Journey part-8

0
404

#Journey

#৮

সাবিনার নাম্বারে রিঙ হচ্ছে,কিন্তু ওপাশ থেকে শুধুই টুট টুট রিঙিং টোন বাজছে,কোন মানুষের কন্ঠস্বর শোনা যাচ্ছে না।আরো দুতিনবার ডায়াল করার পরও যখন সাবিনা কল রিসিভ করে না,তখন জেসমিন জাফারের দিকে তাকিয়ে একটা হাতাশ ভাব মুখে ফুটে উঠে।যেন জিজ্ঞাসা করছে,এখন কি করব?

“আপনি এক কাজ করেন,উনাকে ফোনে,ফেসবুকে,কয়েক যায়গায় মেসেজ করে রাখুন।আর যাই হোক, মেসেজ দেখে তো সে ইগ্নোর করবে না”
“ভাল কথা বলেছেন!”
জেসমিন ব্যস্ত হয়ে যায় সাবিনাকে মেসেজ করতে।ওদিকে আকাশ কালো করে রাত নেমে গেছে।জেসমিনের অস্থির অস্থির লাগছে,যে কাজে ঘর থেকে বের হয়েছে,তার সুরাহা হবে তো?
“জানেন,এই ছেলে রাইফ আমাকে আদৌ পছন্দ করে কিনা আমি তো বুঝতে পারছি না।এখন কি করলে শিওর হওয়া যায়?”
“মমমমম… আমার মনে হয় সরাসরি জিজ্ঞাসা করাই ভালো হবে।শুধু শুধু রাখ ঢাক করে লাভ কি?আর আজকাল মেয়েরাও ভালোবাসা নিবেদনে ছেলেদের থেকে পিছিয়ে নেই।তাই মেয়ে হয়ে যদি আপনি বলেন,তাতে ক্ষতি কি?”
“কি যে বলেন না আপনি! আমি আর প্রেম নিবেদন?তাও এত পুরনো বন্ধুর কাছে?!অসম্ভব!”
“আচ্ছা,তাহলে আরো উপায় আছে অবশ্য…”
“যেমন?”
“আপনি উনাকে বলতে পারেন,আপনি বিয়ে করেন নি,আর করার ইচ্ছাও নেই।তবে কেউ আপনাকে পছন্দ করলে সেটা ভেবে দেখবেন।তখন খেয়াল করবেন তার মুখের এক্সপ্রেশন কেমন, সে কি করছে,চাহনি কেমন। যদি সেও আপনাকে পছন্দ করে থাকে,তবে মুখে কিছু বুঝা না গেলেও পরবর্তীতে সে কিছু একটা করবে”
“বাহ!কেয়া বাত হ্যায় জাফার ভাই!তুছছি গ্রেট হো!”
“হা হা হা!”

জাফারের হাসিটা সব জায়গায় ছড়িয়ে পড়ে।দুজন মিলে কিভাবে রাইফকে কি কি বলা যায় সে নিয়ে প্ল্যান বানায়।রাইফ এখন কোন এলাকায় থাকতে পারে,কি করছে এখন,ওর পছন্দ কি কি,এসব নিয়েই গবেষণা করতে থাকে।মূলত ওদের দুজনের কথা বলার মূল বিষয় ‘রাইফ’!!

কিছুক্ষণ বাদে দুজনেই ঘুমিয়ে পড়ে।তন্দ্রাচ্ছন্ন রাতের আঁধারে বিকট শব্দে জেসমিনের ফোন চিৎকার করতে শুরু করে,আর জেসমিন তাড়াহুড়ো করে কল রিসিভ করে।
“হ্যালো!!”
ওপাশ থেকে সাবিনার কন্ঠ শোনা যায়।বেয়াদব মেয়েটা এতক্ষণে কল ব্যাক করার সময় পেল?এগুলো কোন কথা হল?? বিরক্ত হয়ে বলে,
“তুই আর সময় পেলি না?জানিস না এখন এখানে রাত?!”
“তো তাতে কি!বান্ধবী আর প্রেমিক,এদের সাথে রাত আর দিন কি?”
“হয়েছে,তোর প্রেমিকের কাছে গিয়ে এসব ঝাড়,আমার কাছে না।…যে জন্যে তোকে কল দিলাম,টেক্সট করলাম,সে কথায় আসি। রাইফের কথা সেদিন বললি না?ওর ব্যাপারে একটু ডিটেইলস ইনফরমেশন দিতে পারবি?”
“ডিটেইলস বলতে কি রকম?”
“ও কোথায় থাকে,কিসে চাকরি করে,কার সাথে এখানে থাকে,ফ্রেন্ড নাকি ফ্যামিলি মেম্বাররাও এসেছে,এসব আর কি!”
“ওহ,আচ্ছা।তা রাইফকে নিয়ে এত আগ্রহ কেন হঠাৎ?সেদিন তো এমন ভাব করলি ওর কথা না শুনলেও তোর চলে,কিন্তু আজ…”
“উফ,তুই এত্ত বেশি কথা কেন বলিস বল তো?কথা কম বলবি সবসময়। ও ইটালি আছে,তাই ভাবছি দেখা করব,অনেক দিন দেখা হয় না দেশের কারো সাথে,তাই,আর কিছু না।এখন বল ইনফোগুলো দিতে পারবি কিনা।না পারলে বাদ দে,আমিই ওকে খুঁজে নিব”
“আরে ইয়ার!এত সেন্টি খাস কেন তুই বল তো? আমি তো এমনিই জিজ্ঞাসা করলাম”
“হুম।এগুলো আমাকে জানাতে কতক্ষণ লাগবে?”
“বেশিক্ষণ না,এক দুই ঘন্টা? আমি দেখি রাইফকে অনলাইনে পাই কিনা।পেলে তো আরো তাড়াতাড়ি পাবি,না হলে একটু সময় লাগবে।”
“ঠিক আছে।দ্রুত চেষ্টা কর।ওকে কিন্তু আবার বলিস না যে আমি এসব জানতে চেয়েছি!আমি ওকে জানাতে চাই না”
“হুম।শোন, আমাকে কিন্তু তোদের ছবি দিবি!ইশ,কত মিস করছি সবাইকে।পৃথিবীর কোন কোন চিপায় তোরা একেকজন লুকিয়েছিস!ভালো লাগে না!তাড়াতাড়ি দেশে চলে আয়।”
জেসমিন হাসে।এই সাবিনাটা সেই আগের মতই আছে,আড্ডা দেয়া ছাড়া ভালোই লাগে না।

সাবিনার কল কেটে সামনে সেলিম আর জাফারের দিকে তাকায়।ছেলেটা বাবার কোলে মাথা রেখে কি নিষ্পাপের মত ঘুমাচ্ছে!ওর কোকড়া চুলগুলোতে হাত বুলিয়ে দেয়ার ভীষণ কড়া লোভ জেসমিনের মনে জেঁকে বসেছে।ফোলা ফোলা গাল গুলো একটু ছুঁয়ে দিতে একটু টেনে দিতে ওর সমস্ত শরীর আঁকুপাঁকু করছে।শেষ পর্যন্ত না পারতে আস্তে করে এগিয়ে ঘুমন্ত সেলিমের গালে আদর করে কপালে ঠোঁট ছোঁয়ায়। বাচ্চাটা আরেকটু ছোট হলে এখন ও জোর করে টেনে বুকে জড়িয়ে নিত।এরকম একটা ছেলে হয়ত এইদিনে ওর নিজেরই হত,কিন্তু ভাগ্যের কারণে হয়নি।মানসিক ভাবে সেটা ও মেনে নিলেও ওর ভেতর লুকিয়ে থাকা মাতৃত্বের অস্তিত্বটা মেনে নেয়নি।তাই তো সেলিমকে দেখলেই ওকে আদর করতে, ওকে কাছে টেনে নিতে অস্থির হয়ে যায়।
সেলিমের দিকে তাকিয়ে এসব ভাবতে ভাবতে কখন যে ঘুমিয়ে পড়ে।

ঘুম ভাঙে জাফারের ডাকে।
“এই যে,সেনোরিতা,ট্রেন থেকে নামবেন না?নাকি এখানেই থেকে যাবেন?”
জেসমিন তাড়াহুড়ো করে সব গুছিয়ে নিতে শুরু করে জাফার ওকে সাহায্য করে।এরপরে সব লাগেজ নিজে নিয়ে সেলিমের হাত ধরে ওকে আনতে অনুরোধ জানায়।ট্রেন থামলে ওরা তিনজনই নেমে পড়ে স্টেশনে।সেখানকার ক্যাফেটেরিয়াতে কিছু খেয়ে ফ্রেশ হয়ে নেয়।যদিও প্রায় ১৬ ঘন্টার যাত্রা ছিল,এখন সেটা ২২ঘন্টায় ঠেকেছে।হাতের ক্যাপোচিনোতে চুমুক দিতে জাফার জেসমিনকে জিজ্ঞাসা করে,
“আমাদের এরপরের গন্তুব্য কোথায়?”
“আপাতত একটা ভালো হোটেলে উঠব,সেখানে বিশ্রাম নেব,এরপর রাইফকে খুঁজতে বের হব।ত্রাপানি,মার্সালা,এই দুই যায়গার কোন এক যায়গায় রাইফ থাকে,দুই যায়গায়ই খোঁজ নিতে হবে আমাকে!”
“সে কি!আপনার বান্ধবী বলেনি নিশ্চিত হয়ে?”
“ও রাইফকে অনলাইনে পায়নি,তাই সেভাবে ডিটেলস জানতে পারেনি।আর বলেছে,ও নাকি একটা ডিপার্টমেন্টাল স্টোরে আছে,নামটা মনে নেই,তবে লিখা আছে।এটার উল্টোদিকে একটা বিশাল পার্ক আছে।দেখা যাক,ওকে কোথায় পাওয়া যায়!তা আপনারা কোথায় যাবেন সেটাই তো জানলাম না এখনও? ”
“আমরা আবার যাব এগেডিয়ান দ্বীপে,ওদিকে আমার আর লিলির এক বন্ধু থাকে,সেখানে।”
“যাক,তবে আর কি,ওখানে চলে যান।আমি নাহয়… ”
“না না,এভাবে আপনাকে রেখে যাব কি করে?আপনাকে আর রাইফকে এক সাথে রেখে তবেই যাবে!”
“সিরিয়াসলি? না না,এত কষ্টের দরকার নেই।আমার কারণে কেন আপনারা দেরী করবেন?আমাকে হোটেলে উঠতে হবে,থাকতে হবে পুরোপুরি সকাল হওয়া পর্যন্ত,তারপর আমার কাজে বের হব,কিন্তু এতক্ষণ আপনারা কেন থাকবেন!”
“উহু,আপনার কারণে থাকব না,আমি নিজেই রাইফকে দেখতে চাই,তাই এটা চাচ্ছি।আমি চাই আপনি তাকে খুঁজে বের করুন,আপনাদের নিজের চোখে দেখব,এরপর যাব।প্লিজ,মানা করবেন না,আমি খুবই আগ্রহী এ ব্যাপারে!”
সেলিম জেসমিনের জামা ধরে টানতে টানতে বলে,
“Per favor,vado!” মানে “প্লিজ,আমি যাব!”
জেসমিন হেসে সেলিমকে কোলে নিয়ে মাথা নাড়ে,আর মাথা নাড়ানোই সম্মতির লক্ষণ।

একটা টেক্সি নিয়ে ওরা বেরোয় ত্রাপানির উদ্দেশ্যে,ড্রাইভারকে ভাল দেখে হোটেলে নিয়ে যেতে বলেছে।তবে ওখানে কোথায় কোথায় খুঁজবে ঠিক বুঝতে পারছে না,তাই জাফার এব্যাপারে ড্রাইভারের সাথে আলোচনা চালানোর চেষ্টা করে যাচ্ছে।জাফার যতটা পারছে,ড্রাইভারকে বুঝিয়ে বলার চেষ্টা করছে,ঐ ব্যাটা কি বুঝল আল্লাহ জানে,শুধু মাথা নাড়ায় আর বলে,
“Capito,capito! Ma non lo so!”
মানে, “বুঝেছি বুঝেছি,কিন্তু আমক তো চিনি না!” হতাশ হয়ে ঠোঁট উলটে জাফার জেসমিনের দিকে তাকায়।

শহরের ভেতর দিয়ে যখন টেক্সি যাচ্ছে,জেসমিন মুগ্ধ চোখে তাকিয়ে থাকে চারপাশে।পাহড়ী এই শহরটাকে ভোরের আবছা আলোয় ভীষণ আকর্ষণীয় মনে হচ্ছে,যেন একটা রূপকথার বই থেকে উঠে আসা রাজ্য।কিছুক্ষণ পর যখন সূর্যটা পুব আকাশে উঁকি দিবে,তখন এই শহরটা কেমন রূপ ধারণ করবে,ভেবেই জেসমিনের মন নেচে উঠছে।হোটেলের সামনে আসার পর দ্রুত ওরা নেমে যায়।তিন তলা হোটলটা হলুদ রঙের,তবে খুব গোছালো।রিসিপশনে গিয়ে ওরা দুটো ঘর বুক করে নেয়।তারপর যে যে যার যার ঘরে গিয়ে বিশ্রাম নিতে শুরু করে।

জেসমিন শাওয়ার ছেড়ে ঘরে এসে ধপ করে নরম বিছানায় গা এলিয়ে শুয়ে পড়ে।চোখ বুঁজে ভাবতে থাকে, রাইফকে কোথায় কোথায় খুঁজব আমি? যদি ওকে না পাই?যদি পেতে পেতেই আমার এক সপ্তাহ পেরিয়ে যায়?আবার এখানে কি করে আসব? ফোন হাতে নিয়ে রাইফের একটা ছবি বের করে তাকিয়ে থাকে।আপন মনে মাথা নাড়ায় আর বলে,

“তোমাকে নাহয় নাই বা পেলাম,যে শহরে তোমার নিশ্বাস আছে,সে শহরে আমিও নিশ্বাস নেব,এটাই বা কম কিসে?তবে তোমাকে আমি বুঝতে দিব না কিছুই,জাফারকেও কখনো বলব না,কেউ জানবে না তুমি আমার কাছে কি… আমার বুকে যে তোমার উপর পাহাড়সম অভিমান!”

চলবে…

লেখনীতে, #AbiarMaria

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here