাদের সার্কেলের কাউকে যদি খুঁজে না পাওয়া যায়,তাহলে সাবিনাকে জিজ্ঞাসা করলেই হবে,ও সব জানে!ওর কাছে থেকেই জেনেছি,মানে আমাকে ও নিজেই জানিয়েছে”
“বাহ!”
“একদিন আমাকে ফেসবুকে নক করে বলে,রাইফের সাথে নাকি কথা হয়েছে।রাইফ নাকি আমাকে মনে করে খুব।
এরকম একটা টেক্সট দেখে কেউ কি চুপ করে থাকতে পারে?আমিও দ্রুত ওকে রিপ্লাই দেই।তখন ও বলে,আমাদের সবার কথা নাকি মনে পড়ে রাইফের,বিশেষ করে আমার।আমার নাকি ওর সাথে যোগাযোগ করা উচিৎ,ও নাকি এখনও কারো সাথে এংগেজ হয়নি। আমিও কত বোকা দেখুন জিজ্ঞাসাই করিনি,আমাকে মনে করে বলতে কি হিসেবে মনে করে!উলটো এসব দেখে কি না কি ভাবতে শুরু করে দিয়েছি! কিন্তু আমার রাইফকে নক দেবার মত সাহস হয়নি,একদমই হয়নি।এভাবে পুরো তিন মাস ওর জন্য অপেক্ষা করেছি,কিন্তু নক পাইনি।ওকে নিয়ে এই তিন মাস কি কি ভেবেছি!সবচেয়ে বেশি ভেবেছি,ও আমাকে নক দিলে আমি কি উত্তর দিব,কিন্তু সেটাই এখনও হল না!”

জাফার গলা ছেড়ে হেসে ফেলে,ওর হাসিতে আশেপাশের দু তিন ঘাড় ঘুরিয়ে তাকায়।
“কি বলেন!আপনি এত ভাবলেন,কিন্তু নক দেয়ার সাহসই পেলেন না!এত সাহসী আপনি, অথচ এদিক থেকে তো দেখছি…!”
“সত্যি বলতে কি,এত দূরত্ব আমাদের মাঝে এখন,আমি ওর সাথে কিভাবে কথা শুরু করব,সেটাই না জানি না!তাই আর হয়নি।শেষ পর্যন্ত ভাবলাম,কেন ওর শহরেই চলে যাচ্ছি না আমি!দেখাও হবে,কিছু না কিছু বলা হবে,সাবিনার কথাগুলোর যাচাইও হবে!দেখব,আসলে রাইফ কি ভাবে আমাকে নিয়ে!”
“আচ্ছা,যদি ভুল হয় সব,গিয়ে দেখেন রাইফের গার্লফ্রেন্ড আছে,তখন?”
“তখন আর কি!একটা গিফট দিয়ে আমি আবার আমার কাজে চলে যাব!ওর জন্যে কি আর জীবন আটকে থাকবে?তবে কেন যেন মনে হচ্ছে,এরকম কিছুই হবে না”
“সে যাই হোক,আপনি কোথায় খুঁজবেন আপনার বন্ধুকে,তিনি কোথায় থাকেন,সেটা আগে বের করেন।তানাহলে… এক কাজ তো করতে পারেন! আপনার সেই সবজান্তা বান্ধবীকেই তো কাজে লাগাতে পারেন!সেই খুঁজে বের করবে!”
“আরে গুড আইডিয়া!আমার আগে কেন মনে আসল না?!এখনই কল দিচ্ছি!”

জেসমিনের সাবিনার নাম্বারে ডায়াল করছে।যদিও সাবিনা এখন ফ্রি আছে কিনা সন্দেহ,কিন্তু তবুও ওকে যে লাগবে,হাজার হোক,জেসমিনের এরপরের গন্তব্যটা তো ঠিক হওয়া চাই!!

চলবে…

লেখনীতে, #AbiarMaria

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here