#Journey
#৩১
জেসমিন হাত ধুয়ে নেয় পাশের ছোট বালতিতে জমানো পানি দিয়ে।সিঁড়ি বেয়ে উঠার আগে পেছন ফিরে বন্দী লোকটার দিকে একবার দিকে তাকায়।সে নড়ছে না,শুধু হাল্কা শ্বাস নিচ্ছে।যদি উঠে যায়? আবার ফিরে গিয়ে লোকটার হাত পা শেকল দিয়ে বেঁধে তালা লাগায়।এবার আর পালাতে পারবে না।নিশ্চিত হয়ে উপরে উঠে যায়।
সদর দরজা দিয়ে ঢুকতেই রাইফ ওকে দেখে দুহাতে নিজের সাথে মিশিয়ে ফেলে।
“কি ব্যাপার!আজ এই অসময়ে এত রোমান্স!”
“আমরা তো এখনও নতুন দম্পতি,তাই না?আমাদের রোমান্সের কি সময় আছে কোন?”
“তা ঠিক বলেছ অবশ্য”
রাইফ কিছুক্ষণ তার স্ত্রীকে দুহাতে চেপে ধরে আদর করে।জেসমিন বেশ এনজয় করছে।ইদানীং ওদের মাঝের দূরত্ব অনেকটাই কমে গেছে।যদিও জেসমিন বলেনি ওদের পেছনে কারা লেগেছে,কিংবা এখনও যে লেগে আছে,তবুও সব বদলে যাচ্ছে একটু একটু করে।জীবনে বিপদ আপদ,সমস্যা থাকবেই,তাই বলে ভালবাসা থামিয়ে রাখা যাবে? তাছাড়া জেসমিন ভাবে,অনেক কষ্ট দেয়া হয়ে গেছে বরটাকে,আর দেয়া ঠিক হবে না।
ওদের ভালবাসাবাসি এসে ঠেকে লিভিংরুমের সোফাতে।জেসমিনকে নিচে রেখে রাইফ ওর গলার কাছে নেমে আসে।কি যেন মনে হতেই মাথা তোলে,
“এই!সেলিম কোথায়?”
“ও তো ঘুমায়”
“শিওর তুমি?”
“হুম,কেন?”
রাইফ একটা দুষ্ট হাসি দেয়।এর মানে অনেক কিছু চাই এখন ওর।দুজনেরই নিঃশ্বাস ভারী হতে থাকে,রাইফ ওর আরো কাছে চলে আসে,ওর শার্টের বাটনে হাত দেয়।একটু পর বাইরে খুট আওয়াজ হয়।জেসমিনের সমস্ত ইন্দ্রিয় জেগে ওঠে।ঐ লোকটার কোন সঙ্গী ছিল নাকি আবার?!সর্বনাশ! রাইফকে সরাতে হবে! ও রাইফকে একটু সরিয়ে দেয়।বিরক্ত হয়ে রাইফ ওর কাছে আসলে ও আবার সরিয়ে দেয়।
“ব্যাপার কি!তোমার ভাল লাগছে না?”
“লাগছে,কিন্তু এখন না প্লিজ?”
“এখন না কেন!এখন কি সমস্যা?”
জেসমিন শার্টের বাটন লাগাতে লাগাতে উঠে বসে।রাইফ বিরক্ত হয়ে ওর দিকে তাকিয়ে আছে।জেস ওর দুহাতে রাইফের গলা ধরে বলে,
“আমার এখন ইচ্ছে হচ্ছে না গো,রাতে পুষিয়ে দেব,প্রমিজ!”
রাইফ মুখ গোমড়া করে,
“আমি আজ নাইট শিফটে কাজ করব।তাই তো দিনের বেলা এসেছিলাম,আর তুমি দিলেই না…!”
জেসমিন ভেতরে ভেতরে চমকে উঠে, রাতে তাহলে সেলিমকে নিয়ে একা থাকতে হবে?! কিন্তু রাইফকে কিছু বুঝতে দেয় না।ওর বুকে মাথা রেখে বলে,
“এত ভেবো না, কাল সকালে না হয়…?”
“কিন্তু এখন কি সমস্যা?!আমি একটু পরেই চলে যাব!”
এসময় বাইরে আবার আওয়াজ শোনা যায়।জেস দ্রুত রাইফকে টেনে তোলে।
“সমস্যা আছে,আমার পেট ব্যথা করছে।এভাবে ব্যথা নিয়ে কি কিছু ভাল লাগে?”
রাইফ মুখ গোমড়া করে গাল ফুলিয়ে রাখে।তারপর ওর কোমরের দিকে হাত দেয়।
“কি ব্যাপার,এটা কি?রক্ত মনে হচ্ছে?”
জেসমিন তাকিয়ে বুঝে ঐ লোকের রক্ত কিছুটা ছিটিয়ে পড়েছে গায়ে।
“কোথায় রক্ত?এটা?এটা রক্ত কেন হবে!আমি তো রঙ নিয়ে কাজ করছিলাম বাসার পেছন দিকে”
“কিন্তু,এরকম উটকো লাল রঙ কেন?এটা দিয়ে কি করবে?”
“ঘরে ছবি আঁকব! দেয়ালে কিছু পেইন্ট করব ভাবছিলাম,তখন লেগে গেছে বোধহয়। বাদ দাও তো!চলো,চলো,সন্ধ্যা হয়ে যাবে একটু পরে,তোমার দেরী হয়ে যাবে!”
রাইফ মুখ কাল করে ঠায় দাঁড়িয়ে আছে। জেসমিন কিছুটা আদর করে ওকে উঠিয়ে রাতের খাবার প্যাক করে কাজে পাঠিয়ে দেয়।যাবার আগে আয়াতুল কুরসি পড়ে ওকে ফুঁ দেয়,কে জানে,শয়তানদের কোন ঠিক আছে?আল্লাহ যেন ওকে নিরাপদ রাখে।গেটের কাছে গিয়ে যতক্ষণ ওকে দেখা যায়,ততক্ষণ জেস তাকিয়ে থাকে।রাইফ যখন গাড়ি স্টার্ট দেয়,সাথে ও এক ছুটে বাড়ির পেছন দিকে চলে যায়।দেয়ালের একপাশে লুকিয়ে বোঝার চেষ্টা করে কেউ আছে কিনা।কোন নড়াচড়া তো দেখা যাচ্ছে না! সন্তর্পনে পায়ে পায়ে ও এগিয়ে যায়। ওদের বাসার পেছনে খুব বেশি গাছ নেই,কিছুদিন আগেই জেসমিন এতগুলো আগাছা কেটে ফেলেছে,আর সামান্যই বাকি আছে।সেগুলোর দিকে পূর্ণ দৃষ্টি রেখে এগিয়ে যায়। হুট করে একটা ছোট ঝোপ নড়ে ওঠে!
জেসমিন পকেটে হাত দিয়ে ছুরিটা বের করে।নিচু হয়ে যত এগোয়,আওয়াজটা তত বাড়ে! একদম কাছে গিয়ে উৎ পেতে থাকে আঘাত হানার জন্য।যেই খুব জোরে পুরো ঝোপ লাফিয়ে উঠে,ওমনি জেসমিন ছুরিটা এক বারে সেটার বুকে বিঁধিয়ে দেয়!
ছুরি মেরে খেয়াল করে,এটা বড় একটা র্যাকুন! বুক থেকে একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে,যাক আল্লাহ,বাঁচা গেল!এটা একটা সামান্য র্যাকুন! এখন যদি আরেকজন এসে হাজির হত,তাকে আবার কিভাবে সামলাত! তবুও নিশ্চিত হওয়া চাই।
বাড়ি থেকে বেরিয়ে পুরোটা একবার ঘুরে আসে,আশেপাশে কোন অপরিচিত গাড়ি পার্ক আছে কিনা খেয়াল করে। উহু,তেমন কোন গাড়ি নেই।দূরের মানুষ আর গাড়ি গুলো গতিবিধি খেয়াল করে।নাহ,কাউকে দেখেই তেমন সন্দেহ হচ্ছে না।লোকটি কি তবে একাই এসেছিল?
ঘুরে বাড়িতে চলে যায় জেসমিন।গিয়ে দেখে,সেলিম ঘুম থেকে উঠে টিভিতে কার্টুন দেখছে।
“বাবা,তুমি কখন উঠলে?”
“একটু আগে”
“তুমি কিছু খাবে?”
“না আন্টি”
“আচ্ছা,তাহলে পাশের বাসার অদ্রের কাছে গিয়ে খেল।আজ আর আন্টি পড়াব না,আজ তোমার হলিডে!”
“ইয়েএএএ!কি মজা!”
বলেই জেসমিনের গালে চুমু খায়।
“আই লাভ ইউ জেস আন্টি!”
“লাভ ইউ টু বাবাটা!যাও,ওদের বাসায় যাও তুমি।খেলা শেষ হলে আমাকে কল করবে,কেমন?”
“ওকে!”
সেলিমকে অদ্রেদের বাসায় রেখে জেস স্টোরে যায়।সেখান থেকে ভারী নাইলনের দড়ি,আইকা আঠা,এসিডের দুটো বোতল,টর্চ,আরো কিছু আনুষঙ্গিক জিনিসপত্র কিনে নেয়।একবার মনে উঁকি দেয়,সাধারণ কোন চোর না তো? আবার মনে হয়, সে তো দেখাই যাবে,আগে কথা বলে দেখতে হবে।এসব কিছু নিয়ে বাসায় আসে।বাসায় এসে সদর দরজা লাগিয়ে সবকিছু নিয়ে বেজমেন্টের দিকে চলে যায়।দরজা খুলে আলো জ্বালায়।টিমটিমে আলোতে অন্ধকার গুমোট বেজমেন্টটাকে আরো ভূতুরে লাগে।জেসমিনের এসব নিয়ে মাথা ব্যথা নেই,কারণ ও এই রকম পরিবেশের ভেতরে কাজ করতে অভ্যস্ত হয়ে গেছে।ভেতরে উঁকি দিয়ে দেখে,লোকটা এখনও একইভাবে চেয়ারের সাথে বাঁধা অবস্থায় পড়ে আছে।
জিনিসগুলো এক পাশে রেখে লোকটার পকেট থেকে কি কি বেরিয়ে তা হাতে নিয়ে দেখে,তখন রাইফ চলে আসায় তাড়াহুড়োয় এগুলো দেখা হয়নি।একটা মানিব্যাগ আছে,তাতে কতগুলো ইউরো,কয়েকটা ভিজিটিং কার্ড,এছাড়া আর তেমন কিছু নেই,না কোন আইডি কার্ড,না তার পরিচয় মেলার মত কিছু।মোবাইল আছে যা ফিংগার প্রিন্ট দিয়ে লক।এছাড়াও একটা ছুরি আছে।ছুরিটা কিছুক্ষণ নাড়াচাড়া করে।কিছুটা অদ্ভুত গড়নের এটা।উপরের ফলাটা যতটা চিকন,নিচের কাঠের হাতলটুকু তার তুলনায় বেশি ভারী।এদিক ওদিক করে দেখতে দেখতে খুট করে আওয়াজ হয়।খেয়াল করে কাঠের হাতলের একপাশে ফাঁকা।কিছুটা সরিয়ে দেখা যায়,এতে একটা ছোট শিশি,তাতে অদ্ভুত তরল!
জেসমিনের মনে পড়ে যায়,সিনেমায় দেখা এল ধরনের ছুরি যা দিয়ে মারলে তার ভেতর থেকে বিষ ছড়ায়।এটা কি বিষ?নাকি অন্যকিছু?ভাবতেই শিওরে ওঠে! নাহ,এই লোক সাধারণ চোর না,হতেই পারে না! জিনিসগুলো একপাশে রেখে শুধু ছুরিটা বাঁ হাতে ধরে ডান হাতে লোকটার মুখের উপর থেকে বস্তা সরিয়ে দেয়।অর্ধেক মুখ তার রক্তে মাখামাখি। একটা মগে পানি এনে তার চোখে মুখে ছিটায়।
বেশ কয়েকবার এরকম করার পর লোকটা চোখ খুলে।ঝাপ্সা চোখে তাকিয়ে কি যেন বলার চেষ্টা করে,জেসমিন ওর মুখের কাপড় খুলে দেয়।লোক্টা অস্পষ্ট ভাষায় বলে,
aqua…aqua…
জেসমিন পানি এনে তার মুখে ঢালে,সেটাই সে নাকে মুখে খাওয়ার চেষ্টা করে।পানি খেয়ে কিছুটা ধাতস্থ হতেই তাকে জেসমিন জিজ্ঞাসা করে,
“তোর নাম কি?”
লোকটা কোন উত্তর দেয় না,শুধু ওর দিকে তাকিয়ে থাকে।
“কি হল, কথা বল? তোর নাম কি??”
লোকটা তবুও নির্বাক,কিছু বলে না।এবার জেসমিন কাটা গালে ধাম করে ঘুসি মেরে বসে,এতে ক্ষত থেকে আবারো রক্ত ঝড়তে শুরু করে।এবার আরেক গালে মারে।এভাবে তিন টা মারার পর কাঁদো কাঁদো হয়ে বলে,
“প্লিজ,পারডন,আমাকে মেরো না,আমি বলছি,বলছি! আমার নাম গেব্রিয়েল,গেব্রিয়েল যাকার্তা”
“এখানে কেন এসেছিস?”
“আমি…সত্যি বলছি,তোমার কোন ক্ষতি করার ইচ্ছা আমার ছিল না,আমি শুধু…”
লোকটা হাপাচ্ছে।অনেকগুলো কথা বলে এখন বোধহয় শ্বাসকষ্ট হচ্ছে,বা গলা শুকিয়ে গেছে।জেসমিন পানির মগটা এগিয়ে দেয়।লোকটা ঢকঢক করে পানি গেলে।
“বল…তোর কথা শেষ কর,কেন এসছিস তুই?”
“আমি…আমি তোমাকে কিডন্যাপ করতে এসেছি”
“কিডন্যাপ! আর আমাকে? হা হা হা! কিডন্যাপ করতে এই ছুরি নিয়ে কেউ আসে?কুত্তার বাচ্চা…!”
বলেই লোকটার চুল টেনে গলার মাঝে ছুরিটা চেপে ধরে,
“আমাকে এটা দিয়ে কিডন্যাপ করবি?নাকি আমাকে মার্ডার করতে পাঠিয়েছে?!উত্তর দে!!”
হুংকারে মনে হয় না লোকটা ভয় পেয়েছে।তবুও বলে,
“আমার কাজে কেউ বাঁধা দিলে এটা তার জন্য,তোমার জন্য তো এসব এলাউড না।তোমার কিছু হলে তো… ”
“আমার কিছু হলে কি?? বল আমার কিছু হলে কি…!”
লোকটা অদ্ভুত হাসি দেয়।
“তুমি সব জান,কেন আমাকে জিজ্ঞাসা করছ?”
জেসমিন চুল ছেড়ে ছুরিটা পরখ করতে করতে আবার টেবিলে হেলান দেয়।
“আমাকে কিডন্যাপ করে তারপর কি করতি শুনি?কার কাছে নিয়ে যেতি?”
লোকটার উত্তর শুনে জেসমিন খুব একটা চমকায় না,
“বাংলাদেশে!”
তাচ্ছিল্যের হাসি হেসে উঠে ও,
“তারপর! তোর মনিবের কাছে,না?তা মনিব কে?”
“এটাও তুমি জানো”
“হা হা হা,ফাইন! এবার নাহয় আমি যা জানি না,তার থেকে কিছু জিজ্ঞাসা করি! আমাদের গাড়ির ব্রেক কে কেটেছিল,তুই?”
লোকটা মাথা নাড়ায়।
“আমার লাগেজগুলো কে ধরেছে,তুই?”
আবারো মাথা নাড়ায়।
“তারমানে জাফার ভাইকেও তুই মেরেছিস,না?”
এবারও একই জবাব।
লোকটার কথা শুনে ওর রাগে গা কাঁপতে থাকে,শরীরের শিরায় শিরায় যেন আগ্নেয়গিরির অগ্নুৎপাত ঘটে যায় সেকেন্ডের মাঝেই।টেবিলে রাখা শেকলের একটা টুকরো হাতে পেঁচিয়ে ওর মুখে ধামাধাম মারতে থাকে,মারতে মারতে গাল চোখ ফাটিয়ে ফেলে।লোকটার নাকে মুখে ফিনকি দিয়ে রক্ত বেরুতে থাকে,তবুও জেসমিন থামে না।আজ ওর শরীরে পশুত্ব জেগে উঠে,জিঘাংসার পশুত্ব।বার বার জাফারের মরা মুখ ভেসে উঠছে,সেলিমের দিনের পর দিনের কান্নারত মুখ দেখতে পাচ্ছে।মারতে মারতে আজকে যেন মেরেই ফেলবে ওকে,সমস্ত শক্তি একত্র করে মারছে।
একটা পর্যায়ে জেসমিনের শক্তি যেন শেষ হয়ে আসে,হাত ধরে যায় আঘাত করতে করতে।হাঁপাতে হাঁপাতে জোরে জোরে নিঃশ্বাস নেয়,তবুও সামলাতে না পেরে মেঝেতে বসে পড়ে।লোকটার দিকে তাকায়,তার কান বেয়ে কালচে রক্তের ধারা বেয়ে নামছে,আর তার কোন নড়াচড়াও নেই!
সর্বনাশ!জেসমিন কি তাকে মেরে ফেলল??!!
চলবে…
লেখনীতে, #AbiarMaria