Journey part-10

0
402

#Journey

#১০

জেসমিন আনমনে জানালা দিয়ে তাকিয়ে বাইরটা দেখছে।শহরটা যেন দৌড়ে দৌড়ে ওর পাশ কাটিয়ে চলে যাচ্ছে,আর ও স্থির হয়ে আছে।সব কিছু ওর থেকে ছুটে পালিয়ে গেল,বাবা,মা,ভাই,বাবা মায়ের ভালোবাসা, আনন্দ,বন্ধু বান্ধব,স্বপ্নগুলো, রাইফ…সবাই।আর ও যেন আটকে গেছে এক গভীর কালো গহ্বরে,সেখান থেকে মুক্তির উপায় নেই যেন।ও যতই চেষ্টা করছে,ততই তলিয়ে যাচ্ছে,চোরাবালির মত।জেসমিনের নিশ্বাস বন্ধ হয়ে আসছে,গাড়ির জানালা দ্রুত খুলে দেয় নিশ্বাস নেয়ার জন্য,তবুও বুক ভরে নিশ্বাস নিতে পারছে না।রাইফের চিন্তায় গত কয়েকটা দিন এতটাই ডুবে গিয়েছিল যে এখন ওকে না পাওয়ার চিন্তাটা মাথায় উঁকি দিতেই সব উলট পালট হয়ে যাচ্ছে।

সেলিম জেসমিনের হাত ধরে টানছে,কিন্তু জেসমিন কিছু বলছে না।উইন্ডশিল্ডে হাত রেখে কপালে দুই আঙুল দিয়ে চেপে ধরে চোখ বন্ধ করে রেখেছে,জানালা থেকে প্রবেশ করা বাতাসে ওর স্কার্ফ উড়ছে।জাফার জেসমিনের দিকে তাকিয়ে আছে।বেচারি মেয়েটা।কত দূরের পথ পাড়ি দিয়ে এসেছে এই শহরে,অথচ এখনও সেটা পেলই না! মেয়েটার জন্যে মায়া হচ্ছে,কিন্তু ও আর কি করবে?রাইফকে খুঁজে দেয়ার জন্যে প্রতিদিনই তো ওর সাথে বের হচ্ছে।যদি আজ সিসিলিতে ওর পরিচিত কেউ থাকত,তাহলে ঠিকই রাইফকে ওর কাছে এনে হাজির করত।কিন্তু এটা সম্ভব না। জেসমিনের সাথে রাইফের না দেখা হলে ওরও নিজেরও খুব খারাপ লাগবে।এমনটা নয় যে,জেসমিনের পারিবারিক কষ্টের কথা শুনে ওর করুণা হয়েছে।মূলত একসাথে সময় কাটাতে কাটাতে দুজন মায়ায় আটকে গেছে।মেয়েটার একজন বন্ধু,ভাই,শুভাকাঙ্ক্ষী, যাই বলা যায়,সেই হিসেবে খুব ইচ্ছে হচ্ছে রাইফ আর ওকে একত্র করে দিতে।

সমুদ্র পাড়ে আসতেই জেসমিন দ্রুত টেক্সির দরজা খুলে বেরিয় যায়,যেন কতটা দম আটকানো পরিবেশ এর ভেতর। সমুদ্রের পাড়ে একাই জেসমিন হাঁটতে থাকে,কেমন যেন টালমাটাল অবস্থা। এসব দেখে জাফার দ্রুত টেক্সির বিল চুকিয়ে দিয়ে সেলিমকে নিয়ে দৌড়ে নামে।সেলিমকে নিয়ে জেসমিনের পিছু করতে থাকে।বেচারা সেলিম!বাবার বড় বড় পায়ের সাথে তাল মিলিয়ে কিছুতেই হাঁটতে পারছে না,পড়ে যায় যায় অবস্থা!কিন্তু সেদিকে জাফারের কোন নজর নেই,ছেলেকে এক হাত ধরে টেনে নিয়ে যাচ্ছে বালির উপর দিয়ে।জেসমিন টাল সামলিয়ে চলতে চলতে ধুপ করে এক লোকের উপর পড়ে যায়!এবার জাফার আর অপেক্ষা না করেই সেলিমকে কোলে নিয়ে এক দৌড় দেয়!

ততক্ষণে লোকটা জেসমিনকে ধরে ফেলেছে।জাফার এসেই দ্রু সেলিমকে নামিয়ে জেসমিনকে ধরে।লোকটির দিকে তাকিয়ে বলে,
“আমি খুবই দুঃখিত,আমার বন্ধু খেয়াল করেনি!”
লোকটি মাথা নাড়ায় ওদের কথায় শুধু,এরপর সামনের দিকে আবার হাঁটতে শুরু করে।জাফার দুহাতে ধরে রাখা জেসমিনের দিকে তাকায়,বেচারি সূর্যের আলো থেকে চোখ বাঁচাতে চোখ বন্ধ আছে,আর ভ্রু দুটো কুঁচকে রেখেছে।জাফারের বেশ অস্বস্তি লাগে।একে তো জেসমিন দুম করে ঐ লোকের উপর পড়ে গেল,লোক কি না কি মনে করল,আবার জাফার এই প্রথম জেসমিনকে স্পর্শ করেছে।লোকটার কথা ভাবতেই মনে হয়, তাকে কোথায় যেন দেখেছিল জাফার।কিন্তু কোথায় দেখেছে?ঠিক মনে পড়ছে না।মাথা ঝেড়ে জেসমিনকে এই বালুতেই বসিয়ে দেয়।সেলিম জেসমিনের কাছে গিয়ে ভাঙা ভাঙা শব্দে কিসব যেন বলছে।জাফার আশেপাশে তাকিয়ে দেখে তেমন কেউ নেই ঐ লোকটা ছাড়া।জেসমিনের দিকে তাকাতে গিয়ে দেখে ওর পাশে একটা সানগ্লাস পড়ে আছে।জাফার সেটা তুলে নেয়।লোকটা বেশি দূরে যায় নি।জাফার সেটা তুলে নিয়ে লোকটির পিছনে দৌড়ে যায়।

“সিনর!এটা বোধহয় আপনার! আপনি ভুলে ফেলে যাচ্ছেন!”
জাফারের চিৎকার ঐ লোকের কানে যায়নি মনে হয়। জাফার দ্রু হাঁটে,কিন্তু বালুতে কি খুব জোরে হাঁটা যায়?তবুও চেষ্টা করে।আবার তাকে ডাকে,কিন্তু তার খবর নেই।ব্যাপার কি?ব্যাটা কি বধির নাকি?কাছে এসে কাঁধে হাত দিতেই লোকটা তাকায়।হাঁপাতে হাঁপাতে বলে,
“সিনর!আপনাকে সেই তখন থেকে ডাকছি,শুনতেই পাচ্ছেন না!”

লোকটা ঘাড় ঘুরিয়ে জাফারের দিকে তাকায়।ওর হাতের সানগ্লাস দেখে খুশি হয়ে নেয়।
“অনেক ধন্যবাদ!আমি তো দেখিই নি”
জাফারও ফিরতি হাসি দেয়।লোকটা ওর সাথে হাত মিলিয়ে রওনা দেয় রাস্তার দিকে।জাফারও ফিরে আসে জেসমিনের কাছে।এসে দেখে,ও সেলিমকে জড়িয়ে কাঁদছে,আর বেচারা সেলিম ওর চোখের পানি মুছে দিচ্ছে।জাফার জেসমিনের কাঁধে হাত রেখে হাঁটু মুড়ে বসে,
“একদম ভেব না,আমরা রাইফকে পাবই,আল্লাহই একটা ব্যবস্থা করবে,দেখবে!”
জেসমিন কিছু বলে না,শুধু চুপ করে কাঁদছে।ওর কান্না জাফার সেলিম দু’জনেরই মন খারাপ করে দিচ্ছে।জাফার সমুদ্রের দিকে তাকায়।সেখানে খুব একটা ঢেউ নেই,সমুদ্র আজ ভীষণ শান্ত।কিছু গাঙচিল উড়ছে আর ডাকছে।জাফার সেদিকে তাকিয়ে ভাবে,রাইফকে রাস্তা ঘাটে কোথাও তো আল্লাহ মিলিয়ে দিলে পারত!

আচমকা তড়াক করে লাফিয়ে উঠে জাফার।ওকে এভাবে লাফিয়ে উঠতে দেখে জেসমিন অবাক চোখে মুখ তুলে তাকায়।
“আমি রাইফকে পেয়েছি!”
“মানে!কোথায় পেয়েছেন?! ”
“তুমি যার সাথে ধাক্কা খেয়েছ,সেই রাইফ!”
“কি বলেন জাফার ভাই!”
“সে কি!তুমি খেয়াল কর নি?!”
“না!আমি তো চেহারাই দেখিনি!আচ্ছা,আপনি শিওর ওটা রাইফ ছিল?!”
“আমি কোন ভুল করিনি!তুমি না ছবি দেখিয়েছ?আমি একটু আগে সানগ্লাস ফেরত দিতে গিয়ে ভালোভাবে দেখে নিয়েছি,আমি শিওর!”
“হায় হায়!রাইফ চলে যাচ্ছে তো! রাইফ!এই রাইফ!”
বলতে বলতেই জেসমিন পড়ি কি মরি করে রাইফের পেছন পেছন দৌড় দেয়।ওদিকে জাফার সেলিমকে কোলে নিয়ে দেয় এক দৌড়! যে কেউ এখন ওদের দুজনকে দেখলে ভাবলে,ওরা বুঝি দৌড় প্রতিযোগিতায় নেমেছে।কিন্তু বালুর উপর দিয়ে,তাই কেউ বেশিদূরে যেতে পারছে না।ওদিকে বাতাস বিপরীত দিকে প্রবাহিত হওয়ায় রাইফের কানে কোন ডাকই পৌঁছাতে পারছে না,তাই রাইফ সুন্দর করে একপাশে পার্ক করা গাড়িতে উঠে গিয়েছে।জেসমিন আরো জোরে দৌড় দেয়,যার ফলে ধ্রিম করে বালিতে মুখ থুবড়ে পড়ে ও!

জাফার দৌড়ে এসে জেসমিনকে টেনে উঠতে সাহায্য করে।তারপর দুজন মিলে দৌড় দেয়!কয়েকজন লোক অবাক হয়ে ওদের কান্ডকারখানা দেখছে,একজন আবার মুখে হাত চেপে হেসে ফেলেছে।জেসমিন দুহাত নেড়ে রাইফের দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা করে, তবুও যেন ও গাড়ি স্টার্ট না দেয়!কিন্তু রাইফের আজকে কানে তুলো গোঁজা! সে আনমনে গাড়ি স্টার্ট দিয়ে ফেলেছে।জেসমিন আর জাফার আবার দৌড় দেয়।জাফারের হাসি পেয়ে যাচ্ছে ভীষণ,কোনোমতে হাসি আটকে জেসমিনের সাথে সাথে ও নিজেও রাইফকে ডাকতে থাকে।

ওরা দুজন যতক্ষণে রাস্তার ওপাড়ে আসে, ততক্ষণে রাইফ গাড়ি স্টার্ট দিয়ে ঘুরিয়েও ফেলে।জেসমিন হাঁপাতে হাঁপাতে চারপাশে তাকিয়ে একটা টেক্সি খুঁজে,কিন্তু একটা টেক্সিও নেই!মেজাজ খারাপ হয়ে যায়।অন্যান্য সময় টেক্সিগুলো ডেকে ডেকে মাথা খারাপ করে দেয়,আর আজ একটারও খবর নেই!শিট!জেসমিন কপাল চাপড়ায়।জাফার হাঁপাতে হাঁপাতে কোন মতে বলে,
“এখন কি হবে!”
“আর কি হবে!মন চাচ্ছে গাড়ির নিচে পড়ে মরি!”
জাফার জোরে জোরে মাথা নাড়ে।
“তোমার ভাগ্যের যে দশা দেখছি,গাড়ির নিচে পড়লে ঐ গাড়িই উলটে যাবে,টায়ার পাংচার হয়ে যাবে,তবু তুমি মরবে না!”
জাফারের মজা করায় ভ্রু কুঁচকে জেসমিন তাকায়,তারপর হেসে ফেলে।দুজনেই হাসতে থাকে।সেলিম পুঁচকে কি বুঝল কে জানে,ও হাত তালি দিয়ে হাসি দেয়।

দুজনে এবার ৫মিনিট অপেক্ষা করে একটা টেক্সি পায়।সেটা নিয়েই রাইফ যেদিক গেছে ওদিকে রওনা দেয়।কিন্তু এভাবে কি আর খোঁজা যাবে? জাফার আর জেসমিন টেক্সি নিয়ে এদিক ওদিক ঘুরতে থাকে।
“আচ্ছা,ওর গাড়ির মডেলটা দেখেছিলেন?”
“হুম,এটা সিলভার রঙের ফোর্ড ছিল”
“এরকম গাড়ি দেখা যায় কি না দেখি।একটু খেয়াল করবেন তো জাফার ভাই”
দুজন মিলে ঘুরছে আর গাড়ি খুঁজছে।সিলভার রঙের গাড়ি জেসমিনের ভালো লাগে না।কিন্তু এই মুহুর্তে মনে হচ্ছে,এই রঙটাই গাড়ির জন্যে পার্ফেক্ট! যদি আজ এরকম না হত,তবে হয়ত ওর খেয়ালও করা হত না পৃথিবীতে সিলভার রঙের গাড়ি যে কতগুলো! এত গাড়ি কেন,ইশ!
চরকির মত টেক্সি নিয়ে ঘুরতে থাকে দুজন,আর ওদিকে টেক্সি ড্রাইভারের বিরক্ত লেগে গেছে।বারবার জিজ্ঞাসা করছে কোথায় যাবে ওরা,কিন্তু ওরা বলছে না।শুধু একবার এই রাস্তায় আরেকবার ঐ রাস্তায় যেতে বলে।ড্রাইভার বেচারাও পড়ল বিপদে!

বিশ মিনিট ধরে ঘুরতে ঘুরতে আচমকা জেসমিন চিৎকার দেয়,
“ঐ যে!ঐ যে! ওখানে! ঐটাই রাইফের গাড়ি! ড্রাইভার, থাম!

জেসমিনের যেন মাথাটাই খারাপ হয়ে গেছে,অন্তত ড্রাইভার আর জাফারের সেটাই ধারণা।পার্থক্য এই যে,জাফার ওর পরিস্থিতিটা বুঝছে,ড্রাইভার বুঝতে পারছে না।

টেক্সি থামাতে না থামাতেই জেসমিন দরজা খুলে বেরিয়ে যায়।রাস্তার পাশে পার্কিং এ রাখা সিলভার রঙের গাড়িটার দিকে এগিয়ে যায়। হ্যাঁ,এই গাড়িটাই তো। কিন্তু আশেপাশে তো রাইফকে দেখা যাচ্ছে না।এদিক ওদিক ঘাড় ঘুরিয়ে তাকায়,এখানে রাইফ নেই।তাহলে ও কোথায় ঢুকল?সামনেই একটা বাসায় মনে হচ্ছে পার্টি হচ্ছে,রাইফ আবার সেখানে নেই তো?

জাফার টেক্সির ভাড়া দিয়ে ছেলেকে নিয়ে ওর পাশে এসে দাঁড়ায়।
” রাইফকে তো কোথাও দেখা যাচ্ছে না”
“ঐ সামনের বাসায় পার্টি হচ্ছে,ওখানে রাইফ যেতে পারে”
“পার্টিতে ঢুকবে নাকি?”
“চেক তো করা উচিত! এতদূর এসে এই পাগলকে না খুঁজে বের করে হেরে যাব?দরকার হয় এদিককার সব গুলো বাসায় আমি ঢুঁ মারব,I won’t leave a single stone unturned!”
“Yes!that’s the spirit,I like it! তুমি চিন্তা করো না একদম! রাইফকে না পেলেও ওখানে অনেক খাবার পাবে,After all,তোমার টেনশন হলে তো আবার ক্ষুধা বেড়ে যায়!”
বলেই জাফার চোখ মেরে দেয় জেসমিনকে।জেসমিন চোখ গরম দেখায়,
“সিরিয়াসলি জাফার ভাই?আপনি পারেনও!”

মাথা নাড়তে জেসমিন রাস্তার পাশের বড় বাড়িটার দিকে এগিয়ে যায়,ওকে ফলো করে জাফার সেলিমের হাত ধরে আগায়।বেচারা সেলিম!না বুঝেই শুধু দুটো বড় মানুষের টানাটানিতে ঘুরতে ঘুরতে টায়ার্ড,কিন্তু কিচ্ছু করার নেই! ওদিকে জেসমিন মনে মনে ভাবছে,”রাইফ!তোকে আমি খুঁজে বের করবই করব! তারপর কান ধরে টেনে লাল করব,কেন এই কান দিয়ে আমার কথা শুনলি না,এজন্য!!”

চলবে…

লেখনীতে, #AbiarMaria

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here