Journey part-21

0
334

#Journey

#২১

জেসমিনকে রাইফ ধরে লাল ফুলে সাজানো বিছানার কাছে নিয়ে যায়।বিছানাটা পুরোপুরি ফ্লোরিং করা না,একটু উঁচু ফ্রেমের উপর মেট্রেস বসানো।চারপাশে সাদা সাদা পর্দা একটা বড় ফ্রেম থেকে ঝুলিয়ে দেয়া,সাথে আছে ল্যাভেন্ডার আর বেলী ফুল।কিছু গোলাপও আছে যা দিয়ে বিছানার দুপাশে সাজানো হয়েছে।একটা নিঃশ্বাস নিয়ে রাইফ বলে,
“তুমি যাও,গিয়ে বসো।আমি আসছি”

জেসমিনের সমস্ত শরীর শিহরিত হয়।এই প্রথম রাইফ তুমি বলে ডাকল।পরিচয় থেকে আজ অব্দি যার সাথে তুই তুকারি সম্পর্ক ছিল,আজ সে মানুষের মুখে ‘তুমি’ শব্দটা শুনে মনে হচ্ছে,আসলেই সম্পর্কটি বদলে গেছে।আর কিছুক্ষণ পর মানুষটার আচরণ,চাহনি, স্পর্শ,ভাবনা,সব কিছু বদলে যাবে,বদলে দেবে।আগে মত অনুভূতি হবে না তার স্পর্শে,বরং তাতে মিশে থাকবে অন্য কিছু।একে ভালোবাসা বলে।ভালোবাসা?নাকি প্রেম?নাকি মাদকতা? আবেগে আবারও কেঁপে ওঠে ও।কোনোমতে গাউন নিয়ে বিছানার উপর পা ভাঁজ করে বসে।টেনেটুনে ঘোমটা ঠিক করে।রাইফ কোথায়? কখন আসবে? জেসমিনের মনে ভাবনার ঝড়,আর সমস্ত দেহে আবেগের ঝড়।

ওকে বেশিক্ষণ অপেক্ষা করতে হয়নি।কিছুক্ষণ পরেই রাইফ এসে হাজির হয় ঘরে। এখনও বরের বেশে আছে ও।ঘোমটার ভেতর থেকে আবছা ভাবে দেখে,রাইফ বিছানার একপাশে বসেছে।কিছুটা এগিয়ে এসে জেসমিনের ঘোমটা তোলে,লজ্জায় জেসমিন চোখ বন্ধ করে ফেলছে।রাইফের এই দৃষ্টি ওর সহ্য হচ্ছে না।

এদিকে রাইফ একদৃষ্টিতে ওর সদ্য বিবাহিতা স্ত্রীকে দেখছে।খুব বেশি মেকাপ করেনি,তা দেখাই যাচ্ছে।মুখের উপর হাল্কা আলো এসে পড়ায় ওর এই ন্যাচারাল চেহারাটুকুই টানছে।টানা চোখ,ভারী পাপড়ি,গালে হাল্কা সিমার,গোলাপি এক জোড়া ঠোঁট, সব মিলিয়ে এত কোমল লাগছে জেসমিনকে! রাইফ এমন ভাবে ওকে ছুঁয়ে দেয় যেন একটু জোরে ছুঁলেই ও গলে যাবে,কিংবা ভেঙে যাবে।গালে ছুঁয়ে দুহাতে ওর মুখ তুলে ধরে, তারপর কাছে এনে ওর কপালে আলতো স্পর্শ ছোঁয়ায়। জেসমিন কেঁপে উঠে।কেন যেন হুট করেই ওর মনে ভীষণ ভয় চেপে ধরে,কারণ প্রথম অভিজ্ঞতা তো ভাল না! রাইফ আস্তে করে বলে,
“চোখ খুলে আমাকে দেখবে না কেমন লাগছে?”

জেসমিন ধীরে ধীরে চোখ খোলে।রাইফের মুখ একদম ওর মুখের কাছাকাছি। এত কাছে কেন?কেমন একটু ভড়কে যায়। হাল্কা নড়ে বসে,রাইফও ওর গাল থেকে হাত সরিয়ে নেয়।
“তোমাকে অনেক সুন্দর লাগছে…অনেক…কতটা সুন্দর, তার জন্যে কোন শব্দ আমাদের অভিধানে নেই,উপমা…সেটাও দেয়া সম্ভব না,কারণ পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ রূপে রূপায়িত করা হয়েছে মানুষকে। আর এই মুহূর্তে মনে হচ্ছে আমার সামনে পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দরী রমণী বসে আছে।কত বছর ধরে তোমাকে দেখছি,কিন্তু আজকের মত সুন্দর আর কখনো লাগেনি।তার মানে এই না যে তুমি সুন্দরী নও! তোমার সৌন্দর্য্য দেখার মত চোখের ক্ষমতা আমার এতদিন ছিল না।তবে আমার মনে হচ্ছে, আজ তোমার সমস্ত দেহ,মনে অন্য রকম সৌন্দর্য্য ছড়িয়ে আছে,যেটা আগে ছিল না।সারাদিন আমি তোমাকে দেখিই নি এই রাতে দেখব বলে,মনে হচ্ছে আমার অপেক্ষা সার্থক না,কারণ আজ সারাদিন তোমাকে দেখলেও তোমার সৌন্দর্যে আমার মুগ্ধ হওয়া এতটুকু কমত না…”

এটুকু বলে রাইফ থামে, জেসমিন ততক্ষণে লজ্জায় লাল।রাইফ থেমে যায়,জেসমিনের লজ্জা দেখে নিজেরও লজ্জা লাগছে।এবার জেসমিনের দিকে হাত বাড়ায়,দুসেকেন্ড তাকিয়ে থেকে জেসমিন ওর হাত ধরে।বিছানা থেকে তুলে আনে ওকে,তারপর কানের কাছে মুখ নিয়ে বলে,
“বদলাবে না?”
জেসমিন মাথা নাড়ায়।রাইফ ওর লাগেজ বের করে খুলে দেয় আর নিজের লাগেজ খুলে কাপড় বের করে।জেসমিনের উল্টো দিকে ঘুরে ও কাপড় বদলাতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে।

কাপড়ে বদলে ফিরে দেখে,জেসমিন এখনও গহনা খুলছে।মায়া লাগে খুব,বেচারি মেয়ে হওয়াতে কত কিছু পড়তে হল, এখনও সেগুলো খুলেই শেষ করতে পারছে না! জেসমিনও পেছন ঘুরে ছিল,তাই রাইফ এসে পেছন থেকে ওর ঘোমটায় হাত দেয়,জেসমিন চমকে ওঠে।

“ভয় পেয়েছ?মনে হচ্ছে আমার সাহায্য লাগবে,সাহায্য করব কি?”

কাঁপা কাঁপা ভাবে জেসমিন মাথা ঝাঁকায়।রাইফ প্রথমেই খোপার সাথে লাগানো ঘোমটা খুলে,সেটা পায়ের কাছে লুটিয়ে পড়ে।তারপর এক এক করে জেসমিনের হিজাবের পিন গুলো আলগা করে।দুমিনিটের মাথায় হিজাব সরে জেসমিনের ঝলমলে বাঁধা চুল বেরিয়ে আসে।অনেক দিন পর ওর চুল দেখছে রাইফ,তবে নিশ্চিত এখানে অনুভূতিটাই ভিন্ন।বার্গেন্ডি কালার দিয়ে হাইলাইট করা চুল ছোঁয়ার ইচ্ছা জোর করে ওকে দমন করতে হল। চুলে না ধরে ওর ঘাড়ে হাত দেয় নেকলেস খোলার জন্যে,আর তাতে ঘাড়ে স্পর্শ পেতেই কেঁপে ওঠে।রাইফ এবার কানেফ দুল খোলে দেয়।সব পাশে রাখা টেবিলে রাখে।এবার চুল গুলো একটু একটু করে খুলে দেয়।সব চুল যখন খোলা শেষ,তখন দেখে সেগুলো কোমর ছাড়িয়ে গেছে।রাইফের ভীষণ লোভ হয় আবারো এত লম্বা চুল দেখে।কিন্তু তা না করে জেসমিনের একেবারে পিঠের কাছে চলে যায়।চুল সরিয়ে ওর পিঠে থাকা গাউনের চেইন খুল দেয়,সাথে সাথেই ভারী গাউন কাঁধ থেকে সরে যায়,আর রাইফ উল্টো ঘুরে যায়!

রাইফ জানে জেসমিন খুব বেশিই লজ্জা পাচ্ছে।রাইফ ঘুরে থেকে সামনে এগিয়ে যায়।নিচে থাকা লাগেজ থেকে একটা জামা বের করে বিছানার উপর রাখে।
“এই জামাটা পড়ে নাও,আমি বাইরে অপেক্ষা করছি”

এদিকে রাইফের কান্ডে জেসমিন দুহাতে গাউন বুকে চেপে ধরে চোখ মুখ চেপে ধরে রেখেছে।ভীষণ লজ্জা লাগছে ওর।ঘাড় ঘুরিয়ে পেছনে তাকিয়ে দেখে,রাইফ সত্যি সত্যি বাইরে চলে গেছে।বিছানার উপর রানী গোলাপী রঙের একটা স্লিভলেস সিল্কের জামা রাখা,তাতে সাদা হলুদ বড় বড় ফ্লোরাল প্রিন্ট। জেসমিন হাতে নেয় ড্রেসটা,রাইফের রুচির প্রশংসা করতেই হয়।

জেসমিন কাপড় বদলে বাইরে এসে দেখে রাইফ পুলের পানিতে পা ডুবিয়ে বসে আছে।জেসমিন ওর পাশে এসে দাঁড়ায়।পুলের দিকে তাকিয়ে মনে হয়,এত ঠান্ডা পানিতে কিভাবে ও বসে আছে?ওকেও কি বসতে হবে?যেন ওর মনের কথা বুঝতে পেরেই রাইফ ওর দিকে ইশারা করে পাশে বসতে।জেসমিন ধীরে ধীরে পা ভেজায়।নাহ,যতটা ঠান্ডা ভেবেছিল,ততটা ঠান্ডা না পুলের পানি।

“এরকম পুলে পা ভিজিয়েই সেদিন গল্প করেছিলাম আমরা,তাই না?”
জেসমিন মাথা নাড়ায়।
“অথচ সেদিন আর আজ,কত পার্থক্য! তখনও বুঝিনি আমার পাশে বসা মানুষকে নিজের করে পেতে এত উদগ্রীব হয়ে যাব! জেস…তোমাকে আমি আদর করে এখন থেকে জেস ডাকব।তোমার সাথে এই তারার চাদরের নীচে আজীবন থাকতে চাই,এভাবে পুলের পানিতে পা ভিজিয়ে ঘন্টার পর ঘন্টা গল্পে মশগুল হতে চাই…আর এখন তোমাকে নিয়ে পুলে নামতে চাই…নামবে?”

জেসমিন কিছুটা ভয়ের স্বরে বলে,
“আমি সাঁতার সেভাবে পারি না যে…”
“আমার উপর ভরসা আছে?”
জেসমিন মাথা নাড়ায়। রাইফ ওর হাত ধরে উঠে দাঁড়িয়ে পুলের অগভীর অংশে চলে যায়।সেখানের সিঁড়িতে পা রেখে জেসমিনের দিকে হাত বাড়ায়।কিছুটা দ্বিধা করে রাইফের হাত ধরে। ওর হাতে ভর করে জেসমিন ধীরে ধীরে পানির দিকে এগোয়।বুক সমান পানিতে আসার পর জেসমিনের পা পুলের মাটিতে হাল্কা সরে যায়,ও দুহাতে রাইফকে জাপ্টে ধরে, রাইফও ওকে এক হাতে বুকে চেপে ভারসাম্য রক্ষা করে। কিছু পানি ছলকে তখন জেসমিনের মুখে এসে পড়েছে।ক্লোরিন মেশানো পানির নিচের হলুদাভ রঙের আলো জেসমিনের মুখে অদ্ভুত নকশা তৈরি করেছে।রাইফ মুগ্ধ হয়ে ওর দিকে তাকিয়ে দেখে।এই মেয়েটার এত সৌন্দর্য্য এত দিন কোথায় ছিল??

জেসমিনের হুট করে খেয়াল হয়ে যে ও রাইফকে চেপে ধরে আছে।হাত ছাড়াতে গিয়ে দেখে রাইফ ওকে ধরে রেখেছে।রাইফের চোখের দিকে তাকিয়ে সে দৃষ্টি আর ও ফেরাতে পারে না।এই চোখে কি আছে?নেশা? ওর হাত দুটো রাইফকে আরও শক্ত করে ধরে। এবার রাইফ ওকে নিয়ে পুলের আরো গভীরে যায়।জেসমিনের সে নিয়ে কোন খেয়াল নেই।এক সময় পুলের দেয়ালে হেলান দিয়ে রাইফ দাঁড়ায়, ওর শরীরে ভর করে দাঁড়িয়েছে জেসমিন।

“কেমন লাগছে?”
রাইফের প্রশ্নে ঘোরের মাঝে থেকেই জেসমিন বলে,
“খুব ভালো”
“আমরা কি এই পুলে আজ এভাবেই থাকব?”
“উহু,আমি এখানে তোমার সাথে ডুবব,তোমার সাথে ভাসব,তোমার সাথে পানির মত মিশে যাব”
কথাটুকু বলে জেসমিন অবাক হয়ে যায়।এটা কি বলল?!এরকম কেন হল? ও কি পাগল হয়ে গেল?নাকি রাইফের ভালোবাসা ওকে পাগল করে দিল?ভালোবাসা এরকম মাদকতায় পূর্ণ কেন হয় যাতে মানুষের বোধ বুদ্ধি লোপ পায়?রাইফ তার স্ত্রীর জবাব শুনে তাকে আরো কাছে টেনে আনে।কানের কাছে মুখ নিয়ে বলে,
“আমিও সেটাই চাই,যেন তোমাকে আর আমাকে আর আলাদা না করা যায়”

রাইফ জেসমিনকে দুহাতে কোলে নেয়।জেসমিন দুহাতে ওর গলা জড়িয়ে ধরে। জেসমিনকে নিয়ে পুল থেকে ওঠে আসে।তারপর হেঁটে হেঁটে কাঁচের ঘরের ভেতর চলে যায়।

আজ দুটো মানুষের মন দুটো থেকে এক হয়ে গেছে,তাদের ভালোবাসার জয় হয়েছে।প্রকৃতি তাই শান্ত হয়ে গেছে।চারপাশটা তখন হুট করেই অন্ধকার হয়ে গেল।লোডশেডিং নাকি? নাকি ওদের বাঁধাহীন অবাধ ভালোবাসার ইশারা?

এরকম হয়…অনেক অন্ধকার থাকে যাতে থাকে আলোর দিশা… সেই আলো খালি চোখে দেখা যায় না,তা চোখ বুঁজে অনুভব করতে হয়…।

চলবে…

লেখনীতে, #AbiarMaria

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here